এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_৭,৮,৯

এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_৭,৮,৯
#প্রভা_আফরিন

নাবিলার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। আকদের আর দুই দিন বাকি। কিন্তু নাবিলা নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। এই অস্থিরতার নাম প্রয়াস। প্রতিদিন কফি করে দেওয়া, বিকেলটা একসাথে ছাদে সময় কাটানোর মাঝে নাবিলা কখন যে আবার প্রয়াসকে পছন্দ করে ফেলেছে নিজেও বুঝতে পারেনি। এই পছন্দের নাম ভালোবাসা কিনা সেটা নিশ্চিত হতে পারছে না নাবিলা।

কাল বিকেলে প্রয়াস যখন ওর কান্নায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করে তখন থেকেই নাবিলার মনে হচ্ছে ও আকাশে উড়ছে। প্রয়াস ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে, নাবিলাপাখি ডেকেছে তা ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। এতো খুশি বোধহয় বিগত কয়েকমাসেও হয়নি। কিন্তু পরক্ষনেই অয়নের কথা মাথায় আসতে চুপসে যেতে হচ্ছে। এই দোটানা থেকে মুক্তি পেতে মাহি এবং তানজিলা কে কনফারেন্স কল দিলো নাবিলা।

মাহি রিসিভ করেই বললো,
‘কি ব্যাপার এই রাতের বেলা অয়ন বিলাতিকে ফোন না দিয়ে আমাদের ফোন দিচ্ছিস কেনো? নাকি ভুলে টুলে চলে এলো?’

‘প্লিজ মাহি! ফাজলামো না করে আমার কথাটা শোন তোরা। খুব বিপদে পড়েছি।’

তানজিলা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো,
‘কি হয়েছে বলতো? মি. অয়ন কি আবার কিছু করতে বলেছে তোকে?’

‘উফফ! না।’

‘তাহলে?’ তানজিলার কন্ঠ।

‘আই থিংক আই অ্যাম ইন লাভ।’

বলেই নাবিলা চোখ বন্ধ করে নিলো। ফোনের ওপাশে বিকট শব্দে চিৎকার দিলো মাহি এবং তানজিলা।

‘হোয়াট? সিরিয়াসলি নাবিলা! তুই বিলাতির প্রেমে পড়েছিস?’

মাহির কথায় নাবিলা এবার বিরক্ত হলো।
‘আমি কি একবারও বলেছি যে আমি বিলাতির প্রেমে পড়েছি। ওনার প্রেমে পড়তে আমার বয়েই গেছে।’

তানজিলা বললো,
‘ খোলাসা করে বল প্লিজ কে সেই হতভাগা যাকে আকদের আগে মনে ধরলো।’

নাবিলা প্রয়াসের প্রতি ওর সকল অনুভূতির কথা নিঃসংকোচে বললো ওদের কাছে। সব শুনে মাহি কিছুটা আর্তনাদেএ সুরে বললো,

‘না! এটা হতে পারে না। আমি ভেবেছি তোর সাথে যখন প্রয়াস ভাইয়ার কিছু হলোই না তখন আমিই ট্রাই করি। কিন্তু তুইতো আমার উঠতি স্বপ্নটায় ফাটল ধরালি।’

তানজিলা ধমকে বললো,
‘আহ এখন মজা করার সময় নয় মাহি। পরশু আকদ আর তুই এখন নিজের মনের কথা বুঝলি! তোর কথা ঠিক হলে প্রয়াস ভাইয়াও তোকে পছন্দ করে। ‘

নাবিলা কেদে ফেললো।
‘আমি এবার কি করবো। ভাইয়াকে ভালোবেসে মি.অয়নকে বিয়ে করা যে সম্ভব নয়রে।’

‘আচ্ছা শোন। একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে তো অসুবিধা নেই। তুই প্রয়াস ভাইয়াকে নিজের মনের কথা বলে দে। হয়তো তোর পরিবারকে ভালোবাসে বলেই ওরা তোর বিয়ে ঠিক করায় নিজের মনের কথা চেপে গেছেন উনি। তুই যদি মনের কথাটা বলিস ভাইয়া নিশ্চয়ই কোনো উপায় বের করতে পারবে।’
তানজিলা বলতেই মাহিও সহমত পোষণ করলো।

‘কিন্তু ভাইয়ার যদি সত্যি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড থেকে থাকে তখন? উনি তো বললো পাত্রী ঠিক করা আছে।’

‘তুই যা যা বলছিস তাতে আমার মনে হচ্ছে ভাইয়া তোকে জেলাস ফিল করানোর জন্যই ছাদে পাত্রী ঠিক করা আছে বলেছে। নাহলে তুই কেদে ফেললে ওভাবে ছুটে আসতো না। ভাইয়া হয়তো তোর পরিবারের কথা ভেবেই নিজের মনের কথা বলতে পারছে না। মনের কথাটা বলে দিলে দেখবি কোনো না কোনো উপায় বের হবেই। আমি আর মাহি কখনোই চাই না তুই মি.অয়নের হাতের পুতুল হয়ে থাকিস।’

________

সারারাত ভেবে নাবিলা ঠিক করে নিলো আজ প্রয়াস ভাইয়াকে সে মনের কথা জানাবেই। সারারাত না ঘুমিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার প্র‍্যাক্টিস ও করে নিয়েছে। নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছে। আজ লেন্স নয় চশমা পড়েছে। মুখে একটু ফেইস পাউডার দিয়েছে। প্রয়াস ন্যাচারাল বিউটি পছন্দ করে তাই আর কোনো প্রসাধনী দিলো না মুখে।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সবার চোখ ফাকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো নাবিলা। বাহিরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। এখনো তা প্রখর হয়নি। রাস্তায় মানুষের কোলাহল এখনো কম। নাবিলার আজ সব কিছুই রঙিন লাগছে। কাকের কা কা ডাকও যেনো বিরক্ত লাগছে না শুনতে।

