এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৫১

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫১

‘ আজকে আপনার এই রূপে আনভীর ভাই হার্টএট্যাক করবে ভাবি!’

নাহিদ ভাইয়ার এই কথায় আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সবার চোখে মুখে সেই একই অভিব্যাপ্তি। চারিদিকের হৈ চৈ স্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে। সবার এই হৈ চৈ, আনন্দ, সবকিছু আমায় আর আনভীরকে ঘিরে। আজ আমার আর আনভীরের গায়ে হলুদ। বিষয়টা মনে আসতেই যতটা না আনন্দ অনুভব করি, তার থেকেও আরও বেশি অনুভব করি প্রশান্তি। আর লুকোচুরি নেই, আর ভয়ে থাকতে হবে না কেউ দেখবে কি-না, দেলে কি ভাববে। এখন শুধুই আমাদের ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়ার সময়। দিনে দিনে আনভীর নামক মানুষটি আমার সারা অস্তিস্তে এমনভাবে জুড়িয়ে গিয়েছে যে এর থেকে কখনও পরিত্রাণ পাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। এভাবেই জুড়ে থাকবো উনার সাথে। এভাবেই সাদরে গ্রহণ করে নিবো উনার পাগলামি।
বেডে বসে আছি আমি। আমার গায়ে জড়ানো গায়ে হলুদের হালকা রঙের শাড়ি, মুখে মানানসই সাজ। আয়নায় যতবার নিজেকে দেখি তবারই অবাক হচ্ছি এই রূপে দেখে। মনে হচ্ছে ঘোরে আছি, আমার এই স্বপ্ন নিমিষেই হয়তো চুরমার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু না, এমন কিছুই হবে না আমি জানি। নীলু নাহিদ ভাইয়ার সাথে সাথে আমায় দেখে বলে উঠলো,

‘ আহারে! আমার আপুটাকে পুরো রাণী লাগছে। আজ তো আনভীর ভাইয়া এই রূপ দেখে মরেই যাবে। এমনিতেই তার কত কষ্ট, দু’দিন ধরে বউকে তার সাথে ঘেষঁতে দেই না।’

কথাটি শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। ইশা, ধারা সবাই নিজের শাড়ি পড়ে, মেকাপ করতে ব্যস্ত। শিউলি ভাবি একটি হালকা কারুকাজের থ্রিপিস পড়েছে। আজরান ভাইয়া কড়াকড়ি বলে দিয়েছে এই অবস্থায় কোনো ধরনের কোনো নড়াচড়া না করতে। ভাবির মুখ বিষন্ন দেখে আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে হালকা করে। আদুরে কন্ঠে বললাম,

‘ এমন গুলুমুলু ভাবিটা রাগ করে থাকলে কি ভালোলাগে আমার? তুমি এমন করে থাকলে আমার নিজেরও তো ভালোলাগবে না।’

‘ কি করবো বলো, কত ইচ্ছে ছিলো তোমার আর আনভীরের বিয়েতে একহাতে সব সামলাবো। আমার দেবরটাকে আচ্ছামতো ধোলাই দিবো তোমার সাথে কড়া কথা বললে। আর হলোটা কি? আমি নড়াচড়া করলে দেবর আর দেবরের ভাই মিলে পারলে আমায় ধমকের ওপর রাখে।’

আমি চুপটি হাসলাম ভাবির এমন কথা শুনে। তাই তাকে বসালাম আমি। পেটে হালকা করে মাথা পেতে বললাম,

‘ হেই চাচিজান! তোমার গুলুমুলু মাম্মামটা কত কষ্ট করছে দেখছো? তোমার চাচ্চু-চাচির বিয়েতে ইন্জয়ও করতে পারছে না। তুমি ফটাফট চলে আসো। তারপর তোমায় অনেক বেশি আদর করবো। তোমার গুলুমুলু মাম্মাম পাপাই থেকেও বেশি।’

শিউলি ভাবির বিষন্ন মুখ হঠাৎ হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। হাসলে বড্ড সুন্দর লাগে তাকে। আর গর্ভবতী হওয়ার দরুন স্নিগ্ধতার আদল যেন ফুটে ওঠে আরও। ভাবি মিহি হেসে বললো,

‘ আহি!’

