এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ১৬

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ১৬
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

বিকেলের রোদ্দুর ঢেলে সন্ধ্যা নেমেছে এবার। দূর দূর সকল বিল্ডিংয়ে আলোরাশির সমাহার। বাতাসের দাপটে সর্বত্র এক ঠান্ডা আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। এই হাওয়াটা শরীরে টেনে নিতেই আমার ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর নিমিষেই সতেজতায় ছেয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে পড়া শেষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি এখন। এডমিশন টেস্টের সেই মোটা গাইডবুকের পড়া পড়তে পড়তে মাথাটা কেমন যেন ধরে গিয়েছে। তার ওপর আনভীরের যন্ত্রণাতো আছেই। সেই যে বিকেল থেকে টেবিলে বসিয়ে রেখেছে আমায়, একবারও উঠতে দিলো না। সন্ধ্যের আগে শিউলি ভাবি এসেছিলো আমার কাছে। উদ্দেশ্য ছিলো আজরান ভাইয়ার সাথে ভাবি মার্কেটে যাচ্ছে,আমিও সাথে যাই। কিন্ত আমার হিটলার বর আমার কিছু বলার আগেই না করে দিলো ভাবিকে। আমিও নাছোড়বান্দা, বললাম ভাবির সাথে যাবো মানেই যাবো। কিন্ত শেষমেষ আমায় এমন এক ধমক দিলো যে আমার আর কোনো কিছু বলার সাহস হলো না। এমনিতেও দুপুরে উনার অপেক্ষা না করে একা বাসায় আসাতে আমার ওপর অনেক রেগে আছেন। হয়তো সেই জমানো রাগটাই একবারে ঝাড়লেন। আমি মুখ ফুলিয়ে পড়ায় মন দিলাম এবার। উনার রাগ ধমক এখন কোনো কিছুই গায়ে মাখি না আমি। আমায় হঠাৎ এভাবে চুপ থাকতে দেখেও উনি কোনো পরোয়া করলেন না। চুপচাপ আমায় পড়তে বলে একপাশে ল্যাপটপে রিসার্চের কাজ করতে লাগলেন।

এখন কিছুক্ষণের ব্রেক নিয়ে বারান্দায় অন্যমনষ্ক হয়ে আছি।আনভীর প্রতিদিনকার মতো দু’কাফ কফি নিয়ে আসলেন বারান্দায়। আমি এখন এসব নিয়ে কথা বলি না, আসলে উনার সাথে প্রয়োজন ব্যাতীত কোনো কথাই বলিনা আমি।তবে হঠাৎ উনার একটা উদ্ভট কাজ দেখে আমি বিস্মিত হলাম। উনি আচমকা ডিভানে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন ক্লান্তিবেশে। আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘একি? আমার কোলে মাথা রাখলেন কেনো?’

-‘মাথাটা ব্যাথা করছে প্রচন্ড। মাথাটা টিপে দাও আস্তে করে।’

-‘উঠুন তো। আমি পারবো না।’

থমথমে গলায় বললাম আমি। আমি কেনো উনার মাথা টিপতে যাবো? একটু উনিশ থেকে বিশ হবে , পরে এমন একটা লাগামছাড়া কথা বলে দিবে যে লজ্জায় নাক-মুখ লাল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আনভীর আবার বললেন,

-‘তোমার প্যাক প্যাক শোনার মতো ইচ্ছে আমার নেই। মাথাটা টিপে দাও জলদি।’

মানুষটার কথা শুনে রাগ ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে আমার মস্তিষ্কে।আচ্ছা পূর্বে তো উনি আমার সামনেই আসতে চাইতেন না। আমি আসলেই পারলে গর্জন দিয়ে উঠতেন। তবে এখন এমন করছেন কেনো? আমি এবার মাথাটা টিপে দিতে লাগলাম আস্তে করে। বিড়বিড়িয়ে বললাম,

-‘ইচ্ছে তো করছে গলা টিপে মেরে ফেলতে!’

দু’মিনিট যেতে না যেতেই হঠাৎ পাশে থাকা মোবাইলে ক্রিৎ ক্রিং শব্দ বেজে উঠলো এবার। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম মোবাইলের স্ক্রিনে। ধ্রুব ভাইয়া কল দিয়েছে। হঠাৎ কোচিংয়ের কথা মনে পড়ে গেলো আমার।উনি বলেছিলেন বিকেলে ফোন দিতে। কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলবেন জানি। আমি মিহি কন্ঠে বললাম,

-‘আল্লাহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ধ্রুব ভাইয়া ফোন দিতে বলেছিলেন।’

এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে আমার মাথা টেপা উপভোগ করছিলেন আনভীর। ‘ধ্রুব’ নামটা শোনামাত্রই উনি হতভম্ব হয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে পড়লেন। চোখ দৃঢ় করে জিঙ্গেস করলেন,

-‘কে কল দিয়েছে?’

-‘ধ্রুব ভাইয়া। আমি বিকেলে উনাকে কল দিতে বলে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো!’

আনভীর চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ফোন স্ক্রীনে তাকালেন এবার। যেন পারছেন তো না এই মোবাইলে ঢুকেই ধ্রুবকে গলা টিপে খুন করে ফেলতে। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,

-‘এই ধ্রুবর এত কি কথা তোমার সাথে?’

-‘কই এত কথা ? উনি তো কিছুদিন ব্যস্ততার জন্য আমার নোটগুলো দিতে পারেননি। হয়তো সেজন্যই কল দিয়েছেন।’

আমি কল রিসিভ করে রুমের ভেতরে চলে গেলাম কথা বলতে।কথা শেষ করে পেছনে ঘুরেই হঠাৎ দেখি উনি আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ, অনেকটা কাছাকাছি। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,

-‘এভাবে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো পেছনে? সরুন। আমার কাজ আছে।’

আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি আমার আমার বরাবর দাঁড়ালেন। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছি। তবে উনি নির্বিকার। চোখের দৃষ্টি আমাতে তীক্ষ্ণ করে বললেন,

-‘কি কথা হলো ধ্রুবের সিথে?’

-‘তা আমি কেনো আপনাকে বলবো?’

-‘আমি তোমার হাজবেন্ট তাই।’

আমি একটা ফিচালো হাসি দিয়ে বললাম ,

-‘সো সুইট আফ ইউ আনভীর। আপনি আমার হাজবেন্ট ঠিকই তবে সেটা এগ্রিমেন্টের জন্য। আর আপনিই আমায় বলেছিলে যে আমি আপনার নামেমাত্র ওয়াইফ। তাই আমি আপনাকে কোনো উত্তর দিতে অবশ্যই বাধ্য নই, তাই না?’

আনভীর কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। আমি একটা বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে সরে এলাম। আমি জানিনা যে ধ্রুব ভাইয়ার ব্যাপারে উনি এত ইনসিকিউর কেনো তবে এই ব্যাপারটা মনে এক পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে আমায়। উনি হঠাৎ আমার ফোন নিয়ে কাবার্ডে রেখে দিলেন। আমি কিছু বলতে যাব তখন উনি কড়া গলায় বললেন,

-‘পরীক্ষার আগে কোনো ফোন না, এখন মন দিয়ে পড়ো। আবার ধ্রুবর কথা আমার সামনে উঠালে তোমার খবর আছে।’

বলেই হনহনিয়ে প্রস্থান করলেন উনি।আমি শয়তানি হাসি হেসে খাটে বসে পড়লাম। মানুষটাকে জ্বালাতে ভালোলাগছে। এতদিন অনেক যন্ত্রণা দিয়েছেন আনভীর। এবার আপনাকে যন্ত্রণায় ফেললেই আমার অতৃপ্ত মনে শান্তি পাবে।
.
.
আজ শনিবার। সেই সুবাদে বাবা, আজরান ভাইয়া, আনভীর সবাই বাসায়। সেই সাথে আমিও। একমাত্র এটাই এমন একটা দিন যেই দিন আনভীর পড়ার জন্য কোনো প্রেশার দেয়না আমায়। হুট করে ভোরে আজরান ভাইয়া সবাইকে বললো আজ ভাইয়া আমাদের সবাইকে ঘুরতে নিয়ে যাবে এক জায়গায়। জায়গাটা নাম এখনও বলেননি উনি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছেন। আনভীর প্রথমে না বলেছিলেন যে আজ উনি যাবে না বাহিরে। কিন্ত আজরান ভাইয়ার জোরাজোরির পর অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজি হলেন উনি। এদিকে আমি ভীষণ এক্সাইটেড।কেননা ঢাকায় আসার পর খুব বেশি একটা ঘুরতে পারিনি। আমার আর্ধেক সময় পারই হয়ে গেলো মেডিক্যাল এডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন নিয়ে। তাই আজকে হঠাৎ আউটিং এ কথা শুনে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। দ্রুত নুড়ী আপার সাথে রান্নাঘরের কাজ সারার চেষ্টা করলাম আমি যাতে একটা ভালো ড্রেস চুজ করার জন্য সময় নিতে পারি।
রান্নাঘরে কাজ সামলে ডইংরুমে গেলাম আমি। শিউলি ভাবি ইতিমধ্যে রুমে গিয়েছেন রেডি হওয়ার জন্য। বাবা, আজরান ভাইয়া ড্রইংরুমে কথা বলছেন। আনভীর এখানেই ছিলেন মাত্র; তবে এখন নেই , হয়তো গ্যারেজে গিয়েছেন গাড়ির ডিজেল চেক করতে। কেননা একটু আগে বাবাকে বলতে শুনেছিলাম আনভীরকে গাড়ির ডিজেল চেক করতে।
উনি আসার আগেই রেডি হতে হবে আমায়। তাই দ্রুত রুমে চলে গেলাম কি পড়বো তা খুঁজার জন্য। কার্বার্ডে এত ড্রেসের বাহার দেখে আমি রীতিমতো পাগল হয়ে যাচ্ছি। এদিকে শিউলি ভাবিও ব্যস্ত যে তাকে পছন্দ করতে বলবো। শেষমেষ দোলা আপুকে ফোন দিলাম আমি। একমাত্র দোলা আপুই আছে যে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে।

