এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ২৯

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ২৯
আজকের ঘুমটা ধীরে ধীরে কাটলো সকালের উষ্ণ রৌদ্দুরের সংস্পর্শে। আজ হয়তো পর্দাটা টেনে দিতে ভুলে গিয়েছেন আনভীর। আমি পাশে ফিরে দেখলাম উনি বিছানায় নেই। ব্যাপারটা একটু অবাক করে দিলো আমায়। তাই উঠে বসলাম। ম্যাজমেজে ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে তুলে মুখহাত ধুয়ে নিলাম ওয়াশরুম থেকে। নিচে গার্ডেনের কাছে গিয়ে দেখি আনভীর পুলের একসাইডে ফ্রি হ্যান্ড এক্সেরসাইজ করছেন। একটা থ্রি কোয়ার্টার কালো প্যান্ট আর তার ওপর ‘A’ ওয়ার্ডের প্রিন্ট করা একটা ব্ল্যাক হুডি পড়েছেন। গৌরবর্ণের গায়ে যে কোনো ধরনের ডিপ কালারই দারুন মানায় উনাকে। বিগত কিছুদিন ধরেই ঠান্ডা কড়াকড়িভাবে ধরেছে আমায়। এদিকে আগামীকাল হসপিটালে প্রেজেন্টেশন বলে এই কয়েক দিন কাজের ব্যস্ততায় নিজের তেমন একটা যত্ন নেওয়াও হয়নি। আমার হঠাৎ হাঁচির শব্দে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন আনভীর।
নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম মিশ্রিত এই মুখমণ্ডল বুকে ঝড় তুলতে যথেষ্ট। বলতে বাধ্য যে ছোটোখাটো একটা ক্রাশ খেয়েছি উনার ওপর। আনভীরের চুলগুলো ভিজে হুলস্থূল হয়ে পড়ে আছে কপালে। চোখের প্রগাঢ় দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার দিকে। আনভীর নিজের ছোট থেকে ছোট কাজকর্মের মধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে ইনি একজন রকস্টার। বডি ফিগার, ড্রেসআপ, কথাবার্তা সবকিছু উনাকে অন্য চার পাঁচজন থেকে নিমিষেই আলাদা করে দিতে পারবে যা আরও এট্রাক্টিভ করে তুলতে পারবে উনাকে।

আমায় এভাবে নীরবে উনাকে স্ক্যান করতে দেখে দুষ্টু হাসি দিলেন আনভীর। হাত কোলে ভাঁজ করে বললেন,

‘ এভাবে কি দেখছো ‘জান’? ‘

শেষে উনি যেমনভাবে ‘জান’ শব্দটা বলে উঠলেন, আমার হৃদয়ে কম্পন ধরাতে যথেষ্ট ছিলো এটা। শশব্যস্ত হয়ে আমি তাই তাকাই উনার দিকে। এই লোক কি আমায় হার্টফেল টার্টফেল করিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্তে আছে নাকি? যদি এমন হয় তবে উনি সার্থক। এমন ঘায়েল রূপের এমন ঘায়েল কন্ঠে যে কেউই ঘায়েল হয়ে যাবে। কিন্ত আমি এটা বুঝতে দিলাম না উনাকে। সমান পরিসরে ভাব নিয়ে প্রতিউত্তর দিলাম,

‘ আপনার হুতুমপেচা মুখখানা দেখছি। এভাবে যে এক্সেরসাইজ করে বডি ফিট রাখেন, শরীর তো একদিন কাঠ হয়ে যাবে। আমায় দেখেছেন? জীবনেও আপনার মতো এসবে মাথা ঘামাইনি, তবুও, আমার ফিগার কি খারাপ?’

