#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৯
-‘ এত কাঁপাকাপিঁ করছো কেনো মিসেস আহি? বিয়ে করা বর আমি তোমার। খুব না বলেছিলে আমি এটা-আমি সেটা , এখন লিগ্যালি তোমার কাছে আসাতেই কাপাঁকাপি স্টার্ট? এখন তোমার কাঁপাকাঁপি বন্ধ করার জন্য কিছু একটা করতে হবে মনে হচ্ছে।
উনার শেষ কথাটি শুনে কান গরম হয়ে গেলো আমার। আমতা আমতা করে বললাম,
-ক….কিছুই ক…..করতে হবে না আপনাকে বুঝেছেন? জাস্ট আমার কাছ থেকে দু’ধাপ পিছিয়ে যান৷ এতেই আমি খুশি।’
আমি কথাটি এবার বলে ফেললাম চোখজোড়া বন্ধ করে। অস্বস্তি হচ্ছে আমার৷ এককথায় প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি। আমার সারা শরীর অন্যরকম এক অনুভূতিতে সাড়া দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যে সামনের মানুষটা আমার লাইফ পার্টনার, ‘আনভীর রেজওয়ান খান’ এই মানুষটার সাথে এখন গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছি আমি। হোক সেটা কিছুটা অন্যভাবেই।
আনভীর সরলেন না, বরং আরও কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন আমার৷ উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস অবিশ্রান্তভাবে আছড়ে পড়ছে আমার কপালের ওপর৷ দৃষ্টি আমাতে আবদ্ধ। আমি সেই মুখটির দিকে তাকাতে পারলাম না। মাথা নিচু করে আনমনে ঠৌঁট কামড়ে ধরলাম। আনভীর তপ্তশ্বাস ছাড়লেন এবার। বলে ওঠলেন,
-‘ কি মনে হয় তোমার আহি যে আমি তোমায় কেনো বিয়ে করেছি?’
আনভীরের এমন প্রশ্ন শুনে আমি মাথা তুলে তাকালাম। উনি খানিকটা ঝুঁকে আছেন আমার দিকে। পুনরায় বললেন,
-প্রশ্ন জাগে না মনে যে আমি তো আমার ফ্যামিলির কোনো কথাই শুনি না। চাইলেই আমি বলতে পারতাম যে আমি তোমায় এনেছি অন্যকোনো কারনে। কেন বলিনি জানো? জানো যে কেন এভাবেই বিয়ে করেছি আমি?’
আমি মাথা ডানে বাঁয়ে ঘুরালাম। ইঙ্গিত দিলাম যে আমি জানি না। আনভীরে ঠোঁটজোড়া চেপে নিঃশ্বাস ছাড়লেন আরও একবার৷ বলে ওঠলেন,
-‘ তোমার দোষে তোমায় বিয়ে করেছি আমি। যতই চাইতাম তোমার থেকে দূরে যেতে ততই চুম্বকের মতো আমায় কাছে টেনেছো তুমি। তারওপর যা কান্ড ঘটালে তোমায় আজ বিয়ে না করলে নির্ঘাত তোমার ঠিকানা অন্যত্র হতো আজ।’
আনভীরের কথাটি শুনে একটু রাগ হলো আমার। গলা নিচু করে বলে ওঠলাম,
-‘ আসলেই দোষ আমার। না তখন অপূর্ব ভাইয়াকে দেখে রিয়্যাক্ট করতাম আর না আপনি বাধ্য হয়ে আপনার রুমে আমায় নিয়ে আসতেন। দুজন আনম্যারিড ছেলে-মেয়ে যদি এভাবে এক ছাদের নিচে থাকে শুধু ফ্যামিলি কেন, যে কেউই সমালোচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি রাইট, আমিই কান্ডটা ঘটিয়েছি। নাহলে আপনার মতো পপুলার আইডল এর কাছে তো বিয়ে বোরিং ব্যাপার। আমার মতো ইউজলেস মেয়েকে কেনই বা বিয়ে করবেন আপনি?’
আমি একথা বলে উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।নাকটা অস্বাভাবিকভাবে লাল হয়ে আছে। আমি বুঝলাম আমার কথা শুনে রেগে গিয়েছেন উনি। আনভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ক্লান্ত নিনির্মেষে চুলগুলো ঠেলে দিলেন পেছন দিকে। খানিকাটা শক্ত কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-‘ তুমি ইউজলেস কি না জানিনা তবে তোমার স্টুপিড কথাগুলো চরম লেভেলের ইউজলেস।’
-‘ কেনো?’