‘ হুম?’

‘ আজকে দেখতে মারাত্নক লাগছে তোমায়। আমি জাস্ট ভাবছি যে আমার ভোলাভালা দেবরটা তোমায় এরূপে দেখে নিজেকে সামলাতে পারবে কি-না।’

লজ্জায় গাল লাল হয়ে গেলো আমার। প্রথমত আনভীরের সাথে ‘ভোলাভালা’ ওয়ার্ডটা একেবারেই যায়না। আর দ্বিতীয়ত, বিগত দু’দিন ধরে উনার সাথে কথা হয়নি আমার। বস্তুত নাহিদ ভাইয়া, রিমি আপু নীলু, ইশা ধারা কেউ সেটার সুযোগই দেয়নি। আমি জানিনা আজ হঠাৎ মুখোমুখি হওয়ার পর উনি কি প্রতিক্রিয়া করবেন। তখনই নীলু আর ইশা দৌড়ে আসলো ঘরে। বলে উঠলো,

‘ নিচে ঝাক্কাস এন্ট্রি দিয়েছে দুলাভাই বেইব! তুই রেডি তো? তোর ফুপিশ্বাশুড়ি তোকে নিচে নিয়ে যেতে বলেছে।’

নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো আমার। যতটুকু জানি আজকের এই ফাংশনে আনভীরের পক্ষ থেকে আরও বিশেষ কয়েকজন ব্যাক্তিবর্গ এসেছেন। সাথে ক্যামেরাম্যানরা তো আছেই। আমি নার্ভাস ফিল করছিলাম একটু। ভাবি তা দেখে বললেন,

‘ ভয় পাচ্ছো আহি?

‘ একটু।’

ভাবি আলতো হাসলেন। বললেন,

‘ ব্যাপার না। তুমি এসবে অভ্যস্ত না তো! তাই এমন একটু আধটু নার্ভাস ফিল হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটু ম্যানেজ করো।’

‘ কিন্তু……’

এতক্ষণে মুখ খুললো নীলু। আমায় এত হেসিটেড হতে দেখে ভ্রুকুটি করে অবিলম্বে বললো,

‘ ভয়ের জায়গা পাস না আপু? সেদিন যখন এতগুলা মানুষের সামনে আনভীর ভাইয়েকে জাপ্টে ধরলি তখন ভয় কই ছিলো? তোর ওভাবে উনাকে জড়িয়ে ধরাতে জানিস উনার কতগুলা ফ্যান হার্টফেইল করেছিলো? তখন যদি সবার সামনে জড়িয়ে ধরতে পারবি তাহলে এখন ঢং করবি না। ভাব তো এমন করছিস যে তোকে চুমু দিতে বলা হয়েছে।’

বাচ্চা একটামেয়ে আর কথার কি অবস্থা? মিটমিটিয়ে হাসলো সবাই। এর কপালে যেই জামাই জুটবে তার যে জীবন ত্যানা ত্যানা তা ভালোমতই বুঝলাম। তারপর রিমি আপু, ধারা আমায় নিয়ে নিচে নামলো। এখানে বহু মানুষ। লো ভলিউমে গান বাজছে বিধায় পরিবেশটা আরও মোহনীয় হয়ে উঠেছে। আমি এখানে দাঁড়ানো মাত্রই সবার দৃষ্টি আমাতে এলো। ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ক্যান্ডিড তুলে ফেলেছে। আমি অদূরেই আনভীরকে দেখে থমকে রইলাম। উনি স্টেজে বসে আছেন। হালকা হলুদ পান্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা এই মানুষটির গহীন দৃষ্টি আমার দিকে। উনার উজ্জ্বল গায়ে হলুদ রঙটা নিদারুনভাবে ফুটে উঠেছে।হাতাগুলো ভাঁজ থাকায় নার্ভগুলো দৃশ্যমান আমার কাছে। উনার এমন চাহিনী আর ঠোঁটে লেগে থাকা মারাত্নক হাসি যে কাউকেই স্তব্ধ করতে বাধ্য। আমি নজর সরিয়ে নিলাম। টের পেলাম উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করছে বুক। ধারা আমার পাশেই ছিলো। কানে কানে এসে বললো,