ভেবেছিলাম আমার কথা শুনে থতমত খাবেন আনভীর। কিন্ত আমায় অবাক করে দিয়ে উনি এমন কিছুই বললেন না। বরংচ বলে ওঠলেন,

‘ তোমার ফিগার খারাপ হতে যাবে কেনো? তুমি হলে শুকনো কাঠ। আমার ভার তো জীবনেও নিতে পারবে না। আমি কিসের কথা বলেছি ডুইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’

শেষের ব্যাঙ্গাত্নক কন্ঠে আমার মুখ সিদুর রাঙা বর্ণে ধারন করলো। হাত মুঠো করে নিচের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললাম তাই। হঠাৎ আবার হাঁচি দেওয়াতে আনভীর বলে উঠলেন,

‘ ঠান্ডা বাঁধালে কেনো আবার? বারবার বলি এই সিজনে নিজের এত যত্ন নিতে তবুও এত হীনমন্যতা কেনো?’

আনভীরের কন্ঠে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার রেশ। অহেতুক চিন্তিত হতে দেখে বিরক্ত হলাম আমি। বলি,

‘ এতে এমন বকাবাজি করার মতো কি আছে?’

‘ তুই এমন কাজ করবে আর আমি কিছু বলতে পারবো না?’

আমি চুপসে গেলাম। এইক্ষেত্রে কখনোই আমি পেরে উঠিনা আনভীরের সাথে। তপ্তশ্বাস ছাড়লাম তাই। মৌনতা কাটিয়ে বললাম,

‘ ওকে ফাইন। এখনই আদা চা বানিয়ে নিচ্ছি আমি। তাহলে ঠান্ডা কেটে যাবে। এবার খুশি তো?’

‘ নুড়ী আপাকে রুম থেকে ডেকে নিও।’

‘ আমি আপনার মতো জমিদার মহাশয় না যে নিজের চা বানাতে পারবো না। উনি ঘুমাক। আমি বানাতে পারবো।’

বলেই দ্রুত গার্ডেন থেকে রান্নাঘরের দিকে আমি এগিয়ে গেলাম। চুলায় গরম পানির পট রেখে চা বানাচ্ছি আমি। এভাবেই যখন চা প্রস্তুত হলো ডেস্ক থেকে একটা ব্ল্যাক কালার মগ হাতিয়ে সেটা কিচেন কেবিনেট রাখলাম। ভাবতে থাকলাম আনভীর আর অপূর্ব ভাইয়ার কথা। গতকাল হুট করে কি
একটা ভেবে আমার আগের সিমটা ওপেন করেছিলাম আমি। দেখি অপূর্ব ভাইয়ার অসংখ্য টেক্স আর কল। লাস্ট এর মেসেজটা এমন ছিলো, ‘ আই সোয়্যার আহি যদি তোমায় হাতের নাগালে পাই, একেবারে পাখনা কেটে দেবো। ওই রকস্টারের জন্যই এত সাহস বেড়েছে তাই না? আগে তোমায় পেয়ে নেই দ্যান ওই এআরকের ব্যবস্থা করব আমি।’ এই তিনটি বাক্য বাক্য ভয়ে শেষ করে ফেলেছিলো আমায়। এতটুকু নিশ্চিত হলাম যে সে জানে আমার অবস্থানের ব্যাপারে। আচ্ছা ভাইয়া যদি এটা জানে যে এআরকে আমার লিগ্যালি হাজবেন্ট তবে কি করবে সে? আনভীরের ক্ষতি করবে না তো! জীবনের একটা লম্বা সময় ওই পরিবারে কাটিয়েছি আমি। আমি জানি যে ওরা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। একজন স্মাগলার হিসেবে পলিটিক্যাল, আন্ডারকভার সব পাওয়ার আছে ওদের। যদি আনভীরের কোনো ক্ষ-ক্ষতি করে ফেলে তাইলে?

হঠাৎ অন্যমনষ্ক হওয়াতে গরম চায়ের অল্পাংশ আমার পায়ের ওপর ধপাধপ পড়ে গেলো। এমন করে হঠাৎ ফুল্কির স্পর্শের মতো অনুভূতি পাওয়াতে আর্তনাদ করে উঠি আমি। আমার চিৎকার শুনে আনভীর দ্রুত এসে পড়েন গার্ডেন থেকে। নুড়ী আপা আর নাহিদ ভাইয়াও তন্মধ্যে উঠে পড়েছেন। আনভীর আমায় এভাবে দেখে সময় বিলম্ব না করে দ্রুতই কোলে তুলে নিচের রুমের ওয়াশরুমে নিয়ে যান। বেসিনের পাশে বসিয়ে পা দুটো তুলে দিয়ে আস্তে করে সাইট থেকে কল ছাড়েন। আমি তখনও ঠোঁট কামড়ে উনাকে আঁকড়ে বসে আছি। চা একেবারেই গরম ছিলো। পায়ে ফোস্কা পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে ক্রমাগত। আনভীর যেন এটা দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন আরও। কিছু বলতে গিয়েও না বলে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

