এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-১৩

0
1228

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

১৩.

— তোমাকে নীল শাড়িতে হয়তো আরও বেশি মোহনীয় দেখাতো মিলি। কিন্তু থ্রী-পিসে পরনে খুব একটা অসুন্দর দেখাচ্ছে না তোমায়।

শোয়েব মিলির দিকে কথাটি ছুঁড়ে দেয়। মিলি এতক্ষণ মাথা নীচু করে শোয়েবের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু, শোয়েবের কথায় অবাক হয়ে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে রেগে ফেটে পরছে মিলি। মানে কি? সবাই বলে মিলিকে নীল থ্রী-পিছ পরলে সমুদ্রকন্যার মতো দেখা যায়। আর এই পাগলের ডক্টর কি না বলছে ওকে নীল শাড়িতে বেশি সুন্দর দেখাতো?

— আপনি আমাকে এখানে আসতে বলেছেন কেন? জানেন, আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পেছের গেইট দিয়ে রাস্তায় এসেছি।

মিলির কথায় মুচকি হাসি দিয়ে শোয়েব ওর চোখের সানগ্লাসটি খুলে মিলির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— কারণ, আমার পরিবারের লোকেরা তোমাকে দেখার আগে আমি তোমাকে দেখতে চেয়েছি।

শোয়েবের মুখ থেকে এই কথা শুনে মিলি লজ্জা পায় ভীষণ। শোয়েবের দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাড়ির ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করে মিলি।

মিলির পেছনে পেছনে শোয়েব হাঁটতে লাগলো। মিলির খেয়ালও নেই যে ও পেছনের দরজা দিয়ে শোয়েবের সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু, কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি?

দু’জনে যখন একসাথে ড্রইংরুমে প্রবেশ করে। আর সবাই যখন ওদের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় ঠিক তখনই মিলির টনক নড়ে। লজ্জায় মিলি পারছে না একদৌঁড়ে এই পৃথিবীর বাইরে চলে যায়।

মিলি ওড়নার কোণা ধরে টানাটানি করছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা।

ইরাবতী সোফা ছেড়ে ওঠে এসে মিলির হাত ধরপ টেনে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়। তারপর, মিলির পাশে বসে ওর ভাইকে চোখের ইশারায় বললো,

—বসবে মিলির পাশে নাকি???

শোয়েব ইরাবতীর ঠাট্টা বুঝতে পেরেছে। হাসিখুশি মুখটা গম্ভীর করে এগিয়ে এসে মিলির বাবা মাহতাব সাহেবকে সালাম দেয়। তারপর,রাহিম বর মাহিমের সাথে হ্যান্ডশেক করে সোফায় বসে পরলো।

এদিকে রাসেল উপরে মিলির ঘরে চলে যায় মিলিকে ডাকার জন্য। কিন্তু, মিলির ঘরে ঢুকে অপ্রস্তুত হয়ে যায় রাসেল। কারণ, নিঝুম বসে আছে।

নিঝুম রাসেলকে মিলির ঘরে দেখে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়। তারপর, মিনিমিনে গলায় বললো,

—কিছু বলবেন, ভাইয়া?

রাসেলের মাথা পুরো খারাপ হয়ে যায় নিঝুমের মুখ থেকে ভাইয়া ডাক শুনে। দুই কদম এগিয়ে নিঝুম ডান বাহু শক্ত করে ধরে রাগী ভাব নিয়ে নিঝুমকে বললো,

— এই মেয়ে তুমি আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারো না? মেয়েরা নাকি ছেলেদের চোখের ভাষা চট করে ধরে ফেলতে পারে। কই তুমি তো পারছো না আমার মনের ভাষা বুঝতে?

নিঝুম ভয় পেয়ে যায়। কারণ, মিলির বড়ো ভাই রাসেলের কাছ থেকে এমন ব্যবহার নিঝুম কখনো কল্পনাও করেনি। কিন্তু, কি হলো আজ লোকটার?

—আ.পনি এমন করে কথা বলছেন কেন? আমি খারাপ কিছু বলেছি আপনাকে?

—তুমি খারাপ কিছুই বলোনি। আমার এই চার আঙুলের কপালটা খারাপ। নয়তো, তোমায় এত ভালবাসার পরও কেন বলতে পারি না। নিঝুম তুমি আমার বৌ হবে।

কথাটি বলে নিঝুমের বাহু ছেড়ে দিয়ে ঘরে থেকে বের হয়ে যায় রাসেল। আর নিঝুম হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মানে এতক্ষণ যা কিছু হয়েছে তা কি স্বপ্ন নাকি রঙিন ভবিষ্যতের হাতছানি?

রাসেল রেগেমেগে বেরিয়ে নীচে চলে আসে। ড্রইংরুমে আসতেই দেখতে পেলো অচেনা অনেকেই বসে আছে। তার মধ্যে একটু মুখ অনেক চেনা। কারণ, চিরচেনা মুখটাই রাসেলের জানে জিগার দোস্ত।

রাসেলের মন খারাপ করে হারিয়ে যায় তার যোগাযোগ বিহীন বন্ধু এতদিন পর নিজের বাড়িতে দেখে। হাসিমুখে এগিয়ে যায় তার বন্ধুর দিকে। এমন সময় মাহতাব সাহেব নিজের বড়ো ছেলেকে দেখে শোয়েবের বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রাসেল হাসিমুখে তাদের সালাম দিলেন।

