এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-২৯
লেখিকা_মালিহা_খান❤️
বিশাল উঠানজুড়ে সবুজ দূর্বা ঘাস লাগানো আছে।নিয়মিত পরিচর্যার কারণে সব জায়গায় একেবারে সমানে সমান করে কাঁটা।একটু উঁচু নিচু নেই।নরম ঘাসের উপর নগ্ন পায়ের স্পর্শ লাগলে মনে হয় কোনো পশমি কার্পেটের উপর নির্বিঘ্ন পদচারণ চলছে।একটা কোঁণে পর পর দু তিনটা শিউলি ফুলের বড় আকারের গাছ।নিচে বিছিয়ে থাকা সাদা সাদা ফুলগুলো তাজা নয়।ভোরের দিকেই সেগুলো গাছ থেকে ঝড়ো পরেছে বিধায় তাদের সুরভী ভাবটা এখন আর নেই।কেমন যেন মিইয়ে চুপসে গেছে।
খালিপায়ে একপা দু’পা করে সেদিকটায় এগিয়ে গেলো তোহা।ঝুঁকে গিয়ে কতকগুলো ফুল হাতে উঠিয়ে ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করলো।তীব্র সুঘ্রাণ না আসলেও হাল্কা হাল্কা আসছে।
—“জুতো ফেলে খালিপায়ে ঘুরছিস কেনো?পায়ে বিঁধে যাবেতো কিছু একটা।”
কথাটা শোনামাত্র সচকিত হয়ে পিছে ফিরলো তোহা।তিহানের মুখ দেখার আগে তার নজর গেলো তিহানের হাতের দিকে।তার খুলে রেখে আসা জুতোজোড়া হাতে নিয়ে সটান দাড়িয়ে আছে তিহান।শীতল দৃষ্টি তোহার ফুলভর্তি হাতের মধ্য।
তোহা মুখফুঁটে কিছু বলার আগেই এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পরলো তিহান।একহাতে জুতো নিয়ে আরেকহাত তোহার পায়ের দিকে বাড়াতেই আপনাআপনিই দুই কদম পিছিয়ে গেলো তোহা।মাটিতে পরে থাকা কয়েকটা শিউলি ফুল পদতলে পিষ্ট হয়ে পায়ের সাথে বিশ্রি ভাবে লেপ্টে গেলো।সেদিকে খেয়াল দিলোনা তোহা।তিহানের দিকে চেয়ে সপ্রতিভ কন্ঠে বললো,
—“পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?”
—“জুতো পরাবো।ইডিয়ট।পা’টা আগে আন।”দাঁতে দাঁতে চেপে উওর দিলো তিহান।
তোহার মধ্য পা এগিয়ে দেয়ার কোন উদ্বেগ দেখা গেলোনা।গলার স্বর নামিয়ে উষখুষ করে সে বললো,
—“আমি পরবোনা জুতো।এভাবেই ভালো লাগছে।”
কিছুক্ষন চুপ থাকলো তিহান।অহেতুক মাথাচাড়া দেয়া রাগটাকে সামলে একটু নরম হলো সে।মুখের কাঠিন্য কমিয়ে কোমলকন্ঠে বলল,
—“খালিপায়ে ঘুরে বেরানোর কোনো মানে আছে তিহু?কাঁটা মাটা বিঁধে গেলেতো তুই ই ব্যাথা পাবি।তোর হাতে ফুল,আমি পরিয়ে দেই।”বলেই তোহার পা রাখার জন্য হাতের তালু মেলে দিলো সে।
তোহা পা বাড়ালোনা।তিহানের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তার হাতের উপর পা রাখতেই কেমন একটা ইততস্ত বোধ হচ্ছে।উপায় না পেয়ে হাতের ভুলগুলা ফেলে দিতে উদ্যত হয়ে বললো,
—“আমি পরে নিচ্ছি।”
—“তোমাকে ফুল ফেলতে বলেছি আমি?পা দাও।”
রাশভারি কন্ঠের ধমকিয় আদেশে থেমে যেতে হলো তোহাকে।হাতের ফুলগুলো হাতেই রয়ে গেলো।চুপচাপ ডানপাটা তিহানের হাতের উপর রাখলো সে।প্রথমেই জুতো পরালোনা তিহান।পকেট থেকে রুমাল বের করে পায়ের তালুতে পিষ্ট হয়ে লেগে থাকা ফুলগুলো মুছে পরিষ্কার করে তারপর জুতো পরিয়ে দিলো।জুতো টায় ফিতা আটকাতে হয় তাই নিজে নিজে পা ঢুকিয়ে পরার অবকাশ নেই।হাত দিয়েই পরতে হয়।
কাজ শেষ হতেই দ্রুত পা সরিয়ে নিলো তোহা।উঠোনের একপাশে বড় একটা কাঁঠাল গাছ আছে।যদিও এখন কাঁঠাল নেই তবে গ্রীষ্মের সময় গাছ ভরে উঠে।
