এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৩৪

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৩৪
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

বিকেল ঢেলে সন্ধ্যা নেমেছে এখন। আশপাশে ঘুটঘুটে আধার। আমি ক্লান্তি নিনির্মেষে বারান্দার ডিভানে শরীর ছেড়ে দিলাম। বাড়ি থেকে মেহমান চলে গিয়েছে সবেমাত্র। আমি দুর্বলচিত্তে উচু বারান্দা থেকে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে মগ্ন। সাথে বহমান ফুরফুরে হাওয়া। যার দরুন আমার শাড়ির আচল অকপটে উড়ে চলছে।
আজ আনভীরের কথাবার্তায় সকাল থেকেই বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। ক্রমেই সেটা আমার নজরে এলো দুপুরের পর থেকে। আজ শিউলি ভাবির বাবা বাড়ি থেকিে যারা এসেছিলো তাদের মধ্যেই একজন ছিলো ধ্রুব ভাইয়া। ধ্রুব ভাইয়া যে ভাবির আপন চাচাতো ভাই সেটা বলতে গেলে একেবারেই জানতাম না আমি। ধ্রুব ভাইয়া কখনোই এ ব্যাপারে বলেননি আর আনভীরের বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। সেদিন মেডিক্যাল এডমিশন এক্সামের প্রায় বেশ কিছুদিন পর উনাকে দেখলাম আমি। তাই স্বভাবসুলভই উনার সাথে কথা বললাম। সেখানে গিয়ে আবার বাঁধ সাজলেন আনভীর। উনি সবসময়েই ধ্রুব ভাইয়ার সাথে কথা বলতে দেখলে কেমনযেন ক্ষেপে যান। কথার মাঝখানেই উনি আমার হাত চেপে ড্রইংরুমের এক প্রান্তে নিয়ে আসলেন। মিহি গলায় বললেন,

-‘তোমায় না আমি বারবার না করেছি ওই ধ্রুবটার সাথে কথা বলতে না? তাহলে কেনো কথা বলো তুমি?’

-‘আমি কি ইচ্ছে করে কথা বলেছি নাকি? আমি তো ভাবির সাথেই বসে ছিলাম। হঠাৎ ধ্রুব ভাইয়া এসেই আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো। আর উনি তো এভাবেও প্রাণোচ্ছল মানুষ। আমিও তাই জাস্ট ফর্মালিটির জন্য………’

আমায় কথা বলতে না দিয়েই উনি বলে ওঠলেন,

-‘হয়েছে হয়েছে,,,,,,, আমার সামনে ওর গুণগাণ গেতে হবে না। ছোটবেলা থেকেই ওই রাস্কেলটাকে দু’চোখে সহ্য হতো না। স্কুল লাইফ শেষ হওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম ওর থেকে বেঁচে গিয়েছি কিন্ত তা আর হলো কই? ভাবিমণির আত্নীয় হওয়াতে একেবারে মাথায় ঝুলে পড়লো। আর ওর বরাবরই আমার জিনিসের প্রতি এক্সট্রা আগ্রহ থাকে। স্কুল লাইফে আমায় টপকে যাওয়ার দুঃসাহস করতো এখন আবার তোমার দিকে নজর দিয়েছে।’

হঠাৎ কেনো যেন আমার অপূর্ব ভাইয়ের সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। সে বলেছিলো যে আমি চাইলে নাকি আনভীর সত্যিই আমায় ছেড়ে দিতে পারবে। এটা স্মৃতিচারণ হতেই আক্রোশে গা রি রি করে ওঠলো আমার। আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

-‘আমি আপনার কোনো জিনিস না বুঝেছেন? আপনার সাথে উনার ঝামেলা থাকতে পারে আমার সাথে তো আর নেই? আপনি এতো পজেসিভ হচ্ছেন কেনো?’

