#এক_ফোঁটা_প্রেমের_বিষ
#Tahmina_Akhter
৭.
মিলি ট্রেনের সিটে বসে আছে। মিনিট পাঁচেক হলো মিলির খালা মিলিকে ট্রেনের কাঙ্ক্ষিত সিটে বসিয়ে চলে যায়। কিন্তু, যাওয়ার আগে মিলিকে অনুরোধের সুরে বলে যায়। যেন একটিবার হলেও শোয়েবের ব্যপারটা নিয়ে ভাবে। মিলি ওর খালার দিকে শীতল চোখে তাকালে ওর খালা বুঝে ফেলে মিলি কি বলতে চায়?
ট্রেন ধীরে গতিতে চলতে শুরু করে। মিলি জানালার পাশে বসাতে বাইরে দৃশ্য অনায়সে দেখতে পারছে। এই যে নারায়ণগঞ্জ শহরে আসার আগে কতটা আনন্দিত ছিল মিলি। কত কল্পনা ছিল তার এখান থেকে সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে এই আশায় । কিন্তু, এখানে আসার পর সকল কল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে শুধুমাত্র শোয়েব নামক মানুষটার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে। এই সব ভেবে মিলি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে,
— কিছু মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমাদের জীবনে আসে? চাইলেও তাদের আপন করা যায় না। আবার, তাদের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা চলতে থাকে অনবরত।
কাঁচপুর ব্রীজের ওপর বসে আছে শোয়েব। রাতের আঁধার। নদীর উপর আকাশে থাকা চাঁদের আলো।ব্রীজের উপর সোডিয়ামের আলো। কিছু সময় পর পর গাড়ির শব্দে কিছুটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
শোয়েবকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রকৃতির আঁধার রাতের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু, না। সে ব্যস্ত তার মনকে নিয়ে ভাবতে।
—তাকে পাগলের মতো চাওয়াটা কি ভুল? নাকি তার দিকে কেউ তাকালে আমার সহ্য না হওয়াটা ভুল? আমার একজীবনে যদি কোনো ভুল থাকে তবে তুমি নামক মানুষটাকে নিজের অন্তরে নিহিত করা আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল। কিন্তু, আমিও দেখতে চাই তোমার দেয়া এক ফোঁটা প্রেমের বিষ ঠিক কতটা আহত হয় আমার হৃদয়? কারণ, আমি চাই তুমি নামক মানুষটার দেয়া এক ফোঁটা প্রেমের বিষে আমার ভালোবাসাময় মৃত্যু হয়, মন।
কথাগুলো গুনগুনিয়ে বলতে বলতে চোখের পানি
গড়িয়ে পরে শোয়েবের চোখ থেকে।
সকাল নয়টা বাজে।
মিলির বাবা জনাব মাহতাব ভূঁইয়া কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মিলির বড়ো দু’ভাই চট্রগ্রাম গিয়েছে রাসেলের সৌদি যাওয়ার টিকিট বুকিং করার জন্য। আর মাহিম টেবিলে বসে সুজি দিয়ে পরোটা খাচ্ছে। এমন সময় দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলে মাহিম খাবার বাদ দিয়ে দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, বড়ো গলায় তাদের বাবাকে ডাক দিয়ে বলে,
—বাবা, দেখে যাও। মিলু চলে এসেছে।
মিলির নাম শুনে তাড়াহুড়ো করে মাহতাব সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে আসতেই দেখলেন,সত্যি সত্যিই মাহিম মিলির হাত ধরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কথা বলছে।
মিলি মাহিমের সাথে কথা বলার ফাঁকে যখন ওর বাবাকে দেখতে পেল। তখন মাহিমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখে ওর বাবার দিকে এগিয়ে যায়। ওর বাবার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
—কেমন আছো, বাবা?
মেয়ের প্রশ্নে মাহতাব মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
—ভালো ছিলাম না তোকে ছাড়া। আজ এবং এই মূহুর্ত থেকে ভালো ফিল করছি মা আমার।
মিলি তার বাবার কথায় খুশিতে আপ্লূত হয়। এমন সময় মাহিমের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় মিলি।
—তোর না আরও পাঁচ দিন পর খালার সঙ্গে আসার কথা? তাহলে আজই চলে এলি। এসেছিস কিভাবে বাসে না ট্রেনে?
