#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৬
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে আজ। দূর দূর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলোগুলো বারান্দা থেকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল লাগছে দেখতে। সম্মুখে অবস্থিত বাগান ও একপাশে বিদ্যমান সুইমিংপুলের পানিতে বৃষ্টির কণা আছড়ে পড়াতে অন্যরকম সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটাতে ব্যস্ত। আমার সেসব কিছু দেখে মুহুর্তের মধ্যেই কাজের ক্লান্তিময় অনুভব দূর হয়ে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি। এখন প্রায় আটটা দশ ছুঁই ছুঁই।
আজরান ভাইয়াদের বাসা থেকে এ বাড়িতে ফিরে এসেছি প্রায় দু’দিন হতে চললো। সবাই অনেক জোরাজোরি করেছিলো আরও কিছুদিন থাকার জন্য। কিন্ত আনভীর নিজের সিদ্ধান্তে অটল। বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকীর জন্য যেহেতু আমাদের আসতে বলা হয়েছিলো সেই সুবাদে থাকাও শেষ, এদিকে আমার জন্মদিন উদযাপন করাও শেষ, এবার ফিরে যাওয়ার পালা। এটাই বলেছিলেন আনভীর। আর আমিও উনার সিদ্ধান্তের বিমুখ হতে পারিনি। তবে মা এতে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। বলেছিলেন যে কতদিন এভাবে আনভীর বাবার ওপর অভিমান করে থাকবেন। পরন্তু নীরব ছিলেন আনভীর।
আমি সচরাচর কাউকে আশ্বাস দেই না। মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া তো দূরের কথা। কিন্ত হয়তো এই ক্ষেত্রে প্রথমবার আপন কোনো মানুষকে আশ্বাস দিয়েছি আমি। জানিনা সেটা সত্য না কি মিথ্যা। মা কে বলেছিলাম যে, একদিন আনভীরের সমস্ত ক্ষোভ, সমস্ত অভিমান ভেঙে যাবে। আমি কাটিয়ে তুলবো তা। অন্য চারপাঁচ টা মানুষের মতো উনিও পরিবারকে আগলে নিবেন। মা খুশিতে প্রাণভরে চুমু দিয়েছিলেন আমার ললাটে। আমাকে তাই বিস্ময়ে আবির্ভূত থাকতে হলো মাতৃক্রোড়ের এই ভালোবাসাময় স্পর্শে।
আমার মা নেই। আমি বুঝি এর কষ্ট কি। আর আনভীরের থাকতে সেটাকে হেলিয়ে চলবেন এমনটা আমি কখনোই হতে দিবো না।
আমার অজস্র ভাবনার জাল কাটলো বাতাসের কম্পনে। বাস্তবে ফিরে এসে দেখলাম এখনও বৃষ্টির গতি কমেনি। এই বাসাটা নিতান্তই বড় এবং মানুষ বলতে আমি আনভীর আর নাহিদ ভাইয়াই। বাকি যারা আছে তারা বাড়ির বাইরেই পাহারা দিতে সবসময় মশগুল থাকে। বলতে গেলে একা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার জন্য বেস্ট জায়গা এটা। আনভীর বাসা নেই আজ। না আনভীর, আর না নাহিদ ভাইয়া। বিগত কিছুদিন যাবৎ উনি একটা গানের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত প্রচুর। কথা নাই বার্তা নাই, সময় অসময়ে কল এলেই উনি নাহিদ ভাইয়াকে আর বডিগার্ডকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আমি আগে ভাবতাম এদের লাইফই সুন্দর। বাসায় থাকলে ডিস্টার্ব করার মানুষ নেই, এক অন্যরকম ভাইব পাওয়া যায়। কিন্ত বাস্তব টা নিতান্তই অন্যরকম। এধরনের সিঙ্গার বলি কিংবা আইডল বলি, বেশিরভাগ সময়েই এদের দিন কাটে মিডিয়া, লাইট – ক্যামেরা – একশন, প্রেস কনফারেন্স ইত্যাদি নিয়ে।
আজকেও হুট করে সকাল ছয়টায় ডাক দিলেন আমায়। বললেন, জরুরি কাজে বাইরে যাচ্ছে। নাহিদও যাবে। তাই বাসায় সাবধানে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে দিলেন। আমি জানি আমায় নিয়ে এই দুশ্চিন্তার কারনের পেছনে যে অপূর্ব ভাইয়াই জড়িত আছে। আর আনভীর কোনোক্রমেই চাননা নিজের ছোট কোনো অসাবধানতার জন্য আমায় বিপদে ফেলতে।
