এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৪০

এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-৪০
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

গোটা রাজধানী কুয়াশায় লেপ্টে আছে।ধোঁয়াটে সাদা পদার্থগুলো যেনো পুরো শহরটাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে শীতের ঠান্ডা আলিঙ্গনে।পাখিদেরও ঘুম ভাঙেনি।তন্দ্রাচ্ছন ঢাকাশহর।
ফোনের রিংটোনে গভীর আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তোহার।গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।গায়ের উপরের ভারি কম্বলটা সরিয়ে ওপাশ হতে শরীর সাঁয় দিচ্ছে না।ফোনের রিংটোন বেজেই চলেছে।অবিশ্রান্ত,বিরামহীন।তোহা ঘুরে সোজা হলো।দু’হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শরীরের জড়তা কাটানোর নিষ্ফল চেষ্টা করলো।পিটপিট করে আধবোজা চোখে ফোনটা কানে তুললো।ওপাশ থেকে তিহানের ভারভার কন্ঠস্বরের ডাক ভেসে আসছে,
—“তিহু?”

তোহা ঘুমের ঘোরেই হাল্কা গোঙ্গালো।ঝাপসা স্বরে স্বাড়া দিলো,
—“হু।”

কিছুক্ষণ মৌনমুখে চোখ বোজে তোহার ঘুমন্ত কন্ঠটা অনুভব করার চেষ্টা করলো তিহান।এইতো আর মাত্র কয়েকটা মাস পরই সে রোজ সকালে এই কন্ঠটা শুনবে।এই কন্ঠের আদুরে বুলিতে তার ঘুম কাটবে।অতি সাদরে অপেক্ষা করা কিছু মূহুর্তে জর্জরিত হবে তার এতদিনের ধৈর্যশীল প্রেমিক মন।চোখ মেললো তিহান।নমনীয় কন্ঠে আবদার করে বললো,
—“একটু বাইরে আসবে?আমি অপেক্ষা করছি।”

তোহা উঠে বসলো।লোকটার কোনো কথা,আবদার অমান্য করার স্বাধ্যি নেই তার।আজপর্যন্ত কখনো তিহানের মুখের উপরে কোনো কথা বলেনি।
অগত্যা চোখ কঁচলে ঘুম কাটানোর চেষ্টা করলো সে।দ্রুত বিছানা থেকে নেমে গায়ের শাল জড়িয়ে নিয়ে নিভু নিভু স্বরে উওর দিলো,
—“একটু দাড়ান,আসছি।”

এসময় নিরবতাটা বেশি থাকে।নি:শ্বাস প্রশ্বাসগুলোও যেনো উচ্চরব সৃষ্টি করে ফেলে।রুমের দরজাটা আস্তে করে খুললো তোহা।নি:শব্দে লক করে ঘুরে দাড়াতেই হৃদপিন্ডটা দড়াস করে লাফিয়ে উঠলো।
ঠি ক তার পেছনেই তূর্য দাড়িয়ে আছে।চোখমুখ ঢুলুঢুলু।তোহা বিব্রত,কিৎকর্তব্যবিমূঢ়।
লজ্জিত ভঙ্গিতে কিছু বলার আগেই তূর্য তাড়া দিয়ে বললে,
—“জলদি আয়,দরজা আটকে দিয়ে আমি ঘুমাবো বোন।”

তোহা বিস্মিত,বাক্যহীন।পরিস্থিতিটার আগামাথা তার মাথায় ঢুকছে না।তূর্য কিভাবে জানলো সে বাইরে যাবে?তিহান বলেছে নিশ্চয়ই।ভাইয়ের সামনে কি একটা লজ্জা।ও আল্লাহ!
কথা না বলে চুপচাপ দরজার কাছে গেলো তারা।বেরোতেই দেখলো তিহান দাড়িয়ে আছে।তোহা গুটিগুটি পায়ে চুপটি করে দাড়ালো।কলাপাতা রংয়ের একটা সাদামাটা থ্রিসিপের উপর কালো শাল জড়ানো।মাথায় জর্জেটের ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা।ঘুমের রেশ এখনো লেগে আছে চোখের কোলজুড়ে।তূর্য কন্ঠে হাসিমাখা তবে তীব্র দৃঢ়ভাব নিয়ে বললো,
—“আমার বোনকে নিয়ে যাচ্ছেন তিহান ভাই।সময়মতো আবার ফেরত দিয়ে যেয়েন কিন্তু।”

চাঁপা হেসে এলোমেলো চুলগুলোতে হাত চালানো তিহান।ফিচেল গলায় বললো,
—“একসময় তো একেবারেই নিয়ে যাবো,তখন কি করবি?”