পায়ের ওপর পানির শীতলআআস্তরণ গড়িয়ে যাওয়াতে অন্যরকম লাগছে। জ্বালা পোড়নের ওপর বরফ রাখলে যেমন লাগে, তেমনই। আনভীর তাকালেন আমার দিকে। উনার গালটা একেবারেই আমার মুখ ছুঁই ছুঁই । আনভীর হঠাৎ বলে উঠলেন,

‘ কেমন লাগছে এখন?’

শীতল কন্ঠের আহত প্রশ্ন আনভীরের। আমি এ কথা শুনে থমকে কি বলবো ভেবে পেলাম না। অতঃপর ব্যক্ত করলাম,

‘ ভালো।’

এই উত্তরটিতে সন্তুষ্ট হননি আনভীর। তবুও কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন পুনরায় । পানি তখনও আমার পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ছে বিরতিহীনভাবে। বেশ কিছুক্ষণ পর আনভীর পুনরায় কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসালেন। উনি নাহিদকে বললেন,

‘ বার্ন ক্রিম নিয়ে আয় নাহিদ।’

আমি তৎক্ষণাৎ অকপটে বললাম,

‘ আমার ডেস্কে আছে ভাইয়া।’

আনভীর সরু চাহিনী দিলেন আমাতে। আমি তাই আর কিছু বললাম না। নাহিদ ভাইয়া ক্রিম আনতেই আনভীর তা টেনে নিজ দখলে এনে সন্তর্পণে লাগিয়ে দিলেন পায়ে। প্রথমে মুখ দিয়ে ‘উহ’ প্রতিশব্দ বের হলেও আনভীর থমথমে গলায় বললেন,

‘ অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনেছি আহি। আমার হাতে চড় থাপ্পড় না খেতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখো। ডক্টর হয়ে পেশেন্টের মতো আচরণ করবে না।’

‘ ব্যাথা পেলে তখন কি এতকিছুমনে রাখা যায়?’

আমি কথাটি বললাম মুখ ফুলিয়ে। আনভীর প্রতিউত্তর দিলেন না এবার। অতঃপর মৌনতা কাটিয়ে কাতর কন্ঠে বললেন,

‘ আমার কথাটা শুনলে কি হতো তখন?’

আমি নিশ্চুপ। ক্ষণকাল এভাবেই কাটলো প্রচ্ছন্ন নীরবতা। শুধু ঘড়ির টিকটক বহর বিদ্যমান। আনভীর আবার ঠোঁটজোড়া আবছা নাড়িয়ে বললেন,

‘ নেক্সট টাইম এ ভুল করো না আহি। তোমায় এভাবে দেখলে বুক মোচড় দিয়ে উঠে আমার। এখনই দেখো। কান্ড বাধিয়েছো তুমি আর হার্টবিট আমার বেড়েছে আতঙ্কে। তোমার কিছুই করতে হবে না আহি। রান্নাঘরে আর পা বাড়িও না।’

বাচ্চাদের মতো একএকটা কথা বলে যাচ্ছেন উনি। আমার হঠাৎ হাসি এসে পড়লো উনাকে এমন বাচ্চামো করতে দেখে।