‘ দেখছিস এআরকে কিভাবে দেখছে তোকে? হায় মে মারজাওয়া! উনার চাহিনীর উপর আরও একদফা ক্রাশ খেলাম।’

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইতস্তত হলো ধারা। বলে উঠলো,

‘ দুলাভাই রূপেই ক্রাশ খাইসি বেইব। আর কিছু না।’

আমি কিছু বললাম না। তারপর আমায় স্টেজে আনভীরের পাশে বসিয়ে দিলেন মামী। এই পুরোটা সময়ই আমি চুপ ছিলাম। একটাবারও তাকাইনি আনভীরের দিকে। তারপর হলুদের পর্ব শুরু হলো। একে একে বড় মামু, মামী, ছোট মামা, নীলু এসে গালে মুখে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আনভীরের বাবা-মা তারপর চাচা চাচী ফুপিরাও হলুদ লাগিয়ে দিয়েছেন। তবে শেষমেষ নাহিদ ভাইয়া ইচ্ছে করেই একবাটি হলুদ দিয়ে সারামুখে লাগিয়ে দিয়ে গেলো। আমি রেগেমেগে কিছু বলতে যাবো তখনই নাহিদ ভাইয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

‘ আমায় বলেছিলেন না সকিনা বিবি রসাথে বিয়ে দিবেন? এই আপনার শাস্তি।’

নাহিদ ভাইয়ার এই কান্ড দেখে অট্টহাসিতে মেতে উঠেছিলো সবাই। এমনকি আনভীরও। এই প্রথম উনি নাহিদ ভাইয়াকে আমায় জ্বালাতে দেখে সায় দিলেন। উনার বিক্ষিপ্ত হাসি আমায় নাড়িয়ে দিলেও আমি কিছু বললাম না। তারপর ছবি তুলা হলো আমাদের বেশ কয়েকটা। ছবি তোলার সময় ক্যামেরাম্যান বারবার,বলছিলেন একটু ক্লোজ হতে। আমি ইতস্তত করতেই আনভীর পেছন দিয়ে আমার কোমড়ে হাত দিয়ে নিজের কাছাকাছি বসালেন এবার। আমি ভড়কে গেলাম। এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আনভীরের দিকে। উনার মুখে ভাবনার লেশমাত্র নেই। আমি অস্ফুটস্বরে বললাম,

‘ কোমড় ছাড়ুন আনভীর। সবাই দেখছে।’

‘ দেখলে দেখুক! কাপল ফটোতে এস কমন বেবিগার্ল!’

কেপে উঠলাম আমি। উনার জড়ানো কন্ঠ, আড়ষ্টময় কথাবার্তার ভঙ্গি যেন,নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়েছে। আনভীর খানিকটা হাসলেন। অতঃপর বললেন,

‘ তোমার থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না আহি!’

আমি সচকিত হলাম। তবুও জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেনো?’

আনভীর দুষ্টু হাসি দিলেন। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ তোমায় প্রচন্ড হটট’ট লাগছে আহি। এতদিনে বুঝলাম ওই দস্যু মেয়েগুলো কেন তোমায় আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে রেখেছিলো। ঠিকই করেছে। এতদিন অস্থির হলেও নিয়ন্ত্রণে ছিলাম। এখন তো মাথা ঠিক রাখতে পারছি না। ইচ্ছে করছে টুপ করে গালে চুমু খেতে। কি বলো, খাবো? ট্রাস্টমি, তাইলে বেস্ট কাপল পিক হবে এটা।’

কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে আমার। এতগুলো কমপ্লিমেন্টের মধ্যে আনভীরের কমপ্লিমেন্ট ছিলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর একেবারেই লাগাম ছাড়া। আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকলাম। এ ধরনের কথা কেবল আনভীরের দ্বারাই সম্ভব।

সময় পার হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রাত আরও গভীর হওয়াতে নেমে পড়েছে ঠান্ডা। সবাই ক্লান্ত হয়ে প্রোগ্রামের পার্ট চুকিয়ে দিলো। হয়তো আগামীকাল সকালেই আমার আর আনভীরের হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে রসালো খবর ছড়ানো শুরু হবে। আমি ক্লান্ত নিনির্মেষে রুমে পা বাড়ালাম। বড়রা সবাই ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে যার যার ঘরে। আমি নাহিদ ভাইয়া আর নীলুকে একসাথে এত হাসাহাসি করতে দেখে অবাক হলাম বেশ। নাহিদ ভাইয়া যে নীলুরাণীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে বুঝতে বাকি নেই। আমায় ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে ইশা ধারা অবাক হয়ে বললো,

‘ এভাবে হাসছিস কেন তুই?’

‘ কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের নাহিদ ভইয়ার বউ পেয়ে গিয়েছি।’

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ধারা ইশা ওদিকে তাকাতেই বড়সড় ঝটকা খেলো। কাদো কাদো স্বরে ইশা এবার বললো,

‘ তোর এই সুন্দর দেবরটাও শেষ পর্যন্ত আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো দোস্তোওও। কই ভাবলাম
এরে পটিয়ে ফেলবো…তাও হলো না!’

একবালতি দুঃখ প্রকাশ করলাম ইশার জন্য। অতঃপর ওদের তাড়া দিয়ে বললাম,

‘ এবার যা তো! শুয়ে পড়। আমি শাড়ি পাল্টাবো। যাওয়ার সময় কষ্ট করে রিমি আপুকে ডেকে দিস তো।’

ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি দরজা ভািড়িয়ে দিলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম আপুর জন্য। কিন্তু রিমি আপুর আসার কোনো চিহ্ন নেই। পাঁচ মিনিট, ছয় মিনিট, সাত মিনিট পার হয়ে গেলো শেষমেষ ক্ষান্ত হয়ে ধাতস্থ করলাম আমি নিজেই খুলার চেষ্টা করবো শাড়ির সেফটিপিন। দরজাটা লাগিয়ে দিলাম তাই। বাইরে ঘন অন্ধকার।শো শো বাতাস জানান দিচ্ছে খাগড়াছড়ির আবহাওয়ার। হালকা হালকা কপাট বাড়ি খাওয়ার শব্দে আমি পরোয়া করলাম না। নিভু নিভু আলোয় শাড়ির সেফটিপিন খুলে কুঁচিতে হাত দিতেই পেছন থেকে কেউ জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘ আই লাইক ইট!’

হঠাৎ হাত অকেজো হয়ে গেলো আমার। মাথার নিউরণ হঠাৎ সাদরে গ্রহণ করতে পারলো না ভরাট পুরুষালি কন্ঠটি। কি শুনলাম এটা আমি? মনে হচ্ছে যে ঘোরে আছি। চোখকে কোনোমতে নিয়ন্ত্রণে এনে আয়নায় দৃষ্টিপাত করলাম আমি। দেখা মাত্র চোখ আপনা আপনিই বড় হয়ে গেলো। ভুল দেখছি না তো? নাকি এটা নিছক কল্পনা? আনভীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। হাত ভাঁজ করে প্রাগাঢ় চাহিনী আমাতে নিক্ষেপ করাতে আমি বিমূঢ় হয়ে রইলাম। ওহ গড! সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে উনি কিভাবে আসলেন এখানে? নড়াচড়া করছিনা দেখে ভ্রুকুটি করে বলে উঠলেন,

‘ ও মাই গড! তুমি এখনই সব খুলে টুলে আমায় কন্ট্রোললেস করার প্ল্যানে আছো নাকি আহি?’
.
.
.
.
.
#চলবে

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here