এক ফোঁটা প্রেমের বিষ পর্ব-২০

0
1116

#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter

২০.

মিলি শোয়েবকে ছেড়ে চলে গেছে আজ একমাস হলো। শোয়েবকে দেখলে চেনাই যায় না। সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকা ছেলেটাকে যে কেউ হুট করে দেখলে পাগল ভাববে। কত জায়গায় না মিলিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু মিলির নামগন্ধও নেই। মিলি কোথায় আছে, কেমন আছে ব্যাপারটা যখন শোয়েব মস্তিষ্কে দৃশ্যমান হয় ঠিক তখনি শোয়েব দিশেহারা বোধ করে।

একদিন হসপিটাল থেকে ফিরে এসে নিজের ফ্ল্যাটে আর যায়নি শোয়েব। নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্য রওনা হয়। নারায়ণগঞ্জে নিজেদের ফ্ল্যাটে পৌঁছানোর পর মিলিকে দেখতে পেয়ে বিস্মিত হয়ে যায় শোয়েব। কতদিন পর মিলিকে দেখতে পেয়েছে শোয়েব। কতটা বদলে গেছে মিলি!

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিলির দিকে। মিলি শোয়েবের উপস্থিতি টের পেয়ে সরাসরি শোয়েবের চোখের দিকে তাকায়। শোয়েব মিলির ধারালো চোখের চাহনিতে থমকে দাঁড়ায়। কারণ, মিলির এমন চাহনি সেদিন দেখতে পেয়েছিল যেদিন মিলি তাকে সর্বশান্ত করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

মিলির পাশে একটি যুবক বসে আছে। যুবকটি শোয়েবের বড্ড চেনা। শোয়েবের বন্ধু সাইফ। মিলি শোয়েবের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শোয়েবের মা মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ঠিক একমাস আগে আমি শোয়েবকে ডিভোর্স দিয়েছি। বিশ্বাস না হলে আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন। আমার বাবাকে কিডন্যাপিংয়ের ভয় দেখিয়ে আমাকে নারায়ণগঞ্জ টেনে আনা কি আপনাদের উচিত হয়েছে?

শোয়েব মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই যে মিলি কথাগুলো বলছে ওর কন্ঠস্বর কি একবারের জন্যও বাধাগ্রস্থ হচ্ছে না! শোয়েবের তো এমন কঠিন কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

— আমার ছেলেকে তুমি ডিভোর্স দিয়েছো মানলাম। কিন্তু, তোমাদের ডিভোর্স হতে কে দেখেছে? দুই পক্ষের কোনো সাক্ষী কিংবা অভিভাবক ছিল? আমি তোমাদের ডিভোর্স মানি না।

মরিয়মের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সাইফ মুখ কালো করে ফেলে। মিলি আত্মবিশ্বাসী হয়ে শোয়েবের মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমি জানতাম আজ এখানে এলে হয়তো এমন কথা আমার শুনতে হতে পারে। তাই সেই ব্যবস্থা করেই আমি এসেছি।

কথাটি বলে সবার সামনে ব্যাগ থেকে ডিভোর্স কাগজ বের করে এনে সই করে মরিয়মের হাতে দিয়ে বললো,

— এখন দেখলেন তো আপনারা সবাই? আজকের পর থেকে আমি এই বাড়ির কেউ না।। এমনকি আজকের পর থেকে শোয়েবের আর কোনো অধিকার নেই আমার ওপর।

কথাটি বলে উঠে দাঁড়ায় মিলি। সাইফ মিলির সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মিলি একপলক শোয়েবের অশ্রশিক্ত নয়নের জোড়ায় তাকিয়ে সাইফের হাত হাত রেখে সবার চোখের সামনে দিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়।

শোয়েব মিলির গমনের পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,

— তবে কি সাইফের জন্য আজ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে তুমি চলে গেলে? এত ভালোবাসা দেয়ার পরও কি করে আমার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে চলে গেলে? আর সাইফ তুই কি করে পারলি দোস্ত আমার মনকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে?

_______________________

বর্তমান……

অতীতের স্মৃতিচারণ করতে করতে শোয়েবের চোখদুটো আবারও জলে ভরে ওঠে। শোয়েব চায় না মিলির জন্য এক ফোঁটা অশ্রু ঝড়াতে। কিন্তু, বেহায়া মন যেন চোখের সাথে হাত মিলিয়েছে।

শোয়েব বারান্দা থেকে ঘরে এসে দেখে মিলি এখনো ঘরে আসেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলল সময় তখন রাত তিনটা। রুমের দরজা খুলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় ড্রইংরুমের দিকে।