শোয়েব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাসেলের দিকে। কারণ, রাসেল রোহান আর সে হাইস্কুল এবং কলেজ ফ্রেন্ড। একসাথে কত দুষ্টুমি, কত জায়গায় চষে বেড়িয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, অজানা এক ঝড়ের তান্ডবে যখন শোয়েব ভেঙে পরে সামাল দেয়ার মতো কেউ ছিল না। তখন সব বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়।

— রাসেল, ও হচ্ছে শোয়েব। আমাদের মিলির জন্য শোয়েবকে চুজ করেছি আমি।

নিজের বাবার মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাসেল স্তব্ধ হয়ে যায়।

—মিলির জন্য শোয়েবকে বাবা পছন্দ করেছেন! কিন্তু, শোয়েবের যে…

মনে মনে কথাগুলো বলে। মুখ নকল হাসি ঝুলিয়ে শোয়েবের সাথে হ্যান্ডশেক করে কুশলাদি বিনিময় করে রাসেল।

শোয়েবের মনে কি চলছে বুঝতে পারছে না রাসেল। কিন্তু, রাসেলের মনে কি চলছে তা খুবই ভালো করে বুঝতে পারছে শোয়েব। কিন্তু, এখন সেসব কথা বলার উপযুক্ত সময় নয়।

এরইমাঝে মিলির বাবা আর শোয়েবের বাবা শাফায়াত আহমেদ আলোচনা করে ঠিক করলেন আজ সন্ধ্যার পর মিলি আর শোয়েবের আকদ হবে। যেহেতু ছেলে এবং মেয়ের পরিবার দু’জনেই রাজি তবে আকদ আজই করানো হোক। তাছাড়া, রাসেলর ফ্লাইট আগামীকাল। বড়ো ভাই হিসেবে একমাত্র ছোটবোনের বিয়েতে যদি উপস্থিত থাকতে না পারে তবে কেমন হবে ব্যাপারটা?

বিয়ের অনুষ্ঠান বড়ো করে করা হবে পনেরোদিন পর। আজ আকদ হলেও মিলি এইখানেই থাকবে। একেবারে অনুষ্ঠানের পর শ্বশুরবাড়িতে যাবে।

মিলি এমন সিদ্ধান্ত শুনে চুপ হয়ে যায়। কারণ, এত তাড়াতাড়ি যে বিয়ের ডেইট ঠিক করা হবে মিলি জানত না। কিন্তু, মনের কোনো এক কোণায় শান্তি বিরাজ করছে। কারণ, তার বড়ো ভাইয়া যে তার থাকবে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে।

শোয়েব মনে মনে প্রশান্তির ঢোক গিলল। অবশেষে, মিলি তার হতে চলেছে। কখন সন্ধ্যা হবে কে জানে?

মাহতাব সাহেব নিঝুমকে ডাক দিয়ে বললেন মিলি এবং ইরাবতীকে নিয়ে উপরের ঘরে চলে যেতে। নিঝুম মিলি আর ইরাবতীকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল কিন্তু সেসময় রাসেলের মুখোমুখি হতে হয় তাকে।নিঝুম দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায় মিলি এবং ইরাবতীকে নিয়ে।

যেহেতু হুট করে আকদ হবে তাই তেমন কেনাকাটা করা সম্ভব হয়নি। তাই দুই পরিবারের লোকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন এখন টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করবেন। শাফায়াত আহমেদ জানালেন শোয়েব রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যাবে বিয়ের কেনাকাটা করতে।

শোয়েব আর রাসেল বের হয়ে আসে শপিংমলে যাবার জন্য। গাড়িতে উঠে বসে তারপর রওনা হলো।

পথিমধ্যে রাসেল শোয়েবকে বলল,

— যার জন্য কত পাগলামি করলি আজ তাকে ভুলে আমার বোনকে নিজের করতে সূদুর নারায়ণগঞ্জ থেকে কুমিল্লায় চলে এলি? তাকে এত সহজে ভুলে গেলি কি করে?

শোয়েব রাসেলের কথায় মুচকি হেসে উত্তর দেয়।

— সেই উত্তরটা না হয় সময় এলে বলব বড়ো ভাইয়া।

শোয়েবের দুষ্টুমির সুরে কথা শুনে রাসেল আগের থেকে কিছুটা সহজ হয়। তবুও, মনের কোণের খচখচানিটা কমে না। তাই শোয়েবকে বলেই ফেললো,

— শোয়েব বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়। একজনকে মনে রেখে আরেকজনকে নিয়ে সংসার করা সহজ হয় না। মিলি আমার বোন বলে তোকে এই কথা বলছি না। আরও একবার ভেবে দেখ। কারণ, তোর সেই অজানা প্রেয়সীর জন্য তোর হাজারো পাগলামি আমরা দেখেছি।
তাকে হারানোর বেদনায় তোর ছটফটানি আমরা দেখেছি। তাই বলছিলাম কি আরও একবার ভেবে দেখ।

শোয়েব রাসেলের সব কথার শেষে উত্তর দিলো।

— আগে কি করেছি? আমার মনে কে ছিল? আমি তা ভাবতেও চাই না। কিন্তু, এই শোয়েবের মনে এখন শুধু মিলি আছে এবং থাকবে। কারণ, শোয়েব অপাত্রে ভালোবাসা দান করে না। মিলি জানে আমি মিলির জন্য ঠিক কতটুকু ছিনিয়ে আনতে পারি আর কতটুকু বিলিয়ে দিতে পারি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here