প্রয়াসের বাড়ির সদর দরজা খোলা। হয়তো শাহেদ আংকেল বেড়িয়ে যাবার পর আর লাগানো হয়নি। প্রয়াস ভাইয়ার বাবা খুব ভোরে অফিসে যান আবার বেশ রাত করে ফেরেন। উনি একজন যান্ত্রিক মানুষ বলা চলে।
ভেতরে ঢুকতেই উচ্ছ্বসিত একটা নারী কন্ঠ এবং একটা পুরুষ কন্ঠ কানে এলো। পুরুষ কন্ঠটা পরিচিত। প্রয়াস ভাইয়ার কন্ঠ। কিন্তু নারী কন্ঠ?

দোতলার সিড়ি পেরোতেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো নাবিলা। প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরে আছে একটি মেয়ে। তার কথায় অজস্র খুশি ঝরে পড়ছে। খুশি প্রয়াসও।

‘তোমারতো বিকেলে আসার কথা। আমায় ফোন দিলে না কেনো? আমি রিসিভ করতে যেতাম তোমায়।’ প্রয়াস মেয়েটাকে ছেড়ে বললো।

‘তাহলে কি তোমায় এতো সারপ্রাইজড করতে পারতাম বলো। খুশি হওনি?’

‘খুব খুশি হয়েছি আমি। তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এতোদিন।’

‘আমিও। তোমায় খুব মিস করেছি এই কয়দিন। এসেতো একদম ভুলেই বসে আছো। দরকার ছাড়া কথাই বলো না।’

‘মোটেও না। তোমায় ভুলে যাওয়া কি সম্ভব বলো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির কারন তুমি।’

‘এই জন্যই তো তোমায় এতো…’

এর পরের কথাটুকু নাবিলার কর্নগোচর হয়নি। তার আগেই দ্রুত পায়ে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে গেছে। চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রুপাত হচ্ছে ওর। দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো নাবিলা। সায়মা বেগম পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও শুনলো না। মেয়ের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে চিন্তিত হয়ে ছুটে এলেন সায়মা বেগম। কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পর নাবিলা কর্কশ সুরে মাকে চলে যেতে বললো। সায়মা বেগম কিছুটা আহত হলেও মেয়েকে একা থাকতে দিয়ে চলে গেলো।

নাবিলা চশমাটা খুলে ছুড়ে ফেললো। ওর স্বপ্নে দেখা প্রয়াস ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ফর্সা মেয়েটাই তাহলে সে! তারমানে সত্যিই প্রয়াস ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আছে। নাবিলার প্রতি তাহলে কোনো অনুভূতি নেই প্রয়াস ভাইয়ার? এইসব ভেবে আরো বিমর্ষতা গ্রাস করলো নাবিলাকে। চোখ বন্ধ করতেই দোতলায় প্রয়াসের রুমের সামনে একটা সুন্দর মেয়েকে জড়িয়ে ধরা প্রয়াসের চেহারা ভেসে উঠছে বারবার।
একজন ভুল মানুষের জন্য অনুভূতি কেনো সৃষ্টি হলো ওর?

সারাদিন দরজা বন্ধ করে ছিলো নাবিলা। শুধু মায়ের ডাকাডাকিতে একবার দরজা খুলে খাবার নিয়েছে। কিন্তু খেতে পারেনি। সায়মা বেগমকে চিন্তিত দেখে নয়নতারা বেগম বললেন হয়তো কাল আকদ হয়ে যাবে বলে মন খারাপ। ওকে একা থাকতে দাও। সায়মা বেগমও তাই আর ঘাটালেন না। পারিবারিক ভাবেই আয়োজন হচ্ছে কালকের জন্য। নয়নতারা বেগম আত্মীয়দের ডাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অয়ন বা নাবিলা কেউ চায়না বিয়েতে পরিবার ছাড়া অন্যকেউ থাকুক।

সারাদিন দেখতে না পেয়ে বিকেলে প্রয়াস এসেছিলো নাবিলার খোঁজে। কিন্তু নাবিলা তবুও দরজা খোলেনি। তাই সায়মা বেগমের কাছে যায় প্রয়াস।

‘মনি নাবিলা দরজা খুলছেনা কেনো? শরীর খারাপ?’

‘সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। দরকার ছাড়া খোলেনি। আমার সাথেও রাগারাগি করেছে। একটু দেখতো কেনো এমন করছে। যদি তোকে বলে। আমি কয়দিক সামলাবো বল।’

‘আচ্ছা মনি তুমি যাও আমি দেখছি।’

প্রয়াস চিন্তিত মুখে নাবিলার রুমের দরজায় কয়েকবার টোকা দেয়। নাবিলার কোনো প্রতি উত্তর না পেয়ে প্রয়াসের রাগ হয়। এসে থেকে একদিনও নাবিলাকে বিকেলে ঘুমাতে দেখেনি। আর আজতো একবারের জন্যও ওর দেখা পাওয়া যায়নি। সকাল থেকে দরজা বন্ধ মানে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। প্রয়াস এবার কিছুটা রাগ নিয়ে বললো,

‘তুই যদি ভেবে থাকিস দরজা না খুললে আমি চলে যাবো তাহলে ভুল ভাবছিস। হয় দরজা খোল নয়তো ভাঙবো।’

নাবিলা শোয়া থেকে উঠে আস্তে করে উত্তর দিলো,
‘তুমি চলে যাও। আমার কারো সাথে দেখা করতে ভালো লাগছে না।’

‘তুই দরজা খুলবি কি না?’

