এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৩৭

এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৩৭
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

শরতের কাশফুল মলিন হয়ে পরতেই হেমন্তের আবির্ভাব শুরু হয়।শিশিরভেজা গাছের পাতা,আবছা কুয়াশায় ঢেকে থাকা ধোঁয়াটে সকাল,মেঘমুক্ত রাতের আকাশ,মৃদু মৃদু শীতল হাওয়া সব মিলিয়ে শীতের পূর্বাভাস হিসেবে হেমন্তের আগমন ঘটে।

তোহার পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে আজ।কলেজে যেতে হবে বেলা বারোটার দিকে।এখন বাজে এগারোটা পন্চাশ।ড্রইংরুমের সোফায় কলেজ ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে বসে আছে সে।মাঝে সিঁথি করে দু’পাশে দুই বেণি।সামনের কাঁটা চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।চোখেমুখে বিরক্তি ভর করছে ক্রমান্বয়ে।তিহানের তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সে এখনো আসছেনা।ঘড়ির কাঁটা ঘুরে আরো তিন চারমিনিট গড়িয়ে যেতেই চরম অস্থিরতা নিয়ে সোফা ছাড়লো তোহা।নিজের রুমে যেয়ে ফোন হাতে নেয়ার আগেই আতিয়া জোর গলায় ডেকে উঠলো,
—“তোহা,তিহান ফোন করেছিলো।তোকে নিচে নামতে বলেছে।ও অপেক্ষা করছে।”

ফোনটা আর হাতে নেয়া হলোনা তোহার।সাত পাঁচ না ভেবে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুতপায়ে নিচে নামতে লাগলো সে।আজকে ব্যাগের ঝামেলা নেই।শুধু রেজাল্ট শিটটা নিয়ে আসবে যেয়ে।

তিহান বসে আছে ড্রাইভিং সিটে।চোখের মনি লাল হয়ে আছে।রাতে ঘুম হয়নি।চুল উস্কখুষ্ক।অফিসের একটা ঝামেলা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সে।তার আন্ডারে যেহেতু অনেকেই কাজ করে তাই সব দায়ভার তারই।নি:শ্বাস ফেলার সময় টুকুও পাচ্ছেনা।খালি এই মিটিং ওই আলোচনার মধ্যই আছে।
তোহাকে কলেজে নেয়ার জন্য এখনো একটা মিটিং পোস্টপন্ড করে এসেছে।আর এই মেয়ের নামার নামই নেই।কতক্ষণ যাবত ফোন দিচ্ছে ফোনও ধরছে না।
তোহাকে বকা দেয়ার পরিকল্পনা করে থাকলেও তোহা যখন লম্বা বেণি দুলিয়ে পাশের সিটে বসে মিষ্টি কন্ঠে বললো,”আপনি ব্যস্ত ছিলেন?দেরি করলেন কেনো?”তখন আর তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলার অবকাশ রইলোনা তিহানের।এতক্ষনের চাপা রাগটা শুন্যে নেমে গেলো মুহূর্তেই।
চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো সে।ঠোঁট কোণ টা একটু প্রসারিত করে তোহার সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে এসি ছেড়ে দিলো।অত:পর গাড়ি স্টার্ট দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার।একহাতে ড্রাইভ করতে করতেই ফোন রিসিভ করে ঘাড় কাত করে ধরেই সে ব্যস্তভাবে বললো,

—“হ্যাঁ,আমি আসছি।বেশিক্ষণ লাগবেনা।..না না মিটিং ক্যান্সেল করা লাগবেনা।আমার জাস্ট বিশ পঁচিশ মিনিট লাগবে।আই’ল বি ব্যাক।”বলে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে গাড়ির সামনের জায়গাটায় রাখলো সে।চুলগুলোতে দুবার হাত চালিয়ে বললো,”তোর কতক্ষণ লাগবে কলেজে?”

