এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ৫০

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৫০

পাহাড়ি বুনো গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। চোখ খুলে পাহাড়ি পথের আকেবাকেঁ নিজেকে আবিষ্কার করলাম। অর্থাৎ খাগড়াছড়িতে এসে পড়েছি আমরা। পুরো পিকনিক বাসটা এখনও ঘুমে মগ্ন। আকাশে সবেমাত্র আলো ফুটে ওঠা শুরু করেছে। এসময় পাহাড়ে ঘেরা এই দৃশ্যগুলোকে লাগছে মায়া কাননের মতো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালাম। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে চমকে উঠলাম বেশ। আনভীর ঘুমিয়ে আছেন। তার একহাত আমার হাতে আবদ্ধ আর মাথাটা আলতো ভাবে সিটে এলিয়ে দেওয়া। সদ্য ফুটে ওঠা আলোয় অন্যরকম লাগছে ঘুমন্ত আনভীরকে। আমি অপ্রতিভ হলাম কেননা হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে উনাকে দেখার জন্য নার্ভ সচল ছিলো না আমার। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘুমানোর পূর্বে আমি আমার পাশে দেখেছিলাম শিউলি ভাবিকে। বাসের এক অংশ মেয়েদের দখলে আর বাকি অংশ ছেলেদের। কড়া করে বলে দেওয়া হয়েছে ছেলে মেয়ে একসাথে বসবে না। কথাটি আজরান ভাইয়া আর আনভীরের উপর বিশেষ প্রয়োগ করে বলা হয়েছিলো। আনভীর তখন কথা বলেন নি আর। বুঝেছিলেন যে নীলু আর রিমি নামের দুই অগ্নি বালিকা থাকলে আমার সাথে আর কথা বলতে পারবেন না। বাসের জার্নিটা প্রথম প্রথম আনন্দের লাগলেও ঘন্টা কয়েক বাদে চোখে ঘুম জরিয়ে এসেছিলো। শিউলি ভাবির সাথে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পাই নি!

আপাতত বিভ্রান্তে আছি আমি। চট করে মিলিয়ে নিতে পারছিনা শিউলি ভাবির জায়গায় এখানে আনভীর এলো কিভাবে। তাহলে এটাই ধরে নিবো যে মধ্যরাতে সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে গেলে আনভীর ভাবিকে ম্যানেজ করে এখানে এসেছেন? আমার ঠোঁটকোলে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো এবার। মানুষটা কিছুটা পাগলাটে জানি, তবে এতটা সীমা ছাড়িয়ে অস্থির হবেন তা ভাবতেই পারিনি আমি, হয়তো ভাবাও অসম্ভব ছিলো। অপ্রতুলতার সাথে উনার গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি স্পর্শ করার চিন্তায় হাত বাড়াতেই যেন সঙ্কোচ কাজ করলো। নিজেকে এখন উনার স্ত্রী রূপে মনে হচ্ছেনা। অন্যান্য বাঙালি মেয়েদের মতো হঠাৎ ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘এখন না! বিয়ের পর সব।’

আনমনেই হেসে উঠলাম আমি। তখনকার হঠাৎ বিয়ের থেকে এই বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা মনে এমন জায়গা নিয়েছে যে সবকিছু নতুন আঙ্গিকে অনুভব হচ্ছে আমার। পাখির কলকাতানও যেন আমার ভাবনাকে সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলো।

____________

নাহিদ ভাইয়াদের বিশাল বাড়িটা খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১ কি.মি দূরে। আমাদের পৌঁছুতে পৌঁছুতে রোদ উঠে গিয়েছে। বাস থেকে আমার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে আমি নামলাম। পাশেই শিউলি ভাবি। সবাই ওঠার আগেই আনভীর জায়গা অদল বদল করে নিয়েছিলেন ভাবির সাথে। আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘ আমার ঘুমানোর পর কেন শিউলি ভাবির সাথে জায়গা চেন্জ করলেন আপনি?’