অগত্যা নাবিলাকে দরজা খুলতেই হলো। প্রয়াস ঘরে ঢুকতেই নাবিলা মাথা নিচু করে নিলো। সকাল থেকে কান্নার ফলে চোখের অবস্থা কেমন তা ও নিজেও জানেনা। প্রয়াস তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নাবিলাকে পর্যবেক্ষণ করে বললো,

‘মুখ তোল।’
নাবিলা একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘মুখ তুলতে বলেছি আমি।’

প্রয়াসের এমন শক্ত কন্ঠে নাবিলাকে মুখ তুলতেই হলো। প্রয়াস অবাক হয়ে দেখলো ওকে। ফোলা চোখ, বিধ্বস্ত মুখে এক শ্যামাঙ্গিনী দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় লাল চোখগুলো যেন ফুটে উঠেছে।

প্রয়াস এক পা ওর দিকে আগোতেই নাবিলা কয়েক পা পেছনে চলে যায়। তা দেখে প্রয়াসের কপালের ভাজ আরো একটু গাঢ় হয়।

‘ কি হয়েছে তোর? এমন অদ্ভুত আচরন করছিস কেনো আজ? আয়নায় একবার দেখ কি অবস্থা করেছিস নিজের।’

‘আমায় নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। কি জন্য এসেছো সেটা বলো।’

‘এমন ব্যবহার করছিস কেনো? কান্না করে চোখ ফুলিয়েছিস কেনো? শরীর খারাপ…’

প্রয়াস নাবিলার কপালে হাত দিতে গেলে নাবিলা আবার পিছিয়ে যায়।
‘ আমি একদম ঠিক আছি। বেশি ঘুমিয়েছি তাই চোখ ফোলা।’

প্রয়াস বুকে হাত গুজে বললো
‘আচ্ছা! হঠাৎ আজ এতো ঘুমের কদর কেনো করছেন আপনি?’

নাবিলা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘কাল আমার বিয়ে তাই আজ একটু বেশি বেশি ঘুমিয়ে নিচ্ছি। এবার বলো কেনো এসেছো?’

‘প্রয়াস কিছুক্ষণ নিরব চাহনিতে দেখে বললো,
‘ বিয়ের জন্য এত তাড়া! আচ্ছা যাইহোক, আমার মেহমান এসেছে কানাডা থেকে তোর সাথে পরিচয় করতে চায়। কিন্তু তুইতো একবারও এলি না আজ।’

‘মেহমান!’

‘হ্যা স্পেশাল মেহমান।’
কথাটা শুনে নাবিলা চোখ বন্ধ করে নিলো।

‘আমার এই মুহূর্তে কারো সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না। কাল নিয়ে আসবে দেখা করে নিবো। এখন আমায় একটু একা থাকতে দাও প্লিজ!’

প্রয়াস আহত চোখে তাকিয়ে নাবিলার হাত ধরে টেনে খাটে বসালো। নাবিলা হাত পা ছোড়াছুড়ি করলেও ছাড়াতে পারলো না ওকে।

‘চুপ করে বসে থাক এখানে। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি, কথা থাকে। কোনো কারনে খুব কেদেছিস বোঝাই যাচ্ছে। আমাকে না বলতে চাইলে বলিস না। জোর করবো না। তবে ঝোকের বসে কিছু করিস না। কান্না, মন খারাপ করে বসে থাকা কোনো সমাধান হয় না। হয় যে জিনিসটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিস তা ভুলে যা অথবা তার শেষ দেখে ছাড়।’

নাবিলার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে প্রয়াস আবারও বললো,

‘মনির সাথে নাকি রাগারাগি করেছিস? নিজের একমাত্র মেয়েকে তার অনিচ্ছায় বিয়ে দিতে হচ্ছে বলে তিনি কষ্ট পাচ্ছে। মনির সাথে রাগারাগি করে তার মনের দহন আর বৃদ্ধি করিস না।’

প্রয়াস বেরিয়ে যেতেই নাবিলা শব্দ করে দরজা লাগিয়ে খাটে বসে ফোপাঁতে লাগলো।

‘ মানুষটা এতো কিছু বোঝে অথচ এটা কেনো বোঝে না যে আমি তার জন্যই কষ্ট পাচ্ছি? অন্যের বেলায় জ্ঞানের জাহাজ অথচ নিজে অন্যের মন বোঝে না। বুঝবে কি করে সেতো আরেকজনকে মন দিয়ে বসে আছে। তোমার কথাই নাহয় আরেকবার শুনলাম ভুলে যাবো সবকিছু…সবকিছু।’

কথাগুলো একা একা বিড়বিড় করে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো নাবিলা।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। কারো জন্য কষ্ট পাবে না। প্রয়াস থাকুক তার ভালোবাসা নিয়ে। নাবিলাও অয়নকে বিয়ে করে নেবে। তবে অয়নের পুতুল হয়ে বাচবে না, পাল্লা দিয়ে চলবে অয়নের সাথে।

প্রয়াসের যত্ন, অধিকারবোধকে ভালোবাসা ভেবে শুধুই এক মরিচীকার পেছনে ছুটেছে নাবিলা।ভালোবাসাটা নাহয় অপ্রকাশিতভাবে আবার চাপা পড়ে যাক কিশোরী বয়সের ভালোলাগার মতো। মনের মাঝে আর দ্বিধা দ্বন্দ্ব না থাকুক তাকে নিয়ে।