___________

দুপুরেই আজকে নাহিদ ভাইয়ার বোন রিমি আপু এসে পড়লো কোথা থেকে। হয়তো নাহিদ ভাইয়াই এনেছে যাতে আমি রান্নাঘরে আর পা বাড়াতে পারি। এই দুই পাগলের পাগলামি দেখে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায় আমার। এক আনভীর সারাদিন এটা করোনা, ওটা করোনার পিছে লেগে থাকে ঠিক তেমনি নাহিদ ভাইয়ায় কথায় ছায়ার মতো আমায় অনুসরন করতে থাকতে। কেননা৷ আনভীর ভয়াবহ সংকেত দিয়েছে, উনার অবর্তমানে নাহিদ যদি ‘ ভাবি কেয়ার ডিউটি’ ঠিকঠাক মতো না করে তবে চপাট করে দু দুটো মাইর। বেচারা নাহিদ ভাইয়া না পেরেছিলো কিছু বলতে আর না পেরেছিলো সইতে।

এদিকে আনভীরকে ইগ্নোর করছি আমি। কারন আমি পানি খাওয়ার জন্য কিচেন রুমের সাইড দিয়ে জগটা আনতেই উনি হুংকার দিয়ে বলে ওঠলেন,

‘ বাচ্চাদের মতো এসব কাজকর্মের মানে কি আহি? তোমায় না আমি নিষেধ করেছি ওখানে যেতে? আবার গেলে পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো।’

কথাগুলো শুনে রাগের তুলনায় কষ্ট হলো খুুব। কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে চলে গেলাম এখান থেকে। নাহিদ ভাইয়া বললেন,

‘ এভাবে ভাবির সাথে…..’

‘ তোর এসব ভাবতে হবে না নাহিদ। বকাটা ওর দরকার ছিলো।’

আনভীরের এ কথায় কিছু বলেননি নাহিদ ভাইয়া আর। আনভীর তারপর চলে গেলেন স্টুডিওতে ভোক্যাল প্র্যাকটিসের জন্য৷ এতে অভিমান আরও চাড়া দিয়ে উঠলো। স্থির করলাম, থাকুক উনি উনার মতো। তারপর উনি কল করলেও হু হা করে কোনোমতে উত্তর দিয়ে রেখে দেই আমি। আনভীর টের পেয়েছন সেটা আমার ব্যবহারে।

রাতে যখন উনি ফিরে আসলেন তখন উনি নুড়ী আপাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সবাই খেয়েছে? নুড়ী আপা বললো,

‘ হ সবাই খাইসে। নাহিদ, রিমি আর আফায় ছাদে আপনার জিমির লগে খেলা করতাসে এহন।’

অবাক হলো আনভীর। আহি তো ঠিক ছিলো শেষপর্যন্ত নাহিদও ভাবীপাগলা হয়ে গেলো? ফ্রেস হয়ে ডিনার সেরে অনেকক্ষণ ওয়েট করলে ছাদেও গিয়ে পায়চারি করে আসলো। কিন্ত কারওই ওর দিকে ধ্যান নেই। পরন্ত আনভীর স্থির করলো, ‘ আর না!’

আমি আড়চোখে দেখছিলাম আনভীরের কার্যকলাপ। উনি হঠাৎ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেও কি ভেবে উপরে উঠে এসে চট করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সেই সাথে নাহিদ ভাইয়া আর রিমি আপুও। আপু বললো,

‘ ভাই আপনি….’

‘ তোরা দুই ভাই বোন কোনো কথা বললে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিবো আমি। ‘

রেগে একথাটা বলেই উনি আমায় নিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালেন। ভয়ে আমার দুরুদুরু অবস্থা।
আমায় রুমে নামাতেই আমি কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই আমার কোমড় চেপে কাছে টেনে আনলেন উনি। থমথমে গলায় বললেন,

‘ আমায় ইগ্নোর করতে ভালোলাগে তাই না আহি? আজ সারারাত তোমার কাছাকাছি থাকবো। তারপর দেখি তুমি আর কত আমায় ইগ্নোর করতে পারো।’

#চলবে

ইয়া বড় মন্তব্য চাই তোমাদের আজ। ইদানীং কমেন্ট করোনা দেখে ভালোও লাগেনা লিখতে। আজ যদি কিপ্টেমি করে শুধু রিয়্যাক্ট দিয়ে চলে যাও, তাইলে ছয়দিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে যাবো কিন্ত!

কায়ানাত আফরিনের পাঠকমহলঃ https://www.facebook.com/groups/727233321503560

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here