এক শহর ভালোবাসা পর্ব_৪০

0
1185

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৪০
#সুরাইয়া_নাজিফা

“দেখি তোমার হাতে মেহেদির রং কেমন হয়েছে।”
“দেখে কি করবেন?”
“মানুষ বলে মেয়েদের হাতে মেহেদির রং গাড় হলে নাকি স্বামী বেশী ভালোবাসে তাই দেখতে চাইছি। ”
আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম,
“কেন নিজেই নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না নাকি?”
শান ভ্রু কুচকে বললো,
“আমি সেটা কখন বললাম? ”
“তাহলে দেখে কি করবেন? ”
শান হালকা হেসে বললো,
“শুধু নিজে জানলে তো হবে না পৃথিবীর সব মানুষেরও তো জানা প্রয়োজন আমি আমার বউকে কতটা ভালোবাসি তাই না। ”

উনার কথা শুনে আমি একপলক আমার হাতের দিকে তাকালাম তারপর মুচকি হেসে বললাম,
“তাই নাকি তাহলে দেখেন আপনার ভালোবাসার রং।”

কথাটা বলেই আমি আমার হাত দুটো উঁচু করলাম। আমার হাতে মেহেদির রং অনেক সুন্দর হয়েছে। এই নিয়েও এতক্ষন বড়রা প্রচুর মজা করেছে আমার সাথে।বর নাকি আমাকে চোখে হারায় তাই মেহেদির রং এতটা গাড় হয়েছে।

“বাহ দেখেছো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি এখন তো প্রমাণও আছে। ”
আমি উনাকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,
“ইশ আমার হাতে মেহেদি এমনিতেই লাল হয় বুঝলেন তাই এতো ক্রেডিট নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
শান আমাকে টোন কেঁটে বললো,
“আচ্ছা জ্বলছে না আমি বেশী ভালোবাসি দেখে তুমি তো মোটেও আমাকে ভালোবাসো না এজন্যই আমার হাতে মেহেদির রং হয়নি। ”
শানের কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
“কি মিথ্যা কথা আপনি গান গাইবেন বলে গিটার বাজানোর জন্য নিজের মেহেদি ধুয়ে ফেলেছেন। মেহেদিটা হাতে সম্ভবত দশমিনিট ছিলো এই দশমিনিটে কি রং আশা করেন আপনি? ”
“তাতে কি মানুষ তো এটাই বলবে তাই না যেটা আমি বলেছি। ”

শানের কথা শুনে আমি মুখ ফুলালাম মনে মনে ইচ্ছা মতো গালাগালি করতে থাকলাম কি খারাপ লোক নিজেই তো গান গাওয়ার জন্য হাত ধুয়েছে এখন আমার দোষ দিচ্ছে।

“আমার হাতে রং কেমন হয়েছে দেখতে চাইবে না।”
আমি অভিমান নিয়ে বললাম,
“দেখার কি প্রয়োজন আপনি তো বলেই দিয়েছেন। ”
শান নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে বললো,
“ইশ মুখটা এমন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে কেন বৃষ্টি নামবে বুঝি। ”

আমি কথা না বলে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলাম।শান নিজের হাত সামনে এনে বললো,
“আচ্ছা দেখো তো কেমন হয়েছে। ”
আমি তাকালাম না শান বললো,
“আহা এসব মান অভিমান বিয়ের পর করো যাতে আদর ভালোবাসা দিয়ে ভাঙাতে পারি এখন আমার দিকে তাকাও। ”
আমি তারপরও তাকালাম না। কেন তাকাবো সামান্য একটা মেহেদি দিয়ে উনি আমার ভালোবাসার পরিমাপ করছে কিভাবে।
শান আবারও বললো,
“সুইটহার্ট তাকাও। ”

এতবার বলার পরেও যখন সোহা তাকালো না শানের রাগ উঠে গেলো। শান ধমক দিয়েই বললো,
“সোহা লুক অ্যাট মি। ”

হঠাৎ মিষ্টি কন্ঠের পরিবর্তে কর্কশ কন্ঠে তাজা ধমক শুনে আমি দ্রুত ফোনের দিকে তাকালাম আর তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম উনার হাতে গাড় লাল রং হয়েছে মেহেদির। আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলাম,

“এই আপনার হাতে এতো রং হলো কি করে আপনি তো….।”
পুরো কথা বলার আগে শান বললো,
“আমার বউয়ের উপর কেউ আঙ্গুল তুলবে সেটা কি আমি হতে দিতে পারি নাকি। সবাই জানুক আমি তাকে যতটা ভালোবাসি সেও আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসে কি তাই তো?”