_______
#পর্ব_৮

মেঘে ঢাকা শহরে সন্ধ্যা নেমেছে সবে। চারিদিকে কৃত্তিম আলোর আনাগোনা শুরু হয়েছে। নাবিলাদের বাড়িতে সবাই ছোটাছুটিতে ব্যাস্ত। একটু পরই অয়নের পরিবার চলে আসবে। এতোকিছুর মাঝে নির্জীব নাবিলা। তানজিলা এবং মাহি অনেক কিছু করেও ওর মন ভালো করতে পারেনি। নাবিলা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও আদতে সেই হাসির প্রান নেই।

প্রয়াসের চিন্তা মাথা থেকে ঝাড়তে সেই বিকেলের পর নাবিলা তার সামনেও যায়নি একবার। এমনকি প্রয়াসও নাবিলার খোঁজ নেয়নি, যেটা নাবিলাকে আরো বেশি ভুগিয়েছে। বিকেলে হালকা মিষ্টি রঙের বেনারসি শাড়িতে সেজেছে নাবিলা। মাহি এবং তানজিলা সাহায্য করেছে সাজতে।

গোমড়া, ছন্নছাড়া মুখটা মেকাপের ছোয়া পেতেই যেন সতেজ হয়ে উঠেছে। নাবিলা আয়নায় তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, মুখের মেকাপের মতো যদি অন্তরেও মেকাপ দিয়ে সব দুঃখ ঢেকে দেওয়া যেত তাহলে খুব ভালো হতো। পরক্ষনেই ভাবলো, অন্তরের মেকাপ আছে তো! হ্যা আছে। অভিনয়। অন্তরের দহন ঢেকে দিয়ে একজন মানুষকে বাহিরে একদম উৎফুল্ল দেখাতে সাহায্য করে অভিনয়।

রাতে আকদের অনুষ্ঠান হবে বিধায় সন্ধ্যায় অয়নের পরিবার হাজির হয়। অয়ন তখনো আসেনি। একটু পর এসে পড়বে বলে ফোনে জানায়। এর মাঝেই প্রয়াস দুইজন বিদেশি নারী এবং বাচ্চা নিয়ে হাজির হয়। সবাই কৌতুহলী চোখে তাকালে প্রয়াস পরিচয় করিয়ে দেয় তাদের।

‘মনি তোমার সাথে তো জেসির আগেই পরিচয় করিয়েছি। বাকিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ও হচ্ছে জেসি। আমার বান্ধবী। কানাডায় আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি।’

নাবিলা মুখ তুলে একবার দেখে নিলো। লম্বা মুখ, বাদামি এবং কালো মিশেল চুলের একজন সুন্দরী মেয়ে। দেখতে বিদেশি হলেও স্পষ্ট বাংলা বলতে পারে। নাবিলা মনে মনে ভাবলো,

‘সেদিন সকালের সেই মেয়েটা প্রয়াস ভাইয়ার বান্ধবী! অবশ্য পরিবারের সামনে বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে এটাইতো স্বাভাবিক।’

প্রয়াস এবার অপর মহিলার কোল থেকে বাচ্চাটা নিজের কোলে নিয়ে হেসে ইংরেজিতে বললো,

‘তোমার পরিচয় নাহয় তুমি নিজে দাও।’

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। অতঃপর স্পষ্ট ব্রিটিশ ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিলো,

‘আমি এমিলি। অয়নের বাচ্চার মা।’

নাবিলার দাদি নয়নতারা বেগম ছাড়া বাকি সবার মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটেছে কথাটায়। নয়নতারা বেগম ইংরেজি না জানায় এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।

অয়নের মা এগিয়ে এসে বললো,
‘কিসব আজেবাজে কথা বলছো তুমি!’

তারপর নাবিলার বাবা তারেক হোসেন এর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনাদের আত্মীয় আমার ছেলের নামে এসব মিথ্যা কেনো বলছে? আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কি?’

তারেক হোসেন প্রয়াসের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। প্রয়াস যথেষ্ট দায়িত্ববান একজন ছেলে। সে কখনোই মজা করে না। তাই তারেক হোসেন কি বলবে বুঝতে পারলো না।
এমিলি অয়নের মায়ের কথা কিছুই বুঝলো না। সে প্রয়াসের দিকে তাকাতেই প্রয়াস মাথা নেড়ে আস্বস্ত করলো।
এমিলি আবার বলতে লাগলো,

‘অয়ন আর আমি একই ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলাম। তবে পরিচয় ছিলো না। পাঁচ বছর আগে এক কমন ফ্রেন্ডের জন্মদিনে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। সেখান থেকেই ভালোবাসা। এবং প্রায় তিন বছর আমরা লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলাম। পারফেক্ট কাপল যাকে বলে আমরা ঠিক তেমনই ছিলাম। এরপর অয়ন আমাকে বললো তার পক্ষে এই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়।
ওর পরিবার একজন খ্রিস্টান মেয়েকে পুত্রবধূ রুপে মেনে নেবে না উল্টো ওকেও ত্যাজ্যপুত্র করবে। ততদিনে আমাদের ছেলের একবছর হয়েছে। ওর নাম অলিভার। অয়ন বলেছে সে অলিভারের সব দায়িত্ব নেবে, যাবতীয় ব্যয় বহন করবে। কিন্তু আমাদের সাথে থাকবে না এবং আমার সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে সে জড়াতে পারবে না।
এমনিতেও ছেলে হওয়ার পর অয়ন বদলাচ্ছিলো। ওর সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিলো না। তাই অয়ন আমাকে ছেড়ে দেশে চলে আসার পর আমিও মুভ অন করি। নিজের ক্যারিয়ার এবং ছেলেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। অলিভারকে প্রতি মাসেই একটা মোটা অংক পাঠায় অয়ন। কয়েকদিন পর পর ভিডিও কল দিয়ে দুইটা-তিনটা কথা বলে। দ্যাটস ইট।’

এমিলির প্রতিটা কথা বাংলায় বললো প্রয়াস। এতক্ষণে নয়নতারা বেগম সবটা বুঝতে পেরেছে। তিনি ধপ করে সোফায় বসে গেলো। বাকি সবাই এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। অয়নের পরিবার তখনও দমে যায়নি। নিজের ছেলেকে নির্দোষ প্রমান করতে গলায় জোর এনে অয়নের বাবা জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার কাছে কি প্রমান আছে?’