তোহা এতক্ষণ সবই শুনছিলো।তিহানের ব্যস্ততা যে খুবই বেশি সেটাও বুঝতে পেরেছে সে।

—“শুধু রেজাল্ট শিটটা নিয়েই চলে আসবো।..আপনার দেরি হয়ে গেলে সমস্যা নেই আমি রিকশা করেই ফিরতে পারবো।”

তিহান উওর দিলোনা।গাড়ির স্পিড বারিয়ে তুলনামূলক জলদি ড্রাইভ করতে লাগলো।মেয়েটার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।হয়তো রেজাল্টের ভয়ে।যদিও মুখে কিছু বলছেনা তবুও সে বুঝতে পারছে।রেজাল্ট যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায় তবে আর নিজেকে সামলাতে পারবেনা তোহা।দেখা যাবে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।সেজন্যই ড্রাইভার আঙ্কেলকে না পাঠিয়ে সে নিজেই এসেছে।
____________
গাড়ি থামে কলেজের সামনে।তিহান নেমে তোহার পাশের দরজা খুলে দেয়।তাকে নামিয়ে ঘড়ি দেখে বলে ,”যা আমি অপেক্ষা করছি।ভয়ের কিছু নেই।”তোহা মলিনভাবে হাসলো।বললো,”আপনি থাকতে ভয় কিসের?”বলে আর অপেক্ষা করলোনা সে।গেট পেরিয়ে স্টুডেন্টদের ভিড়ের মাঝে আড়াল হয়ে গেলো।

পুরো ক্লাসের মধ্য অষ্টম পজিশনে আছে তোহা।রেজাল্টটা তাকে হাতে দিয়েই হাসলো শিরিন ম্যাম।তোহাও উওরে মুচকি হাসলো।ভেতরের খুশিটা ভেতরেই চেপে রেখে ম্যামকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই উনি বলে উঠলেন,
—“সে কি,তুমি এখনই চলে যাবে?প্রিন্সিপাল স্যার এসেতো টপ টেনের ছাত্রীদেরই দেখতে চাইবেন।তোমাকে তো থাকতে হবে।”

—“ম্যাম,আমার একটু সমস্যা আছে।যেতেই হবে।প্লিজ।”করুণ স্বরে অনুনয় করে বললো তোহা।শিরিন ম্যাম একটু ধাতস্থ হলেন।মেয়েটার কিসের এতো তাঁড়া?উপরন্ত তোহার করুণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলেন না।নরম কন্ঠে বললেন,
—“আচ্ছা ঠি কাছে।যাও।”

____________
তিহান ফোনে কথা বলছিলো।তোহাকে বেরোতে দেখে দ্রুত কথা শেষ করে ফোনটা কাটলো সে।তোহার চেহারা এতোটাও থমথমে না।তার মানে রেজাল্ট ভালোই হয়েছে।তোহা কাছে এসে দাড়ালো।তিহান হাত বারাতেই রেজাল্ট শিটটা তার হাতে ধরিয়ে দিলোতিহান একবার চোখ বুলালো।মেরিট নাম্বারটা দেখে নিয়ে মুচকি হেসে
তোহার মাথার দুবার হাত বুলিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,”বস,আমার সাথে যেতে হবে একটু।এখন আবার গাড়ি ঘুরালে দেরি হয়ে যাবে অনেক।”
তোহা মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো।তিহান আবারো ব্যস্তহাতে স্টার্ট দিলো গাড়ি।উদ্দেশ্য অফিস যাওয়া।

পনেরো মিনিট যেতে না যেতেই গাড়ি পৌছালো অফিসের সামনে।তোহাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে তিহান ছুটলো উপরে।বিরস মুখে চেয়ে রইলো তোহা।লোকটার এত ব্যস্ততা কেনো?সব ঝামেলা আজকের দিনেই হতে হলো?তার রেজাল্টের দিনে?
সেইবার মাধ্যমিকের সময় সে যখন এ প্লাস পেলো সেইদিন তাকে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছিলো তিহান।সেই থেকে আজপর্যন্ত যত পরীক্ষা হয়েছে কখনো তোহার হাত খালি ছিলোনা।ওই বিশেষ মানুষের দেয়া বিশেষ ঘড়িটা সবসময় তার হাতে ছিলো।কলম পেন্সিল নিতে ভুলে গেলেও ওই ঘড়ি পরতে ভুল হতোনা তার।