মিলি মাহিমের গালে চাপড় দিয়ে বললো,
— এসেছি ট্রেন দিয়ে। আর খুব তাড়াতাড়ি এসেছি কারণ এক্সাম আছে।
— কিন্তু, রাতের ট্রেনে কেন?যদি কিছু হতো?
মিলির বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে কথাটি বললে। মিলি ওর বাবাকে আস্বস্ত করতে বলে,
— বাবা, আমি কিন্তু বড়ো হয়েছি। তুমি চিন্তা করো না। এই দেখো আমি সহি সালামতে বাড়িতে ফিরে এসেছি।
—তবুও রে মা চিন্তা হয়। কারণ, দিনকাল ভালো না। যা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে নে। আমি কলেজে যাচ্ছি। আর হ্যা তুই আর মাহিম যদি ঝগড়া করিস তবে মাইর খাবি।
বাবার মুখ থেকে এমন কথা শুনে মিলি আর মাহিম ফিক করে হেসে দেয়। ছেলে-মেয়েকে হাসতে দেখে মাহতাব সাহেবও হেসে ফেললেন।
শোয়েব যখন বাড়িতে ফিরে আসে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল তিনটা বাজে। বাড়ির সবাই যখন শোয়েবের চিন্তায় অস্থির ঠিক তখনি শোয়েবের আগমনে সবার অন্তরে প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যায়।
শোয়েব ঘরে ফিরে কারো সাথে কথা না বলে সর্বপ্রথম নিজের ঘরে ফিরে যায়। লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। তারপর, রুমে এসে খাটের উপর থেকে মোবাইল নিয়ে কারো কাছে কল দেয়। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে শোয়েব সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে।
—মিলি কোথায়? সকাল থেকে ওকে বিল্ডিংয়ের কোথাও দেখা যায়নি কেন?
—শোয়েব মি..লি তো বাসায় আছে।
— আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। মিলি এবং আপনাকে গতকাল রাতে বারোটার পর এই বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছি আমি সিসিটিভি ফুটেজে । কিন্তু, রাত দুটোর সময় আপনি একা ফিরে এসেছেন। মিলি কোথায় আছে আপনার থেকে ভালো কে জানে, জেসমিন আন্টি?
শোয়েবের এমন শীতল কণ্ঠের কথা শুনে জেসমিনের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। কারণ, শোয়েব যতটা ক্ষীপ্ত হয় ঠিক ততটাই ভেতরে ভেতরে হিংস্র হয়ে যায়।
—কি হলো বলছেন না কেন? আমি গতকাল বাড়িতে ছিলাম না বলে আপনার বোনের মেয়ে এই বাড়ির বাইরে কদম ফেলতে পেরেছে। যদি আমি থাকতাম তবে আপনার দুঃসাহস হতো না ওকে কোথাও দিয়ে আসার জন্য। আপনি বলবেন নাকি আমি..
—মিলি কুমিল্লায় গিয়েছে, শোয়েব।
শোয়েব কথাটি শুনে কল কেটে দেয়। মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,
—এবার তুমি কোথায় গিয়ে পালাবে, মন? একবার যদি আমি তোমাকে আমার করে। তবে, আমার বুকের পিঞ্জর ছেড়ে আর কারো ঘরে গিয়ে থাকতে পারবে না তুমি। আমি আসছি, মন ।
***********
ছয় মাস পরের দিনগুলো….
-আপনার হবু স্বামীর হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
পুলিশের কথায় আমার মাঝে কোনো পরিবর্তন এলো না।
বিয়ের আসরে কনে বেশে লাল লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমার হবু স্বামীর রক্তাক্ত মুখের দিকে। বিয়েতে উপস্থিত থাকা সকল লোকজনের মুখে একটাই কথা। আমার কারণে নাকি আজ বর বেশে থাকা যুবকটির মৃত্যু হয়েছে। আসলে কি তাই? আমার কারণে মৃত্যু হয়েছে তার?