সেই কাঁঠাল গাছের বিস্তৃত ডালপালার নিচে রোদের তেজ পৌছাতে পারেনা।সেখানে ইট সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা বানানো আছে।লাল রংয়ের রং করা বসার সিট বিধায় বেশ দৃষ্টিনন্দন।
সেখানেই বসে আছে বাকি কাজিনরা।যদিও তাদের নজর এদিকে আসার সুযোগ নেই।কারণ এপাশে পিঠ দিয়ে বসেছে সবাই।তবুও কেমন একটা অদ্ভুত ভয় লাগে তোহার।যদি কেউ দেখে ফেলতো কি লজ্জায়ই না পরতো সে।
_______________
গ্রামের দিকটায় গাঢ় সন্ধ্যা হলেই নিরবতা নেমে আছে।সুনসান প্রকৃতির মাঝে ঝিঁ ঝিঁ পোকার এলোপাথারি ডাক।আলো না থাকলেই কেমন ভুঁতুরে পরিবেশ।সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়ায় কেমন ঝিঁমানো অনুভূতি।সারাদিন হইহুল্লোর করায় গতকাল অনেকটা সন্ধ্যার দিকেই ঘুমিয়ে পরেছিলো তোহা।রাতের খাবারো খায়নি।
তথাপি ক্ষুধার জ্বালায় পেটে মোচর দেয়ায় আর আগেভাগে ঘুমানোর ফলে খুব ভোরবেলাই ঘুম ভেঙে গেলো তার।মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে।মেজমেজে লাগছে শরীর।শিরায় উপশিরায় আড়ষ্টভাব।
তার পাশে স্বর্ণালী ঘুমাচ্ছে।ঘুমানোর সময় অবশ্য সে একাই শুয়েছিলো।স্বর্ণালী বোধহয় রাতের বেলা এসেছে।
দু’হাত দুদিকে মেলে টানা দিয়ে উঠে বসলো তোহা।মুখে হাত ডলতেই বুঝলো তৈলাক্ত হয়ে আছে ত্বক।একটা হাই তুলে বিছানা থেকে নামলো সে।লাইট জ্বালাতে যেয়েও জ্বালালোনা।স্বর্নালির ঘুমে অযথা ডিস্টার্ব করে লাভ নেই।
ওয়াশরুমে যেয়ে মুখ হাত ধুলো।গায়ে তখনো কালকের সবুজ জামাটাই।ঘুমানোর আগে আর বদলানো হয়নি।
ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আস্তে করে রুমের দরজা খুললো তোহা।বাড়ির সবাই ঘুম।মুখ ঘুরিয়ে বড় বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো এখনো সব স্পষ্ট নয়।ধোঁয়াটে সাদা ভাব।একটু এগোলো সে।ছোট থেকেই শুনে এসেছে শিউলি ফুল রাতে ফোঁটে আর ভোরে ঝরে যায়।তবে শহরে থাকার দরুন চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়নি কখনো।এতদিনের সুপ্ত বাসনার কৌতুহল দমাতে না পেরে সিঁড়ি ভেঙে ধীরপায়ে নিচে নেমে গেলো তোহা।
অত:পর নরম ঘাস মাড়িয়ে উঠোনে উপস্থিত হতেই সেখানে সাদা পাতলা টি-শার্ট পরিহিত তিহানকে দেখে রীতিমত চমকে উঠলো সে।অষ্পষ্ট স্বরে আপনাআপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
—“আপনি এখানে..?”
কথাটা খুব আস্তে বললেও চারদিকের নিস্তব্ধতার ভীড়ে তা তিহানের কানে যেতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা।সাথেসাথেই ফিরে তাকালো তিহান।তোহাকে দেখে অনেকটা অবাকভাব মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠলেও পরমূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে আবারো আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলো সে।সেদিকে তাকিয়েই কন্ঠে গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,
—“কাছে আসো।”
তোহার গোছানো দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেলো মূহুর্তেই।শূন্যমস্তিষ্কে মাথায় হাল্কা সবুজ রংয়ের ওড়নাটা টেনে নিয়ে আস্তে করে তিহানের পাশে যেয়ে দাড়ালো সে।সে দাড়াতেই পেছন দিয়ে বাহু জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো তিহান।অপ্রস্তুত হয়ে পরলো তোহা।বিচলিত কন্ঠে বললো,
—“কি করছেন?কেউ..”