আমি ঘুম কাটিয়ে উঠে বসলাম তখন। আজ হসপিটালে অফ ডে ছিলো। তবুও কাজের চাপ কম ছিলো না। গতরাতে আমার কলিগ রিনি জানালো যে ডে আফটার টুমোরো ইন্টাটন্যাশনাল কয়েকজন ডাক্তারদের নিয়ে মিটিং আছে আমাদের। এর পরই যাচাই করা হবে যে আমাদের প্রমোশন হবে না কি হবে না।
আনন্দ জেগে উঠেছিলো আমার হৃদয়ে। ডাক্তার হওয়া স্বপ্ন ছিলো আমার। হার্ট সার্জন হওয়া এত সহজও না। এর জন্য পারিবারিক ভাবেই হোক, আর ব্যাক্তিগত ভাবেই হোক, অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আমায়। আর কয়েকটা দিন পরিশ্রম করলে হয়তো আমিও আর ডক্টর ধ্রুবের এসিস্ট্যান্ট ডক্টর হিসেবে থাকবো না, নিজের একটি নাম গড়ে তুলতে পারবো। তাই মিটিংয়ে নিজের স্কিলটা প্রকাশ করার জন্য বেশ কয়েকটা ফাইল প্রস্তুত করেছি। সবই করেছি আজ সকাল থেকে। প্রায় দেড় ঘন্টায় পাওয়ার পয়েন্টের কাজ আধ সেরে আমি বারান্দায় আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যাস্ত হয়ে ছিলাম। ভালোলাগছে সবকিছু দেখতে।
তখনই দরজা খোলার শব্দে অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ি আমি। কিন্ত স্থির হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দাতে। আমি স্পষ্টতই জানি যে মানুষটি কে।
হঠাৎ আমায় পেছেন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আনভীর। আমার গলায় শব্দ করে একটা চুমু দিয়ে কাঁধে থুতনির ভর ছাড়লেন। আমি অপ্রতিভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতে থাকা নেসলে কফির কাপটাও যেন অসাড় হয়ে আসছে।
কন্ঠ জড়ালেন আনভীর। বলে উঠলেন,
‘ রিয়্যাকশন দিলে না যে?’
‘ আপনার এসব কাজে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি একটু বেশিই। তাই হয়তো।’
ঠোঁটে হাসির সুরত ঘটিয়ে বললাম আমি। আনভীর আকস্মিকভাবে হেসে ফেললেন। পেছন থেকে আরও প্রগাড়ভাবে চেপে ধরলেন আমাকে। বললেন,
‘ আমায় মিসেস টা বোধহয় অভিমান করে আছে আমার ওপর। ঠিক বললাম না আমি?’
‘ জ্বি না। ভুল বলেছেন। এখন পর্যন্ত অভিমান করার মতো কাজ আপনি করেননি যে অভিমান করবো। তবে যদি কখনও করি তবে আপনাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হবে।’
আনভীর তথারুপি আরও একদফা মিহি হাসলেন আমার কথায়। আমি উনার হাসিকে পাত্তা দিলাম না। আমার পেটের ওপর উনার হাতের বন্ধনে নিজের হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ কোথায় গিয়েছিলেন এত সকালে?’
‘ জানতে চাও?’
‘ আমি মানুষটার কৌতুহল অনেক বেশি মি.আনভীর রেজওয়ান খান। আমার জেরা করার ভয়ে নাহিদ ভাইয়াও পালাই পালাই করে বেড়ায়। বিগত কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি আপনাকে যে আপনার দুই জন মিলে কিছু একটা লুকোনোর চেষ্টা করছেন আমার থেকে। আর আমি এটাও নিশ্চিত যে আপনি আজকে সকালে সং রেকর্ডিং এর কোনো কাজে যাননি। গিয়েছেন অন্য এক কাজে।’
আনভীর অভিভূত হলেন আমার কথায়। ব্যক্ত করলেন,
‘ বাহ! মিসেস আনভীর রেজওয়ান খান দেখি ইদানীং ডিটেকটিভ এর কাজ শুরু করেছে। আচ্ছা সত্যি করে বলোতো, তোমার প্যাশন কিছু আসলেই ডক্টর ছিলো নাকি গোয়ান্দা টোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছে ছিলো?’