উনার কথা শুনে আমার রাগ গলে জল হয়ে গেল। প্রত্যেকবার উনি এমন এমন কান্ড করে যে আমি বাধ্য হই উনার ভালোবাসার কাছে হারতে।

আমি ছলছল চোখে তাকিয়ে বললাম,
“এটা কিভাবে সম্ভব? ”
শান হেসে বললো,
“সম্ভব কারণ আমি পরিবর্তীতে আবার সেই ডিজাইনের উপর মেহেদি দিয়েছিলাম কিছুক্ষন আগেই সেই মেহেদি শুকিয়েছে এজন্যই তো ফোন দিতে লেইট হলো। ”

আমি একদৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে রইলাম শান বললো,
“এখন অভিমান ভেঙেছে কি?”
আমি নাকের পাটা ফুলিয়ে বললাম,
“কেন ভাঙবে আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না রং তো এমনিতেই হয় মানুষের হাতে তাতে কি আসে যায়। ”
শান চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,
“ওহ তাহলে ভালোবাসো বুঝি। ”
আমি চোখ ছোট ছোট করে গলা উঁচিয়ে বললাম,
“আপনার থেকেও বেশী। ”
“নো সুইটহার্ট তুমি ভালোবাসতে পারো বাট আমার থেকে বেশী না। ”
আমি রেগে বললাম,
“বলেছি তো আপনার থেকে আমি বেশী ভালোবাসি। ”
“আমি বেশী ভালোবাসি। ”
“আমি বেশী।”
“আমি। ”
“বললাম না আমি বেশী এখন কিন্তু কান্না করব না মানলে। ”
শান হেসে বললো,
“ব্লাকমেইল করে কিছু আদায় করতে হয় কি করে কেউ তোমার থেকে শিখুক। ”
আমি উনাকে চোখ টিপে বললাম,
“বেশ করেছি। যেমন বর তেমন তো বউকে হতোই হতো তাই না। ”
শান হালকা বললো,
“হুম বুঝতে পারছি আমার বোকা বউটা দিনদিন চালাক হয়ে যাচ্ছে। ”


সারারাত বসে বসে গল্প করা আর দিন হলে পড়ে ঘুমানোটাই এই কয়দিনের রুটিন হয়ে গেছে আমার। কারণ সারাদিন পুরো বাড়ি ভর্তি এতো মানুষ থাকে যে কথার বলার সুযোগই হয় না।বলা তো যায় না কে আবার কখন বলে উঠে মেয়েটা কি বেহায়া বিয়ের আগেই স্বামীর সাথে প্রেম আলাপ করছে বিশেষ করে বেশী বয়স্ক যারা তাদের একটু সামলে চলতেই হয়।