প্রয়াস উত্তর দিলো,
‘আছে।’

প্রয়াস এমিলিকে ইশারা করলো হাতের মোবাইলটা অয়নের বাবাকে দিতে। এমিলিও তাই করলো। দিশা আগে ফোনটা নিয়ে ঘেটে দেখলো। অয়নের সাথে এমিলির কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি, বিশেষ করে এমিলি যখন প্রেগন্যান্ট তখনকার দুজনের বেশ কিছু ছবি আছে। তাতে বোঝাই যাচ্ছে অয়ন বাচ্চাটা নিয়ে এক্সাইটেড। অলিভারকে কোলে নিয়ে আদর করারও বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। এছাড়া ভিডিও চ্যাট, মাসে মাসে টাকা পাঠনো, দেশ বিদেশে ঘুরতে যাওয়াসহ সব প্রমানই মোবাইলে করে রয়েছে।

দিশাকে হতাশ হতে দেখে অয়নের বাবা-মা যা বোঝার বুঝে গেলো। নাবিলা ফোনটা নিয়ে সব ঘেটে দেখলো। ওর খুশি হওয়া উচিৎ নাকি কষ্ট পাওয়া উচিৎ বুঝতে পারলো না। তবে এই মুহূর্তে অয়নকে সামনে পেলে কয়েকটা চড় নিশ্চয়ই বসিয়ে দিতো। প্রমানগুলো দেখলো বসার ঘরে উপস্থিত দুই পরিবারের সবাই। তারেক হোসেন প্রয়াসকে জিজ্ঞেস করলো,

‘এতোসব তুই জানলি কি করে?’

প্র‍য়াস একটু হেসে অলিভারকে কোল থেকে নামালো। এতো অপরিচিত মুখ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে সে। গুটিগুটি পায়ে এমিলির কাছে গিয়ে দাড়ালো অলিভার।

প্রয়াস জেসিকে দেখিয়ে বললো,
‘ওর মাধ্যমে জেনেছি কাকাই।’

‘কিভাবে? তোমরাতো কানাডায় থাকতে আর এমিলি লন্ডনে। তাহলে?’

‘কানাডা থেকে তিনমাস আগে বন্ধুদের সাথে লন্ডন গিয়েছিলাম ছুটি কাটাতে। সেখানে জেসির বড় বোন জিমি থাকে। আমরা লন্ডনে এক দুপুরে তার বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে জিমি আপুর লিভিং স্পেসের দেওয়ালে বেশ কিছু ফটোফ্রেম ছিলো। যার মধ্যে একটাতে আমার নজর আটকে যায়। এমিলি, জিমি এবং অয়নের একটা ফটো। সম্ভবত এমিলির বেবি শাওয়ারে তোলা ছিলো ওটা। এমিলিকে না চিনলেও অয়নের ছবি মনির থেকে আগেই দেখেছিলাম।
জিমি আপুকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি সব বলে দিলেন। জিমি আপুর সাথে এমিলির বেশ ভালো সম্পর্ক হওয়ায় জিমি আপু ওদের ব্যাপারে সব জানতো। অয়নের ব্যাপারে খোজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হলাম যে এমিলির সাথে ওটা অয়নই ছিলো। তারপরই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলাম হাটে হাড়ি ভাঙতে। আরো আগেই সব ফাস করতে পারতাম। কিন্তু আমি এমিলিকে সামনে রেখেই প্রমানসহ সব জানাতে চেয়েছি। জেসি পরশু দেশে এসেছে আর এমিলি আজ দুপুরের পর ল্যান্ড করেছে। তাই দেরি হয়ে গেলো।’

অয়নের বাবাও ভীষণ ক্ষেপে গেছেন ছেলের প্রতি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে ছেলে যে এতোটা নিচে নামবে তা তিনি ভাবতেই পারছেন না। রেগেই ঘড়ি দেখে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,

‘তোমার ছেলে এখনো আসছে না কেনো? আজ এর বিহিত করেই ফিরবো।’

উত্তরটা প্রয়াস দিলো,
‘আপনার ছেলে আসবে না আঙ্কেল। সে কোনোভাবে জেনে গেছে এমিলি এখানে এসেছে। এবং তাকে আমি এনেছি সেটাও। কিছুক্ষণ আগেই আমার ফোনে একটা মেসেজ এসেছে। সেখানে অয়ন স্পষ্টই বলেছে, কাজটা ভালো করলে না।’

ছেলের এহেন অধঃপতনে, অপমানে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে অয়নের পরিবারের। দিশা অলিভারের দিকে তাকালো। একদম অয়নের মতোই চোখমুখ। পিটপিট করে সবাইকে দেখছে।
দিশা এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরতে চাইলে অলিভার মায়ের পেছনে চলে গেলো। সে প্রয়াস এবং মাকে ছাড়া সবাইকে ভয় পাচ্ছে।