আনভীর আমার কড়া প্রশ্নের পরোয়া করলেন না৷ নিজের মতোই শান্ত সুরে বললেন,

‘ আজরান ভাইয়ের সাথে থেকে শান্তি আছে? যার জিনিস তাকে দেওয়াই ভালো। তাই শিউলি ভাবিকে তার কাছে পাঠিয়েছি।

আমি তাজ্জব না হয়ে পারলাম না। অস্ফুটস্বরে বললাম,

‘ তাই বলে সবার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর? আমার পাশে বসে আশেপাশের মশা মেরেছিলেন বুঝি?’

আনভীর দুষ্টু হাসি দিলেন। অতঃপর এগিয়ে এলেন কাছে ফিসফিসানো সম্মোহিত কন্ঠে বললেন,

‘ শুধু মশা মারিনি। আরও অনেককিছু করেছি। তুমি তো ঘুমে কুটুম হয়ে ছিলে। আমার এতকিছু করাতে কি আর টের পেয়েছো?’

উনি স্পষ্টই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অন্যকিছুর। গাল তখন আমার আপনা আপনিই লাল হয়ে গেলো। নিজেকে মুড়িয়ে ফেলেছিলাম লজ্জায়। তখন থেকে বাস থামার আগ পর্যন্ত একবারও চোখে তাকাইনি উনার। এমনকি বাস থেকে নেমেও না। সবাই ক্লন্ত হয়ে একে একে নামছেন। নাহিদ ভাইয়া আর ছোট মামা ব্যাগ নামাচ্ছেন এবার। আমি চুপচাপ বড় মামুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম বিশালাকার বাড়িটি।

বাস আসা মাত্রই ভেতরে খবর পাঠানো হলো যে আমরা এসে পড়েছি। তারপর বাড়ির লোকেরা একে একে সবাই এসে পড়লো বাইরে। এর মধ্যে মধ্যবয়স্কা এক মহিলা প্রথমেই সালাম দিলেন আনভীরের বাবা-মা’কে। জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেমন আছেন ভাইজান? আজ কতদিন পর আপনাদের সাথে দেখা। সুযোগ ছাড়া তো আসতেই চাননা। এই বোনটার কথা কি একবারও মনে পড়েনা?’

মহিলার চোখে বিন্দু বিন্দু জল। ঠাহর করতে পারলাম যে ইনিই নাহিদ ভাইয়ার মা। চাপা রং, পুরু ঠোঁট, ঘোমটা দেওয়া থাকলেও কাচা পাকা চুল অন্যমাত্রা দিচ্ছে মহিলাটিকে। নাহিদ ভাইয়ার চেহারা অবিকল উনার মায়ের মতো। নাহিদ ভাইয়ার বাবাও এসে কোলাকোলি করলেন বাবার সাথে। তবে উনার স্বভাবটা একটু চাপা ধরনের, যা কথাবার্তার ধাঁচেই ধরা যাচ্ছে। তারপর মহিলা একে একে আমার বড় মামু, মামী, ছোট মামার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো। বাকি আত্নীয়রা বিকেলের পর আসবে তই তাদের আয়োজন পরে হবে বলে স্থির করা হলো। আনভীর নিজেই তারপর নাহিদ ভাইয়ার মা’কে গিয়ে জরিয়ে ধরলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কেমন আছো ফুপি?’

মহিলার চোখ মুখ আনন্দে আটখানা। আনভীরের দু’গালে হাত রেখে পরম চোখে দেখতে থাকলেন উনাকে। স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ কতদিন পর তোর চাঁদমুখখানা দেখলাম বাবা? তোর বাবার মতো এই ফুপিকে তো ভুলেই গিয়েছিস তুই। জানিস মাঝে মাঝে তোকে কত দেখতে ইচ্ছে হতো? নাহিদের থেকেও তোর কথা মনে পড়তো বেশি। ছোটবেলায় কত আসতি, কত তুই আর আজরান মিলে এই উঠোনে দৌঁড়োদৌড়ি করেছিস, সময় কত অদ্ভুত তাই না? এখন তো তোর আর সময়ই নেই। হাজারো মানুষের ভালোবাসার ভীড়ে এই তুচ্ছ মহিলাটিকে কি আর মনে থাকে?’

