এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_৩,৪
#প্রভা_আফরিন
রেস্টুরেন্টে বসে আছে নাবিলা। অয়নের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আজ অয়নের সাথে দুপুরে লাঞ্চ করতে এসেছে। অয়নই সকালে দাদিকে ফোন দিয়ে বলে রেখেছে। তবে অয়নের এখনো দেখা নেই। তার অফিস থেকে আসতে লেইট হচ্ছে। নাবিলা অলস ভঙ্গিতে মেনু কার্ড উলটে চলেছে। ঠিক তখনই পাশে কেউ শব্দ করে চেয়ার টেনে বসলো। নাবিলা মেনু কার্ড থেকে মাথা তুলে দেখলো প্রয়াস ভাইয়া। কিছুটা চমকেও গেলো।
নাবিলা বললো,
‘ ভাইয়া তুমি এখানে?’
‘ একই প্রশ্ন তো আমারও। তুই এখানে কেনো?’
‘ ইয়ে.. মানে..’
‘ তোর ফিয়ন্সি অয়নের জন্য ওয়েট করছিস তাইতো। আমি বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম। যাওয়ার পথে তোকে দেখলাম। আজকের লাঞ্চটা নাহয় তোদের সাথে করি। অয়নের সাথেও পরিচয় হয়ে যাবে।’
‘ তুমি জানলে কিভাবে?’
‘ দাদিকে ফোনে কথা বলতে শুনেছি। তোর হবু সব তোর দাদি কে জানায়। সেও বুঝে গেছে কাকে বললে কাজ হয়।’
নাবিলা আর কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলো। অয়ন যতই স্মার্ট হোক বা নাবিলাকে স্মার্ট করতে চাক না কেনো। নাবিলা জানে অয়নের মনটা খুবই নিচু। অন্যের ভালোলাগা খারাপ লাগার কোনো মূল্যই দেয় না। নাবিলার তো না ই। আর নাবিলার সাথে ছেলে বন্ধুদেরও পছন্দ করে না। প্রয়াস ভাইয়াকে করলে হয়। মনে মনে চাইলো নাবিলা।
কয়েক মিনিট পেরোতেই অয়ন এলো। একদম ফরমাল ড্রেসআপ এ এসেছে। নাবিলার পাশে প্রয়াস কে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো। প্রয়াস নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিচয় দিলো। অয়ন সৌজন্য দেখিয়ে হ্যান্ডশেক করে বসে পড়লো। অয়নের সাথে একজন মেয়েও আছে। অয়নের বোন দিশা।
দিশা নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি করলো। নাবিলা এবং প্রয়াস বসেছে একপাশে আর অন্যপাশে অয়ন এবং দিশা। দিশা প্রয়াসের সামনাসামনি বসেছে। প্রয়াসকে আগে কখনো দেখেনি। আর না পরিচয় হয়েছে। দিশা কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলো প্রয়াসের প্রতি। বারবার আড়চোখে তাকাতে লাগলো। কিন্তু প্রয়াস সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন।
অর্ডার নিতে ওয়েটার বয় আসলে অয়ন নিজের এবং নাবিলার খাবার অর্ডার দিলো। সব হাফ বয়েল এবং সাথে স্যুপ। নাবিলা কোনো দ্বিরুক্তি করলো না বা সেই সুযোগটাই পেলো না। অয়নকে অর্ডার দিতে দেখে প্রয়াস একবার নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলা নির্বিকারভাবে বসে আছে। প্রয়াস কিছুটা অবাক হলো। নাবিলা জীবনেও এইসব খাবার খেতো না। স্যুপ তো ওর জীবনেও পছন্দ না। সেই মেয়ে এসব খাবে!
