এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৩৩
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
ফুরফুরে হাওয়ার আমেজে আজ সকালটা বেশ স্নিগ্ধ। তার থেকেও আমার আরও বেশি স্নিগ্ধ লাগছে আনভীরের ঘুমন্ত মুখশ্রী। ঘুমিয়ে গেলে উনাকে পুরোই বাচ্চাদের মতো লাগে। কিভাবে যেন ঠোঁট উল্টে ঘুমায়। কপালের কাছে পড়ে থাকা অগোছালো চুলগুলো নিমিষেই যে কারও হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো প্রবল ক্ষমতা রাখে। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে একপ্রকার তপ্তশ্বাস ছাড়লাম। আমি এখন উনার ব্যবহারে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি। গতকাল হসপিটাল থেকে আসার পর একদন্ডও কথা বলেননি আমার সাথে। আগে তো পড়াশোনা নিয়েও একটু-আধটু কথা হতো এখন তো তাও হয় না। আমার আসলে জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে যে এমন কি হয়েছে যে উনি এতটা গুরুগম্ভীর? তাই শত চেষ্টা করেও আমি উনার কাছ থেকে কিছু জানতে পারলাম না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। গতকাল মা বলেছিলো যে শিউলি ভাবির সুসংবাদ শুনে ভাবিদের বাড়ি থেকে আজ কয়েকজন মেহমান আসবে। তাই উনি সকালে উঠতে বলেছেন আমায়। যদিও আমার পায়ে ইনফেকশনের জন্য ব্যান্ডেজ করা তাই মা বলেছিলেন যে কাজে সাহায্য করতে হবে না। সেট মা আর নুড়ী আপাই সামলে নিতে পারবে। কিন্ত বাড়ির বৌ হওয়ার সাপেক্ষে উনাকে একা কাজ করতে দেওয়াটা বেশ দৃষ্টি কটু । তাই এসব ভাবতে ভাবতেই আমি কোনোমতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। আনভীর গতকাল আমার ব্যান্ডেজ করা পায়ে ফয়েল পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছেন যাতে পানির সংস্পর্শে ব্যান্ডেজ ভিজে না যায়। তাই গোসল সারাটা খুব একটা কষ্টকর হতো না আমার জন্য।
আমি উঠে কাবার্ড থেকে জামা আর তোয়ালে হাতিয়ে নিলাম। পেছনে একবার পরখ করে নিলাম ঘুমন্ত শুভ্রমানবটিকে। সে কম্বল মুড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে মগ্ন। রৌদ্দুরের আবাধ্য রশ্নি উনার কালচে চুলে পড়ে একটু খয়েরী আভা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখেই আমার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠলো এক চিলতে হাসি। আমার হঠাৎ কি হলো আমি জানিনা তবে আমি এগিয়ে উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে একটু ঝুকে এলাম উনার দিকে। পরক্ষণে আমার বোকামি কীর্তিকলাপের বিষয়টা অনুধাবন করতেই আমি তৎক্ষণাৎ সরে এলাম। আনভীর তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে আমার মনে স্বস্তি বয়ে এলো। ভাগ্যিস উনি একচিলতেও টের পাননি নাহলে যেই ঠোঁটকাটা মানুষ রে বাবা ! আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে হতো।
.
.
গোসল শেষ করে বাইরে এসে দেখি আনভীর উঠে গিয়েছেন ইতিমধ্যে। তবে চোখে এখনও ঘুমুঘুমু ভাবটি বিদ্যমান। কিন্ত আমায় হঠাৎ গোসল করে আসতে দেখে নিমিষেই উনার চোখের ঘুমুঘুমু ভাবটি কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেলো। এমন বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছেন যে আমি বোধহয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। আমি অস্বস্তি নিয়ে ওড়না টেনে নিজেকে পরখ করে নিলাম। নাহ্ ! সবকিছুই তো ঠিক আছে। তাহলে উনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? আমি চোখজোড়া ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম,
-‘আজব তো! এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?’
-‘তুমি হুট করে সকালে কেনো গোসল করলে?’
উনার সন্দিহান কন্ঠ। আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই উনি আবার বললেন,
-‘না মানে…………আমার জানামতে গতকাল রাতেতো আমি ডিসেন্ট ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই সুবাদে আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যে সকালে উঠেই তোমায় গোসল করতে হবে , নাকি হয়েছিলো?’
শেষ কথাটি উনি বললেন আমার একেবারেই কাছাকাছি এসে কানের কাছে ঝুঁকে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। উনি রম্যাত্নক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে শয়তানি হাসি হাসছেন।আমার রীতিমতো গা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে এলো এবার। কড়া গলায় বললাম,
-‘আজ বাড়িতে মেহমান আসবে দেখেই সকাল সকাল গোসল সেরে নিয়েছি । বুঝেছেন?’
