#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter
২২.
এক গ্লাস লেবুর শরবত হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিলি। ঘর্মাক্ত শরীর, কয়েকগাছি চুল গালের সাথে লেপ্টে আছে। কিন্তু, ঠোঁটে হাসি লেগে আছে মিলির। আট মাসের উঁচু পেটে এক হাত রেখে শোয়েব কখন জুতা খুলে ঘরের ভেতরে আসবে সেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে মিলি।
শোয়েব জুতা জোড়া খুলে ঘরের ভেতরে এসে মিলির হাত থেকে শরবতের গ্লাসটি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। গরমের দাবদহে জনজীবনে এখন একটি আকাঙ্খা। আর তা হলো এক পশলা বৃষ্টির।
শোয়েব গ্লাসটি টেবিলের ওপর রেখে মিলির হাত ধরে টেনে এনে ড্রইংরুমের সোফা বসিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— আজ একসপ্তাহ ধরে আমি বারবার করে বলছি। যে, আমার জন্য কষ্ট করে শরবত বানিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে না। কিন্তু, তুমি তো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দাও। আরে টুইন বেবির মা হচ্ছো তুমি। একজন প্রেগনেন্ট নারীর যতটুকু খেয়াল রাখা উচিত। তারচেয়ে ডাবল টুইন বেবিদের মায়ের খেয়াল রাখা দরকার। কেন বুঝো না তোমার একটি ভুল স্টেপে তোমার এবং আমাদের বেবির ক্ষতি হতে পারে।
শোয়েব কথাগুলো শেষ করার পর মিলি হাসিমুখে শোয়েবকে বললো,
— আমি যদি মরেও যাই তবুও শেষ অব্দি চাইব আপনার সন্তানেরা যেন সুস্থ থাকে। এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারে মুগ্ধ হয়ে।
মিলির মুখ থেকে এই কথাটি শুনে শোয়েবের বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়। এত সহজে কি করে মৃত্যুর কথা বলতে পারে!
— এই মেয়ে তুমি ভুলে যেও না আমি কেমন? কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছো আমার সামনে দাঁড়িয়ে? তুমি মরলে তোমার সন্তানদের কে দেখবে?
শেষের কথাটি বলতে গিয়ে শোয়েবের গলা ধরে আসে।
মনের অন্তরালে রাগ অভিমানের ছাইয়ে চাপা পরে আছে অঢেল ভালোবাসা। কতখানি ভালোবাসার পরও যখন অবেহলা আর করে ছুড়ে ফেলা হয় তখনই বোঝা যায় ভালোবাসা নামক প্রেমের বিষ না পান করলে বুঝি বেঁচে থাকার স্বাদ পাওয়া যেত।
শোয়েব নিজের চোখের পানি আড়াল করতে তড়িঘড়ি করে মিলির চোখের সামনে থেকে সরে আসে। নিজের ঘরের চলে যায়। দরজা লক করে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে পাগলের মতো ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত পায়চারি করতে থাকে।
কি করে নিজের কাছে মিলির জন্য হৃদয়ে বরাদ্দকৃত ভালোবাসা ভুলে যাবে, শোয়েব? এই হৃদয়ে এক তৃতীয়াংশে যদি মিলির প্রতি অভিমান জমে থাকে। তবে বাকি অংশে শুধু মিলির জন্য ভালোবাসা থাকবে। সেই ভালোবাসার মানুষকে দিনের পর দিন অবহেলা করে আসছে। ভালোবেসে আগের মতো কাছে টেনে নিতে পারছে না। গভীর রাতে যখন মিলি পায়ের অসহ্য ব্যাথায় কাতরায় তখন শোয়েব পাশের ঘরে বসে দাঁতে দাঁত চেপে মিলির আর্তনাদের সুর হজম করার বৃথা চেষ্টা করে। যেই মিলির গায়ে শোয়েব একটি ফুলের স্পর্শ দিতে দেয়নি। আজ সেই শোয়েব মিলির শত ব্যাথাকে নিজ চোখে দেখেও না দেখার ভান করে। শোয়েব মনে করে আজ যদি মিলিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে সাহায্য করে তবে শোয়েব নিজের ভালোবাসার কাছে ছোট হয়ে যাবে। মিলি শোয়েবের এক আকাশ সমান ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা কবেই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু, নতুন করে শোয়েবের মনে হচ্ছে অনাগত সন্তানদের দিকে তাকিয়ে হলেও মিলির সঙ্গে একটি সমোঝোতায় আসা উচিত।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মিলির আর্তনাদ শুনতে পায় শোয়েব। এক দৌঁড়ে ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। কারণ, মিলি নীচে পরে যায়। দু’পায়ের ফাঁকে লাল রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেন।
শোয়েবের পায়ে যেন কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই।
যেন কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে।
— শোয়েব??? আ..মার বাচ্চারা???
মিলির এতটুকু কথা শুনে শোয়েব কোনোমতে দৌঁড়ে এসে মিলির পাশে বসে মিলির মাথা উঁচু করে জিজ্ঞেস করে ,
— কি হয়েছে, মন? এ..এত রক্ত কেন?