মেনু কার্ড হাত ঘুরে প্রয়াসের কাছে আসতেই ও বিরিয়ানি অর্ডার দিলো। সাথে কোক। ওর অর্ডার শুনে নাবিলা বাদে বাকি দুজন অদ্ভুত চোখে তাকালো যেনো আজব কিছু অর্ডার করেছে। প্রয়াস ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বসে রইলো। ক্ষানিক বাদে খাবার এলে প্রয়াস হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। এটা দেখে অয়ন নাক ছিটকালো। প্রয়াসকে ওর একদমই ভালো লাগছে না। কিন্তু সৌজন্য রক্ষার্থে কিছু বলছে না। দিশার কাছে প্রয়াসের এই ড্যাম কেয়ার ভাবটা খুবই ভালো লাগলো।
প্রয়াসের খাবার দেখে নাবিলা বারকয়েক ঢোক গিললো। এইসব স্যুপ, ছাইপাশ খেতে হয় অয়নের সাথে খেতে আসলে। তারওপর হাতও ব্যাবহার করতে পারে না। সব খেতে হয় চামচ দিয়ে। অয়ন একবার জিজ্ঞেস ও করে না নাবিলার কি খেতে ইচ্ছে করে। নাবিলাকে তাকাতে দেখে প্রয়াস কোকের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ওর দিকে। তা দেখে অয়ন সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললো,
‘ নাবিলা এখন ডায়েটে আছে। ওর জন্য কোক বা ড্রিংকস খাওয়া ঠিক হবে না।’
নাবিলা অসহায় মুখে গ্লাসটার দিকে তাকালো। মনে মনে ঠিক করলো এখান থেকে ফিরেই কোক খাবে আগে। এইসব ডায়েট ফায়েট ওর জন্য না। নাবিলা অবশ্য ডায়েট মানতোও না। শুধু বাড়িতে এবং অয়নের সামনে দেখাতো। আর বাহিরে ইচ্ছামতো স্ট্রিট ফুড খেতো। কিন্তু অয়ন এখন ওর ওজন পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে। অয়নের মতে নাবিলার ওয়েট আরেকটু কমাতে হবে।
প্রয়াস অয়নের কথা উপেক্ষা করে বললো,
‘একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না।’
আবার নাবিলার দিকে গ্লাস এগিয়ে দিলো। নাবিলা নিতে যেতেই অয়ন বলে উঠলো,
‘ নাবিলা তুমি কি ভুলে গেছো তোমায় এখনো পাঁচ কিলোগ্রাম বার্ন করতে হবে। সেখানে তুমি এসব খেতে চাইছো?’
‘ নাবিলার ওজন কত! যে ওকে পাঁচ কেজি বার্ন করতে হবে?’ প্রয়াস রুষ্ট গলায় বললো।
‘ ৫৫ কেজি। ৫০ তে আসতে হবে।’
‘ কেনো?’
‘ কারন ভাইয়া বেশি ওয়েট পছন্দ করে না। ভাবীর উচ্চতা ৫ ফুট দুই ইঞ্চি অনুযায়ী ৫০ কিলোগ্রাম মোটা লাগবে না, মানানসই হবে। ভাইয়া চায় ভাবী সবদিক দিয়ে পারফেক্ট হোক।’
দিশা ইচ্ছে করেই উত্তর টা দিলো। অনেকক্ষন ধরে প্রয়াসের সাথে কথা বলার সুযোগ খুজছিলো সে।
প্রয়াস গম্ভীর চোখে নাবিলাকে দেখলো। নাবিলা মাথা নিচু করে আছে। আসলে সে ভেতরে ভেতরে ফুসছে অয়নের প্রতি।