আমি এই প্রশ্নটা করতেই আনভীর কোমড় চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন আমায়। আমি ভড়কে গেলাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম উনাকে। কিন্ত ভাবান্তর নেই উনার। আমার কাটা চুলগুলো কানের পেছন গুঁজে মিহি কন্ঠে বলে ওঠলেন,
-‘ আজ আমাদের ফার্স্ট নাইট না হলে নির্ঘাত দু’গালে টাস টাস করে মারতাম আমি। আফসোস, তোমায় মারার মতো সাহসটা আমার নেই। কারন তোমার এই গাল দুটো মারার জিনিস না, আদর করার জিনিস। আর কি বললে, আমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি তোমায়! তাহলে লিসেন, এআরকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনোই কোনো স্টেপ নেয়না। আমি তোমায় বিয়ে করেছি সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়। তোমায় নিয়ে কম্প্রোমাইজ করা অসম্ভব আমার পক্ষে। আর বিয়ে করতে যেভাবে রাজি হয়েছো সেভাবেই আমায় নাহয় মেনে নেওয়া স্টার্ট করো!’
আমি মৌনতা কাটালাম উনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ আমায় ভালোবাসেন আনভীর?’
আনভীর মিহিয়ে গেলেন। আমি আবার বললাম,
-‘ আঙ্কেল আন্টির সামনে আপনি হ্যাঁ বলেছেন কেনো, আমি জানিনা। আমি এখন পুনরায় জানতে চাই যে আপনি আমায় ভালোবাসেন কি-না! কারও কাছে প্রতিশ্রুতি বা জেদ হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। দরকার পড়লে আজীবন একা থাকবো কিন্ত কারও পাগলামি বা জেদ হতে চাইনা আমি। হ্যাঁ অথবা না বলবেন আমার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে।’
মিহি হাসলেন আনভীর। বলে ওঠলেন,
-‘ এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় হয়নি তোমার। ছোটো মাথায় এত প্রেশার নিও না তো! প্রশ্নটা তুলে রাখলাম। সময় হলে উত্তর পেয়ে যাবে।’
বলেই আমায় ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে যেতে লাগলেন আনভীর৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ আর সেই সময়টা কখন হবে?’
-‘ যখন তোমাকে পুরোপুরি ওই জাহান্নাম থেকে নিয়ে আসতে পারবো তখনই।’
আর কথা বললেন না আনভীর। একটা সাদা তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিলেন৷ আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরখ করে নিলাম নিজেকে। ভাবতে থাকলাম যে শেষের কথাটি কেনো বললেন উনি? আর কেনই বা নিজ থেকে আমার সাহায্য করছেন? মাঝে মাঝে এই আমিটাকেই পুরো মিথ্যে মনে হয় আমার। মনে হয় যে আমি হলাম শুধুমাত্র কিছু মানুষের খেলার গুটি। নাহলে কেনো রাহি আপু দিন দিন এতগুলো সত্য লুকিয়েছে আমার কাছ থেকে? কেনো বাবা স্বার্থপরের মতো আমায় অপূর্ব ভাইয়ার কাছে ঠেলে দিয়েছে?
নিরঙ্কুষ আঁধার রাত। ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দ করে চলছে। আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎ এক বলিষ্ঠ হাত আমায় টেনে শুয়িয়ে দিলো বিছানায়৷ আমি নিজের কাছাকাছি আবিষ্কার করলাম আনভীরকে। উনি বললেন,
-‘ রাত হয়েছে অনেক আহি। ঘুমিয়ে পড়ো।’
-‘ আপনি আমার এতো কেয়ার করেন কেনো বলেনতো? আমার জীবনের এতগুলো বছর শুধুমাত্র সবার কাঠপুতুল হিসেবেই ছিলাম। আপনি কেনো এভাবে দেবদূতের মতো এসেছেন আমার জীবনে?’
-‘ কারন আমার বেঁচে থাকতেও তোমাকে প্রয়োজন।’
উনার গভীর সম্মোহনী কন্ঠ তোলপাড় লাগিয়ে দিলো আমার অশান্ত হৃদয়ে। বাইরের বাতাসের শব্দের থেকেও তীব্রগতিতে শুনতে পারছি আমার হৃদয়ের ধুকপুক শব্দ। আনভীর আমার পাশে নিরাপদ দুরত্ব নিয়ে শুয়ে পড়লেন এবার৷ আমিও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজত্বে।
_____________
-‘ স্যার, রাহি এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।’
অপূর্ব একহাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে কিছু একটা ভাবতে মশগুল ছিলো। এই কথা শুনে মাথা উঠিয়ে তাকালো সে। বললো,
-‘ আসতে বলো।’
কিছুক্ষণ পরেই এসে পড়লো ২৬-২৭ বয়সী এক যুবতী। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুলগুলো বাধা, ঢিলেঢালা একটা পোশাক পড়া। কেউ দেখলে মনেই করবে না যে এই মেয়ে এত বড় একটা সংস্থার সিক্রেট এজেন্ট হয়ে কাজ করছে৷ অপূর্ব চোখ পাকিয়ে তাকালো রাহির দিকে। তেজী কন্ঠে বললো,
– হুটহাট কোথায় উধায় হয়ে যাও তুমি? জানো যে এর ফল আমি তোমায় কতটা ভয়ঙ্করভাবে দিতে পারি?’