তিহান ফিরে আসে মিনিট পাঁচেক পরই।তোহা তখন গাড়িতে একচোট ঘুমিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
তবে তার আগেই তিহান সেখানে উপস্থিত হয়।তোহাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দরজা লক করতে করতে বলে,”আমার দেরি হবে।এতক্ষণ গাড়িতে বসতে পারবিনা।কষ্ট হবে তোর।উপরে চল।”বলে তোহার হাত ধরে উপরে উঠলো তিহান।কলেজড্রেস পরা তোহাকে দেখে অনেকে বাঁকা চোখে তাকালেও তিহানকে তার পাশে দেখে কিছু বলার সাহস পেলোনা কেউই।

তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে বড় সোফাটায় বসালো তিহান।নিজের ফোনটা বের করে হাতে ধরিয়ে বললো,”আমি পাশের মিটিং রুমেই আছি।ভয় পাস না।আর কেউ আসবেনা এখানে।নিশ্চিন্তে থাক।”বলে আর দেরি করলোনা তিহান।বেরিয়ে যেতে যেতে গেটের পাশে দাড়ানো মেয়েটাকে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,”আমার কেবিনে যেনো কেউ না ঢুকে।জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি মানা করেছি।মেয়েটা”আচ্ছা স্যার”বলে মাথা নাড়ায়।এই তলার ত্বত্তাবধানে সে আছে।তিহানের কেবিনে কে ঢুকবে না ঢুকবে বা কখন কোন ফাইল দিতে হবে সব সে-ই দেখে।
_____________
মিটিং শেষ হতেই হুড়মুড়িয়ে কেবিনে ঢোকে তিহান।তোহা তখন কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে।একপাশের বেণি সোফা ছাড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।একটা হাত বেরিয়ে আছে সোফার বাইরে।সেই হাতে ফোন ধরা।ইউটিউবের ভিডিও চলছে স্বশব্দে।প্রায় দেড় দু ঘন্টা যাবত মেয়েটাকে একা রেখে মিটিংয়েও ভালোমতো মনোযোগ দিতে পারছিলোনা তিহান।তবুও এখন বেশ দায়মুক্ত লাগছে।এই একটা মিটিংয়েই যে একয়দিনের গোটা সমস্যার পাট চুকে যাবে একেবারেই ভাবেনি সে।এই মেয়েটা তার জন্য শুভ্রতা নিয়ে আসে সবসময়।সে পাশে থাকলেই সবকিছু শুভ্রতার আস্বাদনে ঢেঁকে যায়।
তিহান নি:শব্দে পা ফেলে এগিয়ে যায়।হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভিডিও অফ করে দেয়।কেবিনের একপাশের কাঁচের গ্লাস ভেদ করে দুপুরের রোদরশ্নি তেরছাভাবে তোহার চোখে মুখে ছড়িয়ে পরেছে।মনে হচ্ছে সূর্য নিজে তাকে আদুরে চুম্বন করে যাচ্ছে চোখেমুখে।সূর্যের রাগী তেজও এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের কাছে হার মেনে নিজেকে মোলায়েম করে দিয়েছে।সুর্যটাও বোধহয় তার রাজকন্যাটাকে নিজের রাজ্যের সম্রাজ্ঞী বানাতে ইচ্ছুক।তিহান কপাল কুঁচকে তাকাল।কাঁচের সামনের মোটা পর্দাটা টেনে দিতেই সূর্যের আলো আর প্রবেশ করতে পারলোনা।
এবার যেনো তৃপ্তির হাসি হাসলো তিহান।পরক্ষনেই হাসি থামিয়ে তোহার মাথার কাছে বসে মাথাটা সযত্নে নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে অসন্তুষ্টি নিয়ে বললো,

—“—“এই চরিত্রহীন সূর্যের সাহস কি করে হয় তোমার গাল ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার?তুমিতো শুধু আমার।আমার প্রেমিকাকে ছোঁয়ায় আগে ও আমার অনুমতি নিলোনা কোন স্পর্ধায়!”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here