প্রয়াস তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো। খাওয়ার সময় অসাবধানতা বসত হাত লেগে কিছুটা স্যুপ নাবিলার হাটুর ওপর পড়ে। প্রয়াস সাথে সাথে টিস্যু নিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো,
‘ এখনো খাওয়ার সময় জামাকাপড় নষ্ট করার অভ্যাস গেলো না তাইনা। মি.অয়ন আপনার কপালে দুর্ভোগ আছে এই ভ্যাবলাকান্তকে নিয়ে।’
প্রয়াস স্বাভাবিক ভাবে মুছে দিলো যেনো কিছুই হয়নি। অপরদিকে অয়ন বিষ্ফোরিত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তা দেখে নাবিলা অনুমান করলো আজ দাদির কানে আরো কিছু মন্ত্রনা দেবে অয়ন নামক প্যারাটা।
প্রয়াস খাওয়া শেষে আয়েশ করে ঢেকুর তুললো। অয়ন এমনভাবে তাকালো যেনো প্রয়াস ভুল কিছু করেছে সে। প্রয়াসের তাতে কিছু আসলো গেলো বলে মনে হলো না। বরং সে ওয়েটারকে ডেকে আরো দুই প্লেট বিরিয়ানি প্যাক করে নিলো।
______
বাড়ি ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো নাবিলা। সেই ঘুম ভাঙলো মোবাইলের আওয়াজে। প্রয়াস ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে কানে দিতেই প্রয়াস বললো,
‘ এক্ষুনি এ বাড়িতে আয়। কোনো বাহানা চলবে না।’
কথা শেষ করে নাবিলাকে কিছু বলতে না দিয়েই লাইন কেটে দিলো প্রয়াস। অগত্যা বাধ্য হয়েই নাবিলা ঘুম জড়ানো চোখে, এলোমেলো চুলে চলে গেলো প্রয়াসের বাড়িতে।
ঘুমানোর আগে লেন্স খুলেছিলো। এখন আর পড়তে ভালো লাগছে না বলে একদমই কম ব্যবহার করা মোটা ফ্রেমের চশমাটা বের করে পড়ে নিয়েছে।
প্রয়াস সোফায় পা দুলিয়ে মোবাইল স্ক্রল করতে ব্যস্ত। নাবিলা তা দেখে বিরক্ত হলো। ওর সাধের কাচা ঘুমটা ভেঙে আসতে হয়েছে। প্রয়াস মুখ তুলে এক পলক নাবিলাকে দেখে আবার মোবাইলে মনোযোগ দিয়ে বললো,
‘ এক কাপ কড়া করে কফি বানিয়ে দে তো। মাথাটা খুব ধরেছে।’
‘ তুমি এইজন্য ঘুম ভাঙিয়ে আনলে আমায়? আমি ভাবলাম দরকারি কিছু হবে। ধুর!’
‘ আপাতত আমার জন্য এইটাই দরকারি কাজ। দুই বছর ছিলাম না বলে আমার মুখের ওপর ঘুরিয়ে কথা বলতেও শিখে গেছিস! আগে যেমন তুই বানাতি আজ থেকে আবারও তুই ই বানাবি। বুঝলি। আর শোন আমার বিরিয়ানিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে একটু গরম করে আন। পেট ভরেনি আমার। তোর ননদ দিশার জন্য ভালো করে খেতেই পারলাম না।’
নাবিলা চোখ ছোট ছোট করে বললো,
‘দিশা কি করলো আবার?’
‘ খাবারের সময় কেউ হা করে তাকিয়ে থাকলে কি খাওয়া যায়। তোর ননদ তো আমাকেই দেখে যাচ্ছিলো যেনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিউজ টেলিকাস্ট চলছিলো আমার মুখে। অবশ্য সুন্দর হলে যা হয় আরকি।’
‘ বিরিয়ানি আর কফি একসাথে আবার কিভাবে খায়?’