সন্ধ্যাবেলা হলুদের অনুষ্ঠান। পুরো বাড়ি বিভিন্ন রঙের ফুলের সাথে মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। একদম ঝলমল করছে বাড়িটা। আম্মু আমাকে আর স্মৃতি আপুকে শাড়ী আর জুয়েলারি দিয়ে গেছে। জুয়েলারি বলতে ফুলের গয়না। অন্যদিনের মতো আমার কাজিন আর ফুফি মামিরা মিলে আমাদের সাজিয়ে দিয়েছে। সাজানো হয়ে গেলে বড়রা বাকি আয়োজন দেখার জন্য বেরিয়ে যায়। তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে একদম স্পষ্ট উঠে আছে “শান ইজ কলিং” বাট এখন চাইলেও আমি এই বিচ্ছু গুলার সামনে ফোন রিসিভড করতে পারবো না তাহলে শুরু হয়ে যাবে এদের পঁচানো। আমি হাতটা বাড়িয়ে ফোনটা কাঁটতে যাবো তখনই আমার কাজিন ঝুম আমার হাত ধরে বসল।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
“কি হয়েছে? ”
ঝুম একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
“দাঁড়া শুধু তুই কথা বললে হবে জিজুর সাথে আমাদেরও একটু সুযোগ দে। ”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“মানে? ”
“মানে হলো তিয়াশা এখন তুই হয়ে ভাইয়ার সাথে কথা বলবে আমরাও দেখি ভাইয়া তোকে কতটা ভালোবাসে তুই আর তিয়াশার কন্ঠের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে কিনা। ”
আমি আঁতকে উঠে বললাম,
” ঝুম আপু এটা ঠিক না তিয়াশা তো আমার কন্ঠ নকল করতে পারে তাহলে উনি বুঝবে কিভাবে? ”
“কন্ঠ নকল করলেই তো হলো না কথা বলার ভঙ্গি তো অবশ্যই আলাদা হবে তাই না দেখাই যাক তোদের ভালোবাসা কতটা স্ট্রং। ”

ঝুম আপুর কথা শুনে আমিও ভাবলাম দেখি খানিকটা বাজিয়ে দেখি কি হয়। আমি সম্মতি দিলাম। প্রথমবার এসব তর্ক করতে করতে ফোনটা কেঁটে গেল দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই তিয়াশা রিসভড করল। আমার বুকের ভিতর ডিপ ডিপ করতে লাগলো বুঝতে পারবে তো শান?ফোন স্পিকারে দেওয়া হলো।

ওপাশ থেকে শান বললো,
” হ্যাঁলো। ”
তিয়াশা চুপ করে রইল শান আবার বললো,
“কথা বলো। কি করছো এখন?”
তিয়াশা আমার মতো মিনমিনে গলায় বললো,
“এই তো সবাই সাজিয়ে দিয়ে গেলো বসে আছি চুপচাপ। ”
“খেয়েছো তো?”
“হুম। ”
“ওহ বাসার সবাই ভালো? ”
তিয়াশা একবার সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হুম ভালো। ”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সচারাচর তো শান আমার সাথে এভাবে কথা বলে না। সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে। এদিকে ঝুম আপু মিনমিনিয়ে বলছে,
“কিরে সোহা তুই বুঝি ঘন্টার পর ঘন্টা এমন নিরামিষ আলাপ করিস। ”

আমি ভ্রু কুচকে আপুর দিকে তাকালাম।ব্যাপারটা বুঝার জন্য তিয়াশা কে ইশারায় জিজ্ঞেস করতে বললাম যে আজ হঠাৎ আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? তিয়াশা আমার ঠোঁটের নাড়ানো চাড়ানো দেখে সেভাবেই শানকে বললো,

“আচ্ছা আপনি আজকে এভাবে কথা বলছেন কেন?”
“কিভাবে?”
“এই যে কেমন নিরামিষ নিরামিষ সচারাচর এভাবে তো বলেন না। ”
শান একটু হেসে বললো,
“কারণ আমি জানি বউয়ের সাথে কি করে কথা বলতে হয় আর শালীদের সাথে কিভাবে।”

শানের কথা শুনে আমি বিষম খেয়ে কাঁশতে লাগলাম আর তিয়াশা কন্ঠে বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“মানে? ”
“মানে পরে বুঝাচ্ছি আগে কেউ আমার বউটাকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেও। ”

কথাটা শুনে আমার কাশি বন্ধ হয়ে গেল।সবাই থম মেরে বসে রইল। স্মৃতি আপু আমাকে পানি এগিয়ে দিতেই আমি এক ঢোকে পানিটা খেয়ে নিলাম। আমার মুখে বিশ্ব জয়ের একটা হাসি ফুঁটে উঠলো।