আনভীর কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। চোখ রাঙিয়ে শুধু আরেকবার বুঝিয়ে দিলেন ধ্রুব ভাইয়ার সাথে আমায় যেন আর না দেখে। আমি উনার মুখোমুখি অকপটে থাকলেও উনি চলে যাওয়ার পর বুকে ফুঁ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লাম।কেননা উনি যেভাবে থমথমে গলায় আমায় থ্রেড দিচ্ছিলেন পারলে এখনই নিজের সাথে শিকলবন্দী করে রাখবেন আমায়। তবে উনার চোখে মুখে হিংসাত্নক ভাবটা বেশ মজা লাগছিলো আমার। আনভীরের মুখে স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে ধ্রুব ভাইয়ার সাথে আমায় দেখলে উনি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যান। তবুও মুখ ফুটে বলবেন না যে এত জেলাসির কারনটা কি। আমিও তেমন কিছু ভাবলাম না আর। দ্রুত ভাবির কাছে চলে গেলাম।
.
.
এসব কিছু স্মৃতিচারন করছিলাম তখনই ভেতর থেকে আনভীর ডাক দিলেন আমায়। আমি গিয়ে দেখলাম উনি কিছু কাগজপত্র নিয়ে বসে আছেন। এর মধ্যে আমার কলেজের পাসপোর্ট সাইজের কয়েকটা ছবি দেখে ভ্রু কুচকে এলো আমার। আমি জিজ্ঞেস করলাম ,

-‘এসব কি?’

-‘তোমার ভর্তি ফরম।’

কাঠ কাঠ গলায় প্রতিউত্তর দিলেন আনভীর। আমার চোখ বড়ো বড়ো হয়েএলো এ কথা শুনে।অপ্রস্তুত কন্ঠে বললাম,

-‘ম,,,মানে?’

-‘মানে বুঝো না? মেডিক্যালে চান্স পাওনি তো কি হয়েছে?পড়ালিখা তো চালিয়ে যেতে হবে তাই না? তাই তোমার প্রাইভেট ইউনিার্সিটির জন্য এডমিশন ফরম নিয়ে এসেছি। পাবলিকে তো এখন আর সময় নেই।’

আমি শুকনো ঢোক গিললাম। কেননা পড়ালিখা করার মতো বিন্দুমাত্র মোটিভেশন আমার মধ্যে নেই। আমি এবার বললাম ,

-‘আমি,,,,,আমি আসলে সময় নিতে চাচ্ছি আনভীর। আমি প্রস্তুত নই।’

আনভীর সরু চোখে তাকালেন আমার দিকে। চোখের দৃষ্টি অপ্রতিভ। গম্ভীর ভাবে বললেন,

-‘আমি তোমার কাছে মতামত জানতে চাইনি আহি , জাস্ট সিদ্ধান্তটি জানিয়েছি তোমায়। তাছাড়া কেনো পড়ালেখা করার জন্য সময় নিতে চাচ্ছো?’

আমি বলতে পারলাম না কিছুই। শাড়ির আচলের একপ্রান্ত আঙুলে মুড়িয়ে নিচের দিকে চাহিনী নিবদ্ধ করলাম। উনি এবার কাগজের দিকে মনোনিবেশ করলেন। আমার দিকে না ভ্রুক্ষেপ করেই বললেন,

-‘মা-বাবা , আজরান ভাইয়া সবাই রাজি আছে এ ব্যাপারে। তাই চিন্তা করো না। আর আমি ভার্সিটির প্রফেসর হয়ে তোমার মতো ফাকিঁবাজকে ঘরে বসিয়ে রাখবো নাকি? তুমি ভার্সিটিতে এডমিশন নিচ্ছো দ্যাটস ফাইনাল। তাও আবার আমি যে ভার্সিটিতে প্রফেসর হিসেবে আছি সেখানেই।’

আমি তৎক্ষণাৎ তাকালাম উনার দিকে। উচুগলায় বললাম,

-‘কি?’

-‘কানে কি সমস্যা হয়েছে তোমার? বারবার কি , কেন এসব জিজ্ঞেস করছো কেনো? আমি বলেছি আমি যে ভার্সিটির প্রফেসর সে ভার্সিটিতেই এডমিশন নিচ্ছো তুমি। পার্থর্ক্য শুধু একটাই , আমি তোমার ডিপার্টমেন্টের স্যার না। ইজ ইট ক্লিয়ার ফর ইউ?’