ঘটনার আকস্মিকতা মেনে নিতে পারেননি নয়নতারা বেগম। আদরের নাতনিকে সর্বোচ্চ সুখী করতে গিয়ে তার বিপদই ডেকে এনেছিলেন।
নাবিলার জন্য তিনি সারাদিন চিন্তা করে। নাবিলা হালকা শ্যাম বর্ণের হওয়াতে নয়নতারা বেগমের মনে হালকা সংশয় আছে। তার ওপর চশমা পড়তে হয়। কোনোদিন যেনো এইসকল দিক নিয়ে কেউ নাবিলাকে হেয় করতে না পারে তাই তিনি ভাবতেন অয়নের মতো একজন পেলে এবং তার কথায় চললে নাতনি সামাজিক, সাংসারিক সব দিকে এগিয়ে থাকবে। মানুষ খোটা দেওয়ার সুযোগ পাবে না।
কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি নাবিলার মন বুঝতেই ভূলে গিয়েছেন। মেয়েটার ওপর সব চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ ছোটবেলায় দাদিই ছিলো নাবিলার সবথেকে ভালোবাসার মানুষ। তার মতো করে নাতনিকে কেউ বুঝতে পারতো না। স্বামীর শেষ ইচ্ছা লালন করে, সমাজ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কবে যে নাতনির সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে বুঝতেই পারলেন না।

তারেক হোসেনেরও অপরাধবোধ হচ্ছে। ব্যাবসায়ীক বন্ধু বলে তার ছেলে সম্পর্কে খোজ খবর নিতে গাফিলতি করেছেন তিনি। যার ফল এখন হারে হারে টের পাচ্ছেন। বাবার ইচ্ছা এবং নিজেদের বন্ধুত্ব আত্মীয়তায় রূপ দিতে মেয়েটার মতামতকেও অগ্রাহ্য করেছেন। মেয়ের চোখের দিকে তাকাবে কিভাবে সেই মরমে মরে যাচ্ছেন তিনি।

‘দাদি!’

হঠাৎ করেই নাবিলা চিৎকার করে উঠলো। ছুটে দাদির কাছে বসলো। নয়নতারা বেগম বুকের বা দিকে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পরছেন। একের পর এক ঘটনার আকস্মিকতায় নাবিলার পরিবারের সবাই দিশেহারা হয়ে পড়লো। নাবিলা ভয়ে কেদে ফেলেছে। প্রয়াস ছুটে এসে নয়নতারা বেগমকে কোলে তুলে নিতে নিতে নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘কান্নার সময় নয় এখন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। অ্যাম্বুল্যান্সে ফোন দিয়ে আনতে অনেক সময় চলে যাবে। তার থেকে আমার গাড়িতে নিয়ে যাই। চল আমার সাথে।’

নাবিলাসহ ওর পুরো পরিবার প্রয়াসের পেছনে ছুটলো। উদ্দেশ্য হাসপাতাল।

_______
#পর্ব_৯

হাসপাতালের করিডোর ধরে পায়চারি করছে প্রয়াস। নয়নতারা বেগম হার্ট অ্যাটাক করেছেন। নিশুতি গভীর হয়ে মাঝ পথে এসেছে। নয়নতারা বেগমের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। হাসপাতালে এখন নাবিলা, প্রয়াস এবং তারেক হোসেন এবং সায়মা বেগম রয়েছে। তারেক হোসেন গেছেন ডাক্তারের সাথে।

শত বলেও নাবিলা এবং মনিকে বাড়িতে পাঠাতে পারেনি প্রয়াস। একটার পর একটা ধকল সইতে না পেরে পুরো পরিবার নেতিয়ে গেছে। প্রয়াস ধীর পায়ে হেটে সায়মা বেগমের পাশে বসলো। সায়মা বেগম এতক্ষন কাদার ফলে এখন কিছুটা ফোপাঁচ্ছে। প্রয়াস সায়মা বেগমের ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

‘আমি দেরি করে ফেলেছি তাই না মনি! আমার আরো আগে সব জানানো উচিৎ ছিলো। তাহলে হয়তো দাদি এভাবে কষ্ট পেতো না।’

সায়মা বেগম কিছুক্ষন চুপ রইলো। তারপর লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,

‘তোর কোনো দোষ নেই বাবা। মা একটু বেশি আশা করে ফেলেছিলো। তাই নিরাশা মেনে নিতে পারেনি। সারাজীবন নাতনির জন্য তিনি সেরাটাই করেছে। তাই ভেবেছে এবার ও সেরাটাই হবে। ভুল করে নাবিলার ক্ষতি করতে যাচ্ছিলো এটা তিনি মানতে পারেননি। সেই মনঃকষ্ট থেকেই এই অবস্থা।’

‘আমাকে ক্ষমা করে দিও। সব জেনেও অভিনয় করে গেছি সবার সাথে।’

‘ধুর বোকা ছেলে। নিজেকে ছোট ভাবিস না। । আমার মেয়ের জীবন রক্ষা হয়েছে তোর সাহায্য। তুই যে কত বড় একটা উপকার করলি। একদম তোর মায়ের মতোই হয়েছিস। একবার তোর মা আমার মেয়েকে বাচালো, এবার তুই বিপদ থেকে রক্ষা করলি।’

কথাটা শুনে দুই চেয়ার পরে বসে থাকা নাবিলাও কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো।
নাবিলা প্রশ্ন করলো,

‘ মামনি কি করেছিলো মা?’

সায়মা বেগম সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই প্রয়াস বললো,

‘চোখে কি হয়েছে তোর?’

প্রয়াসের কথায় সায়মা বেগম নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলার চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে।

‘আসলে লেন্সটা খোচাচ্ছে। অনেকক্ষন ধরে পড়ে আছি তাই..’