শান আবারও বললো,
“আমি জানি ফোনটা স্পিকারে দেওয়া তুমি আমায় শুনতে পাচ্ছো সুইটহার্ট তোমার নিঃশ্বাসের শব্দটাও আমি খুব ভালো করে চিনি সেখানে তুমি ভাবলে কি করে যে আমি অন্যকেউকে তুমি ভেবে ভুল করব। এতোটা অবিশ্বাস আমার প্রতি। ”

আমি তিয়াশার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললাম,
” ছি ছি এটা কি বললেন আসলে এটা ঝুম আপু আর তিয়াশা মিলে আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য করেছে আমি এসবের কিছু জানি না। ”

ঝুম আপু লজ্জা পেয়ে বললো,
“স্যরি জিজু আমরা একটু মজা করার জন্যই এটা করেছি প্লিজ কিছু মনে করো না। ”

“না আমি কিছু মনে করছি না শালী হিসেবে এতটুকু মজা তোমরা করতেই পারো।”

তখনই তিয়াসা বলে উঠলো,
“ওয়াও জিজু সো সুইট অফ ইউ। আর কি কি গুন আছে তোমার কালকে গান শুনে ফিদা হয়ে গেছিলাম আর আজকে তো তোমার উপর ক্রাশই খেয়ে গেলাম। ”

শান হেসে বললো,
“সো স্যাড শালীসাহেবা এখন তো ক্রাস খেয়েও কোনো লাভ নেই কজ আমি অলরেডি একজনের হয়ে গেছি সো আমি তাকে ছাড়তে পারবো না। ”

তিয়াশা আফসোস করে বললো,
“ইশ কেন যে সোহার আগে আমার সাথে তোমার দেখা হলো না। ”

শান সোহাকে জ্বালানোর জন্য মজা করে বললো,
“রিয়েলি তাহলে তোমার বোনকে বলো আমাকে ছেড়ে দিতে তাহলে কিছু একটা হলেও হতে পারে।”

শানের কথা শুনে আমার চোখ গুলো স্বাভাববিকের তুলনায় বড় হয়ে গেল।রাগান্বিত কন্ঠে তিয়াশার মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,
“আর কত ক্রাশ খাবিরে তুই। পৃথিবীতে এমন কোনো ছেলে বাকি আছে যে ক্রাশ খাশ নাই। ”

তিয়াশা ঠোঁট ফুঁলিয়ে বললো,
“এখন পৃথিবীর সব ছেলেকে যদি ভালো লাগে আমার কি করার আছে। ”

তিয়াশার কথা শুনে সবাই একযোগে হাসতে লাগলো শান ওপাশ থেকে বললো,
“আহা বেচারী বাচ্চা একটা মেয়ে এতো সিনক্রিয়েট করছো কেন?”

শানের কথা শুনে রাগ আরো সপ্তমে উঠে গেল,
“এই বের হো সবগুলো এখনি রুম থেকে বের হো বলছি। ”

সবগুলোকে কান ধরে বের করে দিয়ে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম,
“আমাকে ছেড়ে দেওয়ার এতো তাড়া দেখছি ভালোবাসা সব পালিয়েছে নাকি? ”

“তোমার কিছু যায় আসে নাকি তাতে তুমিই তো এইমাত্র অন্যকে ধরিয়ে দিয়েছো কথা বলতে আমার থেকে পিছু ছাড়াতেই। ”

“আমি কতবার বলবো আমি কিছু করিনি এগুলো সব ওদের কারসাজি। ”

“হুম কিন্তু যদি বুঝতে না পারতাম কেসটা তো আমিই খেতাম তখন তো তুমিও উল্টাই বুঝতে তাই না। ”

“আমি জানতাম আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন। ”
“এতো বিশ্বাস?”
“হুম। ”
“ওকে এইবার ঝটপট হলুদের সাজে আমাকে কয়েকটা পিক দেও তো আর ভিডিও কল দিচ্ছি। ”
“না।”
“না মানে?”
“না মানে না। না পিক পাবেন আর না ভিডিও কলে কথা বলবো এটা আপনার শাস্তি আমাকে কষ্ট দেওয়ার। ”
“এখন দোষটা তুমি করলে আর শাস্তিটা আমি পেলাম এটা কেমন নীতি আমি কিন্তু চাইলেই রাগ করতে পারতাম। ”
“করেন রাগ তাতে আমার কি আমি তো দিবো না পিক। ”
“ওকে দিতে হবে না আমার জিনিস আমিই জোগার করে নিবো। ”
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
“কি করবেন আপনি? ”
“সময় হলেই দেখতে পাবে।”

