এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৩৪

এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৩৪
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

আংটি পরানো শেষ হতেই মিষ্টিমুখ করলো সবাই।এদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সবাই ই জানতো এংগেজমেন্টের বিষয়টা।শুধু তোহা ছাড়া।
তোহার অবস্থা তখন শোচনীয়।প্রচন্ড লজ্জায় চোখ তুলতে পারছেনা সে।কেমন একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতি।এই সব যে এই পাশে বসা লোকটার কারসাজি তা বুঝতে একরত্তি অসুবিধা হলোনা।গতকাল রাতে বাবার কথাগুলো শুনে সে কিছুটা আন্দাজ অবশ্য করেছিলো।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি “বাগদান” হয়ে যাবে কস্মিককালেও ভাবনায় আসেনি।
নিজাম রহমানের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা হাসির ঝলকানিতে।লোকটার খুশি যেনো উপচে পরছে।

আফিয়ার পর তিহানের বাবা আমজাদ সাহেব তোহার মুখে একটু খানি মিষ্টি তুলে দিলেন।অপরহাত মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—“বিয়েটা হবে তোমার উচ্চমাধ্যমিকের পরে।তিহান কিছুতেই তোমার পরীক্ষার আগে বিয়ের ঝামেলা চাচ্ছেনা।বুঝলে?”

তোহা তাকালোনা।হাল্কা মাথা নাড়ালো শুধু।এখনো কেউ তাকে এখান থেকে যেতে বলছেনা কেনো?ও আল্লাহ!

খানিক বাদেই তিহানের ইশারায় তোহাকে রুমে দিয়ে গেলো আফিয়া।সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার তাদের মধ্যেকার বিষয়টা নিয়ে কেও তাকে চেতাচ্ছেনা পর্যন্ত।নুহাশ,সাইফ,তূর্য এমনকি স্বর্ণালিও স্বাভাবিক।যেনো তাদের কড়া আদেশ দেয়া হয়েছে যাতে তোহাকে কোনরকম বিরক্ত না করা হয়,লজ্জা অসস্তিতে না ফেলা হয়।
_____________

বিছানার বামকাত হয়ে ফিরে শুয়ে আছে তোহা।চোখে ঘুমের ছিঁটেফোটাও নেই।ঘরের নীলরঙা ডিমলাইটের মৃদু আলোয় হাতের অনামিকা আঙ্গুলে জলজল করছে আংটিটা।হাতটা চোখের সামনে মেলে ধরে আংটিটার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে সেই বিশেষ মূহুর্তটা স্বতিচারণ করার চেষ্টা করছে সে।চোখের কোঁণে এখনও চিকচিক করছে আবেগী জ্বল।
এই আংটিটা আসলেই তিহান পরিয়ে দিয়েছে তাকে?হঠাৎ করেই কিভাবে তাদের সুপ্ত অপ্রকাশিত প্রণয়টা সবার কাছে প্রকাশ পেয়ে গেলো?শুধু প্রকাশ না একেবারে পূর্ণতা পাওয়ার প্রথম ধাপটাও পেরিয়ে ফেললো নিমিষেই।
জীবন কি এতই সহজ?সবকিছু কি এতটাই বাঁধাহীন?কারো জন্য হ্যাঁ।আবার কারো জন্য হয়তো “না”।
তবে এই লোকটা বোধহয় তার জীবনে কখনো বাঁধা-নিষেধ,চড়াই উতরাই সৃষ্টি হতে দিবে না।নিজের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও প্রশস্ত বুকটার নিচে তাকে আগলে রাখবে সবসময়।
ফোনের ভাইব্রেশনের কাঁপুনিতে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো তোহার।ভ্রু কুঁচকে বালিশের পাশ হাতরালো সে।ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রীনে “তিহান ভাই” নামটা চোখে পরতেই ভেতরটা একটু কেঁপে উঠলো বোধহয়।কিছুক্ষন রিং হতেই কেটে গেলো ফোনটা।ভাইব্রেশনের কাঁপুনিটা থেমে যেতেই সম্ভিৎ ফিরে পেলো তোহা।জিভে কামড় দিয়ে তৎক্ষনাত ধরফরিয়ে উঠে বসলো।সেকেন্ড পেরিয়ে যেতেই আবারো স্বউদ্যমে ফোনটা ভাইব্রেশনের হতে শুরু করলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রিসিভ করলো তোহা।এখন নিশ্চিত একটা রামধমক খাবে।ফোন রিসিভ করে “সরি” বলার আগেই ওপাশ থেকে তিহান গুরুগম্ভীর শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
—“বাইরে আসো।”

কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ হয়ে রইলো তোহা।অত:পর গলা খাদে নামিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
—“জি?”