আমি পেছনে ঘুরে ফিরি এবার। হাতের কাপ রেলিংয়ের সপ্রান্তে রেখে দাঁড়াই আনভীরের মুখোমুখি হয়ে। ঘুমের জন্য সকালে আনভীরকে আমি আবছাভাবে দেখেছিলাম। তবে এখন দেখে নিলাম পূর্ণদৃষ্টিতে। সাদা-কালো চেক শার্টের গুটানো হাতা তার উজ্জল ফর্সা গায়ে ফুটে উঠেছে নিদারুনভাবে। বুঝলাম অন্য সময়কার মতো ফর্মাল হয়ে বের হননি আজ। আমি নতমুখে প্রতিউত্তর করলাম,
‘ জ্বি না মি.রকস্টার। আমার সবসময় একটাই ইচ্ছে ছিলো ডক্টর হবো। দেশের একজন বড় মাপের হার্ট সার্জন। সেবাব্রতী হবো মানুষের উদ্দেশ্যে। দেখবো যে আমার মতো কাউকে যেন কষ্ট করতে না হয়। ‘
‘ আচ্ছা আজ যদি আমার তোমার একটি চাপা কষ্ট দূর করে দেই?’
আনভীরের কথায় বিগলিত হয়ে পড়ি আমি। শশব্যস্ত হয়ে তাকালাম তাই উনার দিকে।।আনভীরের ঠোঁটে এখনও বুক উজাড় করা হাসি। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এখন?’
‘ জ্বি মহারাণী এখন। এর জন্যই তো সকাল সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম।’
‘ ম…মানে?’
উনার কথার মর্মার্থ না বুঝে শেষমেষ প্রশ্ন করেই ফেললাম উনাকে। আনভীর নিচু হলেন আমার কাছে। কর্নের কাছে শিরশির বাতাসের স্বরে বললেন,
‘ তোমার বার্থডে গিফ্টতো সেদিন দেওয়া হয়নি ম্যাডাম। আজ দেওয়ার পালা।’
আমি অপ্রতিভ হয়ে যাই এতে। অনুনয়ের সহিত তাই বললাম,
‘ আপনি এখনও গিফ্ট গিফ্ট করছেন কেনো আনভীর? বলেছিলাম না আমার প্রয়োজন নেই?’
‘ আর আমিও কি বলেছিলাম না যে আমার গিফ্ট কিছুটা আলাদা হবে যা তোমার ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলবে?’
চোখ শক্ত আনভীরের। এমন শাসানো ভঙ্গির কথায় আমি মাথা উপর নিচ করে বললাম,
‘ হুম!’
‘ তাহলে আর কোনো কথা না। নাও ক্লোস ইউর আইস মাই বেবিগার্ল। যখন আমি খুলতে বলবো তখন খুলবে। আমি হাত ধরছি। চোখ বন্ধ করেই চলো আমার সাথে।’
আমি তাই করলাম। অগত্যাই কথামতো আনভীরের হাত ধরে ত্যাগ করলাম ঘরটি। সিড়ি দিয়ে ধীরপায়ে আমাকে নামতে হলো আনভীরের হাত ধরে। আমার চোখজোড়া তখনও বন্ধ অবস্থায়। আনভীর এবার পেছন থেকে বললেন,
‘ নাও ইউ ক্যান ওপেন ইউর আইস আহি!’
আমার মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরেই কৌতুহলতা চরমভাবে শিরায় উপশিরায় তরতর করে বইছিলো যে আসলে কি করতে চাচ্ছেন আনভীর। তাই উনি চোখ খোলার কথা বলামাত্রই আমি পিট পিট করে চোখ খুলে সম্মুখে তাকালাম।
সামনে যে এমন কিছু দেখবো, এটা কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি আমি। স্তব্ধ অবস্থায় ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম তাই। আনভীর এবার বললেন,
‘ এটা তোমার ডে ড্রিম না আহি। তুমি সত্যিই দেখছো যা আমি দেখছি।’
আমার চোখ টলমল করে উঠলো অশ্রুতে। এটা কিসের অশ্রু সেটা যেন ব্যক্ত করা অসম্ভব আমার কাছে।
.
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
পুরান ঢাকায় আজ সাঁকরাইন উদযাপিত হচ্ছে। সকাল থেকেই ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় ছাদে ফানুস আর আতশবাজির খেলায় মুখোরিত আশপাশ। আমার মনোযোগটা আজ গল্প লেখার দিকে ছিলো না বললেই চলে। খুব দ্রুত লিখেছি। ভুলক্রুটি হলে শুধরে দেওয়ার অনুরোধ থাকবে। ভালোবাসা।