বাসর রাতে আমার,স্বামীর পরিবর্তে আমার শাশুড়ী আমার সাথে ঘুমাবে।কথা’টা শুনে বেশ অবাক হলাম আমি’।আমার সামনে’ই মাথা নিচু করে,বসে আছেন।আমার শাশুড়ী।তার মুখে,ভয়ের ছাপ স্পষ্ট’।উনি আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।হয়তো ভেতর জড়তা কাজ করছে।তাই বলতে সংকোচ বোধ করছেন’।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার হাত দু’টি ধরে বললেন।
–তানহা মা’ তুমি আমাকে মাফ করে দাও।আমি তোমার জ্বালা কমিয়ে দেওয়া’র বদলে,আরো বাড়িয়ে দিলাম।ভেবেছিলাম ছেলেটা’কে আমার বিয়ে দিলে,ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু ইফাদ এমন একটা কাজ করে বসবে।আমি কল্পনা-ও করতে পারি নাই।তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম’।
আমি অধীর আগ্রহে উনার দিকে তাকিয়ে আছি’।উনি কি করে,আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।বিষয়টা আমাকে খুব করে ভাবাচ্ছে’।উনি তো আমাকে মৃত্যুপুরী থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছেন।তার জন্য উনার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।আমি মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম’।
–আপনি আমাকে মৃত্যুপুরী থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছেন।আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন’।আমাকে এত সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া’র জন্য,আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব’।
আমার শাশুড়ী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন’।
–ইফাদ আজ বিয়ে শেষ করে,প্রবাসে চলে গেছে’।আমি জোর করে,ওকে বিয়ে দিয়ে ঠিক করি নি’।পাঁচ বছর পরে ছেলে আমার দেশে আসছিল’।ছয়টা মাস থাকতে-ই পারল না।আবার আমার ওপরে রাগ করে চলে গেল’।আমার উচিৎ হয় নাই।ইফাদ’কে জোর করে বিয়ে দাওয়া।তার থেকে বড়কথা আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।তোমার কষ্টময় জীবনটা’য় আরো একটু বিষ ভরে দিলাম’।এখন সমাজের মানুষ তোমাকে পেয়ে বসবে।নানান কটু কথা শোনাবে’।আমি তোমার ভালো করতে গিয়ে,খারাপ করে ফেললাম তানহা।
বিয়ে নিয়ে একটা মেয়ের কত স্বপ্ন থাকে।অনেক আশা থাকে।ইচ্ছে থাকে’।তানহার-ও ছিল।ইচ্ছে ছিল।যেদিন মৃত্যুপুরী থেকে মুক্তি পাবে।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করবে’।তবে তার মুক্তি এত তাড়াতাড়ি হবে।তানহা কখনো ভাবতে পারে নাই’।তানহার শাশুড়ী যখন তনহার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল।বাসায় প্রতিটি মানুষের রুপ বদলে গিয়েছিল।সময়ের তাগিদে চিনা মুখ গুলো।হয়ে উঠলো অচেনা না।ছেলে প্রবাসী।অনেক টাকা মালিক।তানহার বিয়েতে তানহার চাচি এক কথায় রাজি হয়ে যায়।তনহা-ও প্রহর গুনতে থাকে।কবে সে মুক্তি পাবে।স্বামী সংসারে গিয়ে,সবকিছু নিজের মতো সাজিয়ে নিবে।সবাইকে অনেক ভালোবাসবে।স্বামী মানুষটিকে নিয়ে,অনেক স্বপ্ন বুনেছিল মনে,যখন শুনল তার স্বামী তাকে বিয়ে করে’ই প্রবাসে চলে গেছে।শুনে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো’।নিমিষেই সব স্বপ্ন চোখের সামনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো’।তবে কি’ তার ভাগ্য এতটাই খারাপ।আল্লাহ কি তার ভাগ্যে সুখ নামক অধ্যায়টি লিখতে ভুলে গিয়েছিল’।সেজন্য তানহার কপালে এত দুঃখ কষ্ট।ভাবতেই নোনাজল গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে’।সে,আর কিছু ভাবতে পারছে না।তানহা কান্না করছে দেখে।তানহার শাশুড়ী তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