নাবিলা কথা শেষ করতে পারলো না। সায়মা বেগম এবং প্রয়াস দুজনেই রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।

‘কতটা কেয়ারলেস হলে এমন কথা বলে কেউ! এক্ষুনি খোল বলছি।’
রেগে বললো প্রয়াস। এর পর সায়মা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘মনি আমায় অনুমতি দাও। বাড়ি গিয়ে ওর সব লেন্স জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলবো আমি। এমন কেয়ারলেসদের জন্য লেন্স নয়। অন্ধ হয়ে বসে থাকবে।’

নাবিলা চুপসে গেলো একেবারে। হসপিটালের ওয়াশরুমে গিয়ে কোনোমতে লেন্সটা খুলে ফেললো। তারপর অয়নকে কয়েকটা গালি দিয়ে লেন্স জোড়া ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। চোখে বেশ কয়েকবার পানির ঝাপটা দেওয়ার পর কিছুটা আরাম বোধ করলো।

তারেক হোসেন এসে জানালো নয়নতারা বেগম এখন আশঙ্কা মুক্ত। সবাই চিন্তা মুক্ত হলো। তিনি নাবিলা এবং সায়মা বেগমকে চলে যেতে বললে সায়মা বেগম বাধা দিয়ে বললো,

‘প্রয়াস বরং নাবিলাকে নিয়ে চলে যাক। মাকে সুস্থ না দেখে আমি যেতে পারবো না।’

তারেক হোসেন সহমত পোষণ করলেন। প্রয়াসের বাধ্য হয়ে রাজি হতে হলো। নাবিলার চোখের যত্ন এবং বিশ্রাম প্রয়োজন। চোখ লাল হয়ে আছে। প্রয়াস মনি ও কাকাই এর জন্য খাবার কিনে দিলো। যাওয়ার সময় সায়মা বেগম নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘যা হয়েছে ভুলে যাও। তোমার জীবনে আর কেউ কোনোকিছু চাপিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করবে না। দাদিকে নিয়ে ভেবো না। তিনি খুব জলদিই সুস্থ হয়ে যাবে। দুই ভাইবোন বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিও।’

‘ভাই-বোন’! প্রয়াসের হঠাৎ কাশি উঠে গেলো। নাবিলা ভ্রু তাকালো। প্রয়াস কোনোমতে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। প্রয়াস নাবিলার উপকার করলেও নাবিলার মেঘ ঘনানো আকাশ ভেদ করতে পারেনি। ওর মনের হাজারটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে। যার সবটাই প্রয়াস এবং জেসিকে নিয়ে।

‘প্রথমত, প্রয়াস ভাইয়া যদি সত্যি বলে থাকে জেসি তার বান্ধবী, তাহলে জরিয়ে ধরলো কেনো? প্রয়াস ভাইয়াতো এমন নয়। নাবিলাকেও হালকাভাবে একহাতে ধরেছিলো মাত্র। সেখানে জেসিকে একদম…

দ্বিতীয়ত, জেসি যদি বন্ধুই হবে তাহলে সেদিন কেনো বললো জেসি তার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশির কারন?’

নাবিলা মনে মনে চাইছে ওর ধারনা যেনো মিথ্যা হয়। জেসি যেনো শুধুই বন্ধু হয়। এখনতো অয়ন নামের কাটাটাও নেই।

‘কি হলো? কি ভাবছিস এতো?’

প্রয়াসের ডাকে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো নাবিলা। নিজেকে সামলে বললো,

‘জেসি আপু তোমার কি হয় ভাইয়া?’

প্রয়াস এমন প্রশ্নে অদ্ভুত হাসলো।
‘কেনো? বলেছিতো বান্ধবী হয়। ‘

‘শুধুই বান্ধবী?’

‘না খুব কাছের বান্ধবী। ও আমার জন্য খুব লাকি বুঝলি।’

‘বুঝলাম।’
ভাঙা গলায় উত্তর দিলো নাবিলা। শেষ আশাটা বুঝি ডুবতে বসেছে। সরাসরি জিজ্ঞেসও করতে পারছে না প্রেমের কথাটা নিয়ে। কিন্তু সংকোচ রেখে লাভটা কি?

‘উনি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?’

প্রয়াস নিঃশব্দে হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। নাবিলা কিছুক্ষন উত্তরের আশায় প্রয়াসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রয়াসের পুরো মনোযোগ ড্রাইভিংয়ে। যখন বুঝলো প্রয়াস ওর প্রশ্নের উত্তর দেবে না তখন হতাশ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসলো নাবিলা।

‘তোর হাটুর নিচের সেলাইয়ের দাগটা কি মিলিয়ে গেছে?’

‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ নাবিলা যেন আকাশ থেকে পড়লো।

‘সেলাইটা কি জন্য পড়েছিলো জানিস?’

‘হ্যা। মা বলেছে ছোটবেলায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো আমার। আবছা মনে আছে। হাটুর নিচে গভীরভাবে কেটেছিল তাই সেলাই পড়েছে।’