ড্রইংরুমের সোফার এখানে যেতেই শোয়েব থমকে দাঁড়ায়। মিলি সোফায় ঘুমিয়ে আছে কোনোমতে। শোয়েব দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় মিলির দিকে। খুবই সাবধানে মিলিকে কোলে তুলে নেয় যেন মিলির ঘুমে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। হাঁটতে হাঁটতে ঘরে এসে মিলিকে খাটের ওপর শুইয়ে দেয়। মিলির গায়ে চাদর জরিয়ে দেয়। তারপর, রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় চলে শোয়েব।

শোয়েব রুম থেকে চলে যাওয়ার পর মিলি চোখ খুলে তাকায়। শোয়েব যখন মিলিকে কোলে তুলে নেয় ঠিক তখনি মিলির ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু, মিলি ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় করে। নয়তো, শোয়েব যে বিব্রতবোধ করবে। অন্ধকার ঘরে মিলির দুচোখের পানি দেখার মতো কেউ নেই। একজীবনে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার উচ্চ লোভে পরে খাঁটি হীরাকে হারিয়ে ফেলেছে মিলি।

বারান্দায় বসে নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত শোয়েব। শোয়েব যদি জানত তার জন্য মিলি আজ চোখের পানি ফেলছে। তবে কি রিয়েকশন হতো কে জানে? কারো সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়াতে যে ঠিক কতটা বিব্রতকর যারা এই পরিস্থিতিতে পরেছে শুধুমাত্র তারাই জানে। শোয়েব জানে এক আকাশ ভালোবাসা বুকে ধারণ করেও আজ সে মিলির কাছে শুধুমাত্র একটি অপ্রয়োজনীয় বস্তু।

এই বিষাক্তময়ী রাতটা কেটে গেল দুজনের এটাই ভাবতে ভাবতে যে শুধু মাত্র অপাত্রে ভালোবাসা দান করে তারা আজ দেউলিয়া হয়ে ঘুরছে।

পরদিন সকালে মিলির ঘুম ভাঙে ওর শ্বাশুড়ির ডাকে। মিলি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে ওঠতে যেয়ে চাদরের সঙ্গে পা আঁটকে পরে যাচ্ছিল মিলি। মরিয়ম ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। মিলি যাওয়ার আগমুহূর্ত আগে কোত্থেকে শোয়েব এসে মিলিকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়।

শোয়েব এবং মিলির দু’জনেরই আতংকে পুরো শরীর কাঁপছে। শোয়েব এখনো মিলিকে দু’হাত দিয়ে জরিয়ে রেখেছে। আর মিলি ওর ডানহাত নিজের পেটের ওপর রেখে শান্ত হয়ে বসে আছে। মরিয়ম এসে মিলিকে টেনে ধরে উঠিয়ে খাটের ওপর বসিয়ে দেয়। শোয়েব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মরিয়মকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— মা, তাকে বলে দিও আমাকে দেয়া সকল আঘাত আমি ভুলে যাব। বাট আমার বেবির যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে আমি কাউকে ছাড় দেব না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে তৈরি হতে বলো ওকে। হসপিটাল যাব আমরা।

কথাটি বলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় শোয়েব। মরিয়ম ছেলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিলির হাত ধরে ওয়াশরুমের ভেতরে নিয়ে যায়। মিলিকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য সাহায্য করে। মিলি ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে খাটের উপর বসে আছে। আর মরিয়ম মিলিকে রেখে রান্নাঘরো চলে যায়। মিলির পছন্দের খাবার ভুনা খিচুড়ি, চ্যাপা শুটকির ভর্তা,ইলিশ মাছ ভাজি একটি প্লেটে করে নিয়ে আসে। তারপর, মিলিকে খাইয়ে দেয়।

এতসময় ধরে মিলি এবং মরিয়ম দুজনেই চুপচাপ। সকালের সেই ইন্সিডেন্টের জন্য দুজনেরই মন খারাপ। মিলি পুরো খাবার শেষ করতে পারেনি,বমি বমি ভাব তাই । মরিয়ম মিলির হাতে পানির গ্লাস দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

কিছু সময় শোয়েব আসে হাতে একটি শপিংব্যাগ নিয়ে। ব্যাগটি মিলির সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— আজ থেকে বাড়িতে এগুলো পরবে। জলদি তৈরি হয়ে নীচে এসো। এগারোটা বাজে ডক্টরের কাছে আমাদের এপোয়েনমেন্ট নেয়া হয়েছে।

মিলি শোয়েবের হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে খাটের ওপর রেখে দেয়। শোয়েব মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে বের হয়ে যায়। শোয়েব চলে যাওয়ার মিলি উঠে দাঁড়ায়। কাবার্ড থেকে বোরকা-নিকাব বের করে তৈরি হয়ে যায়।

নীচে যেতেই দেখল শোয়েব কারে বসে আছে। মিলি ধীরপায়ে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। মিলি গাড়িতে উঠে বসতেই শোয়েব কার স্টার্ট দিয়ে রওনা হয় হসপিটালের উদ্দেশ্য।