‘ আমি খাবো তোর সমস্যা কোথায়? যা জলদি।’
নাবিলা প্রয়াসের অগোচরে মুখ ভেঙচি দিলো। তারপর রান্নাঘরের চলে গেলো। বিরিয়ানি গরম করতে গিয়ে সেই ঘ্রানে নাবিলার নিজেরও খিদে পেয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টে নামমাত্র খেয়েছে সে। তবুও নিজেকে সামলে খাবার এনে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। বিরিয়ানি আর কফি কোন নবাবজাদা একসাথে খায় নাবিলার জানা নেই।
‘ নিন আপনার খাবার। আমি গেলাম।’
‘ চুপচাপ বসে পড়।’
‘ মানে? আমি কেনো বসবো? আমার ঘুম পাচ্ছে।’ বলে নাবিলা সত্যি সত্যিই হাই তুললো।
প্রয়াস এসে চেয়ার টেনে দিয়ে বললো,
‘ বসতে বলছি। এতো বিরিয়ানি আমি একা খেতে পারবো না। বাবাও বাড়িতে নেই তাই নষ্ট হবে। তুইও খাবি আমার সাথে।’
নাবিলা কি করবে বুঝতে পারলো না। ওর সত্যিই বিরিয়ানির গন্ধে খিদে পেয়েছে। বাড়িতে দাদি খেতে দেবে না। আবার প্রয়াসের কাছে নিজেকে হ্যাংলামি প্রকাশ করতেও চাইছে না। আবার ভাবলো হ্যাংলা ভাববে কেনো? খেতে তো প্রয়াস ভাইয়াই বলেছে।
‘ এতো ভাবার কি আছে শুনি। না খেলে নষ্ট হবে তাই বলেছি। না খেলে থাক, তুই গিয়ে ঘুমা।’
প্রয়াস কফি মগ হাতে নিয়ে বসে পড়লো। নাবিলাও কিছু না বলে চুপচাপ প্রয়াসের বরাবর বসে দুইটা প্লেট নিয়ে খাবার বাড়লো। প্রয়াস অর্ধেক কফি শেষ করে বিরিয়ানি প্লেট টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। নাবিলাও চুপচাপ খেয়ে নিলো। দুজনে মিলে পুরোটা শেষ করে ফেলেছে। শেষে নাবিলা শব্দ করে ঢেকুর তুলে সাথে সাথে মুখ চেপে ধরলো। মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে ভাবলো,
‘ইশ ভাইয়া কি ভাববে!’
প্রয়াস ঠোট টিপে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। ফ্রিজ থেকে কোক বের করে নাবিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ দুটো গ্লাসে ঢেলে বারান্দায় আয়।’
নাবিলা বাধ্য মেয়ের মতো তাই করলো। অয়নের দেওয়া ডায়েটের চক্করে পছন্দের খাবার থেকে দূরে থাকতে হয়। আজ একটু ভালো লাগছে।
বারান্দায় হালকা হাওয়া বইছে। সূর্যের তেজ এখনো কিছুটা রয়েছে। তেরছাভাবে কিছুটা রোদ এসে প্রয়াসের বারান্দা দখল করেছে। টাইলসে প্রতিফলিত হয়ে সেই রোদ ঝলকে উঠছে।
নাবিলা গ্লাসে কোক ঢেলে আনতেই প্রয়াস বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসতে বললো।
দীর্ঘক্ষণ কেউ কোনো কথা বললো না। এভাবে চুপচাপ বসতে নাবিলার অস্বস্তি শুরু হয়েছে। কারন প্রয়াস নাবিলার দিকে তাকিয়েই কোকের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। রোদ ওদের গায়ে না লাগলেও টাইলসে আলোর ঝলকানিতে নাবিলার এলোমেলো কোকড়ানো চুলগুলো ঝলমল করছে। কপালে চুলের কাছটায় বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা মিলছে। মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর চোখজোড়া যে অস্বস্তি অনুভব করছে তা প্রয়াস বুঝতে পারলো। কানাডা থেকে আসার পর এই প্রথম নাবিলাকে চশমায় দেখলো প্রয়াস।
‘ আজকে তোকে একদম আগের নাবিলা মনে হচ্ছে।’