‘তোর তখন চার বছর বয়স। ভীষণ দুষ্ট ছিলি। সুযোগ পেলেই সবার চোখ ফাকি দিয়ে মেইন রোডে চলে যেতিস। গাড়ি চলা, হর্ন এর শব্দ, রাস্তার পাশের মামাদের নানা রকম খাবারের দোকান সব তোকে অাকৃষ্ট করতো। তাই সবসময় দাদি তোর পাশে পাশে থাকতো।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরতেই শুনি তুই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস। দাদির ঘুমে চোখ লেগে যাওয়ায় সবার চোখ ফাকি দিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়েছিলি। বাইকের সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশের রড হাটুর কাছটায় ঢুকে গেছিলো। তোর খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে রক্তাক্ত তোকে দেখে মনি সাথে সাথেই মূর্ছা যায়। দাদি তো পুরো এলাকা জড়ো করে ফেলেছিলো চিৎকার করে।
দাদু, দাদি, কাকাই, মনি সবাই হাসপাতালে ছোটে। আমিও স্কুল থেকে ফিরে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি দাদি পাগলের মতো কাদছে সবার সামনে। তোর শরীর থেকে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। যার ফলে রক্ত দিতে হবে।
একমাত্র দাদির সাথেই তোর রক্তের গ্রুপ মিল ছিলো। এবি নেগেটিভ। হাসপাতালে সেই মূহুর্তে এই গ্রুপের রক্ত ছিলো না। যোগার করতে অনেক সময় লেগে যাবে। দাদি পাগলের মতো চিৎকার করে বলছিলো আমার রক্ত নাও। আমার দাদুটাকে বাচিঁয়ে দাও। কিন্তু দাদির রক্ত নেওয়া সম্ভব ছিলো না। কারন তার কিছুদিন আগেই দাদির কাধে একটা টিউমার অপারেশন হয়েছিলো। যার ফলে তিনি প্রচন্ড দুর্বল ছিলেন।
কাকাই যেখানে পারছিলো দৌড়াচ্ছিলো। আত্মীদের কারো রক্তের গ্রুপ মিলে গেলেও দিতে রাজি হচ্ছিলো না। বাহানা দিচ্ছিলো। তোর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো ক্রমশ। তা দেখে দাদি ছুড়ি দিয়ে ডাক্তারকে শাসায় তার রক্ত নিতে। সেই মুহূর্তে দাদিকে দেখে যে কেউ বদ্ধ উন্মাদ ভাবতো। আমি নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই দিশেহারা অবস্থা থেকে সবাইকে উদ্ধার করে আমার মা। মানে তোর মামনি।’

‘মামনি!’
নাবিলার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

‘হ্যা মা। মা টিচার ছিলো সেটা তো জানিস। তাকে খবর দেওয়ার কথা কারো মাথায়ও আসেনি। মায়ের রক্তের গ্রুপও জানতো না কেউ। সেদিন টিচার্স মিটিং শেষে বাড়ি ফিরতে মায়ের সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। তোর খবর শুনে হাসপাতালে এসে দাদিকে শান্ত করে বলে তিনি রক্ত দেবে। মায়ের রক্তের গ্রুপও তোর সাথে মিল ছিলো।
এরপর দীর্ঘ একমাস লেগেছে ক্ষত সারতে। আর ছয় মাস পর্যন্ত দাদি তোকে হাটতে পর্যন্ত দেয়নি। কোলে করে সব যায়গায় নিয়ে যেত। দাদির হাটুর ব্যাথা এমনি এমনি হয়নি। ওটার কারন তুই। তোদের ভালোবাসা দেখলে আমারই হিংসা হতো, কেনো আমার আমার একটা দাদি নেই। কিন্তু দাদি আমাকেও খুব ভালোবাসতেন। যদিও তোর থেকে কম।’

গাড়িটা বাড়ির সামনে থামতেই প্রয়াস নাবিলার দিকে তাকালো মুখ চেপে কাদছে মেয়েটা। বাড়িতে ঢোকার পর প্রয়াস বললো,

‘দাদি মানুষটা খুবই সরল।তোর কোনো ভাই নেই বলে কি দাদিকে কোনোদিন আফসোস করতে দেখেছিস?’

নাবিলা ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। দেখেনি।

‘দাদু মারা যাবার পর দাদি তোকেই আকড়ে ধরে বেঁচে আছে। ভীষণ ভালোবাসে তোকে। মাঝে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিলো শুধু। তাইতো আজকে তোকে ভুল মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার অনুসূচনায় হাসপাতালে শুয়ে আছে। কাকাইও কম অনুসূচনায় ভুগছে না। খেয়াল করবি তোর চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। এইবাড়ির প্রতিটা মানুষের এক বুক ভালোবাসা তুই। তাই কারো ওপর রাগ করে থাকিস না। মানছি ওদের কিছুটা ভুল ছিলো। কিন্তু বিয়েটা তো হয়ে যায়নি। ছোট থেকে যারা তোর হাজারটা ভুল ক্ষমা করেছে তাদের একটা ভুল নাহয় তুইও ভুলে গেলি। পারবিনা?’

‘পারবো।’

‘এবার মুখটা ধুয়ে আয়। মেকাপ, কাজল লেপ্টে এতোদিনে সত্যিকারের পেত্নী লাগছে। যা ভাগ। বিয়ের আগে মরতে চাই না এই মুখ দেখে।’

নাবিলা মুখ বেকিয়ে রুমে গেলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঝাপসা দেখলো। তবুও বুঝলো সত্যিই ভুতের মতো লাগছে। তারাতাড়ি ফ্রেস হয়ে নামতেই প্রয়াস ওর চোখে চশমা ঠেলে দিলো। এটারই অভাববোধ করছিলো এতোক্ষন। হাসপাতাল থেকে আসার আগেই লেন্স খুলে ফেলেছিলো। সবই ঝাপসা দেখেছে পুরোটা সময়।
টেবিলে তাকিয়ে দেখলো প্রয়াস নিজেই খাবার গরম করে সাজিয়ে ফেলেছে। খাবার খাওয়ার পর যাওয়ার সময় প্রয়াস কন্টাক্ট লেন্স এর খুটিনাটি যা আছে সব নাবিলার ঘর থেকে নিয়ে গেলো।

দরজা আটকে দিয়ে শুতে যাওয়ার আগে একটা ভাবনা মাথায় এলো নাবিলার। বিড়বিড় করে বললো,

‘অয়ন এতো সহজে সরে যাবে আমার জীবন থেকে? ও কি মেনে নেবে এমিলি আর অলিভারকে? নাকি আবার কোনো ঝামেলা বাধাবে?’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here