দোলা আপু ভিডিও কল রিসিভ করে বললো,

-‘কিরে ! এতদিন পর মনে করলি আমারে?’

-‘এসব কথা পরে বলো আপু। আগে বলো আমি কি পড়বো?আজকে আজরান ভাইয়া আউটিংয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।’

কাচুমাচু হয়ে বললাম আমি। আপু অবাক গলায় বললো,

-‘একটা সামান্য ড্রেস চুজ করতে পারিস না তুই ইডিয়াট? তোর বরকে বললেই তো করে দেবে।’

-‘আরে আমার বর আর তুমি কি এক হলে? তোমার পছন্দের ড্রেস গুলা সবসময়ই ভালো হয়। এখন পছন্দ করে দেও না?’

আমি নরম গলায় বললাম। আপু বললো,

-‘আচ্ছা এভাবে তো বুঝবো না, এককাজ কর। ছবি তুলে সেন্ড কর তোর পছন্দের কয়েকটা। তারপর আমি চুজ করে দিচ্ছি।’

আমি তাই মিহি হেসে কল কাটলাম। কাবার্ডে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো ড্রেসগুলোর ছবি তোলার উদ্দেশ্যে মোবাইল উচু করে ছবি তুলছিলাম তখনই কাবার্ডের পাশের বাথরুম থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আনভীর। উনি শুধু একটা সাদা তোয়ালে কমোড়ে পেচিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। চুলে জমা পানিগুলো টপটপ করে ঝরে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। আমি তো ভেবেছিলাম উনি বোধহয় রুমে নেই,,,,,কিন্ত এভাবে যে দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে যাবো তা আমরা দুজনেই ধারনা করতে পারিনি। আমি এতটাই আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম যে আমার হাতের মোবাইল ক্যামেরায় এখনও চাপ দিয়ে রেখেছি যার কারনে ড্রেসগুলোর ছবি তোলা হচ্ছে কিনা জানিনা তবে উনার অর্ধনগ্ন ছবি পুরৈটাই তোলা হচ্ছে।
আনভীর আমার হাতের মোবাইলটা উনার দিকে এভাবে তুলে রাখাতে বুঝতে বাকি রাখলেন না যে হচ্ছেটা কি, দ্রুত কাছে এসে পড়লেন আমার। আমি হঠাৎ উনার কাছে আসাতে পিছিয়ে গেলাম এবার। চিল্লিয়ে বললাম,

-‘আপনি এভাবে তোয়ালেমানব হয়ে বেরিয়ে এসেছেন কেনো?’

আমার চিল্লাতে দেখে উনি আমায় পেছনে থাকা বুকশেলফটার সাথে চেপে ধরলেন এবার। একহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন আর এক হাত দিয়ে আমার হাতের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উনার আক্রমণে শূণ্যমস্তিষ্কের হয়ে গেলাম আমি। উনি মোবাইলটা ছিনিয়ে কড়া গলায় বললেন,

-‘মোবাইলের গ্যালারীতো আমার অর্ধনগ্ন ছবি তুলে ভাসিয়ে রেখেছো সে খেয়াল কি আছে? জলদি ডিলিট করো।’
.
.
.
.
~চলবে,,,,,,,ইনশাআল্লাহ!

আমার বাবা স্ট্রোক করেছেন দুপুরে। এই অংশগুলো গতকাল রাতে আর আজ সকালে লিখে রেখেছিলাম। তাই হয়তো গল্পটা দিতে পেরেছি। আজকে আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে একটা বিশাল ঝড় গিয়েছে। কি লিখেছি জানা নেই,,রিচেকও করিনি সময়ের অভাবে। শুধু কাপাকাপা হাতে পোস্ট করে দিলাম।আজকেও হয়তো দিতাম না তবুও জাস্ট পূর্বে লিখা অংশটুকুই পোস্ট করে দিয়েছি। যদি ভুল হয়ে থাকে অবশ্যই ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।দোয়া করবেন আমার বাবার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here