-‘ওহ্! আমি তো ভেবেছিলাম রাতে আমার ঘুমের ফাঁকে আমার মতো ডিসেন্ট ছেলের ভার্জিনিট লুটে নিয়েছো।’
আমার মাথা ঘুরবার মতো উপক্রম।কে বলবে এই লোকটা গতকাল ভুতুমপেঁচার মতো মুখ করে ছিলো। মাঝরাতে আবার জ্বীনে টিনে ধরেছে নাকি যে এরকম আচরণ করছে? আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,
-‘ম্যাথ করতে করতে আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে প্রফেসর আনভীর।এসব উল্টাপাল্টা বকবকানি না করে আমার সামনে থেকে সরুন।’
উনি সরলেন না। বরং নিজের বড়ো বড়ো পা ফেলে আমার দিকে আরও দু’কদম এগিয়ে আসলেন। আমি এবার দরজার সাথে মিশে দাঁড়িয়েছি অবাকের চরম সীমানায় পৌছেঁ। করছেনটা কি উনি? আনভীর নিরাপদ দুরত্ব রেখে আমার দু’পাশে হাত আটকে বলে ওঠলেন,
-‘ম্যাথম্যাটিক্সের প্রফেসর হলেও আমি বায়োলজিতে কিন্ত এক্সপার্ট মিসেস আহি আনভীর খান। দেখতে চাও?’
উনার গহীন কন্ঠ। ঠোঁটে বাকা হাসি ঝুলিয়ে এমন ভাব করছেন যে আমাকে চরম মাত্রার বিভ্রান্ত করাটাই উনার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম,
-‘আপনি তো এমনিতেও অর্ধপাগল আনভীর , এখন পুরোটাই পাগল হয়ে গিয়েছেন।’
বলেই আমি দরজার কাছ থেকে সরে আসলাম। আনভীর দরজায় একটু হেলে আমার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলেন,
-‘দেখা যাক্ ! তোমার জন্য আর কতটুকু পাগলামির সীমা অতিক্রম করতে হয়?❤’
________________________________________
বাড়িতে আজ প্রচুর মেহমান। সবই এসেছে মূলত শিউলি ভাবিদের বাড়ি থেকে। মা প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে দিন পার করলেও সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার জন্য সময় যথাসাধ্যভাবে বের করে নেন। নুড়ী আপা রান্নাঘরে হরেক রকমের রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। এদিকে আমি ডাইনিং টেবিলে বসে চুপচাপ শসা , টমেটো , পিয়াজ এগুলো কুচি কুচি করছি সালাদ বানানোর উদ্দেশ্যে। আমার চোখ-মুখ অবসন্ন। এভাবে থম মেরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে ভাবির সাথে আলাপচারিতায় মশগুল হতে। কিন্ত আনভীর ক্রুদ্ধ গলায় আমায় বলে দিয়েছেন যে আমি যেন কোনো কাজ না করি। এতে পায়ে চাপ পড়তে পারে যা উনি কোনোভাবেই চাচ্ছেন না। অগত্যা আমায় মা বসে বসে সালাদ বানানোর নির্দেশ দিয়ে দিলো। আমিও আপন মনে তাই করে চললাম।
আজ পবিত্র জুম্মা। তাই যোহরের আজান দেওয়ার পরপরই আজরান ভাইয়া , বাবা , শিউলি ভাবির পরিবারের কয়েকজন নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। সেই সাথে আনভীরও। সকালে বাজার নিয়ে আসতে আসতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়াতে উনি প্রায় হতদন্ত হয়ে গোসল সেরেই মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। যাওয়ার আগে বরাবরের মতোই বলে গেলেন আমি যাতে নিজের খেয়াল রাখি।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম এবার। আর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই হয়তো সবাই ফিরে আসবে। সালাদ বানানো শেষ হলেই আমি ধীরপায়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম সালাদ রেখে আসার জন্য। হঠাৎ মায়ের ডাক পড়াতেই আমি আর আপার সাথে কথা বলতে পারলাম না।চলে গেলাম মায়ের কাছে।
মা আমায় এবার নিজের সাথে উনার ঘরে নিয়ে গেলেন। তপ্ত দুপুর। জানালা বদ্ধ থাকার কারনে ঘর কেমন যেন ভ্যাপসা হয়ে আছে। আমি মিহি কন্ঠে তাই জিজ্ঞেস করলাম,
-‘আমায় হঠাৎ ডাকলেন যে মা?’
মা নিঃশব্দে নিজের পুরোনো কাঠের আলমারি থেকে শাড়ি বের করলেন। বলে ওঠলেন,
-‘বাড়ির বৌ দের শাড়ি না পড়লে কি হয় আহি? বাসায় থ্রি পিস পড়ো সেটা তো সমস্যা নেই। কিন্ত মেহমান আসলে শাড়ি পড়তে তো পারো , তাই না?’