–কান্না করো না মা’।তোমার এই মা যতদিন তোমার কাছে আছে।কেউ তোমার মন ছুঁইয়ে কষ্ট দিতে পারবে না।ইফাদকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমার’।
তানহা মাথা নিচু করে বসে আছে।কোনো উত্তর করছে না।তানহার শাশুড়ী রোকেয়া বেগম,তানহাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন।হাতে কালো রংয়ের একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললেন’।
–বিয়ের শাড়ি বদলে ফেলো’।এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবে’।তানহা বিনাবাক্যে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো’।ওয়াশরুমে এসে নিজের কান্না কিছুতে’ই আটকে রাখতে পারল না।অঝোরে কান্না করে দিল।ওয়াশরুম থেকে ফোঁপানির আওয়াজ শুনতে পেয়ে,রোকেয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ালেন’।ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁই ছুঁই’।তানহা কালো রংয়ের শাড়ি পড়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো’।ফর্সা শরীরটা’য় কালো রংটা একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে।রোকেয়া বেগম তানহার দিকে তাকিয়ে বললেন মাশাল্লাহ’।আফসোসের সুরে বললেন’।
–তুই কেনো তানহার মুখটা দেখলি না ইফাদ’।আমি আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি।তুই তানহা’র মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলে,কখনো তানহা’কে ছেড়ে চলে যেতি না।এতবড় ভুল কেনো করলি’।তুই একদিন ঠিক বুঝবি মা’ ভুল করে নি’।তানহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানহা’র শাশুড়ী বললেন’।
–দাঁড়িয়ে আছো কেনো মা’।আমার পাশে এসে শুইয়ে পড়।অনেক রাত হয়েছে’।কষ্ট পেও না।মা আছে না,সবকিছু ঠিক করে দিবেন।তানহা কোনো কথা বলল না।চুপচাপ শুইয়ে পড়ল।তানহা’র শাশুড়ী তানহা’র মাথায় বিলে কেটে দিচ্ছে’।কতগুলো বছর পড়ে মায়ের আদর পেয়ে তানহা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেল’।কতদিন মায়ের আদর পায় না তানহা’।জন্মের আগেই তানহা’র বাবা মারা যায়।তানহা’র যখন ছয় বছর বয়স।তখন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তানহার মা তানহা’কে একা করে দিয়ে চলে যায়।মা মারা যাওয়া’র পরে’ই খুব করে চেনা পৃথিবীটা হয়ে উঠে অচেনা।কাছের মানুষ গুলো রুপ বদলে যেতে শুরু করল।তানহা’র জীবনে কালো অধ্যায় নামক অধ্যায়টি শুরু হলো’।সুখের জীবন যতটা দ্রুত চলে যায়।কালো অধ্যায়ের সময় গুলো খুব স্বার্থপর হয়।খুব সহজে যেতে’ই চায় না।তানহা অনেক বার চেষ্টা করেছে আত্মহত্যার করার।কিন্তু বিবেকের কাছে হেরে গেছে’।যে,জীবন আল্লাহ তায়ালা নিজে দিয়েছে।সে,জীবন নষ্ট করার আমি কে’?আমার জীবনে’র ওপরে আমার কোনো অধিকার নেই।আমার জীবনটা আল্লাহ তায়ালা’র আমানত।যা’ রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।ধংস করা নয়।যে,জীবন আল্লাহ তায়ালা’র,সে জীবন নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই’।
পরের দিন সকাল বেলা তানহার ঘুম ভেঙে গেলো’।উঠে দেখলো শাশুড়ী পাশে নেই’।ঘড়িতে ছয়টা বাজে।এত ঘুমালো কি করে সে’।তানহা তো কোনোদিন এত ঘুমায় না।নাকি আজকে শরীরে কারো আঘাত পরে নাই।সেজন্য আরামে ঘুমিয়েছে’।তানহা উঠতেই তানহার ননদ চৈতালি দৌড়ে আসে’।
