এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা ৪৩.

#এক_বৃষ্টিস্নাত_সন্ধ্যা
৪৩.
#WriterঃMousumi_Akter

বাইরে উত্তপ্ত সূর্য প্রকৃতির পরিবেশ আগুনময় করে তুলেছে।সূর্য নিজ তেজ নিয়ে আস্তে সস্তে আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।এই শরৎকাল টা বড্ড ভালো লাগে আমার অবেলায় হুট করে বৃষ্টি আসে,ভ্যাপসা গরম আবার রাত শেষে একটু ঠান্ডা পড়ে ফ্যান ছেড়ে পাতলা কাঁথার নিচে শেষ রাতে আরামদায়ক একটা ঘুম দিয়েছি।কাল রাতে আম্মু আমার পাশে ঘুমিয়েছিলো।আমাকে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিলো আম্মুর কাছে।প্রচন্ড মাথায় পেইন বাড়ার ফলে একটা কম পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম।মাথাটা ঝিম ধরে আছে এখনো ঘুম ছাড়ছে না।আয়রা ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লিপিস্টিক পরছে।চুড়ির আলনা থেকে চুড়ি নিয়ে পড়ছে।চিরকুট টা কতশত বার পড়লাম আমি তার শেষ নেই।প্রতিটা লাইন যেনো এক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের প্রতিটা লাইন জুড়ে ছিলো মনের গভীরের জমে থাকা ডিপ ভালবাসা।নিজের কাছেই বিশ্বাস হচ্ছে না এ চিঠি আমার। কাল সারারাত ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেছি বিহান ভাই আর প্রেয়সী আপু ঘুরে বেড়াচ্ছেন।বার বার ঘুম ভেঙেছে সারারাত এপাশ ওপাশ করেছি ঘুমের মাঝে।আমার স্বপ্নে বার বার প্রেয়সী আর বিহান ভাই এসছেন।সারারাত মন জ্বলে পুড়ে একাকার হয়েছে।ঘুমোনোর আগে জানালা খুলে জানালার গ্রিলেত ফাঁক দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দুইঘন্টা মতো।এই অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই।কষ্ট পেলে মন খারাপ হলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট উজাড় করে দেই।কাউকে কিছুই বলি না।

বাট ঘুম থেকে উঠেই এমন চিরকুট কিভাবে সম্ভব।বিহান ভাই তো ঢাকাতেই আছেন।আয়রা কে বললাম এটা কে দিয়েছে তোকে। আয়রা বললো বলবো না আমাকে তুমি কিছু দাও না। আয়রা কে বললাম সব সাজুগুজু দিয়ে দিবো আয় আমার কাছে বল কে দিয়েছে।আয়রা বললো কাউকে বলো না বিহান ভাইয়া বলেছে তোর দিয়া আপুকে বিয়ে দিবি আমার সাথে বলেই আয়রা মুখে হাত দিয়ে লজ্জায় লুটিয়ে পড়ে বললো আমার সাথে বিয়ে দিলে রোজ এত্ত এত্ত চকলেট দিবো।এটা বিহান ভাইয়া দিয়েছে তোমাকে আর কাউকে বলতে নিষেধ করেছে তুমিও বলো না কাউকে দিয়াপু।আমাকে এ রুমে পাঠিয়ে ভাইয়া দরজায়া দাঁড়িয়ে ছিলো।আয়রার কথা শুনে এক লাফে বিছানা থেকে নামলাম বাইরে বেরোতেই আম্মু বললো উঠেছিস আয় ভেতরে আয়।আম্মু আমার হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে আমার চোখ চাতক পাখির মতো তাকে খুজছে।কোথায় সে কতকাল দেখি না তাকে।প্রায় চার মাস তার মুখ টা দেখি নি।আম্মু আমার হাত ধরে রুমের মাঝে নিয়ে যাচ্ছে আর আমার ঘাড় বাইরের দিকে ঘোরানো আমি তাকে খোজার চেষ্টা করছি।আম্মু চুলে চিরুনি করে দিয়ে চুলে কাকড়া মেরে দিলো।ব্রাশে পেষ্ট মাখিয়ে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো।আম্মু বললো দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার আনছি।ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসলাম।আম্মু সেদ্ধ ডিম আর খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে।খাওয়ার দিকে মন নেই আমার।আমার মন রয়েছে বাইরে উনি কি আছেন নাকি চলে গিয়েছেন।শুধু উঁকিঝুঁকি মারছি আমি।আম্মুকে বললাম আম্মু কেউ এসছিলো সকালে।আম্মু বললো হ্যাঁ বিহান এসছিলো সকালে একটু আগেই চলে গেলো।

আম্মুর কথা শুনে বুকের মাঝে বাড়ি মেরে উঠলো উনি সত্যি এসছিলেন।বিহান ভাই না ঢাকাতে আম্মু।