আমি স্পষ্ট টের পেলাম উনার মনের কোণে জমে থাকা মেঘ। আনভীর পরম আদরে আগলে ধরলেন উনার হাত। নরম কন্ঠে আহ্লাদি সুরে বললেন,

‘ সরি ফুপি, তোমার এই ছেলেটাকে এবারের মতো মাফ করবে না?’

উনি হেসে দিলেন আনভীরের এমন কান্ডে। বললেন,

‘ ধ্যুর ছেলে, তোর ওপর কি রাগ থাকা যায়? দিন দিন কত সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস রে তুই আনভীর! বিয়েও করছিস। আল্লাহপাক না করুক মানুষের কু নজর যেন তোর ওপর না পড়ে। তো, তোর হবু বেগম কোথায়?’

এই কথা শুনে অস্বস্তি নিয়ে,দাঁড়িয়ে পড়ি আমি। আনভীর মিহি হেসে ইশারায় উনাকে দেখালেন আমার দিকে। এভাবে সরাসরি তাকানোতে আমি যেন আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। অতঃপর এগিয়ে বললেন,

‘ তুমিই তাইলে ইকবালের মেয়ে আহি?’

বুঝলাম উনি চিনেন আমার,বাবাকে। হয়তো সেটা পারিবারিকসূত্র থেকেই। আমি সালাম দিলাম উনাকে। বললাম আমিই সেই মেয়ে। মহিলা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখলেন আমায়। বলে উঠলেন,

‘ মাশাআল্লাহ… মাশাআল্লাহ.. মাশাআল্লাহ! তুমি তো বেজায় সুন্দর দেখতে? আনভীরের পছন্দ আছে বলতে হবে। এমন মেয়ের জন্য তো যে কেউ জানও দিতে পারবে।’

আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তবুও কথা আগানোর জন্য উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কেমন আছেন ফুপি?’

উনি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলেন আমার মুখপানে। হয়তো ফুপি বলেছি বলে মনেমনে খুশিই হয়েছেন বেশ। বলে উঠলেন,

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। তোমরা সবাই ভেতরে আসো, বসো। বিশাল বাসা আমাদের। এক ঘর পুরো ছেলেদের জন্য আর আরেক ঘর মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। ওই যে রিমি কি যেন বলছিলো ডেস্টিফিশন….’

‘ ডেস্টিনেশন ওয়েডিং মা!’

রিমি আপু বললো। ফুপি প্রতিউত্তরে বললেন,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই। এর জন্য কি আবার রিসোর্ট ফিসোর্ট হোটেল বুক করতে লাগে? আমাদের বিশাল বাড়ি। নাহিদের দাদা খুব শখ করে করেছিলেন এই বাড়ি। জম্পেশ মজা করতে পারবে সবাই। বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই।’

ফুপির কথা শুনে ভেতরে ভেতরে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো নীলু আর রিমি। আনভীরকে জব্দ করার জন্য হয়তো এরা,ভয়ংকর থেকেও ভয়ংকর কোনো পরিকল্পনা করেছে। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লাম। আসলেই ক্লান্ত আমি। আমি,সহ বাকি সবাই। শিউলি ভাবি যেহেতু প্রেগনেন্ট তাই দায়িত্বটি এড়িয়ে যেতে চাইনি। তার,হাত ধরেই চলে গেলাম ভেতরে।