হেসে ফেললো তূর্য।দরজা আটকে দিতেই তোহা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো,
—“আপনি এটা কি করলেন?”

—“কি করেছি?”

—“ভাইয়া কি ভাবছে!আমিতো আসছিলামই..আপনি ভাইয়াকে কেনো ডাকলেন?”

তিহান এগিয়ে গেলো।তোহার বামহাতটা নিজের হাতের মাঝে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিয়ে বললো,
—“তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরবো।সময় লাগবে।এভাবে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রেখে গেলে বিপদ হতে পারে।আর তূর্য কিছু ভাবেনি।আমার প্রেমিকা ওরফে হবু বউকে আমি নিয়ে যাচ্ছি কে কি ভাববে তা ভেবে আমার কি?”

—“আপনি পাগল।সত্যিই পাগল।”

তিহান হাসলো কেবল।তোহাকে কাছে টেনে সিঁড়ি ধরে নামতে নামতেই তোহা জিজ্ঞেস করলো,
—“এসময় কোথায় নিয়ে যাবেন?”

—“জানিনা।অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবো।তোমাকে অনুভব করবো।ব্যস এতটুকুই।”

—“হাঁটবেন?”

তিহান ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
—“নাহ্,এবার রিকশা ঠি ক করে রেখেছি ।তোমার তো পা ব্যাথা হয়ে যায়।”
_________________
রিকশা চলছে ধীরগতিতে।কুয়াশায় আচ্ছাদন কাটিয়ে এগোনো মুশকিল।তবুও রিকশা ওয়ালা মামাটা পাক্কা চালক হওয়ায় বিশেষ ঝামেলা হচ্ছেনা।আশেপাশের কোনো দোকান এখন অবধি খুলেনি।ফোন বা ঘড়ি নেই সাথে বিধায় সময়টাও বোঝা যাচ্ছেনা।ছয়টা বোধহয় বাজেনি এখনো।
শীতে কুঁকড়ে তিহানের সাথে ঘেঁষে বসেছে তোহা।তিহানের পরণে পাতলা টি-শার্ট আর ট্রাউজার।চোখমুখ একেবারে স্বাভাবিক।নির্বিকার চিত্তে তোহার একহাত টেনে সেই হাতের দিকে তাকিয়ে তা নেড়েচেড়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে।যেন শীত তাকে ছুঁয়ে দিতে অক্ষম।তোহা চোখমুখ কুঁচকালো।বললো,
—“আপনি এটা কি গায়ে দিয়ে এসেছেন?শীত করছেনা?”

—“করছেনা তো।”

—“কেনো করবেনা?”

তিহান ঘাড় ফিরালো।তোহার মুখের দিকে কিছুক্ষন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে আবিষ্ট স্বরে বললো,
—“আমার উত্তাপ টা যে আমার সাথেই আছে।শীত আমায় ছুঁবে কি করে?”
_____________
শীতকালে রান্নাঘরে খুব আরাম বোধ হয়।আগুনের তাপে গরম গরম লাগে।সেই গরম গরম ভাবটা অনুভব করতেই রান্নাঘরে পদচারণ করলো তোহা।আতিয়া বিকেল থেকেই কিছু একটা করছে।সে এতক্ষণ ঘরে পড়ছিলো তাই জানেনা।
তোহা কাছাকাছি যেয়ে দাড়ালো।নাকে চিরপরিচিত কিছু একটার মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসতেই উৎসুক কন্ঠে বললো,
—“কি করছো আম্মু?”

আতিয়া মুচকি হাসলো।বললো,
—“খুন্তি টা দে তো।পাটিসাপটা করছি।”

চওড়া হাসলো তোহা।খুন্তিটা এগিয়ে দিয়ে আতিয়ার পাশে দাড়াতেই আতিয়া দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বললো,
—“তোর ও বানানো শিখা উচিত।তিহানটা খুব পছন্দ করে এসব।”

—“তো?”

—“বিয়ের পর করে খাওয়াবি।”

তোহা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।এই লোকটার লাগামহীন কথাবার্তার ছোঁয়া তার পুরো পরিবারে লেগে গেছে।
সবাই যেন তাকে লজ্জায় ফেলার ঘোর ষড়যন্ত্রে নেমেছে গাঁট বেঁধে।সে কি করবে?কোথায় মুখ লুকাবে?তিহানের বুকে?