আমি কিছু বলার আগেই উনি ফোনটা কেঁটে দিলো। কি করতে চাইছে উনি?আচ্ছা সত্যি সত্যি রাগ করেনি তো। আমি কয়েকবার ফোন করলাম বাট রিসিভড করল না।

কিছুক্ষন পর এসে আমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো।হলুদ লাগানোর আগে ভূমিকা আপু আমার অনেক গুলো ছবি তুলে নিলো।পরে বড়রা মিলে শানের গায়ের হলুদ আমার গায়ে ছোঁয়ালো। সবাই একটু একটু করে আমার আর আপুর গায়ে হলুদ মাখালো অনেক রাত পর্যন্ত হলুদ প্রোগ্রাম হলো। তারপর আমাকে আর আপুকে গোসল করার জন্য রুমে পাঠিয়ে দিলো।আজকে আমাদের রুমে কেউ থাকবে না ওদের জন্য অন্যরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে এটা শুনে ভালো লাগলো।আমি রুমে এসেই ফ্রেস হতে চলে গেলাম আর আপু অন্য ওয়াসরুমে। ফ্রেস হয়ে এসে চুল মুছতে মুছতে আমি এসে বেডের উপরে বসলাম। আপুও ফ্রেশ হয়ে আসলো।আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,

“উফ এই মিষ্টি খেতে খেতে একদিনে মোটা হয়ে যাবো আমি। ”
আপু হাসলো,
“আচ্ছা ভাইয়া তখনের কাজে রাগ করেনি?”
“করেনি আবার তোদের জন্য সব ঝড় আমার উপর দিয়েই গেলো। ”
আপু বেডের অন্যপাশে এসে বসে বললো,
“এজন্যই বিয়ের এই কয়দিন আরশকে বলেছি তেমন একটা কথা না বলতে জানি তো সুযোগ পেলেই এরা এভাবে মজা নেবে। ”

আপু হাসল। আমি মুখ ফোলালাম। তখনই আমার ফোনের ম্যাসেজ টিউনটা বেজে উঠলো। ওপেন করতেই দেখলাম আমার হলুদ ফাংশনের কিছু ছবি শান পাঠিয়েছে মানে কেমনে সম্ভব। উনি কোথায় পেলো ছবি গুলো।
ছবি গুলোর নিচে লেখা ছিল,
“আমার পরীকে হলুদ শাড়ীতে একদম হলুদপরী লাগছে। ”

ছবি গুলো দেখে আমি শানকে কল করলাম,
“এই ছবি আপনি কই পেলেন। ”
শান কিছু না বলে শুধু হাসল।
“আমি আপনাকে হাসতে বলিনি। ”
“শুধু ছবি? আমি তো তোমার পুরো হলুদ অনুষ্ঠান লাইভ দেখেছি। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কেমনে?”
“তোমাকে বলবো কেন তুমি তো আর দেওনি আমি কালেক্ট করে নিয়েছি। ”
“কে দিয়েছে আজকে তো সবাই কম বেশী বিজি ছিল বাড়ির আর আপনার গুপ্তচরেরও তো সেই টাইমে গায়ে হলুদ ছিল তাহলে? ”
শান আবারও হাসলো,
“তুমি অনেক বোকা সুইটহার্ট আমার জন্য এটা কোনো ব্যাপারই না।তোমার যেখানে হলুদ প্রোগ্রাম হয়েছিল সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। আজকের মতো টাটা কালকে দেখা হবে প্রিয়া ফুলের বাসরে। ”

কথাটা বলেই উনি একটা ভাব নিয়ে ফোনটা কেঁটে দিলো অদ্ভুত।আমি হা করে রইলাম। কি ফাজিল লোক। তারপরই উনার পরের কথাটা মনে পড়তেই লজ্জা পেয়ে গেলাম।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়তেই আমি আর আপু ঘাবড়ে গেলাম এতো রাতে কে? আপু গিয়ে দরজা খুলে দিলো আব্বু, আম্মু দাঁড়িয়ে আছে হাতে খাবার নিয়ে।
আপু বললো,
“বাবা,মা তোমরা এত রাতে?”