হসপিটালে পৌঁছানোর পর যথাসময়ে ডক্টরের সঙ্গে দেখা করে শোয়েব আর মিলি। যেহেতু,ডক্টর শোয়েবের পরিচিতি তাই ডক্টর জাহিদ বারবার মিলিকে ভাবি বলে সম্বোধন করছে। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এবং আল্ট্রাসাউন্ড করতে হয়েছে মিলিকে।

ব্লাড টেস্ট সন্ধায় আসবে। বাকি রিপোর্ট কিছু সময় অপেক্ষা করার পর হাতে পেয়ে যায় মিলি। আবারও ডক্টরের সঙ্গে দেখা করে শোয়েব আর মিলি। আলট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখার পর ডক্টর মুচকি হাসি দিয়ে শোয়েবকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ডক্টর সাহেব আপনি টুইন বেবির বাবা হতে চলছেন।

শোয়েব আর মিলি এই খবর শুনে স্থীর হয়ে আছে। খুশিতে আত্মহারা দুজনেই কিন্তু প্রকাশ করছে না কেউই।

ডক্টর প্রেসক্রিপশনে কিছু ঔষধ লিখে দেন যেগুলো গর্ভকালীন সময়ে সেবন করতে হয়।

শোয়েব মিলিকে নিয়ে ডক্টরের চেম্বার থেকে বের আসে। তারপর, রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্য। মিলি প্রথমে ভেবেছিল হয়তো নারায়ণগঞ্জ যাবে কিন্তু শোয়েব ঢাকার পথে রওনা হয়েছে। কিন্তু, হুট করে কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে কেন?

ঢাকার ফ্ল্যাটে পৌঁছানোর পর থেকে শোয়েব কেমন নির্জীব হয়ে আছে। চোখ দুটো কঠিন করে রেখেছে। মিলি সেই কখন থেকে ড্রইংরুমে বসে আছে। কিন্তু, শোয়েব সেই আগের মতো জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।

কিছুসময় পর শোয়েব নিজে এসে মিলির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর, কঠিন সুরে বললো,

— আমাদের টুইন বেবির একজন আমার কাছে থেকে। ওদের জন্ম হবার পরপরই একজনকে বিনাবাক্য আমার কাছে দিয়ে দিবে।

শোয়েবের মুখ থেকে এই কথা শুনে মিলি যেন সাত আসমান থেকে পরে গিয়েছে। মিলি বিস্মিত হয়ে শোয়েবকে প্রশ্ন করে,

— কিন্তু, কেন? একজন কেন আপনার কাছে থাকবে? ওরা দুজনই আপনার এবং আমার কাছে থাকবে।

— না শুধু একজন আমার কাছে থাকবে। তোমাকে আমি মেনে নিয়েছি শুধুমাত্র আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য। যেহেতু সন্তান দুজন আসবে তাহলে একজন তোমার কাছে থাকবো আরেকজন আমার কাছে। আমাদের বেবিরা চলে এলে তুমি তোমার পথে আর আমি আমার পথে।
আমি চাই না তুমি আমার সাথে সমাজের ভয়ে কিংবা আমাদের বেবির অজুহাতে থাকো। যেই সংসারে ভালোবাসা নেই ওই সংসার নাকি বালুর সংসার হয়। তুমি তো বলেছিলে আমায়।

— কে বলেছে ভালোবাসা নেই? আপনি আমাকে ভালোবাসেন না?

মিলির এমন প্রশ্ন শুনে শোয়েব মিলির দিকে তীর্যক দৃষ্টি এবং ব্যাঙ্গতক হাসি দিয়ে বললো,

— এতকিছুর পরও বলছো আমার তোমার প্রতি ভালবাসা থাকা উচিত? আমার তোমার প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। যা আছে তা শুধুই সম্মান। আমার বাচ্চাদের মা হবার জন্য তুমি যতটা সেক্রিফাইস করবে। ঠিক ততটুকুই সম্মান তুমি আমার কাছ থেকে ডির্জাভ করবে।

শোয়েব কথাগুলো বলে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়। আর মিলি বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কি শুনছে আজ সে? শোয়েবকে না হয় না পেলো সে। কিন্তু, বেবিকে ছাড়া মিলি থাকবে কি করে?

চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে মিলি। এতটা নির্দয় কেন হচ্ছে শোয়েব? যেই শোয়েবের চোখের দিকে তাকালে শুধু ভালোবাসা দেখা যেত। আজ সেই শোয়েবের চোখের দিকে তাকালে শুধু ঘৃণা দেখতে পাওয়া যায়। এতটাই যদি ঘৃণা করে তবে কেন মিলিকে আবারও সমাজের সামনে স্বীকৃতি দিয়েছে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here