নাবিলা কিছু বললো না।
‘ তোর হবু বর তোকে পারফেক্ট পাশ্চাত্যের রমনী করতে চাইছে। সবদিকে খেয়াল রাখছে কিন্তু পাশ্চাত্যের রমনীদের মতো আত্মবিশ্বাসী কেনো বানাচ্ছে না। নাকি সে চায় তুই বাইরে দিয়ে পারফেক্ট হ, আর ভেতরটা ফাকা থাকুক।’
প্রয়াসের এমন কথায় নাবিলা থতমত খেয়ে গেলো। কোনো উত্তর দিলো না বা কি উত্তর দেওয়া উচিৎ ভেবে পেলো না।
প্রয়াস আবার বললো,
‘ বাহিরের চাকচিক্যের চেয়ে নিজের মনোবল এবং আত্মবিশ্বাস বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ভালো মন্দের ওপর কারো অন্যায় হুকুম মানা যে কিনা এখনো আপন নয়, এর মানে নিজের ব্যাক্তিত্ব হীনতার পরিচয় দেওয়া। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখ বুজে অন্যের কথা মানার চেয়ে তার সামনে নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ করা উচিত। এতে অপর ব্যাক্তিটি কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ কম পাবে।’
নাবিলা মনোযোগ দিয়ে প্রয়াসের কথাগুলো শুনলো। আসলেই নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে নাবিলার। মনের কথা জোর দিয়ে প্রকাশ করতে পারে না।
প্রয়াস কোকটা শেষ করে শব্দ করে গ্লাসটা রেলিং এর ওপর রাখলো। তারপর নাবিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ বি কনফিডেন্ট অ্যাবাউট ইওরসেলফ।’
__________
নাবিলা যা ভেবেছিলো ঠিক তাই হয়েছে। অয়ন দাদির কাছে ফোন দিয়েছে। কিন্তু এমন কিছু বলবে তা ভাবতেও পারেনি নাবিলা। অয়ন খুব জলদি বিয়েটা সেড়ে ফেলতে চায়। হয়তো এই মাসের মধ্যেই। কথাটা শোনার পর থেকে নাবিলা থম মেরে আছে। বিয়ে করা মানেই অয়ন নামের কারাগারে বন্দী হওয়া। কিন্তু নাবিলা দেরি করে ফেলেছে। সিদ্ধান্তটা আরো আগে নিলে হয়তো কিছু করা যেতো।
বিকেলে প্রয়াস ভাইয়ার থেকে কথাগুলো শুনে নাবিলা অনেক ভেবেছে। সত্যিই তো! নাবিলার প্রান খুলে কথা বলার, নিজের ইচ্ছে জানানোর অধিকার আছে। অয়নের অন্যায় কথা কেনো মেনেছে? কেনো মুখের ওপর নিজের ইচ্ছেটাও জানালো না? কিন্তু পরক্ষনেই আবার চুপসে গিয়ে ভাবছে এতে পরিবারের মান সম্মানও জড়িত।
এখন কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে দাদি। দাদুর শেষ ইচ্ছা নিয়েই তার দাদি বেচে আছে। তিনি নাবিলার ভালো চাইতে গিয়ে যে তার ওপর, তার মনের ওপর জোর করছেন তা নয়নতারা বেগম বুঝতেই পারছেন না।
এক তপ্ত শ্বাস বেড়িয়ে এলো নাবিলার বুক চিরে। দিশেহারা চোখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। নিকষ কালো আধারে বিল্ডিংগুলোর বারান্দা, জানালা দিয়ে বিচ্ছুরিত হওয়া আলো খেলা করছে। আধারে নিজেদের ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও সেই আলোর বিস্তৃত বেশি দূর যেতে পারছে না। শেষে আধারই জয়ী। ঠিক তেমনই নাবিলার ভাবনাগুলো আধারের মাঝে বিস্তৃত হতে পারছে না বা বিস্তৃত করার উপায় নেই। পরমুহূর্তেই আবার ভাবছে আধারের পরতো আলোও আসে। যা সেই কৃত্তিম আলোক ছটাকে ছাপিয়ে দেয় সাথে আধারকেও দূর করে ঝলমল করে ওঠে। নাবিলার জীবনে কি সেই আলো আসবে। যা ওর ভাবনাকে ছাপিয়ে চারপাশ আলোকিত করে দেবে? হয়তো আসবে। হয়তো না।