আমার আর কি বলার? এই অর্ধপাগল লোক শেষমেষ আমায় রাজি করিয়েই ছাড়বে। আমি আনমনে হুম প্রতিউত্তর দিলাম। উনি বললেন,

-‘গুড ! তাহলে প্রস্তুত থেকো কাল পরশু। এডমিশন ফরম জমার দিন তোমায় যেতে হবে। তোমার পায়ের অবস্থা একটু ঠিক হলেই তোমায় নিয়ে যাবো।’

আমি মাথা নাড়ালাম এতে। উনি সচরাচর গম্ভীর থাকলেও চিন্তা করেন আমার জন্য এ বিষয়টা আার মনের অন্তঃকোণে এক ভালোলাগা ছাড়িয়ে দেয়। আমি আসলে জানিনা আমাদের অন্তর্নিহিত সম্পর্কটি কেমন তবে এতটুকু জানি পূর্বের ন্যায় এত বিভীষিকাময়তা আর নেই।হয়তো কোণো এক শ্রাবণ হাওয়া নিমিষেই আমাদের দুজনের মনের উথাল-পাতাল ঝড়কে শান্ত করে দিবে।

______________________________________

পরদিন দুপুরবেলা। কাঠফাটা রোদের দরুন উত্যপ্ত চারিপাশ। ঘরের সব জানালা খোলা থাকলেও গরম হাওয়ার আনাগোনায় আমার অস্থির লাগছে। মা আর আজরান ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে এক গাইনোলজিস্ট এর কাছে গিয়েছেন। বাবা অফিসে। নুড়ী আপাও জরুরি তল্লাশিতে একটু গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। আজ রাতেই ফিরে আসবেন। বাড়িতে আনভীর আর আমি ছাড়া কেউই নেই। আনভীরের আজ ভার্সিটিতে কাজ ছিলো কিন্ত আমি যেহেতু বাড়িতে একা তাই আমায় রেখে যাননি আর। লাইব্রেরি রুমেই বসে বসে স্টুডেন্ট এর থিসিসগুলো চেক করছেন। আমি ড্রইংরুমে আনমনে বসে বসে টিভি দেখছি। ভালোলাগছে না শরীরটা। গরমে অস্থিরভাব ফুটে উঠেছে।
আমি ভাবলাম গোসল করে নিলেই হয়তো ভালো হবে। অস্থিরতটা একটু হলেও কমবে। আমি তাই ধীরপায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেডরুমের দিকে এগোলাম। লাইব্রেরি রুমটা পার হওয়ার সময় হাটার গতি কমিয়ে দিলাম আরও আস্তে। আনভীর যদি শব্দ পান তাহলে আমায় রামধমক লাগিয়ে দেবেন হাঁটাহাঁটির জন্য। তারপর জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যেতেই নিঃশ্বাস ছাড়লাম। এ যাত্রায় আনভীর টের পাননি।
.
ঝর্না দিয়ে গড়িয়ে পড়া শীতল পানির সমাহারে আমার অস্থির দেহ ক্রমশই শীতল হয়ে গেলো। তপ্ত গরমের আমেজ নিমিষেই হারিয়ে গেলো কর্পূরের ন্যায়। আমি দ্রুত একটা শীতল গোসল সেরে শরীরটা ঠান্ডা করে নিলাম। বাথরোব পড়ে যেই না তাক থেকে জামা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম দুর্ভাগ্যবশত পিচ্ছিল পড়ে পা ফসকে গেলো আমার। যার দরুন ফ্লোরে পড়ে যেতেই মুখ দিয়ে আত্নচিৎকার বেরিয়ে এলো। আমি ফয়েল পেপার দিয়ে মোড়ানো ব্যান্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ক্রমশই ব্যান্ডেজের সাদা রঙ রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে হয়েছেটা কি। তখনই বাথরুমের দরজায় খটখট শব্দ শুরু হলো,

-‘এই আহি? কি হয়েছে তোমার?’