______________________

রাত ঢলেছে ধরনীর বুকে। শীতল ছমছমে হাওয়া বহমান। বাড়ির সামনে বিশাল ঘাসে আচ্ছাদিত সমান্তরাল জায়গায় সাজানো হচ্ছে স্টেজ। আজ দুপুর নাগাদই ঢাকা থেকে ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্টের লোকেরা এসেছে। একে একে আনভীর আর আমায় দেখিয়েছে সকল আয়োজন।সব তো ঠিকছিলো কিন্তু বিরক্ত হলাম এত ভারী লেহেঙ্গা আর মেক-আপের সামগ্রী দখে। সাজগোজে যে আমার অনীহা ব্যাপারটা তা না। কিন্তু একপর্যায় যখন আমায় আর আনভীরকে হাজারো ক্যামেরার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তখন সত্যিই নার্ভাস হয়ে পড়বো আমি।

ছাদে সবাই আড্ডা দিচ্ছি আমরা। আমার সাথে ইশা আর ধারা বসা। বিকেলেই প্যাকিং করে এসেছে দু’জন ঢাকা থেকে। এদের রিসিভ করতে গিয়েছে নাহিদ ভাইয়া। নাহিদ ভাইয়াকে দেখেই এদের মাথাঘুরে যাওয়ার উপক্রম হলো।আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘ দোস্ত! এই হ্যান্ডু দেবরটাকে এতদিন কই লুকিয়ে রেখেছিলি তুই? কি ফিগার মাইরি! তাকালেই হার্ট ধুকপুক করতে থাকে।’

আমি চোখ গরম করে তাকালাম এদের দিকে। বললাম,

‘ তোরা মেয়ে জাতটাকে কলঙ্ক বানিয়ে দিলি রে! ছেলে দেখলেই পিনিক উঠে যায়।’

মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো এরা দু’জন। এদিকে আমি ভাবছি আনভীরের কথা। আসা পর্যন্ত একবারও কথা হয়নি উনার সাথে। বস্তুত কেউ সুযোগই দেয়নি সেটার! নীলু হতো খেয়াল করলো সেটা। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠলো,

‘ ছটফট করছিস কেন আপু?’

‘ আরে বুঝো না মেয়ে? ভাবিজানটা আমার আনভীর ভাইয়ার শোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে।’

রিমি আপুর কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। ওপাশে নাহিদ ভাইয়াও মিটমিটিয়ে হাসছে। গাল লাল হয়ে গেলো আমার। এরা সবাই ভয়ঙ্কর রকমের অ’শ্লী’ল কথাবার্তা শুরু করেছে। আমি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে সত্যি সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যাবো। উঠে যেতে নিবো আমার সাথে সাথে উঠে এলো নীলু, রিমি এমনকি ধারাও। বিরক্ত হলাম আমি। যেখানেই যাই সেখানেই এরা বডিগার্ডের মতো আশপাশে ঘুরঘুর করে। মূলত আনভীরের সাথে যাতে একদন্ডও কথা নাহয় সেই প্রচেষ্টা।

আমি কিছুক্ষণ পরপরই আশপাশে দেখেছি আনভীরকে। বারবার আমায় দেখছেন, চোখাচোখিও হয়েছে কয়েকবার। তবে বাবা, মামু বা আজরান ভাইয়ার জন্য ভয়ে এদিকে এগোতে পারলো না। নাহিদ এবার মোবাইল নিয়ে বসলো আনভীরের পাশে। আনভীর বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ এভাবে কতদিন জ্বালাতন করবি তোরা? আমার বউ দুনিয়ার সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলছে অথচ বদমাশগুলো আমায় কথা বলতে দিচ্ছে না। বাবার জন্য এগোতেও পারছিনা ভয়ে।’

অন্য সময় হলে আনভীরের শোকে সমান সমবেদনা জানাতো নাহিদ। তবে এইবার এই প্রথম সে মনে মনে শয়তানি আনন্দে মেতে উঠলো। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘ আপনারা দুই মিয়া বিবি আমার সিঙ্গেল লাইফের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন আনভীর ভাই। এক মাঘে শীত যায় না। এতদিন আমার সামনে বউ নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে আমায় বউয়ের অভাব বুঝিয়েছিলেন না! এবার বুঝবেন ঠেলা।’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
অর্ধশত পর্ব পড়ে অনুভূতি কেমন আপনাদের? মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকবো🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here