নাবিলার বিয়ের খবরে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে দুজন মানুষ। এক দাদি নয়নতারা বেগম এবং আরেক প্রয়াস। প্রয়াসের এই খুশি নাবিলার কোনো এক অজানা কারনে অসহ্য মনে হচ্ছে। দাত যেনো ঠোঁটের আড়াল হতেই চাইছে না প্রয়াসের। হেসে হেসে দাদির সাথে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। বিয়েতে কি করবে তা নিয়ে।
সায়মা বেগমের অবশ্য মন খারাপ। তিনি এখনি বিয়ে দিতে চান না মেয়েকে। কথাও ছিলো না। হুট করেই অয়নের এহেন সিদ্ধান্ত তিনি পছন্দ করছেন না। অয়ন অবশ্য বলেছে এখন ছোট করে আকদ হবে। পরে নাহয় বড় করে আয়োজন হবে। কিন্তু তাও মায়ের মন মানতে চায় না। নাবিলার বাবা তারেক হোসেনও বিশেষ আপত্তি দেখালেন না বিয়ে নিয়ে। বাবার মন যে মায়ের মতো নরম হয় না।
দুই পরিবার আলোচনা করে আগামী সপ্তাহেই আকদের দিন ঠিক করা হলো। এটা শুনে নাবিলার আরো মন খারাপ হয়ে গেলো।
বিয়ের কথা বলতে অয়নের পরিবার নাবিলার বাড়ি এসেছে। দিশাও এসেছে। তবে তার মনোযোগ আলোচনায় নেই। সেই কখন প্রয়াসকে দেখেছিলো এরপর কোথায় যে গায়েব হলো আর দেখতেই পেলো না। প্রয়াসের চলাফেরা কথা বলা সবই দিশাকে আকৃষ্ট করছে। দিশা বয়সে নাবিলার একটু বড় হবে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে পরছে। তবুও নাবিলাকে ভাবী ডাকে সে।
ধারালো সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ায় ছেলেদের চোখ একবার হলেও দিশার ওপর পড়বে। সেখানে প্রয়াস ঘুরেও তাকাচ্ছে না। এই ব্যাপারটা দিশার আরো বেশি আগ্রহের কারন।
দিশা বড়দের আলোচনা থেকে উঠে নাবিলার কাছে গেলো। নাবিলা মুখ ভার করে বসে আছে। দিশা ওকে টেনে নিয়ে দোতলার খোলা বারান্দায় গেলো। নাবিলার রুমের এই বারান্দাটা প্রয়াসের বারান্দার মুখোমুখি। এখানে যে প্রয়াস থাকে দিশা তা জানতো না। প্রয়াস বারান্দায় বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কোনো কাজ করছে বোধহয়। ওর কপালে সুক্ষ্ম ভাজ এবং মুখে গাম্ভীর্য। ওকে দেখেই দিশা কিছুটা খুশি হয়ে গেলো।
দিশার মুখের হঠাৎ পরিবর্তন নাবিলার চোখ এড়ালো না। প্রয়াসকে দেখে নাবিলার রাগ হলো। সকালে এসে প্রয়াস নাবিলাকে বলেছে,
‘দেখলি আমি কতো লাকি তোর জন্য। তোদের সাথে লাঞ্চ করতে গেলাম আর বিয়ে ফাইনাল।’
নাবিলা ফুসে উঠতে গিয়েও চুপসে গিয়েছিলো। কি বলবে সে! প্রয়াস গেছে বলে অয়ন ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি বা নাবিলাকে ছেলেদের সংস্পর্শে আসতে দিতে পছন্দ করে না?
তাকে বলতে হবেও না। প্রয়াস ভাইয়া যে এইটুকু বুঝেছে তা তার তাচ্ছিল্য ভরা কথাতেই বুঝতে পারছে নাবিলা।
নাবিলার ফাটা বেলুনের মতো মুখ দেখে প্রয়াস শব্দ করে হেসে নাবিলার মাথায় হালকা চাপড় মারে।
দিশার ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো নাবিলা। ততক্ষনে প্রয়াস বারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে গিয়েছে।
‘তোমার এই ভাইটা কি সবসময় সিরিয়াস মুডে থাকে?’
