#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪২
নিজেকে কারও সাথে আবদ্ধ পেয়ে অগত্যাই আস্তে করে চোখ খুলতে হলো আমায়। আনভীর আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। গতকাল রাতে যেভাবে ছিলেন , এখন শুয়ে আছেন ঠিক একই ভঙ্গিমায়। একটা তীব্র ঘ্রাণ টের পাচ্ছি উনার এত কাছাকাছি থাকাতে। গতকাল রাতের উনার সেই আগ্রাসী স্পর্শগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করতেই মুখে ছড়িয়ে পড়লো রক্তিম আভা। কোনোমতে নড়েচড়ে উনার কাছ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা চালালাম তাই। কিন্ত আমি নড়াচড়ার প্রচেষ্টা করতেই আনভীর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আদেশের মতো করে বললেন,
‘ ডোন্ট ট্রাই টু মুভ আহি!’
আমি কিঞ্চিত চমকে উঠলাম। কেননা এই কন্ঠে ঘুমের রেশ এর ছিঁটেফোটা টুকুও ছিলো না। কেমন যেন এক আলাদা মাদকতা কাজ করে মাঝে মাঝে উনার কথাগুলোতে। আমি মাথা উঠিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে। উনি এখনও আছেন চোখ বন্ধ অবস্থায়। কেউ চট করে এসে উনাকে এই মুহূর্তে দেখলে নিশ্চিত ধোঁকা খাবে যে ইনি ঘুমে মশগুল। আনভীর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন এবার। চুপচাপ নিজকে আধশোয়া অবস্থায় ধাতস্থ করে আমায় বুকে টেনে নিলেন। কে বলবে এই মানুষটা আমায় বিয়েই করেছে নিছক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে? যদিও উনি নিজের লক্ষ্য পাল্টে ফেলেছেন তবুও এক চাপা অভিমান কাজ করলো আমার আনভীরের উপর। নিজেকে উনার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা পুনরায় করতেই উনি জড়ানো গলায় বললেন,
‘ বড্ড নড়বড়ে টাইপ মেয়ে তো তুমি? শুনো নি যে আমি নড়াচড়া করতে না বলেছি?’
‘ তাহলে এভাবেই সারাদিন কাটাবো নাকি?’
কথাটি অনেকটা রেগেই বলতে হলো আমায়। তবে আমার এই কথার পরোয়া করলেন না আনভীর। পাত্তাহীন ভাব নিয়ে বললেন,
‘ সারাদিন কেন, সারাদিন প্লাস সারারাতই তুমি চাইলে এভাবে থাকতে পারবে। আমার একেবারেই কাছাকাছি। আমি মাইন্ড করবো না। তারপর এভাবেই নাহয় বেবি প্ল্যানিং এর চিন্তা ভাবনা করা যাবে।’
চোখ নামিয়ে ফেললাম আমি টুপ করে। ঠোঁট কামড়ে অন্যত্র তাকিয়ে রইলাম নিজেকে সংযত রাখার জন্য। আচ্ছা এই লোকের কি আসলেই লজ্জা শরমের ছিঁটে ফোটা নেই? যেসব কথা বলে রে আল্লাহ, বুলেটের মতো ছ্যাঁত করে বুকে গিয়ে আটকে যায়। অন্য সময় হলে আমি লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে চলে যেতাম, কিন্ত এখনও চুপ থাকতে দেখে আনভীর আন্দাজ করতে পারলেন আমার বিষয়টা। প্রশ্ন করলেন,
‘ রেগে আছো এখনও আমার উপর?’
আমি নিরুত্তর। গতকাল পণ করেছিলাম না উনার কথার জবাব না দেওয়ার, সে পণের সাপেক্ষেই চুপচাপ আছি। আনভীর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভ্রুকুটি করে দেখতে থাকলেন আমার কার্যকলাপ। অতঃপর ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
‘ ডোন্ট ডেয়ার টু ডু দ্যাট আহি। তোমার এসব লক্ষণ কিন্ত আমার ভালোলাগছে না।’
না লাগলেও কিছু করার নেই। আমি যখন উনাকে শাস্তি দেওয়ার পণ করেছি সেটার শেষ তাহলে করেই ছাড়বো।মাথাঘুরিয়ে ঘড়িতে দিকে তাকালাম আমি। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,
‘ আমাকে হসপিটালে যেতে হবে আনভীর। উঠতে দিন।’
আমায় কথায় আনভীর তাই ছেড়ে দিলেন আমায়। আমিও কথা না বাড়িয়ে তাই কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম।
_________
নীলু ড্রইংরুমে বসে মোবাইল স্ক্রল করতে ব্যস্ত আনমনে। বারবার সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে যে আহি কখন আসবে। কিন্ত আসার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে মনে ফুসে উঠলো নীলু৷ বিড়বিড়িয়ে বললো,
‘ উফ! আপুর কি ঘুম শেষ হচ্ছে না?’