বাবা একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“তোরা তো খাসনি কিছু তাই ভাবলাম খাইয়ে দি কে জানে আজকের পর আর কখনো সুযোগ হয় কিনা। ”

বাবার কথা শুনে আমাদের দুই বোনের চোখে পানি চলে আসল। তারপর আমাদের খাইয়ে দিল বাবা আর মা পাশেই বসে ছিল।

খাওয়ানো শেষে বললো,
“জানিস পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন কাজ হচ্ছে মেয়েকে বিদায় দেওয়া। এতগুলো বছর লালন-পালন করে তারপর হুট করেই একজনের হাতে তু্লে দেওয়াটা কতটা কষ্টের সেটা একজন বাবা মাই জানে। ভাবতেই পারছি না আমার ছোট মেয়ে দুটো কবে এতো বড় হয়ে গেল যে কালকে আমার পুরো বাড়িটা ফাঁকা করে চলে যাবে।”

বাবা মায়ের চোখে পানি আমরা দুই বোন গিয়ে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।চারজনই চারজনকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকলাম। ভাবতেই পারছিনা মেয়েদেরকেই সবসময় কেন এতো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তারপর মা বাবা আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল।


আজকে খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল।সত্যি বলতে কাল রাতে ঘুমই হয়নি এতো কান্নাকাটির মাঝে।তারউপর বিয়ে নিয়ে এতো টেনশন হচ্ছে। কি একটা টান টান উত্তেজনা। মনের মধ্যে একদিকে আনন্দ লাগছিলো অন্যদিকে ভয় সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ অনুভুতি। আজকে আমাদের সবার এতোদিনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার। হুম আজ আমাদের বিয়ে। বিয়ে কথাটা মনে পড়লেই লজ্জা, ভয়, খুশি সবকিছু একসাথে এসে মিলিত হয় মনের কোনে।

আজকে কেউ তেমন একটা বের হতে দেয়নি আমাদের রুম থেকে। পার্লার থেকে মেয়ে নিয়ে এসে সাজানো হয়েছে। কারণ বাবা এর আগের বারের মতো রিস্ক নিতে চায়নি। আপু তো পার্লার থেকেই পালিয়ে ছিল। আবার না কোনো অঘটন ঘটে তাই পার্লারই ঘরে বসিয়ে দিয়েছে। আমার আর আপুর দুজনেরই একসাথে সাজ কমপ্লিট হয়ে গেল।আমি একটা লাল বেনারসি পড়েছি তার সাথে গোল্ডের জুয়েলারি। নিজের দিকে নিজেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি। প্রথমবারের বিয়ের থেকে এই বিয়ের কত পার্থক্য প্রথমবার তো এই ফিলিং গুলোই কাজ করছিলো না আর এখন কত সুন্দর করে প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছি।

আপু আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার ছোট্ট বোনটা কবে এতো বড় হয়ে গেল বলতো যে সে আজকে আমার সামনে লাল বেনারসি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু তাই নয় সম্পর্কে তো আমার থেকে বড় হয়ে গেল।”

আমি আপুকে জড়িয়ে ধরলাম,
“প্লিজ এতো ইমোশনাল কথা বলিস না নাহলে আমার মেকাপটা নষ্ট হয়ে যাবে। ”

আমার কথা শুনে আপু হেসে দিল। কিছুক্ষন পর শুনতে পেলাম বর এসেছে বর এসেছে বলে সবাই ছুটে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দটা যেন আরো বেড়ে গেল। আমাদের স্বপ্ন থেকে আর কিছুটা দূরত্ব আমাদের।