দিশার প্রশ্নে নাবিলা মনে মনে বললো,
‘সিরিয়াস না ছাই। ওইসব লোক দেখানো। ওইসব সিরিয়াসনেস সারাজীবন আমাকে দেখিয়েছে। ভাইয়া যে কতটা মিচকা তা আমার থেকে ভালো কে জানে।’
কিন্তু মুখে হেসে বললো,
‘ না না আপু। সিরিয়াস মুডে থাকে না। তুমি যতবার দেখেছো হয়তো সেই সময় সিরিয়াস মুডে ছিলো। এমনিতে আমাদের বাড়িতে সারাক্ষণ হাসি মজায় মেতে থাকে।’
দিশা কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
‘উনি তো তোমার থেকে ভালোই বড়। তাহলে ভাইয়ের বিয়ের কথা ভাবোনি। না মানে.. শুনেছি তোমরা আলাদা বাড়িতে থাকলেও একই পরিবারের মতো। নাকি ওনার পছন্দ করা আছে কাউকে?’
‘ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে।’
কথাটা নাবিলা কেনো বললো জানে না। তিনবছর আগে শুনেছিলো ভাইয়া কাউকে ভালোবাসে। এখনও তার সাথে সম্পর্ক আছে কি না নাবিলার জানা নেই। দিশা যে ইনিয়েবিনিয়ে প্রয়াস সিঙ্গেল নাকি মিঙ্গেল সেটা জানতে চাইছে নাবিলা তা বেশ বুঝেছে। ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা নিশ্চিত না হলেও উত্তরটা হুট করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো।
দিশার মুখের উজ্জ্বলতায় ভাটা পড়েছে। হয়তো এই উত্তরটা আশা করেনি বেচারি।
________
অয়নের পরিবার চলে যেতেই নাবিলা বিষন্ন মনে ছাদে উঠলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশের নীলের রঙটা ফিকে হতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশের একটুকরো মেঘ থেকে বেড়িয়ে এসে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
নাবিলা কিছুক্ষণ স্থির চোখে সেই সন্ধ্যাতারায় ডুবে রইলো। মস্তিষ্ক দখল করে আছে বিয়ে নামক শব্দটা। ওর বিবাহিত জীবন যে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো হবে না সেই সম্পর্কে নিশ্চিত নাবিলা। অয়নের পারফেক্ট জীবনের নিয়ম মেনেই দিন চলে যাবে। নিজের শখ আহ্লাদ বলে কিছুই থাকবে না।বাবা-মাকে বলেও ফায়দা নেই। অয়ন তাদের খুব ভালো হ্যান্ডেল করতে পারে। দাদির ওপর রাগ হচ্ছে নাবিলার। এই মানুষটার মুখ চেয়ে সহ্য করতে হচ্ছে সব।
হঠাৎ করে কাধে কেউ হাত রাখতেই চমকে উঠলো নাবিলা। পেছনে প্রয়াসকে দেখে আবার পশ্চিমের তারাটার দিকে নজর দিলো। কেউ কোনো কথা বললো না। কিছুক্ষন পর নাবিলা বলে উঠলো,
‘ আমার মনের কথা কেউ কেনো বুঝছে না ভাইয়া।আমিতো এই বিয়েতে খুশি নই তা কেনো কারো নজরে পরছে না? দাদু আমাকে কেনো এভাবে জড়িয়ে গেলো বলতে পারো? দাদুর ইচ্ছে পূরন করতে বাবা আর দাদি বদ্ধ পরিকর। অথচ আমার খুশি…’
নাবিলা মাথা নিচু করে নিলো।
প্রয়াস নাবিলার বরাবর এসে দাড়ালো। নাবিলার থুতনিটা তর্জনী আঙুল দিয়ে উচু করে ধরলো। চোখে জলরাশি চিকচিক করছে।
‘আকাশে কালো মেঘের চাদর চিরস্থায়ী হয় না। কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে গিয়ে ঝলমলে সূর্য বিরাজ করে। আমাদের জীবনেও খারাপ সময় চিরস্থায়ী হয় না। ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই উত্তম কিছু রেখেছে বান্দার জন্য। বাবা, দাদিকে দোষারোপ করে কষ্ট পাস না। বিয়ে তো হয়ে যায়নি। কখন কার জীবন কোনদিকে মোড় নেয় তা কে বলতে পারে।’
নাবিলা নির্বিকার। প্রয়াস হালকা হাসলো।
‘ঘুরতে যাবি কালকে? সারাদিন যেদিকে ইচ্ছা ঘুরবি, যা ইচ্ছা খাবি। যাবি?’
নাবিলা কিছুটা অবাক হলো। প্রয়াস কখনো ওকে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যায়নি উল্টে, ঘুরতে গেলেই বকেছে। আজ হঠাৎ..!
কিন্তু নাবিলার মানা করতে ইচ্ছা করলো না। দুইবছরে জীবনের অনেক বদল এসেছে। তাই নাবিলারও একটু মুক্ত বিহঙ্গ হতে ইচ্ছে করলো।
‘কিন্তু দাদি?’
‘সেটা আমি দেখে নেবো। মনিকে বলে সব মেনেজ করে নেবো। তুই নয়টার মধ্যে তৈরি থাকবি কেমন! এখন নিচে যা। আধারে তোর কোকড়া চুল দেখে যে কেউ পেত্নী ভেবে হার্ট অ্যাটাক করবে।’
নাবিলা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো।
_______
তারেক হোসেন এবং সায়মা বেগম প্রতিদিন সন্ধ্যায় একসাথে বসে চা খায় আর গল্প করে। বাবা মায়ের এই অভ্যাসটা নাবিলা ছোট থেকে দেখে আসছে। এবং তার ভালোও লাগে বাবা মাকে একসাথে দেখতে। নাবিলা কিছুক্ষন সেইদিকে তাকিয়ে নিজেকে এবং অয়নকে ভাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ওর মস্তিষ্ক অয়নকে তার পাশে ভাবতেই পারলো না। যেই অয়ন বিয়ের আগেও দরকার ছাড়া কথা বলে না সে বিয়ের পরও তেমন থাকবে কিনা ভাবছে নাবিলা।
যখন প্রথম প্রথম এঙ্গেজমেন্ট হয়, নাবিলার আশা ছিলো আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোই অয়ন ওকে ফোন করবে, ওর ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে এবং দুজনের প্রেমও হয়ে যাবে। কিন্তু সময় যত গড়ালো ঘটলো তার উল্টো। অয়ন শুধু নাবিলাকে আধুনিক গড়নে গড়তে চেয়েছে। কিন্তু অয়নের মনটা কি সত্যিই আধুনিক? নাকি শুধু বাহ্যিক দিকটাই আধুনিকতায় ডুবিয়ে রাখতে চায়? উত্তরটা নাবিলার জানা।
‘কিরে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আয় এসে বোস এখানে।’
মায়ের কথায় নাবিলা কিঞ্চিৎ হেসে বাবার পাশে বসে পড়লো। দাদি এইসময় সিরিয়াল দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তারেক হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ মুখটা এতো শুকনো কেনো লাগছে মা? বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে? ওসব নিয়ে ভেবো না। অয়নের পরিবার বিয়ের পর তোমায় আগলে রাখবে।’
‘আর অয়ন?’
প্রশ্নটা মনে আসলেও মুখে কিছু বললো না নাবিলা।
‘ তাছাড়া আকদের পর তুমি এখানেই থাকবে। অনার্স শেষ হলেই অয়নের বাড়ি যাবে তুমি।’
এই কথাটা শুনে নাবিলা খুশি হয়ে গেলো। যাক আরো প্রায় দুই বছর আছে তাহলে। তবে নাবিলা ঠিক করে ফেলেছে। এখন থেকে একদম নিজের মতো করে বাচবে। দাদির জন্য অয়নের সব কথা মানবে না আর। নিজেকে অন্যের পুতুল হতে দেবে না।
চলবে…