নাহিদ আজ বেশ সকালেই বেরিয়ে গিয়েছিলো জগিং করতে। সপ্তাহে তিনবার ও ট্রেডমিলে দৌঁড়ায় আর অন্য টাইম গুলোতে বাইরে। কমপক্ষে বিশ মিনিট না দৌড়ালেঁও কেমন যেন ভার লাগে শরীর। আজ প্রায় পৌনে এক ঘন্টা দৌঁড়িয়ে আসলো বাইরে থেকে। এসেই হাঁপিয়ে বসে পড়লো সোফায়। কপালে বিন্দু বিন্দু গাম জমেছে নাহিদের। সেই সাথে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। নাহিদ কেডস খুলতে খুলতে বললো,
‘ নুড়ী আপা, ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে আসেন তো একটু!’
নুড়ী আপা এখানে নেই। ইয়ার্ডে পানি দিতে গিয়েছে। তাই অগত্যাই উঠলো নীলু। ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে নাহিদের দিকে বাড়িয়ে বললে,
‘ এই নিন।’
পরিচিত কন্ঠ না পেয়ে নাহিদ তাকালো নীলুর দিকে। ঘুম থেকে উঠেছে বেশ অনেকক্ষণ হলেও মুখটা স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটার। নাহিদ ওর হাত থেকে বোতল নিয়ে বিনয়ী সুরে বললো,
‘ থ্যাংক ইউ!’
নীলু কোনো প্রতিউত্তর করলো না। তখনই হঠাৎ ইয়ার্ড থেকে জিমি এলো দৌঁড়িয়ে। কুকুরের আওয়াজে নীলু কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও যখন দেখলো সেটা নাহিদের কোলের উপর বসার জন্য উতলা হয়ে আছে তখন ভ্রুকুটি করলো। বললো,
‘ এটা কে?’
‘ এআরকে’র পেট ডগ। জিমি নাম।’
নীলু এখনও বিস্ময়ে। বাচ্চা কুকুর ছানাটি বলতে হবে অনেক সুন্দর দেখতে। তাই বলে উঠলো,
‘ দেখিনি তো একে আগে?’
‘ দেখবে কিভাবে। জিমি তো ইয়ার্ড থেকে এখানে আসতে পারে না। ভাবি ভয় পায় দেখে ওকে ওখানেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘
মাঝে মাঝে আহির এত ভালো ভাগ্য দেখে মনে মনে হিংসে হয় নীলুর। কিন্তু ও এই ব্যাপারে কিছু বললো না। জিমি নাহিদের কোলে নানারকম ভঙ্গিমায় খেলা করে যাচ্ছে। নীলু এবার বললো,
‘ আপনারও কি পেট ডগ পছন্দের?’
নাহিদ বিষম খেলো। কেননা নীলু কখনও ওর ব্যাপারে এতটা আগ্রহ দেখায় নি। তাই প্রতিউত্তরে বললো,
‘ উমমম! হ্যাঁ বলতে পারো।’
‘ আমার এতটাও পছন্দ না। সত্যি কথা বলতে আগ্রহও দেখাইনি কখনও এ ব্যাপারে। আচ্ছা ভাবুন তো, আপনার উডবি ওয়াইফ যদি আহি আপুর মতোই কুকুর ভয় পায় তাইলে আপনি কি করবেন?’
‘ থাপ্পড় দিয়ে ভয় কাটিয়ে দিবো। আমার আবার এত ধৈর্য নেই বউকে সামলানোর৷ ভাইয়ের বউ সামলাতে সামলাতেই আধমরা হয়ে যাচ্ছি তারপর আমার আপকামিং বউয়ের জ্বালায় তো মরেই যাবো।’
এতক্ষণ এদের কথাবার্তা শুনছিলাম আমি। নাহিদ ভাইয়ার এই কথা শোনামাত্র কটাক্ষ করে বললাম,
‘ কি বললেন?’
থতমত খেলেন নাহিদ ভাইয়া। ভাবতে পারেননি যে আমি এভাবে উনার কথা শুনে ফেলেবো। পিছনে ঘাড় বাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ভ-ভা-ভাবি লিসেন…….’
‘ আমায় সামলানো খুব কষ্টের কাজ, তাইনা?’