এমন সময় এম্বুল্যান্স চলে এলো। সাইফের লাশটা পুলিশ আরও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে জানালো পোস্ট-পোর্টামের জন্য লাশটা নিয়ে যেতে হবে।
সাইফের বাবা-মা এবং ভাইদের কান্নার সুর যেন আরও বেড়ে গেলো। আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে সাইফের এরকম প্রস্থানটুকু দেখে। কতশত স্বপ্ন ছিল আমার তাকে ঘিরে। কিন্তু সেই আমার জন্য আজ তাকে এই ভুবন ছেড়ে যেতে হয়েছে অসময়ে।
ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালাম, দেখলাম বাবা অদূরে হুইল চেয়ারে বসে কাঁদছে। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারায় আশ্বাস দিলাম, আমি ফিরে আসব বাবা। তুমি চিন্তা করো না।
দুজন লেডিস কনস্টেবল এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির বাইরে রাখা পুলিশ ভ্যানের দিকে।
চারপাশ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসছে শিক্ষক আশফাক মুনিরের মেয়ে একজন খুনী। যে কিনা মানুষদের শিক্ষা দিয়ে এসেছে। আজ তারই মেয়ে কিনা প্রাক্তন স্বামীর জন্য নিজের হবু স্বামীকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করেছে!
পুলিশ ভ্যানে আমাকে উঠানো হয়। এমন সময় আমার তিন ভাই কোত্থেকে এসে ভ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে বলে,
— কোনো চিন্তা করিস না, মিলি। আমরা থাকতে তোর একটি চুলও কেউ ছিঁড়তে পারবে না। আমরা থানায় আসছি। উকিলের সঙ্গে কথা বলে আজই তোর জামিনের ব্যবস্থা করছি।
আমি মলিন চোখে তাকিয়ে আছি আমার ভাইদের দিকে। চোখে তাদের জল ভরা কিন্তু আমার থেকে ওই চোখগুলোর জল লুকানোর কত প্রচেষ্টা!
— কেমন আছো, মন?
চিরচেনা সেই কন্ঠ শুনে হাঁটু থেকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি সেলের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে একটি যুবক। যার জন্য আজ আমার জীবন নরকে পরিণত হয়েছে। যার জন্য আজ পাঁচদিন ধরে আমি এই জেলখানায় বন্দি। আমার ভাইদের হাজারো চেষ্টার পরও আমি মুক্ত হতে পারিনি।
— কি হলো কথা বলবে না আমার সঙ্গে?
আবারও তার প্রশ্ন। চোখ বুঁজে নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর,চার কদম এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তার আর আমার মাঝে শুধু জেলের এই রড গুলোর বাঁধা। তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— খুব ভালো আছি যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন।
—কিন্তু, আমি তো চেয়েছি তোমাকে আমার বুকের এই জায়গায় রাখতে চেয়েছি (তার বুকে হাত রেখে)। কিন্তু, তুমি তো জেলে চলে এলে স্ব-ইচ্ছায়।
—আপনার এই নির্দয় বুকে থাকার চেয়ে এই জেলখানায় বন্দি থাকা অনেক ভালো আমার জন্য।
— কিন্তু, তুমি তো কোনো অপরাধ করোনি। তবে কেন শাস্তি ভোগ করবে?
—কারণটা, হয়তো আপনার খুব ভালো করে জানার কথা।
আমার কথায় তার মুখে হাসির দেখা মিললো। মুখে হাসি রেখে আমাকে বললো,
—তবে, তুমি সেই কথায় আছো? ফিরবে না আমার কাছে?
—আমি মরে গেলোও দি গ্রট মাস্তান শোয়েবের কাছে ফিরব না।
কথাটি বলে উল্টো ঘুরে চলে আসব এমন সময় শোয়েব বললো,
— সময় কথা বলবে, মন। তবে একটি কথা মনে রেখো, তুমি যদি শোয়েবের না হও তবে আর কারো হবে না। দরকার হলে এই হাত দিয়ে আরও অনেক খুন করব।
শোয়েবের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমার পা থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম শোয়েব এসআই ফরিদের সঙ্গে কি যেন বলছে? তারপর,আমার দিকে আবারও একপলক তাকিয়ে থানার সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে গেলো।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। চোখের পানিগুলো আবারও গড়িয়ে পরছে। ঝাপসা নয়নে সেই কালবেলার কথা ভাবছি যেদিন এই শোয়েব নামক মানুষটার সঙ্গে আমি না চাইতেও এক সুতোয় বাঁধা পরেছিলাম ।
#চলবে