ছিলো রাত তিনটার দিকে বাসায় এসছে।আর সকালে আমাদের বাসায় এসছিলো।তোর কোচিং নিয়ে কথা বলতেই এসছিলো।দেখ দিয়া বিহান কিন্তু ভাই হিসাবে ওর কোনো দায়িত্ব থেকে এড়িয়ে যায় না।কারো কোনো চিন্তা নেই কিন্তু বিহান একমাত্র মানুষ যে তোকে নিয়ে ভীষণ টেনশন করছে।বিহানের কথা শুনে একটু নিশ্চিত হয়েছি আমি।

মনে মনে বললাম আম্মু কত যে বোনের নজরে দেখে সে কি আর বলতে।মনে মনে আরো দুঃখ হচ্ছে আমার জন্য কি একটুও খারাপ লাগে না উনার।এতদিন দেখেন না আমাকে এসছেন আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেলেন।কিভাবে পারেন উনি এভাবে থাকতে।এসছিলেন হয়তো আম্মু ডেকেছিলো তাই।আমাকে ভেবে তো আসেন নি।সকাল গড়িয়ে দুপুর কই একটা বার ও তো ফোন দেন নি আমাকে।একটা মেসেজ ও না।তাহলে চিঠি দিয়েছিলেন ক্যানো?বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা তাও কোনো ফোন দিলেন না।কিভাবে পারেন উনি।না দেয় না দিক আমিও দিবো না ফোন।ফোন দিবো বলবে বিজি আছি পরে ফোন দিচ্ছি মানুষের এত অবহেলার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই।কষ্ট হয় নিজের ভেতর চেপে রাখবো।নিজের কষ্ট নিজেই ভোগ করবো তবুও কারো কাছে বেহায়া হবো না।মনে মনে অনেক অভিমান সাজিয়ে রইলাম।

কাল বাসার পাশে বান্ধবীর বিয়ে।রিয়ার আম্মু,রিয়া আর আমি গেলাম বিয়েতে।যেহেতু রাত থাকতে হবে তাই কাকিমনি আমাদের সাথেই এসছে।হলুদ সন্ধ্যায় এসে উপস্হিত হলাম আমরা।চারদিকে মানুষ এর ছড়াছড়ি বিভিন্ন আলোর রোশনায়।এই এত এত আলোর মাঝে আমার মন অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে আছে।আমাদের অন্য একটা বান্ধবী বললো একটু গেটের কাছে চল তো দিয়া আমার বয়ফ্রেন্ড এসছে একটু দেখা করে আসি।চারদিকে অনেক মানুষ জন আছে দেখেই ওর সাথে গেলাম।ওর বয়ফ্রেন্ড আগে থেকেই উপস্হিত ছিলো ওখানে।ও রাস্তার ওপাশে গেলো কথা বলার জন্য সেই টাইমে দুইটা মেয়ে এসে একজন আমার মুখ চেপে ধরলো আরেকজন হাত চেপে ধরলো এমন টাইমে একটা অটো আসলো মেয়ে দুইটা জোর করে আমাকে অটোতে তুলে নিলো।বুঝলাম না ঠিক হলো আমার সাথে।এরা কারা।এরা যে মেয়ে সেটা বোঝা যাচ্ছে।ছেলে হলে না হয় বুঝতাম অন্য কাহিনী আছে।কিন্তু এরা কি চায় আমার কাছে।অটো টা সিটি কলেজ এর রাস্তায় গিয়ে বালুর মাঠে গেলো।সেখানে বিশাল কাশবণের মাঝে আমাকে ফেলে দিলো।ফেলে দিয়ে অটো নিয়ে তারা চলে গেলো।ভয়ে আমার স্ট্রোক হওয়ার মতো অবস্থা। এই মধ্যরাতে কাশ বনের মাঝে আমাকে ফেলে গিয়েছে এখান থেকে জান নিয়ে আমি ফিরতে পারবো না।ভয়ে দুই কানে হাত দিয়ে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুজে বসে আছি।বুকের মাঝে ঢক ঢক সাউন্ড হচ্ছে।