– ছিলাম কোনো একটা কাজে। এখন কেনো খুজেছো আমায় বলো? আফটার অল, খামোখা আমায় ডাকার মতে মানুষ তুমি না?’
– আহি মিসিং।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো রাহি। বলে ওঠলো,
-‘ যেই জানোয়ারটার মতো বিহেভ করো ওর সাথে, ও পালিয়ে যাবে না তো কি করবে?’
একথা শোনা মাত্রই অপূর্ব হিংস্র বাঘের মতো তেড়ে আসলো রাহির দিকে। গলা চেপে ধরে বলে ওঠলো,
-‘ ইদানীং সাহস টা একটু বেশিই বেড়ে যাচ্ছে না তোমার? ভুলে যেও না যে তোমার পুরো লাইফটাই আমার হাতে। তাই আমি যা বলবো সেটাই তুমি করতে বাধ্য রাহি। যতদ্রুত সম্ভব আহিকে ফেরত আনো। ওকে আমার চাই!’
গলা ছেড়ে দিতেই কেশে উঠলো রাহি। মিনমিনিয়ে বলে ওঠলো,
-‘ আর কতদিন আমায় কন্ট্রোলে রাখবে অপূর্ব! একদিন তো এর পতন হবেই!’
—————–
সকালে উঠে পাশ ফিরেই আমি দেখলাম আনভীর নেই। কোথায় গিয়েছে, আমি জানিনা। তাই আমি দ্রুত মুখহাত ধুয়ে নিচে নামলাম। দেখি সবাই নিচেই আছে। আঙ্কেল কিছুক্ষণ পর ইন্ডাস্ট্রিতে যাবেন আর আন্টি বসে আছেন তার পাশে। শিউলি ভাবি কিচেনে কিছু একটা করতে ব্যস্ত। আমি কিচেনে গেলাম। দেখলাম নুড়ী আপাকে কিছু একটা কথা শোনাচ্ছেন উনি। প্রসঙ্গটা এমন যে আনভীর একা থাকে আর উনার খাবার নিয়ে কারও নাকি কোনো খেয়াল নেই। আমি ভাবিকে শুভসকাল জানালাম। নাহিদ ভাইয়াও ছিলো সেখানে। হাতে একমগ কফি।
কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলে ওঠলেন,
-‘ কেমন গেলো ফাস্ট নাইট আহি?’
আমি অনিমেষ পানে তাকালাম তার দিকে। কি বলবো বুঝতে পারছি না৷ শিউলি ভাবি নাহিদ ভাইয়ার হাতে বারি মেরে বললেন,
-‘ মাইর চিনিস ব্যাটা! এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করে?’
-‘ ইসসস! আমার বিয়ে হলে তুমিই আমার বউকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে প্রথম।’
আমি উনাদের কান্ডকারখানা দেখে মিহি হাসলাম এবার। ভাবি প্রশ্ন করলেন,
-‘ কি খাবে আহি? চা-না কফি?’
-‘ ক….কফি!’
খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই উত্তর দিলাম। মাথা ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলাম আনভীরকে। নাহিদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-‘ কাকে খুঁজছেন? ‘
-‘ উ….উনি কোথায়?’
-‘ উনিটা কে গো!’
শিউলি ভাবি রম্যস্বরে কথাটি বলতেই আমি চুপসে গেলাম। নাহিদ ভাইয়া বলে ওঠলেন,
-‘ আহি কাছে দু’কাপ কফি দিয়ে তার উনির কাছে পাঠিয়ে দাও তো ভাবি!’
শিউলি ভাবি হাসলেন। বললেন,
-‘ জিম করছেন এখন মহাশয়। বাবা যেহেতু এখানে আছে তাই ব্রেকফাস্ট এখানে করবে না। তুমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে যাও, আধঘন্টা পর ও খেয়ে ফেলবে।’
ভাবি আমার হাতে ট্রেটা দিতেই আমি উনার কাছে চলে গেলাম। দরজা খুলে উকি মারতেই দেখতে পেলাম পুশ-আপ করছেন আনভীর। একটা কমলা রঙের পাতলা টিশার্ট আর কালো রঙের স্পোর্টস ট্রাউজার। কপাল বেয়ে টপটপ ঘাম ঝরছে উনার। উনি পুশআপ করতে করতেই বললেন,
– ভেতরে আসো৷
আমি দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম ভেতরে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে রেখে বললাম,
– এইযে ব্রেকফাস্ট!
এ কথা শুনে পজিশন চেন্জ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন উনি৷ আমার ওপর এক শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগোতে লাগলেন। আমি উনার এমন চাহিনী দেখে শূণ্যমস্তিষ্কের হয়ে গেলাম। পেছাতে থাকলাম আস্তে আস্তে। আমি পেছনের দরজার সাথে মিশে যেতেই উনি বলে ওঠলেন,
-‘ আমার সামনে এভাবে ঠোঁট কামড়াবে না মিসেস আহি। আমি মানুষটা খারাপ তো, হুটহাট উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারি৷ গট ইট?’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
আজকে সবার কমেন্ট চাই😊