অন্য চার-পাঁচজন শ্বাশুড়ি আর উনার মধ্যে এটাই বড় তফাৎ। আমার মধ্যে কোনো খুঁত পেলে তা ভৎসর্না করে বলেন না , বলেন মিহি কন্ঠে বুঝিয়ে। আমি শাহিটা উনার কাছ থেকে নিতে খানিকটা দ্বিধাবোধ করছি। কেননা শাড়ি আমার কাছেও আছে। আমি আপত্তি জানিয়ে কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই উনি বলে ওঠেন,
-‘আমি জানি যে শাড়ি তোমার কাছে আছে। তবুও এটা পড়ে নিও। মায়ের কথা রাখতে হয় , বুঝেছো?’
আমি তাই আর কোনো কথা বাড়ালাম না।স্মিত হেসে উনির হাতজোড়া থেকে আগলে নিলাম শাড়িটি। আমি চলে যাচ্ছি তখনই উনি সরুগলায় বললেন,
-‘আনভীরের নীল রঙ কিন্ত বড্ড পছন্দের আহি।তাই তোমায় শাড়িটি পড়তে দিয়েছি।’
আমি বিস্ময়ে কদাচিত হয়ে ওঠলাম এবার। উনি আসলেই স্নিগ্ধ মনে চাচ্ছেন যে আমি আর আনভীর একত্রে থাকি। আমি এবার কি বলবো ভেবে পেলাম না। মৌনতার সহিত শাড়ি নিয়ে উনার ঘর প্রস্থান করলাম।
_________________________________
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আমি যতটা গহীনভাবে দেখছি ততটাই যেন অবাক হচ্ছি। কেননা আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছি যে শাড়িটা সুন্দর নাকি আমায় শাড়ি পড়াতে সুন্দর লাগছে? নিঃসন্দেহে শাড়িটি সুন্দর। মা বলেছিলেন যে আজরান ভাইয়ের জীবনের প্রথম ইনকাম দিয়ে তিনি নাকি মায়ের জন্য এ শাড়ি কিনেছিলেন। সেই হিসেবে এই শাড়িটি বিশেষ কিছু উনার কাছে যা উনি আমায় পড়তে দিয়েছেন ভাবতেই আমার মনে ভালোলাগা ছাড়িয়ে পড়লো।
বেলকনির থাই দিয়ে আছড়ে পড়া রৌদ্দুর আমার পরনে নীল শাড়িতে আছড়ে পড়াতে কেমন যেন চিকচিক করছে। আমি এভাবেই কিছুক্ষণ যখন শাড়ির গহীনে ডুবে ডুবে ছিলাম তখনই দরজায় খট করে খোলার শব্দ হওয়াতে পেছনে ঘুরলাম। আনভীর এসে পড়েছেন। সাদা পান্জাবী আর সাদা টুপিতে প্রফুল্ল লাগছে উনাকে। আমার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই উনি প্রথমে টুপিটা খুলে টেবিল থেকে চশমা হাতিয়ে নিলেন পড়ার জন্য। যেই না আমার সাথে উনার চোখচোখি হলো থমকে গেলেন উনি।
উনার এমন চাহিনীতে আমি বিব্রত হয়ে পড়লাম। আনভীরের চোখমুখে রাজ্যের বিস্ময়। এই দৃশ্য আমার প্রথম দেখা। হয়তো এর আগেও আমায় দেখে এরকম করতে পারেন কিন্ত উনার চশমার আড়ালে সেই দৃশ্যটা আমার দেখা হতো না। আজ উনার খালি চোখজোড়ায় এই প্রথম একরাশ মুগ্ধতা দেখতে পাচ্ছি আমি । আমি এবার চোখ নামিয়ে ফেললাম। কিন্ত নড়েননি আনভীর।হাতে চশমা নিয়ে ওভাবেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে চলছেন আমাকে। আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটা শুকনো কাশি কাশতেই উনি ঢোক গিলে বললেন,
-‘তুমি কি আসলেই আহি?’
আমার অস্বস্তি এবার বিরক্তিতে রূপ নিলো। চোখ ছোট ছোট করে বলে দিলাম,
-‘নাহ্! আমি আহির পাতানো বোন।’
আমার কথা শুনে হেসে দিলেন আনভীর। বললেন,
-‘আজ হুট করে শাড়ি পড়লে যে?তাও আমার পছন্দের রং? ব্যাপার কি? আমায় ইম্প্রেস করার চেষ্টায় আছো?’
আনভীর দেয়ালে হেলান দিয়ে ভ্রু নাচালেন এবার। আমি থমথমে গলায় বললাম,
-‘সবসময় মাথায় এসব আজগুবি চিন্তা কোথা থেকে আসে আপনার?……………আমায় এই শাড়ি মা পড়তে দিয়েছে এজন্য পড়েছি। বুঝেছেন?’
আনভীর বরাবরের মতোই ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন।নিজের গোছালো চুলগুলো হাত দিয়ে একটু অগোছালো করে মিনমিনয়ে বললেন,
-‘বউয়ের গুপ্ত সৌন্দর্য বরের নজরে নিয়ে আসার জন্য এমন শ্বাশুড়ি সবার ঘরে ঘরে থাকা উচিত।’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ !
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।