শান স্টেজে বসে আছে আর অপেক্ষা করছে সোহার জন্য। তখনই স্মৃতি সোহা দুজনকেই নিয়ে আসা হলো। শান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। এই রূপে হয়তো পৃথিবীর সব মেয়েকেই সবচেয়ে বেশী সুন্দর লাগে। সোহাকে শানের পাশে আর স্মৃতিকে আরশের পাশে বসানো হলো। তারপর বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হলো। তিনবার কবুল পড়ে দ্বিতীয়বারের মতো শানের হয়ে গেলাম সারাজীবনের জন্য। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো। শান কানে কানে বললো,
“কনগ্রাচুলেশন সুইটহার্ট অবশেষে দ্বিতীয়বারের মতো তুৃমি আমারই হলে। ”

আমি শানের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি উপহার দিলাম। তারপর একে একে সবাই আসলো ছবি তোলার জন্য।

কিছুক্ষন পর একজন দম্পত্তি এসে বললো,
“কনগ্রাচুলেশন তোমাদের দুজনকেই। ”

এতো মানুষের মধ্যেও তাদের চিনতে আমাদের অসুবিধা হলো না। আমার আর শানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো শান আর আমি হেসে বললাম,
“তোমাদেরকেও অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ। ”

তিমির আর ঐশী হাসল। আমি একটু অভিমান করে বললাম,
“এতগুলো প্রোগ্রামে এলে না কেন?কত অপেক্ষা করেছি তোমাদের জন্য। ”

ঐশী বললো,
“আসলে বাবার শরীরটা অনেক অসুস্থ ছিল তাই বাবাকে দেখতে গিয়েছিলাম বাবার টেক কেয়ারের প্রয়োজন ছিল তাই বাবার পাশেই ছিলাম তবে আজকে বিয়ে দেখে ছুটে চলে এলাম আমার দুটো প্রিয় মানুষের কাছে। ”

ঐশীর চোখে জল চলে এলো। আজও ঐশী শানকে দেখলে নিজের চোখের পানি আটকাতে পারেনা। তবে আগের মতো ফিলিংস গুলো আর কাজ করে না। এখন মনে যত অনুভুতি, প্রেম, ভালোবাসা আছে সব তিমিরের নামে।

তিমির শানকে উদ্দশ্যে করে বললো,
“শুনেছি ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায় কিন্তু তোর এতোবার যাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন বলতো আমার জীবনতো একবারই তেজপাতা হওয়ার উপক্রম।”

কথাটা বলতেই ঐশী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তিমিরের দিকে। তিমির ঐশীর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“না ঐ শানকে বলছিলাম যে একটু সাবধানে থাকতে। ‘
“আমি তোমার জীবন তেজপাতা করেছি তাই না আজকে বাসায় চলো হচ্ছে তোমার। ”
তিমির কান্না কান্না মুখ করে রইল শান মজা নিয়ে তিমিরের পিঠ চাপড়ে বললো,
“ইশ ভাই আমাকে সাবধান করতে গিয়ে নিজেই ফেসে গেলি বেষ্ট অব লাক ওকে। ”

“ভাইরে ভাই এটাকেই বউ বলে।তবে সোহা ভাবী আপনার কিন্তু আমার তরফ থেকে একটা স্পেশাল গিফট পাওনা আছে। ”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“কেন?”
“কেন আবার আপনার মনে আছে যেদিন আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় সেদিন কি বলেছিলেন আপনাদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে যাতে যখনই আপনাদের বাড়িতে আসি যেন বউকেও নিয়ে আসি আপনার ভবিষ্যৎ বাণীটা তো সত্যি হয়ে গেল। ”

তিমিরের কথা শুনে আমি, শান, ঐশী তিনজনই হেসে দিলাম। আসলেই জীবনটা কতো অদ্ভুত তিন-চারমাসে জীবনের মানেটাই বদলে গেছে সবার। ভালোবাসার মানুষ, নিজের ঠিকানা সব সবটা বদলে গেছে। ঐশীর দিকে তাকিয়ে মনে একটু প্রশান্তি পেলাম। মেয়েটা জীবনে নিজের জন্য একজন সত্যিকারে ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে। সবাই সবার মতো সবার জীবনে ভালো আছে এরচেয়ে আর বেশী কি চাই জীবনে।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here