কেমন যেনো মনে হলো কেউ একজন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।একটা সুন্দর পারফিউম এর ঘ্রাণ নাকে ভেষে আসছে।এই পারফিউম টা একজন মাত্র মানুষ ইউজ করেন।আমি তার রুমে গেলে কতবার এই পারফিউম চুরি করে মেখে কত কটু কথা শুনেছি সে আবার নিজে ফুস ফুসস করে আমার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে।হালকা একটু মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি স্নিগ্ধ চাঁদের আলোতে মানুষটার ছায়া কাশবনে পড়েছে।এবার একটু ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখি পরনে কালো জিন্স, গায়ে কালো এক কালারের শার্ট, শার্টের হাতা গোটানো,হাতে কালো ফিতার ঘড়ি দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছেন বিহান ভাই।উনাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম আমি।উনার আর আমার মাঝে কয়েক গোছা কাশবনের দূরত্ব। হাত দশেক এর দূরত্ব। এক ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনাকে দেখেই বুকের মাঝে ধুকপুক সাউন্ড শুরু হলো।হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু হলো।আমার যে উনাকে দেখে ভয়ে এমন হচ্ছে তা নয় হঠাত বুকের মাঝে প্রচন্ড জোরে ধুকপুক শব্দের সাথে সমস্ত শরীর কাঁপা শুরু হলো।সাথে সাথেই চোখে পানি চলে এলো।ঝাপসা হয়ে এলো চারপাশ।এর আগে কখনো উনাকে দেখে এমন হয় নি।দীর্ঘদিন পর উনাকে দেখে প্রচন্ড কাঁন্না পাচ্ছে।চোখ দিয়ে টুপটাপ পানি পড়ছে।বার বার মনে হয়েছিলো উনাকে হারিয়ে ফেলেছি উনাকে বোধহয় এই জীবনে আর দেখা হবে না।উনার ওই মায়াবী চেহারার দিকে তাকালে আরো বেশী কাঁন্না পাচ্ছে।অনেক গুলো অভিমান জড়ো হওয়াতে কোনো কথা বললাম না উনার সাথে।উলটা দিকে ঘিরে রওনা দিলাম। দু’পা বাড়াতেই আমার সামনে গোল একটা লাল আলো এসে পড়লো আর বড় একটা ঢিল এসে পড়লো।এটা যে ভুত পেত্নি হবে সেটাই ভেবে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বিহান ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম।বুকের মাঝে যেনো হাতুড়ির বাড়ি দিচ্ছে কেউ।উনার বুকের সাথে কান লেগে যাওয়াতে খেয়াল করি উনার বুকের মাঝেও ধুকপুক শব্দ হচ্ছে।বিহান ভাই দুই হাতে আগলে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে উনার থুতনি আমার মাথায় ঠেকেছে এসে।ঘন ঘন কয়েক টা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন বিহান ভাই।উনি উনার সব টা দিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন আমাকে।উনার মুখে কোনো কথা নেই কিন্তু উনার স্পর্শ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে উনার মনের মাঝে জমে থাকা ভীষণ কষ্ট।উনার বুকে মাথা না রাখলে বুঝতেই পারতাম না মানুষ টার মনে আমার জন্য এত কষ্ট। উনার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বুঝিয়ে দিচ্ছে উনার ভেতরে ভীষণ অপরাধবোধ, আমার পাওয়া কষ্ট গুলো উনি বুঝতে পেরে আমার থেকে ভীষণ কষ্ট উনি পাচ্ছেন।জীবনে কিছু মুহুর্ত আসে যে মুহূর্তের কাঁন্না শুধু আঘাত থেকেই আসে না ভীষণ ভালবাসা থেকে ও আসে।উনার আর আমার মাঝে ভীষণ এক মিল আছে একজন কষ্ট পেলে অন্যজন সহ্য করতে পারিনা।

কাঁন্নার আওয়াজ টা খুব জোরে বেরিয়ে এলো আমার।ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।আস্তে আস্তে আরো জোরে কেঁদে দিলাম।বিহান ভাই নিজের সব টা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,,কেঁদো না দিয়া প্লিজ।আমি তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারি না।আপনি ক্যানো আমাকে ভুলে গেছিলেন বিহান ভাই ক্যানো?আমি বার বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি ক্যানো আমাকে ছেড়ে গিয়েছে সে।কি অপরাধ ছিলো আমার।আপনি সব সময় বলেছেন বিজি আছি।আপনার ব্যাস্ততা আমাকে ভিতরে ভিতরে মেরে ফেলেছে।আপনি এতটুকু অবহেলা করলে আমি খেতে পারি না ঘুমোতে পারি না।

বিহান ভাই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,আমি তোমাকে ঠকায় নি দিয়া তবুও অপরাধ করেছি তোমাকে ঠকানোর মতো।আমি তোমাকে কষ্ট দেয় নি তবুও আমার ই কারণে কষ্ট পেয়েছো তুমি।সব দোষ আমার দিয়া। আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল।আমি ভাবতাম আমার দিয়া অনেক স্ট্রং।বুঝবে আমি এক্সাম এর জন্য বিজি।দিয়া এতটা অবুঝ আমার জন্য আমি বুঝিনি।দিয়া পিচ্চি, পাগলি,অবুঝ সব জানতাম কিন্তু এতটা অবুঝ জানতাম না।আমি বিজি থাকলেও আমার মন জানতো আমি আমার দিয়ার।তুমি আমাকে এত ভালবাসো দিয়া আমি বোধ হয় একজনমে এই ভালবাসা শোধ করতে পারবো না।কথা গুলো বলার সময় উনার কন্ঠ ছিলো কাঁন্না ভেজা।কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন হ্যাপি এনিভার্সারী বউ।

চলবে,,,

(গত দুই পর্ব লিখতে কেমন যেনো ইমোশনাল হয়ে গেছি।এক্সট্রা পার্ট পেলে কি পাঠক পাঠিকা খুশি হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here