শীতল কন্ঠে কথাটি জিজ্ঞেস করলাম আমি। নাহিদ ভাইয়া শুকনো ঢোক গিললেন। ব্যাটার এই অবস্থা দেখে নীলু না পারছে হাসতে না পারছে কিছু বলতে। তবে এই নাহিদ রেজওয়ানের সাথে যে আমার সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয় তা ভালোমতোই আন্দাজ করতে পেরেছে।
আমি পা বাড়িয়ে নাহিদ ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। কটাক্ষ করে বললাম,
‘ আমায় সামলাতে সামলাতে আধমরা হয়ে যাচ্ছেন তাই না নাহিদ ভাইয়া? তাহলে এমন কিছু করা উচিত যাতে আপনি একেবারেই টপকে যান। টেনশন নট ব্রাদার, এই তায়্যিরাত উম্মে আহি এতটা সহজ মেয়ে নয়, খুব শখ না আমার জ্বালা থেকে ছাড় পাওয়ার? আজ জ্বালাতে জ্বালাতেই আপনাকে মেরে ফেলবো। একটু তিড়িং বিড়িং করলে ডিরেক্ট আপনার ভাইয়ের কাছে বিচার। উনি তারপর কি করবেন তা নাহয় পরেই দেখে নিয়েন৷ ‘
আমার একথায় ভালোমতোই জব্দ হয়েছে নাহিদ ভাইয়া। আমি এবার দুষ্টু হাসি দিয়ে সরে এলাম। একটা ভাব নিয়ে বললাম,
‘ মি. নাহিদ। জলদি গাড়ি রেডি করুন। আমায় হসপিটালে যেতে হবে। আজ আর আনভীরের সাথে যাবেন না আপনি।’
আনভীর নামতে নামতে শুনে ফেললেন আমার কথা। একটা সাদা চেক শার্ট পড়েছেন উনি। সাথে ব্লু জিন্স। আজ উনার একটা টক-শো তে যাওয়ার কথা ছিলো। হয়তো সেখানেই যাবেন৷ আনভীর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আজকে আমার আসতে লেট হবে নাহিদ। আসিফকে নিয়ে যাচ্ছি। তুই আহির সাথেই থাকিস। আমার মনে হচ্ছে সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জার্নালিস্ট আসতে পারে ওর কাছে। তাই সাবধানে থাকিস৷ ওই দল যেন আহির মুখোমুখি হতে না পারে।’
আনভীর তাকালেন আমার দিকে। আমায় এভাবে নির্বিকার দেখে অবাক হলেন বেশ। তার থেকেও আরও বেশি অবাক হলেন এটা দেখে যে আমি উনি ছাড়া সবার সাথেই কথা বলছি। হসপিটালে যাওয়ার সময় উনি বারবার বললেন সাবধানে যেতে। আর অপূর্ব কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করলে উনাকে বলতে। আমি তখন বললাম,
‘ আমারটা আমি ভালো বুঝি আনভীর। এই নাটকীয়তার আর দরকার হবে না।’
______________
‘ আহি তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে? এটা কি সত্যি?’
ধ্রুব স্যারের এ কথায় চমকে উঠলাম বেশ। হসপিটালে এখন লাঞ্চ টাইম। আমরা সবাই এখন ক্যান্টিনে বসে আছি। তিশা একথা শুনে অবাক হয়ে বললো,
‘ কি বলছেন স্যার? আমরাই তো জানিনা।’
‘ ওকে কল দেওয়ার পর ওর উডবি রিসিভ করেই বললো।
ধ্রুব স্যারের এ কথায় কি বলবো ভেবে পেলাম না। তিশা রেগেমেগে তাকালো আমার দিকে। বলে উঠলো,
‘ এভাবে কথাটা লুকালি কেন তুই আহি?’
আমতা আমতা করে উঠলাম আমি। বললাম,
‘ আমি… আমি আজই বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু…’
‘ আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে। ছেলেটা কে রে? কি করে?’
মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি৷ তিশা যদি শুনে যে ওই ছেলে কে হতে পারে ও তো শোকেই পটল তুলবে৷ ধ্রুব স্যার এবার বললেন,
‘ কি হলো আহি? বলো সে কে?’
আমি চট করে বললাম,
‘ ইটস সিক্রেট গাইস। একদিন উনাকে নিয়ে আসবো এখানে।’
আমার এই মিথ্যে কথায় সবাই আশ্বস্ত হলেও সন্তুষ্ট হলো না। তারপর লাঞ্চ সেরে আমরা যে যার মতো ডিউটিতে চলে গেলাম।
_______
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে প্রায়। নাহিদ ভাইয়ার সাথে বাড়ি ফিরছি আমি। মনটা কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নাহিদ ভাইয়া হয়তো সেটা আন্দাজ করতে পারলেন। তাই জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কিছু খাবেন ভাবি?’
‘ কি খাবো এখানে?’
‘একটা ভালো ক্যাফে আছে এখানে। চাইলে খেতে পারবেন।’
‘ তাহলে নিয়ে যান ওখানে।’
সেখানেই নিয়ে গেলো নাহিদ ভাইয়া৷ একটা চকলেট কেক অর্ডার দিলেন। বললেন,
‘ আমি প্রায়ই এখানে আসলে পেস্ট্রি খাই যখন প্রচুর চাপে থাকি। খেয়ে দেখবেন, আপনার ভালোলাগবে। ‘
নাহিদ ভাইয়ার কথাটা সত্যি বের হলো। আসলেই ভালো হয়েছে পেস্ট্রিটা। এর জন্য থ্যাংকস জানাতেও ভুলিনি। তখন হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে আনভীরের নাম লিখা। প্রথমে ভাবলাম রিসিভ করবো না। তারপর দু’বার কেটে যাওয়ার পর কি ভেবে পরের বার রিসিভ করে নিলাম কলটি। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ কি হয়েছে?’
এতক্ষণ কলের ওপর কল দিচ্ছিলেন আনভীর। আমার কল রিসিভ করাতে চুপ হয়ে গেলেন। থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি হয়েছে তোমার হ্যাঁ? সমস্যাটা কি?’
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
সবার কমেন্ট চাচ্ছি এই পোস্টে ❤️