–ভাবি তুমি উঠেছো’।আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।আম্মা বলছে,তোমাকে ঘুম থেকে না জাগাতে’।আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি।কালকে খুব খারাপ লাগছিল।তাই বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।ভাবি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নাও।
তানহা চৈতালির কথায় খুব খুশি হলো’।তানহা প্রতিদিন ফজরের আজানের সময় জাগা পায়।আজ কেনো সে,পেলো না।তাড়াতাড়ি করে উঠে,ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো’।সব অশান্তির মধ্যে নামাজ-ই একমাত্র শান্তির কারন তানহার কাছে’।নামাজ শেষ করে চৈতালি কাছে বসলো’।
–ভাবি তুমি একটু অপেক্ষা কর।আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।বলেই বেড়িয়ে যেতে নিলে,তানহা চৈতালির হাত ধরে ফেলে।
–আমার একা খেয়ে অভ্যাস নেই।আমি সবার সাথে সাথে খাব’।
–মিথ্যা কথা বলছো কেনো ভাবি।আমি কিন্তু সব জানি।রাজরানি হয়ে থাকবে আমাদের বাসায় বুঝছো।হতে পারে আমাদের বাসাটা এক তলার ছোটা একটা বাসা।কিন্তু এই বাসা থেকে অনেক বেশি ভালোবাসা তুমি পাবে।আমি আম্মু খেয়ে নিয়েছি।শুধু তুমি বাকি আছো।আমাদের বাসায় খাবার খাওয়ার কোনো নিয়ম নেই।যার যখন ইচ্ছে খায়।
চৈতালির কথা শুনে,তানহা দৃষ্টি নত করে ফেলে’।
–তুমি আমার কথায় কষ্ট পেয়োনা ভাবি’।আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই নাই।মা’ বলছে নিজের সবটুকু উজাড় করে,তোমাকে ভালোবাসতে।তাই তোমাকে নিজের বোনের নজরে দেখছি।তুমি যদি রাগ কর।তাহলে তোমার সাথে আর এমন করবো না।
চৈতালির কথা শুনে তানহার চোখ ছলছল করে উঠলো’।এত ভালোবাসা-ও তার কপালে লিখা আছে।এত সুখ সইবে তো’।
–তুমি কাঁদছো কেনো ভাবিমনি’।আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো’।
–সব কান্না কষ্টের হয় না বোন।কিছু কিছু কান্না সুখের হয়’।আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখছে।সুখ নামক অধ্যায় আমার জীবনে-ও এসেছে’।খুব ভয় হচ্ছে,এত সুখ আমার সইবে তো’।
–সইবে গো’ সইবে’।চৈতালি যতদিন আছে’।কষ্ট আমার ভাবিমনি-কে ফুলের টোকা’ও দিতে পারবে না’।
চৈতালির কথায় তানহা হেঁসে দিল’।
–এই তো আমার ভাবি হেঁসেছে।আমার ভাবিকে হাঁসলে কত সুন্দর দেখায়।ও-ভাবি তুমি সব সময় হাঁসবে।আর গম্ভীর মুখ করে থাকবে না’।একটু অপেক্ষা কর।আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি’।বলে’ই চৈতালি চলে গেলো’।
সৌদি আরবে’র অন্ধকার রুমে দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইফাদ’।চোখ দু’টো অসম্ভব লাল হয়ে আছে’।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।শার্টের ওপরের দু’টি বোতাম খোল’।কালো রংয়ের শার্ট পরিহিতা শ্যামপুরুষ’কে একটু বেশি আর্কষণীয় দেখাচ্ছে’।নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে ইফাদে’র।মায়ের ওপরে এক আকাশ পরিমাণ অভিমান জমেছে’।মনে মনে ঠিক করে নিল’।আর কোনোদিন দেশে ফিরবে না।সবকিছু জেনেশুনে তার মা’ কেনো তার সাথে বেইমানি করল’।নিজের মাথা নিজেই দেওয়ালে ঠুকে দিল’।ব্যাথায় মুখ দিয়ে ‘আহ’ শব্দ বের হলো’।রেগে রুমে থাকা সবকিছু ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।কোনোভাবেই নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।তবে কেনো তার মা সাথে এমন মিথ্যা নাটক করলো’।দু’হাতে নিজের চুলগুলো টেনে ধরলো ইফাদ’।
চলবে…..
#এক_মুঠো_কাঁচের_চুরি
#পর্ব_০১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu