এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_৫,৬

এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_৫,৬
#প্রভা_আফরিন

শাড়ি পড়ে, খোলা চুলে, চোখে চশমা লাগিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নাবিলা। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি এবং লজ্জার আভাস। দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ। একটি পুরুষালি হাত ওকে কাছে টেনে নিলো। বাহুডোরে আবদ্ধ করে কপালে উষ্ণ স্পর্শ ছোয়ালো। তার গা থেকে পারফিউমের মৃদু সুবাস আসছে। খুব কাছে না আসলে এই সুবাস পাওয়া যাবে না। নাবিলার ভালো লাগলো সুবাসটা। তার আঙুলগুলো কিছুক্ষন নাবিলার চুলে খেলা করলো। এবার নাবিলা চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকালো।
সাথে সাথেই নাবিলার ঘুম ভেঙে গেলো। তাড়াতাড়ি উঠে বসে দেওয়াল হাতরে লাইট অন করলো। টেবিল থেকে কাপাকাপা হাতে গ্লাসটা নিয়ে পানি খেলো।

এ কি স্বপ্ন দেখলো সে! প্রয়াস ভাইয়া তাকে… ছিঃ…ছিঃ! দুদিন পর যার অন্যের সাথে বিয়ে সে কিনা প্রয়াস ভাইয়াকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখলো। নিজেকে ধিক্কার দিলো নাবিলা। কিন্তু স্বপ্নে এতো সুন্দর করে গন্ধ কিভাবে অনুভব করলো তাই বুঝতে পারলো না নাবিলা। মনে হচ্ছে এখনো নাকে লেগে আছে সুবাসটা।

বিছানা ছেড়ে উঠতেই চোখ গেলো বারান্দার দরজায়। দরজাটা খোলা আছে। তা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে রুমে। নাবিলা এগিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলো প্রয়াসের ঘরে আলো জ্বলছে। একবার ঘড়ি দেখলো নাবিলা। ভোর চারটা বাজতে চলেছে। এইসময় লাইট কেনো জ্বালানো বুঝলোনা নাবিলা। কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। প্রয়াস ভাইয়াকে নিয়ে যত ভাববে ততই মস্তিষ্কে এমন উল্টো পালটা ভাবনা আসবে।

কিন্তু স্বপ্নটা মাথায় গেথে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। ওরকি মনে মনে কোথাও প্রয়াস ভাইয়ার জন্য ভালোলাগা এখনো বেচে আছে?
এসব ভাবতে ভাবতে আর ঘুম হলো না নাবিলার। আযানের সময় উঠে ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় দাড়ালো সে। সকালের ফুরফুরে হাওয়ায় স্বপ্নটা ভুলে থাকার চেষ্টা করলো। এমন সময় চা হলে মন্দ হয় না। তাই নিচে গেলো চা করতে।

ফিরে এসে চায়ে চুমুক দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো প্রয়াস সাদা পাঞ্জাবি পড়ে টুপি মাথায় বাড়িতে ঢুকছে। নামাজ পড়ে এসেছে। ওকে দেখে নাবিলার আবার স্বপ্নটার কথা মাথায় চেপে বসলো।
নাহ! প্রয়াস ভাইয়ার আশেপাশে থাকা যাবে না। নাহলে এমন উদ্ভট ভাবনা মাথায় আরো চেপে বসবে।

স্বপ্নের কথা ভুলে থাকার জন্য বই নিয়ে বসলো নাবিলা। পড়ার মাঝে ডুবে থাকলে আর কোনো ভাবনা আসবে না।

__________

অনেক গাইগুই করেও প্রয়াসের সাথে ঘুরতে যাওয়া আটকাতে পারলো না নাবিলা। হয়তো মনের কোথাও প্রয়াস ভাইয়ার সাথে ঘুরতে যাওয়াটা সায় দিচ্ছিলো তাকে। দাদি নয়নতারা বেগমকে ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাসের কথা বলে বেড়িয়েছে সে। গাড়ি না নিয়ে প্রয়াস আজ রিক্সা নিলো। রিক্সায় করে নানা অলিতে গলিতে ঘুরলো প্রায় দুই ঘন্টা। আঁকাবাকা, ভাঙা রাস্তার ঝাকুনিতে নাবিলা যখন ভারসাম্য রাখতে পারছিলো না প্রয়াস নিজে থেকে ওর বাহু আকড়ে ধরেছে। প্রয়াসের এই ছোট ছোট ছোয়ায় নাবিলা কুকড়ে যাচ্ছিলো।

রিক্সায় পাশাপাশি থাকায় একটা জিনিস খেয়াল করলো নাবিলা। স্বপ্নে যে সুবাসটা পেয়েছিলো সেই একই সুবাস এখন প্রয়াস ভাইয়ার শরীর থেকে আসছে। এই গন্ধটা স্বপ্নের মাঝেও কিভাবে প্রানবন্ত ছিলো তা মাথায় ঢুকলো না ওর। প্রয়াস বিভিন্ন অলিগলি নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। ছোট বেলায় কোথায় কোথায় খেলেছে, নাবিলা কিভাবে ওকে ভয় পেতো সব গল্প জুড়ে বসেছে প্রয়াস। সেই গল্পে ডুবে পারফিউমের কথাটা আপাতত ভুলে গেলো নাবিলা।

দুই ঘন্টা রিক্সায় ঘুরে ওরা একটা দিঘির পাশে নামলো। এখানে সব স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। প্রয়াস নাবিলাকে কোনো কিছু খেতে বাধা দিলো না। উল্টো সে নিজেও নাবিলার সাথে যোগ দিলো। শুধু আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে কিছুটা চোখ গরম করলো। ঠান্ডা কোক খেয়েও সে আইসক্রিমের বায়না ধরেছে। নাবিলা যেনো আজ প্রয়াসে বন্ধু হয়ে উঠেছে এমন ভাবে সময় কাটালো।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে দিঘির অপর প্রান্তে কোলাহল মুক্ত যায়গায় বসলো দুজনে সূর্য মামা মাথার ওপর থেকে একটু পশ্চিমে হেলেছে। অর্থাৎ দুইটা বেজে গেছে। একটা গাছের নিচে বসে রোদ আড়াল করলো ওরা। নাবিলার মনটা আজ ভীষণ ভাল লাগছে। প্রয়াসের সাথে তার যতটুকু জড়তা ছিলো তা যেনো প্রয়াস নিজেই ওকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করলো।

নিরাক পড়া দুপুরে চারিদিকে কোলাহল বিরাজ করলেও তা প্রয়াস আর নাবিলাকে যেনো খুব একটা বিরক্ত করলো না। কিছুটা দূরে একটা গাছে একজোড়া শালিক বিশ্রাম নিচ্ছে। প্রয়াস সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নাবিলার দিকে তাকালো। ঘেমে গেছে ইতিমধ্যে।

নাবিলাকে বসতে বলে প্রয়াস কোথাও একটা গেলো। ফিরে এলো একটা তালপাতার হাতপাখা নিয়ে। প্রয়াস সেটা দিয়ে নিজেই নাবিলা এবং নিজেকে বাতাস করতে লাগলো। প্রয়াসের এই ছোট ছোট কেয়ারিং নাবিলার মনে পুলকসঞ্চার করতে সাহায্য করলো আরো।

‘তোর ফিউচার প্ল্যান কি?’

‘ পারফেক্ট বউ হওয়া।’
প্রয়াসে প্রশ্নে তাচ্ছিল্য করে উত্তর দিলো নাবিলা।

‘বলেছি না আজ এসব নিয়ে না ভাবতে। এখন বল কি করতে চাস ভবিষ্যতে?’

‘তেমন কিছু ভাবিনি। আগে ইচ্ছা ছিলো বাবার বিজনেস একা সামলাবো। সারাদেশে প্রসার করবো। কিন্তু এখন আর কিছু নিয়েই ভাবছি না।’

‘এটা কেমন কথা?’
প্রয়াসের কন্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়লো।
‘কিছু ভাববি না কেনো? অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া মেয়ের জীবন নিয়ে কোনো লক্ষ্য নেই!’

‘নেই।’

‘ আচ্ছা ধর, আজ তোর বিয়ে হলো। স্বামী সংসার সামলে গেলি। টাকা পয়সা চিরকাল থাকবে না। আল্লাহ না করুক যদি তোর স্বামীর এমন অসুখ হয় যে সে আর বিজনেস সামলাতে পারলো না বা মারা গেলো। হুট করে কিছু না জানা তুই কি বিজনেসটা সামলে নিতে পারবি?
সংসার বাচ্চা, বিজনেস সব নিয়ে বিপদে পড়বি না? আবার বিজনেসে ধস নামলে বা টিকিয়ে রাখতে না পারলে কি রাস্তায় নামবি?
নাকি নিজের যোগ্যতা দিয়ে সংসারের হাল ধরবি।

আবার, বাচ্চারা বড় হয়ে গেলে মা হয়ে যায় বোঝা। তখন তার আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রম নয়তো ঘরের এক কোনা। কিন্তু তোর নিজের যদি ফিনানশিয়াল অ্যাবিলিটি থাকে। তুই যদি সংসারে কন্ট্রিবিউট করতে পারিস তাহলে তুই হয়ে উঠবি একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কিংবা বাকিটা জীবন নিজের মতো কাটাতে পারবি।

সংসার ভাসিয়ে দিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার কথা বলছি না। আমরা রোজগারে ছুটিই সংসারের জন্য। আপন মানুষগুলোকে ভালো রাখার জন্য। চাকরির জন্য সংসার নয়, সংসারের জন্যই চাকরি।
আবার কেউবা শুধুই টাকার পেছনে দিনাতিপাত করে। তুই করবি নিজের এবং পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য।
আজকাল কাজের কত সুবিধা আছে।তুই রেগুলার অফিসে না গিয়ে ঘরে বসেও তোর বাবার বিজনেস সামলাতে পারবি। মিটিংও অনলাইনে ঘরে বসে করতে পারবি। তাহলে করবি না কেনো?’

নাবিলা মন দিয়ে প্রয়াসের কথাগুলো শুনলো। ঠিকইতো বলেছে। ও কেনো এভাবে ভেবে দেখলো না? উল্টে পরিবারের ওপর, অয়নের ওপর রাগ করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলো। বিয়ের পর কিছু কিনতে হলে বা শখ হলে তো অয়নের কাছেই চাইতে হবে। আর অয়নের যদি সেই জিনিস পছন্দ না হয় তাহলে নাবিলাকে তা দেবে না। অয়নের কাছে ওকে সারাজীবন নিজের শখ বলি দিতে হবে। আর মানুষটা অয়ন না হয়ে অন্য কেউ হলে একটা কথা ছিলো। নাবিলার যেনো এতক্ষনে টনক নড়লো। প্রয়াসে দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আমি বাবার বিজনেসে ঢুকবো। একটু একটু করে সব শিখে নেবো।’

নাবিলার কথায় প্রয়াস মুচকি হাসলো। নাবিলার মাথায় হাতপাখাটা দিয়ে হালকা চাপড় মেরে বললো,

‘চল এবার উঠি। বাতাস করতে করতে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। বাড়ি গিয়ে আগে কফি করে দিবি।’

আরো কিছুক্ষণ রিক্সায় ঘুরে ওরা বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে গেছে। কিছুটা দূরে রিক্সা থেকে নেমে আগে আগে হেটে আসছিলো নাবিলা। প্রয়াস ভাড়া মেটাতে গিয়ে পেছনে পড়েছে। প্রয়াস নাবিলার কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই একটা সাদা রঙের গাড়ি নাবিলার সামনে ব্রেক করলো। প্রয়াস কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে গেলো।

অয়ন গাড়ি থেকে নেমেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো নাবিলার দিকে।

‘তুমি আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?’

‘আমার তো মনে হয় আপনি জানেন আমি কোথায় ছিলাম। আমার এ টু জেড সবইতো নজরে রাখেন। তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেনো?’

এই প্রথম নাবিলা সংকুচিত না হয়ে কনফিডেন্সের সাথে অয়নের চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলো।
তা দেখে অয়ন কিছুটা অবাক হলেও ওর রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো।

‘ওহ আই সি! তোমার ওই সো কল্ড ভাইয়া নাকি সাইয়া তোমায় মুখে মুখে কথা বলা শেখাচ্ছে তাইনা?’

‘মুখ সামলে কথা বলুন।’

অয়ন নাবিলার হাত চেপে ধরলো খুব জোরে। ব্যাথায় নাবিলা কুকিয়ে উঠলো।

‘ গায়ে লাগছে তাইনা? খুব গায়ে গায়ে লাগছে। ঢলাঢলি করার সময় মনে হয়নি তুমি যে অন্যের বাগদত্তা।’

‘আহ লাগছে! ছাড়ুন বলছি।’

প্রয়াস এগিয়ে এসে নাবিলার হাত অয়নের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো।

‘ নাবিলা আপনার বাগদত্তা। কিন্তু আপনার বউ বা পারসোনাল সম্পত্তি নয় যে রাস্তার মাঝে তাকে অপমান করবেন।’

‘ আমাদের মাঝে আসার কোনো অধিকার আপনার নেই। এখনো ঘোরাঘুরি হয়নি বুঝি!’

‘ আপনার থেকে বেশি অধিকার রাখি আমি ওর জীবনে। ছোট থেকে আমি ওর অভিভাবক ছিলাম। আর সেই দায়িত্ব ওর পরিবারই আমায় দিয়েছে। দুই বছর ছিলাম না বলে যে অধিকার থাকবে না তা ভাবলে ভুল করবেন। আগে স্বামী হোন পরে অধিকার দেখাতে আসবেন।’

নাবিলা চুপচাপ দুজনের কথা শুনে গেলো। ওর এখন ভয় হচ্ছে। বাড়িতে না জানি আবার কি বলে বিচার দেবে অয়ন। মা বাবা আবার নাবিলাকে না ভুল বোঝে। বিয়েটা যেহেতু ভাঙা যাচ্ছে না। সেহেতু নাবিলাকে যে অয়ন ছেড়ে দেবে না তা বেশ বুঝতে পারলো সে।

প্রয়াস নাবিলার হাত ধরে অয়নকে সাইডে ফেলে সামনে এগোতে লাগলো। অয়ন গাড়িতে একটা ঘুসি মেরে বললো,

‘আই উইল সি ইউ নাবিলা।’

প্রয়াস থেমে পেছনে ঘুরে বললো,
‘অ্যান্ড আই উইল অলসো সি ইউ মি.অয়ন।’

_______

বাড়ি ফিরে প্রয়াস আগে নাবিলাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো হাতটা লাল হয়ে গেছে। আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। প্রয়াস কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে রাগ সংবরন করতে চেষ্টা করলো। নাবিলাকে সোফায় বসিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নাবিলা নিরবে সব দেখলো। ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ও অয়নের সাথে এভাবে কথা বলেছে। নিজের পরিবর্তনে নিজেরই খুশি লাগছে সাথে এর পরিনতি ভেবে ভয়ও করছে।

নাবিলার এইটুকু পরিবর্তনে প্রয়াস নিজেও কিছুটা খুশি। একটা বক্স নিয়ে ফিরে এসে নাবিলার হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলো। একটা কথাও বললো না কেউ।

বাড়ি ফিরে শুরু হলো নাবিলার নতুন চিন্তা। অয়ন যদি ফোন দিয়ে সব বলে দেয় তবে নাবিলার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সারা বিকাল স্থির হয়ে কিছুই করতে পারলো না। দাদি আশেপাশে দিয়ে হাটা চলা করলেও বুক কাপছিলো নাবিলার। বেশ কয়েকবার লুকিয়ে দাদির ফোন চেক করলো নাবিলা। নাহ! এখনো ফোন দেয়নি।

মাথায় একটা বুদ্ধি আসতেই আবার চুপিচুপি দাদির ঘরে গেলো সে। বিকেলে নয়নতারা বেগম রাস্তায় হাটতে বের হয়। প্রতিবেশীদের সাথে গল্পে মেতে থাকে তাই নাবিলার জন্য সুবিধা হলো। সে বেডসাইড টেবিল থেকে দাদির ফোনটা পেলো। সিমফোনির বাটন মোবাইল। সেটা নিয়ে অয়নের নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিলো নাবিলা।

পুনরায় ঘরে ফিরে আরাম করে বসতেই ভাবলো দাদিকে না পেলে তো মাকেও ফোন দিতে পারে কিংবা অয়নের পরিবার থেকেও ফোন আসতে পারে। ভাবতেই আবার অস্থির হয়ে উঠলো নাবিলা। পাশের বারান্দা থেকে প্রয়াসের গলা ভেসে আসলো। নাবিলা ওড়না গায়ে জড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে বারান্দায় গেলো। প্রয়াস ওকেই ডাকছে।

‘ প্রতিদিন এই সময় তোকে আমায় কফি দেওয়ার কথা ছিলো। ভুলে খেয়েছিস দেখছি।’

নাবিলা অবাক চোখে তাকালো। সে ভয়ে থিতিয়ে যাচ্ছে আর উনি কিনা কফির চিন্তা করছে। নাবিলাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রয়াস আবার বললো,

‘তুই এসে বানাবি নাকি আমি তোর বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো কোনটা?’

‘আসছি।’

বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে নিলে প্রয়াস পিছু ডেকে বললো,

‘ শোন!’

‘কি?’

‘ওইসব লেন্স ফেন্স খুলে চশমা পড়ে আসবি।’

মেঘহীন পশ্চিম আকাশে সূর্য এখনো বিরাজমান। কমলা রঙের আভার ছড়াছড়ি চারিদিকে। আজকের আকাশটা যেনো একটু বেশিই স্বচ্ছ মনে হচ্ছে প্রয়াসের কাছে। মৃদু সমীরণে নাবিলার কোকড়ানো চুল দোল খেয়ে চলেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নাবিলার দৃষ্টি দূরে সাইকেল চালানো একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর নিবদ্ধ। কিন্তু মন অন্য কোথাও ঘুরপাক খাচ্ছে তা বেশ বুঝলো প্রয়াস। কফি নিয়ে ছাদে উঠেছে ওরা। আজকে ঘোরাঘুরি করার পর দুজনের বন্ডিংটা আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। কথা বলায়ও কোনো জড়তা কাজ করছে না নাবিলার মাঝে। প্রয়াস কফিতে চুমুক দিয়ে নিরবতা ভাঙলো।

‘ কফিটা শরবত হওয়ার জন্য ওয়েট করছিস?’

‘ হু! কিছু বললে?’ নাবিলার ধ্যান ভাঙলো।

‘বলছি কফিটা শরবত বানিয়ে ফেলছিস।’

‘ওহহ খাচ্ছি।’
নাবিলা এক চুমুক মুখে নিলো।

‘এতো চিন্তার কিছুই নেই। অয়ন কিছুই করবে না।’

‘তুমি এতো শিওর কি করে? উনি পান থেকে চুল খসলেই আমার নামে দাদির কাছে কথা শোনায়। যদিও দাদির ফোন থেকে ওনাকে ব্লক করে দিয়েছি আমি।’

নাবিলার এমন বাচ্চামিতে হেসে উঠলো প্রয়াস।

‘অয়ন বলতে চাইলে ব্লক দিয়েও ঠেকাতে পারবি না ওকে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি অয়ন কিচ্ছুটি বলবে না।’

‘কেনো বলবেনা? উনার তো চুপ থাকার কোনো কারনই দেখছি না।’

‘সেটা নাহয় আমার ওপর ছেড়ে দে। হ্যাভ অ্যা রিলাক্স।’

_______

রাতে আবার সেই পারফিউমের গন্ধটা নাবিলার নাকে এসে লাগলো। প্রয়াস ভাইয়ার গায়েও রিক্সায় বসে গন্ধটা পেয়েছিলো। স্বপ্নে এর আগে কখনোই সে গন্ধ পায়নি। তবে সেই স্বপ্নটা দেখেনি আজ। একই সময় আবার ঘুম ভেঙে যেতেই দেখলো আজও প্রয়াসের ঘরের আলো জ্বলছে।

আজকে বারান্দায় চাদের আলো গলে পড়ছে। যার ফলে আধার কিছুটা মলিন হয়ে আছে। বারান্দায় কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে নাবিলার মনে হলো সে প্রয়াসের কাছাকাছি থাকছে বলেই হয়তো স্বপ্ন এতো জীবন্ত লাগছে। নাবিলা না চাইতেও বারবার প্রয়াসকে নিয়েই ভেবে ফেলছে। নিজের মনকে আটকানোর চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। নাবিলা আরেকবার নিজেকে শাসিয়ে ঘুমাতে গেলো।

_______

পর পর তিন রাত একই ঘটনা ঘটেছে নাবিলার সাথে। গতকাল রাতে আবার স্বপ্ন দেখেছে সে। প্রয়াস একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে। তবে মেয়েটা সে নিজে নাকি অন্য কেউ তা বুঝে উঠতে পারেনি নাবিলা। তার আগেই ঘুম ছুটে গেছে। সেদিন স্বপ্নে প্রয়াসের সাথে নিজেকে দেখে এতো খারাপ লাগেনি যতটা এখন লাগছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা অন্যকেউ ছিলো। ফর্সা গায়ের রঙের কেউ।
‘ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড?’

কথাটা মাথায় আসতেই অস্থিরতা বেড়ে গেলো নাবিলার। সে শিকার না করলেও মনে মনে এখন সারাক্ষণ প্রয়াসের কথাই ভাবে। কিন্তু প্রয়াস ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড এখনো আছে কি না তা জানে না নাবিলা। আর জানলেই বা কি। সে নিজেই তো এখন অন্যের হতে চলেছে। কিশোরী বয়সের সেই ভালোলাগাটা কি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে?
মাথা চেপে ধরে এই সকল চিন্তা ভুলতে চাইলো।

সারাটাদিন বারান্দায় কিংবা বাড়ির বাইরে গেলো না নাবিলা। মনটা প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ওর। প্রয়াসের সামনে পড়ে তা আর ঘাটাতে চাইলো না। ছোটবেলা থেকে সবসময়ই নাবিলা নিজের সিদ্ধান্ত একা নিতে হিমশিম খেয়েছে। এর জন্য প্র‍য়াসের অনেক বকাও খেতে হয়েছে তাকে। মনের কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে না। এখনো নাবিলার মনে হচ্ছে বিয়েটা কোনোভাবে আটকানো গেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু ওর কাছে কোনো উপায় নেই। সেদিনের রাস্তার ঘটনার পর অবিশ্বাস্য ভাবে অয়ন আর ফোন দেয়নি। কেনো দেয়নি তার উত্তর নাবিলার কাছে নেই।

বিকেলে মাহি এবং তানজিলা এলো নাবিলার কাছে। মাহি এবং তানজিলা নাবিলার বান্ধবী। তিনজন একসাথে নাবিলার খাটে বসে গল্প করছিলো। একপর্যায়ে মাহি আফসোসের সুরে বললো,

‘ওই হাদাটাকেই শেষে বিয়ে করবি? এর থেকে তো পাশের বাড়ির জন হাজারগুন ভালো।’

তানজিলাও সহমত পোষণ করে বললো,
‘ঠিক, তোর দাদু আশেপাশে একটু তাকাতে পারলো না? বিলাতিই কেনো নজরে পড়লো।’

নাবিলাও আক্ষেপের সুরে বললো,
‘আসলেই।’

ওর উত্তর শুনে তানজিলা এবং মাহি দুষ্টুমির চোখে তাকালো। সেটা দেখে নাবিলা মেকি হেসে উঠলো।

‘হে..হে..আমিতো কথার কথা বলছিলাম আর কি।’

‘সত্যি করে বলতো! তোর কি প্রয়াস ভাইয়ার জন্য একটুও অনুভূতি নেই? ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে শুনেই ভালোলাগা চেপে গেলি কিন্তু গার্লফ্রেন্ড এর কিছুই তো জানতে পারলি না। এমনওতো হতে পারে ভাইয়ার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।’ মাহি বললো।

‘তুই যা যা বলছিস তাহলে এখনতো তোদের সম্পর্ক সহজ হয়ে গেছে। ভাইয়াও তোর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করছে। একজন মেয়ে একজন ছেলের চোখের ভাষা খুব ভালো বুঝতে পারে। তুই কি কখনো খেয়াল করেছিস ভাইয়া তোর দিকে বোনের নজরে তাকায় নাকি অন্য কিছু?’

তানজিলা বলতেই নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর ডানে বামে মাথা দোলালো।

‘তেমন কিছু তো খেয়ালই করিনি।’

মাহি এবং তানজিলা হতাশ নিশ্বাস ফেললো। মাহি নাবিলার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,

‘ তা খেয়াল করবে কেনো? তুমি শুধু কফি বানিয়ে দিয়ে নিজের সমস্যার সমাধান নিয়ে আসবা। তুই আসলেই বুদ্ধু।’

____________

শেষ বিকেলে রোজকার মতো ছাদে উঠতেই চোখ গেলো পাশের ছাদে প্রয়াস দুইহাত বুকে গুজে এদিকেই তাকিয়ে আছে যেনো সে নাবিলার অপেক্ষাই করছিলো।

‘এদিকে আয়।’

প্রয়াসের গম্ভীর কন্ঠে নাবিলা ধীর পায়ে এগিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাড়ালো।

‘আমার কফি করার কথা তোকে মনে করিয়ে দিতে হবে কেনো?’

নাবিলা প্রয়াসের চোখের দিকে তাকালো। খোজার চেষ্টা করলো সেই চোখে কোনো মুগ্ধতা আছে কিনা। কিংবা ভালোবাসার ছোয়া। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না।

‘ বিয়ে করে ফেলো। বউ প্রতিদিন কফি করে দেবে।’

‘সেতো করবোই। তোর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপর ধুমধাম করে বউ তুলবো ঘরে। ততদিন নাহয় কফিটা তুই করে দিলি।’

‘ পাত্রী ঠিক করে রেখেছো বুঝি।’

প্রয়াস হালকা হেসে বললো,
‘হ্যা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি। মাঝখানে একটু মান-অভিমান ছিলো। তবে এখন ঠিকঠাক এগোচ্ছে। তুই কি এখন কফিটা করে দিবি? আমি কিন্তু এখনো খাইনি। আর কফি না খেলে অফিসের কাজগুলোও করতে পারবো না। এখনো অফিসে যাওয়া শুরু করিনি। তোর বিয়ে পর্যন্ত বাড়িতে বসেই সব কাজ করবো ঠিক করেছি তাই বাবাও আপত্তি করেনি।’

‘পারবোনা।’

বলেই ঝরঝর করে কেদে ফেললো নাবিলা। প্রয়াসের মুখে পাত্রী ঠিক কথাটা শুনে নাবিলা খুবই কষ্ট পেয়েছে। সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তারই সামান্য বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চোখের অবাধ্য জ্বল বেরিয়ে পড়েছে।

নাবিলা কান্না শুরু করতেই প্রয়াস কিছুটা ভরকে যায়। তখনই ওর মোবাইলে কল আসে এবং প্র‍য়াস ছাদ থেকে চলে যায়।
নাক টানতে টানতে মুখ উঁচিয়ে প্রয়াসকে চলে যেতে দেখে কান্নার বেগ বেড়ে গেলো নাবিলা। নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড কল দিয়েছে। তাই ওর চোখের পানিকে উপেক্ষা করলো।

নাবিলাকে অবাক করে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে নাবিলাদের ছাদে আসলো প্রয়াস।এসেই আলতো হাতে নাবিলার মাথা বুকে চেপে ধরলো। কিছুটা আহ্লাদ পেয়ে নাবিলা এবার শব্দ করে কেদে ফেললো।

‘এই কান্না থামা বলছি। এইসব চোখের জল আমার একদম সহ্য হয় না।’

নাবিলা কান্না আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ।

‘কাদছিস কেনো? আমি কি এমন বললাম যে কাদতে হবে। নাকি অন্য কেউ বকেছে? আহা! নাবিলাপাখি কান্না থামা প্লিজ!’

নাবিলা পাখি! কথাটা বিষ্ময়ে নাবিলার হৃদয়ে প্রবেশ করেছে। সাথে সাথেই কান্না থেমে গিয়েছে। মুখ তুলতেই প্রয়াসের উদ্বিগ্ন চোখ দৃষ্টিগোচর হলো নাবিলার। এই চোখে কি শুধুই বোনের স্নেহ? নাকি ভালোবাসাও?

প্রয়াস চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কাদলি কেনো?’

‘আপনার না ফোন এসেছে?’ ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো নাবিলা।

‘রাখ তোর ফোন। এদিকে আমি চিন্তায় মরছি উনি ফোন নিয়ে পড়েছে।’

ধমকে উঠলো প্রয়াস। আবার গলার স্বর নরম করে বললো,

‘ আগে বল অয়ন কি ফোন দিয়ে কিছু বলেছে তোকে? নাকি কেউ কিছু বলেছে?’

নাবিলা হকচকিয়ে গেলো। সত্যি কথা জানলে ভাইয়া কি ভাববে! তাই কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,

‘না আসলে… কয়দিন পরই তো মি.অয়নের অধীনে যেতে হবে তাই…’

‘পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুই কাদবি নাকি তোর মি.অয়ন সেটা সময়ই বলবে।’
বলে নাবিলার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here