আনভীরের অস্থির কন্ঠ শুনতে পেলাম আমি। নিজের দুহাত দিয়ে সর্বোজোড় দিয়ে উঠার চেষ্টা করেও পারলাম না। আমার পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা হচহছে। না পারছি উঠতে , না পারছি কিছু বলতে।

-‘তুমি ঠিকাছো আহি? চিৎকার দিলে কেনো? সে সামথিং ড্যাম?’

আনভীরের ক্রুদ্ধ কন্ঠ আমার কানে আসতেই আমি অবগত হলাম যে উনি আন্দাজ করতে পেরেছেন কিছু একটা। আমি ঠোঁট চেপে মিনমিনিয়ে বললাম,

-‘পা ফসকে পড়ে গিয়েছি আনভীর। তবে চিন্তা নেই , আমি উঠতে পারবো।’

কথাটি কোনোক্রমে বললেও আমি উঠতে পারলাম না। পায়ে চাপ পড়লেই চিনচিন করে ওঠে রগটি।উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণই। আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার দরজায় শব্দ করে বললেন,

-‘উঠেছো?’

-‘আমি,,,,,আমি আসলে উঠতে পারছি না।’

খপ করে বলে ফেললাম কথাটি আমি। আনভীর নিঃশব্দে ছিলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর জড়ানো কন্ঠে বললেন,

-‘আমি আসবো?’

-‘মোটেও না। আমি বাথরোব ছাড়া কিছুই পড়িনি।’

আমি আহত সুরে বললাম। কিন্তু চোখজোড়া ছলছল করছে আমার। হাতে ভর দিয়ে ওঠার মতো শক্তি থাকলেও পায়ে একফোটাও শক্তি নেই। তারওপর ফ্লোর পিচ্ছিল হয়াতে যদি আবার আমি পড়ে যাই? আমি চেষ্টা করলাম ওঠার জন্য। আনভীর এবার অধৈর্য হয়ে বলে ওঠলেন,

-‘আমি আসছি ভেতরে।’

উনি তৎক্ষণাৎ বাথরুমের দরজার একপ্রান্তে ঝোলানো চিবি নিয়ে দরজার লক খুলে নিলেন যেহেতু আমি দরজা লক করেছিলাম। উনার উপস্থিতি টের পেয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলি। কেননা আমার পরনে হাটু পর্যন্ত বাথরোব ছাড়া আর কিছুই নেই। লজ্জায় ও সংকোচ ব্যাথার তুলনায় মনে বেশি জায়গা করে নিয়েছে। আনভীর তৎক্ষণাৎ আমার কাছে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন। আমি চোখ খুলতেই থমকে গেলাম। কেননা উনি এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আমার বদ্ধ চোখের দিকে। আমাদের চোখাচোখি হওয়ার পরেও আমার চোখ থেকে নজর সরালেন না। একবারও দেখলেন না আমি কেমন অবস্থায় ছিলাম। উনি তপ্তশ্বাস ফেলে আমায় কোলে তুলে নিতেই আমি উনার গলা নিজের দুহাত দিয়ে আকড়ে ধরলাম। নজর সরিয়ে নিলাম নিজের। আমার ভেজা চুল দিয়ে উনার হাত ভিজে গেলেও উনি কিছু বললেন না। বরংচ বিচলিত হয়ে গেলেন আমার এ অবস্থার জন্য। উনার চোখ-মুখ রক্তিম লাল। যেন ব্যাথা তো আমি পায়নি , পেয়েছেন উনি। উনি আমায় সন্তর্পণে খাটে বসিয়ে আমার পায়ের উন্মুক্ত অংশ কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। পায়ের কাছে বসে সাবধানতার সাথে খুলতে থাকলেন রক্তে মাখা ব্যান্ডেজটি। আমি ‘আহ্’ শব্দ করতেই উনি বাচ্চাদের মতো করে বললেন,

-‘বেশি লাগছে?’

আমার ব্যাথাতুর মুখেও হঠাৎ একচিলতে হাসি ফুটে ওঠলো উনার বাচ্চামো দেখে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here