ভাবনার সুঁতো ছিঁড়লো।আতিয়া তিনটে গরম পিঠা বাটিতে তুলে তোহার হাতে ধরিয়ে বললো,”ছেলেটাকে দিয়ে আয়।”
________________
তিহানের রুমে ঢুকতেই একটা লোমশ তুলতুলে কিছু পা ছুঁয়ে যেতেই তুমুল গতিতে লাফিয়ে উঠে তোহা।চোখমুখ খিঁচে গগনবিদারী চিৎকার করতেই কেউ একজন পাশ থেকে তাকে বুকে টেনে নেয়।স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্তভরা কন্ঠে বলে,
—“বিড়াল ওটা,ভয় পায়না।”

তোহা স্হির হয়।ভয়টা হয়তো কমেছে কিছুটা।তিহান তাকে ছেড়ে দাড়ায় ।তোহা জোরে শ্বাস নেয়।বুকে থুতু দিয়ে আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ভীত কন্ঠে বলে,
—“কোথায় বিড়াল?”

তিহান আচমকাই হাসে।মেয়েটা এতো বেশি ভয় পায়।
তোহার হাত থেকে কাঁচের বাটিটা খুব সন্তর্পনে নিজের হাতে নিয়ে নেয় সে।হাতের উচিয়ে ইশারা করে বলে,
—“ওইতো বিছানায় বসেছে।”

কালো সাদা রংয়ের একটা মাঝারি আকারের বিড়াল।সবুজ চোখ।বিছানার মাঝে বসে গা চাটছে।তোহা চিনে বিড়ালটাকে।সেই যে একবার তিহান পথ থেকে বাঁচিয়েছিলো এই বিড়ালটা।এরপর থেকে তাদের বাসার নিচতলার গ্যারেজেই থাকতো।দারোয়ান চাচা খেয়াল রাখতো।তিহান বোধহয় খাবার দাবারের টাকা দিয়ে আসতো।সে জানেনা ঠি ক।তখন অবশ্য বিড়ালটা ছোট ছিলো অনেক।এখন বড় হয়েছে।
তোহা সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
—“আপনি ওকে ঘরে এনেছেন কেনো?”

—“শীত পরেছে তো।গ্যারেজে অনেক ঠান্ডা থাকে।ওর থাকতে কষ্ট হয়।তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।আমার সাথে ঘরে থাকুক।”বলতে বলতে বিছানায় যেয়ে বসলো তিহান।তোহাও গেলো কাছাকাছি।বিড়ালটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বিছানায় বসলো।বললো,
—“আপনাকে কামড়ে দিলে?”

—“অলরেডি খামছে দিয়েছে।রাতে সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম।পিঠটা আঁচরে কিছু রাখেনি।”

—“আল্লাহ!দেখি।”আৎকে উঠলো তোহা।

তিহান হাসলো।একটানে গায়ের টি-শার্ট খুলে নিয়ে পিঠ দেখিয়ে বললো,
—“তোমার কাজটা তোমার আগে বিড়ালটা করে দিলো।দুষ্টু বিড়াল।”

রসিকতাটা গায়ে মাখলোনা তোহা।ব্যাথাতুর নয়নে চেয়ে থেকে তৎক্ষনাত উঠে গেলো।সেন্টার টেবিলের নিচের অংশ থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা বের করে মলম হাতে এগিয়ে আসলো।তারপর অবিলম্বে লাল হওয়া অংশগুলায় মলম লাগাতে লাগাতে কান্নামাখা কন্ঠে বললো,
—“বেশি জ্বলছে?”

তিহান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে বললো,
—“জলছেইনা।”

—“একদম মিথ্যা বলবেন না।আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে।অসহ্যকর।আপনি এমন কেনো?”

তিহান এবারো হাসলো।মেয়েটা একসময় সবসময় তাকে এভাবে শাসন করবে।তার পাশাপাশি থাকবে,কাছাকাছি থাকবে।অদ্ভুততো,তার হঠাৎ এতো লজ্জা লাগছে কেনো?
________________
দিন গড়িয়ে গেছে।বছর ঘুরেছে।গত মে মাসে শেষ হয়েছে তোহার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা।ব্যস্ততারা ছুটি নিয়েছে।তোহার এখন অফুরন্ত সময়।মনে মনে চলছে বিয়ের মৌসুম।এ মাসের শেষেই খুব সম্ভবত তাদের কাবিন হয়ে যাবে।
ঋতুর পালাবদল ঘটেছে।শীত থেকে গ্রীষ্ম,গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা।অত:পর প্রকৃতি সিক্ত করতে আবারো এসেছে শ্রাবণ মাস।

~চলবে~

[যারা যারা গল্পটা একদম শুরু থেকে পড়ছেন তারা অবশ্যই কমেন্টে কিছু বলে যাবেন আজকে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here