ওপাশ থেকে তপ্ত নি:শ্বাসের আওয়াজ শোনা গেলো শুধু।তোহা পাল্টা কিছু বলার সাহস পেলোনা আর।ঘুমন্ত স্বর্ণালিকে একবার পরখ করে নিয়ে বিছানা নামতে নামতে মিনমিন করে বললো,
—“আসছি”।

সে “আসছি” বলতেই ফোনটা কেটে গেলো অপরপাশ থেকে।ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা বিছানায় রেখে এলোমেলো চুলগুলো হাতখোঁপা করে নিলো তোহা।মাথায় ওড়না চাপিয়ে নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো দরজা খুলে।

বারান্দায় তখন ঠান্ডা শীতল মনমাতানো বাতাস।বাতাসের প্রথম দমকা টা উষ্ম শরীর ছুঁয়ে যেতেই গায়ের লোমগুলো শিরশির করে দাড়িয়ে পরলো।এদিক ওদিক তাকিয়ে রেলিং ধরে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা তিহানকে দেখতে পেলো তোহা।সুতির সাদা ওড়নাটা আষ্টেপিষ্টে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তিহানের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো।তার উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে দাড়ালো তিহান।ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তোহার সারামুখে দৃষ্টি ঘুরালো বেশ অনেকক্ষন।তোহার নত দৃষ্টিতে একঝাঁক প্রশ্ন উপচে পরছে।এই রাতের বেলা ডেকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো লোকটা?শেষমেষ প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুললো তোহা।বললো,

—“আপনি এতরাতে..”

—“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো সেজন্য ডেকেছি।”তোহার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই উওর দিলো তিহান।
তোহা একপলক তাকালো।মূহুর্তেই ঠোঁট চেপে ক্ষীণ হাসলো।তিহানের চোখ আটকে রইলো সেই হাসিতে।
“খট”করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠলো তোহা।তবে কি কেউ আসছে এদিকটায়?তাদের একসাথে দেখে ফেললে কি হবে?”
তোহার অস্থির দৃষ্টি দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তিহান।
—“কেউ আসছেনা।বাতাসের ধাক্কায় হয়তো শব্দ হয়েছে কিছুতে।এত ভয় পাও কেনো?”

তোহার মধ্য কোন পরিবর্তন দেখা গেলোনা।সে ভীত দৃষ্টি বারান্দার ওপাশে চেয়ে রইলো।হাঁফ ছাড়লো তিহান।
তোহার হাত টেনে ধরে সামনে এগোতে নিলেই তোহা সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

—“তুমি যে হারে ভয় পাচ্ছো।আমি একটু মন ভরে দেখার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।”

—“আপনি মজা নিচ্ছেন?”

তিহান সরু চোখে তাকালো।তোহার কথাটা তোয়াক্কা না করে চুপচাপ ছাদের সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে লাগলো।
______________
ছাদভর্তি চাঁদের আলো।পাশের একটা ছোট্ট টব থেকে বেলি ফুলের তীব্র ঘ্রান নাকে এসে ঠেকছে।মাথা ঝিমঝিম করছো তোহার।তিহান দাড়িয়ে আছে মুখোমুখি।আংটি পরানো হাতের চার আঙ্গুলের অগ্রভাগ আলতো করে ধরে ঠোঁটের কোঁণে ক্ষীণ হাসি নিয়ে একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে বিরতিহীন ভাবে।যেন সেখানেই তার গোটা জীবনের সব সুখ এসে ভর করেছে।
একপর্যায়ে ধৈর্যহারা হয়ে পরলো তোহা।বললো,

—“এতো কি দেখছেন?”

তিহান মুখ তুলে তাকালো।আবার মাথা নামিয়ে আংটিটায় বৃদ্ধাআঙ্গুল বুলিয়ে বললো,
—“সুন্দর লাগছে।তাইনা?”

তিহানের খেই হারানো কথাবার্তায় হেসে ফেললো তোহা।একটু পর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে হাসি থামিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
—“আপনি কি এখন থেকে সবসময় “তুমি” করে ডাকবেন?”