আজ কতমাস পর শোয়েবের মুখ থেকে “মন” নামটি শুনে মিলির মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। মিলি ডানহাত বাড়িয়ে শোয়েবের গালে হাত
রেখে বললো,
— বলুন তো আজ কতদিন পর আপনার মুখ থেকে এই নামটি শুনেছি আমি? জানেন আমার কানদুটো যেন এই নামটি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল এতদিন।
মিলির কথায় শোয়েবের মাঝে কোনো পরিবর্তন হলো কি না বুঝা গেল না। মিলিকে আর কোনো প্রশ্ন না করে কোলে তুলে নেয়। তারপর, সোজা দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে লিফটে ঢুকে পরে।
মিলির চোখে শোয়েবকে এখন অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ খুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
লিফট নীচতলায় আসতেই শোয়েব মিলিকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসে। নিজেদের গাড়ির কাছে যেয়ে মিলিকে সামনের সীটে বসিয়ে সিট ব্লেট বেঁধে দিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।
গাড়িতে ড্রাইভিং করা অবস্থায় শোয়েব মিলির ভাই রাসেলকে কল দিয়ে মিলির অবস্থা জানিয়ে দেয়। তারপর, নিজের মা এবং বোনদের জানায় এপোলো হসপিটালে চলে আসতে।
শোয়েব যদি পারত তবে আজ অদৃশ্য কোনো জাদুর আশ্রয় নিয়ে মিলিকে খুব দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যেত। কিন্তু, আফসোস শোয়েব তা কখনোই পারবে না।
— আপনি যখন আমাকে বকা দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। তখন, আমি আনমনা হয়ে হাঁটছিলাম। কখন যে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে এসেছিলাম বুঝতেই পারিনি। নীচে হয়তো আগে থেকেই পানি পরে ছিল। পায়ে স্লিপ কেটে পরে যাচ্ছিলাম ডাইনিং টেবিলের সাহায্য নিয়ে পরে যাওয়া থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, টেবিলের কোণায় যেয়ে ধাক্কা লাগবে বুঝে উঠতে পারিনি। জানিনা আমার বেবিরা কেমন আছে? আমার পেটের ভেতরে অসহ্য ব্যাথার যন্ত্রণায় আমি বোধহয় মরেই যাব শোয়েব। আ..পনি ঠিকই বলেছিলেন আমার বেখেয়ালি কারণেই একদিন আমার বেবিদের ক্ষতি হবে।
কথাগুলো বলে উচ্চস্বরে কান্না করতে থাকে মিলি। একদিকে ব্যাথা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মিলি ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে ওর সন্তানদের কিছু হলো কি-না?
— আমার কাছে তুমি আগে। আমার সন্তানদের হায়াত থাকলে ওরা এই পৃথিবীর আলো দেখবেই। কিন্তু, মন তোমার কিছু হলে আমি মরে যাব।
মিলির মুখের প্রাপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। সেই পুরনো শোয়েবকে আজ মিলি দেখছে। তাহাজ্জুদ নামাজ পরে ওপর ওয়ালার কাছে কত প্রার্থনা করেছে যেন জীবনের অন্তিম মূহুর্তে একবার হলেও শোয়েবের দুচোখে মিলির জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়। আজ বুঝি আল্লাহ তার ডাক কবুল করেছে। মরণ বুঝি মিলির অতি নিকটে। তাই তো শোয়েব আজ ঠিক আগের মতো মায়া মায়া কথা বলছে। এত মায়া নিয়ে কথা বললে মিলি কি এই পৃথিবী ছেড়ে পরকালে যেতে পারবে?
—মিলি, চোখ খুলে রাখো। আর একটু অপেক্ষা করো আমরা হসপিটাল পৌঁছে যাব।
— শোয়েব, আমি যদি মরে যাই। তবে আমার আলমারীর ড্রয়ারে একটি জিনিস রাখা আছে। আমার অবর্তমানে শুধু আপনার কাছে সেই জিনিসটা থাকবে।
—আমার কিছুই চাই না। তুমি কথা বলা বন্ধ করো।
শোয়েবের বারণ না শুনে মিলি আবারও বলতে শুরু করে।
— আমার বাচ্চাদের অনেক আদর করবেন। ওরা যখন বড়ো হবে তখন ওদের বলবেন ওদের মাম্মা ওদের অনেক ভালোবাসে। ওদের অনেক মিস করবে।
শোয়েব কোনো উত্তর দিতে পারে না। চেষ্টা করছে খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে হসপিটালে পৌঁছানোর জন্য।
মিলি হাত বাড়িয়ে শোয়েবের গাল স্পর্শ করার বৃথা চেষ্টা করতে করতেই খুব কষ্ট করে বললো,
— শরৎ, আমি আপনাকে অনেক ভালো……বাসি।
—“শরৎ” তুমি কোন শরৎের কথা…
কথাগুলো সম্পুর্ন করে বলতে পারেনি শোয়েব। তার আগেই অপরদিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী ট্রাক শোয়েবের গাড়িতে ধাক্কা দেয়।
গাড়ি তিনবার উল্টে গিয়ে রাস্তার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুৎের খাম্বার সাথে ধাক্কা লাগে। শোয়েবের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। গাড়ির থেকে চারফুট দূরত্বে মিলি রাস্তার পাশে পরে আছে৷ হয়তো গাড়ির উল্টানোর সময় মিলি নীচে পরে গিয়েছিল। রক্তে ভিজে আছে মিলির গায়ে থাকা হলুদ মেক্সিটা।
চারদিকে মানুষের হইহই। ট্রাকচালক এবং হেলপার পালিয়ে গেছে সেই কখন। কিন্তু, দুটো মানুষ জীবন-মরণের পথে পরে আছে। কে জানে কে বাঁচে আর কে মরে?
#চলবে