—“কেউ নেই এখানে।”তিহানের কাঠ কাঠ উওর।
হঠাৎই বাকশূন্য হয়ে গেলো তোহা।শিউলি ফুলের তীব্র সুঘ্রাণে চারিপাশ ম ম করছে।ফুলেল সুবাস সাথে প্রেমিকের উষ্ণ আবেগী ছোঁয়ায় মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে।মনে হচ্ছে এখনি মূর্ছা যাবে সে।
—“এত ভোরে উঠেছো যে?কালরাতে তো খাওনি,ক্ষুধা পেয়েছে?”
কিছুক্ষন আমতা আমতা করলো তোহা।অত:পর একটু থেমে থেমে বোকাকন্ঠে উওর দিলো,
—“আমি আসলে ফুল দেখতে এসেছিলাম।”
—“ফুল?”
—“ওইযে শিউলি ফুল..”হাতের তর্জনী উচিয়ে ইশারা করলো তোহা।তার ইশারা অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো তিহান।মাটিতে চাদরের ন্যায় বিছিয়ে থাকা শিউলি ফুলগুলো দেখতেই ঠোঁটের কোঁণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার।তোহা সমেত সেখানটায় গিয়ে দাড়ালো সে।তোহাকে ছেড়ে দুহাতের মুঠোয় ভর্তি ফুল নিয়ে তোহার হাতের আজলা ভরে দিলো।কেনো যেনো এতগুলো তাজা সৌরভী ফুল দেখে তোহার মনের কোঁণে নিভিয়ে থাকা বাচ্চাসূলভ মনটা জেগে উঠলো।খুশিতে লাফিয়ে উঠে নেহাতই ছেলেমানুষি কন্ঠে সে বললো,
—“দেখেছেন,কি সুন্দর!”
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো তিহান।মেয়েটা অল্পতেই বাঁধভাঙা খুশিতে ফেটে পরে।তার আগে থেকেই জানা আছে।
উঠে দাড়ালো সে।আচমকাই তোহার মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে কানে একটা ফুল গুঁজলো।তারপর আরো একটা অত:পর আরো আরেকটা।মোটমাট তিনটে ফুল।তোহার অস্থিরতায় ভরপুর দৃষ্টি মেঝের দিকে।
তিহানের ঠোঁটে তখন ধীর কন্ঠে গান চলছে,
বাতাসে ঠোঁট উড়িয়ে দিলাম তাকালে তুই ঘুরে
আমার মন তাই কান ধরে আর গান ধরে বেসুরে
বায়নাগুলো আয়না সেজে বুকের ঠোট্ট তিলে
যেভাবে জল কামান চলে মোমবাতি মিছিলে
তেষ্টাভেজা বালির দেশে ছুঁলি যখন জল
বৃষ্টি ভরা মেঘ ঝরিয়ে আমার হবি বল
এ কোন ভোরে শিউলি ফোটায়
দোরে কড়া নেড়ে বলে যায়
হারিয়ে যাব চলে আয়
~
জমা অভিমান,পড়ে ফেলা বই
মনে রেখো মুখ ফুটে বলনি তো কই
হেঁটে চলে কেউ,পথে অবরোধ
ভেজা জামা ভালবাসে দুপুরের রোদ
রঙ মুছে তুলি যদি সাদাকালো হয়
মুখে হাসি রাখা মানে ভালো থাকা নয়
তেষ্টাভেজা বালির দেশে ছুঁলি যখন জল
বৃষ্টি ভরা মেঘ ঝরিয়ে আমার হবি বল
এ কোন ভোরে শিউলি ফোটায়…
[Shiuli(শিউলি)-Rishi panda]
এটুকু গেয়েই থামলো তিহান।সামনে থাকা প্রেমিকার লজ্জারাঙা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট আর একরত্তিও চললো না তার।এই রূপ সহ্য করার মতো নয়।শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম তবুও চোখ ফেরাতে মন সাঁয় দেয় না।অগত্যা তিহান শুধু দেখেই গেলো,দেখেই গেলো এবং দেখেই গেলো।
~চলবে~