তোহার বাহু ধরে কাছে টেনে নিলো তিহান।হাতের উল্টোপিঠ গালে ছুইয়ে দিয়ে ভ্রু উচিয়ে বললো,
—“ডাকা তো উচিত।আমার অধিকার আছে।”

তোহা উওর দিলোনা।তার মুখে চিন্তার প্রখর ছাপ স্পষ্ট।এই লোকের মাঝেমধ্য একান্তে ডাকা”তুমি” ডাকেই লজ্জায় শেষ হয়ে যায় সে আর সবসময় সবার সামনে ডাকলেতো আর চোখ মেলানোর অবকাশ থাকবেনা।

—“নাহ্ ডাকবোনা।বিয়ের পর ডাকবো।নয়তো আমার “তুমি” ডাকটায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে তুমি।তখন “তুমি”ডাকার পরমূহুর্তেই তোমার লজ্জারাঙা আরক্তিম চেহারাটা আর দেখতে পাবোনা।তা কি হয় বলো?”

কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাহেন্দ্রক্ষণ।তিহানের ধূসর রংয়ের সম্মোহিত দৃষ্টি তখন তোহার গভীর কালো চোখে।লোকটার মধ্য কোন সংকোচ নেই।

—“নিচে নামবেন না?অনেক রাত হয়ে গেছে।”আস্তে করে বললো তোহা।

তিহান সে প্রসঙ্গে কোন উওর দিলোনা।আচমকা তোহার বাম চোখের পাতায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো তোহা।চোখ বন্ধ অবস্থাতেই তাড়াহুড়ো করে বললো,”কি করছেন?”

আরো কিছুক্ষণ তোহার ঘন পাপড়িতে আঙ্গুল দিয়ে খেললো তিহান।প্রশ্ন করলো,
—“তুমি চোখে কাজল দাওনা কেনো?”

প্রশ্নটায় অপ্রস্তুত হয়ে পরলো তোহা।বাস্তবিকই সে আজপর্যন্ত কখনো চোখে কাজল দেয়নি।কেনো জানি কাজল লাগাতে ভয় লাগে।একবার অবশ্য চেষ্টা করেছিলো।কিন্তু পারেনি বরং হাত কেঁপে চোখে বাজেভাবে খোঁচা লেগে গিয়েছিলো।তারপর আর কখনো সাহস করেনি।আইলাইনার দিয়েই সবসময় কাজ চালিয়ে দিয়েছে।

—“আমি কাজল দিতে পারিনা।ছোটমুখে উওর দিলো তোহা।

তিহান হাসলো।তোহার একগালে হাত রেখে মোহনীয় স্নিগ্ধ ভারি পুরুশালী কন্ঠে বললো,
—“জানো,তোমাকে কাজল চোখে দেখার কত শখ আমার।তোমার কাজল দেয়া চোখের মায়ার মাত্রাটা ভেবেইতো আমার ভয় হচ্ছে।আচ্ছা,সেই চোখে একবার তাকালে আমি দৃষ্টি ফেরাতে পারবোতো”লাজুকলতা”?

তোহা লজ্জা পেলো।লোকটা নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে।এই রাত বিরেতে তার প্রেমিক মন আবারো জেগে উঠেছে।এই ভয়ংকর প্রেমিককে সে কি করে সামলাবে?তার যে অত স্বাধ্যি নেই।

তার ভাবনার মাঝেই তিহান একবুক আবদারমাখা ছেলেমানুষি স্বরে বললো,
—“আমি একদিন তোমাকে কাজল পরিয়ে দিব।ঠিকাছে?”

তোহা একমূহুর্ত দেরি না করে উওর দিলো,
—“আচ্ছা,দিয়েন।”

বাতাসের বেগ বেড়ে গেছে।গাছের পাতা নড়ার সাঁ সাঁ শব্দ হচ্ছে।একটা দমকা হাওয়ায় তোহার মাথার ঘোমটা পরে গেছে।খুলে গেছে খোঁপার চুল।তীব্র বাতাসে অগোছালো চুল সামলাতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তোহাকে।কিছুতেই সবগুলো চুল হাতের মুঠোয় আনতো পারছেনা।
বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে চুলগুলো খোঁপা করার পর গায়ের ওড়না ঠি ক করতেই তিহান এগিয়ে এলো।নিজেই ওড়নার আচঁল টেনে নিয়ে তোহার মাথায় পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

—“তোমাকে ঘোমটায় মানায় খুব।”

~চলবে~

[বাসার ওয়াই-ফাই কানেকশন নিয়ে কি যে একটা ঝামেলায় আছি।সময় উল্টাপাল্টা হওয়ার জন্য দু:খিত।একটু পরে নেট চলবে কিনা জানিনা।তাই আগেভাগেই দিয়ে দিলাম]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here