এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫১

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫১
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

ভার্সিটির লাইব্রেরিতে বসে বসে ক্লাসের নোটগুলো এক এক করে লিখছি। বাহিরে স্টুডেন্টদের সমাগম। শুধু লাইব্রেরিটাই একটু ফাঁকা আর শব্দহীন হয়ে পড়ে আছে। আমার কানে ইয়ারফোন গুজা আর সেখানে একটা সফ্ট সং বেজে চলছে। আমি এতদিনের সব জমা ক্লাসের পড়াগুলো নোট করতে ব্যস্ত। আনভীর অনবরত কল করে চলছেন মোবাইলে। আমি শেষমেষ বিরক্ত হয়ে মোবাইল ভাইব্রেট করে রাখলাম। উনাকে দু’চোক্ষে দেখার মতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমার মন ভেঙে এখন আমারেই কল করা হচ্ছে হুহ! আসলে গতকাল উনার সাথে তুমুল সংঘর্ষ লেগেছে আমার। গতকাল বিকেলে আমি উনার সাথে সুপার শপে গিয়েছিলাম কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য। তারপর বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই দেখা পাই মিস রোজনীলের। আনভীর তখন বলেছিলেন যে মিস রোজনীলের বাসা নাকি এই এলাকাতেই। যদি এই কথাটা আমি আগে জানতে পারতাম তাহলে কখনোই এই পথে পা বাড়াতাম না। ঘটনা এখান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হলেও হতো , কিন্ত ঘটনা এ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়নি। মিস রোজনীল আনভীরকে দেখার মাত্রই ছুটে চলে এলেন আমাদের সামনে। আমায় ইগ্নোর করেই বলে ওঠলেন,

-আরে মিঃ আনভীর, আপনি এখানে? হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি?

-অ্যাহ! শখ কত। আমার বরের তো আর কাজ নাই যে আপনার সাথে দেখা করতে আসবে।

কথাটি বিড়বিড়িয়ে বললাম আমি। আনভীর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। কেননা মিস রোজনীল স্বভাবসুলভের তুলনায় একটু বেশি এক্সপেক্টেশন নিয়েই আলাপচারিতা করেন আনভীরের সাথে। আনভীর শীতল স্বভাবতই বললেন,

-আসলে এখান থেকে কিছু জিনিস কিনতে এসেছি , আমার ভাবিমণির কিছু জিনিস দরকার তো , তাই?

-ওহ্।

মলিন করে প্রতিউত্তর দিলেন মিস রোজনীল। তারপর আমার দিকে তাকােই উনার ভ্রু কুচকে এলো। যাক! এতক্ষণে তাহলে উনার নজর পড়েছে আমার প্রতি। নাহলে এসেই যেই পকপক শুরু করেছেন, দেখলে মনে হবে যে এখানে আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। উনি এবার আমায় দেখিয়ে আনভীরকে বললেন,

-এই বাচ্চা মেয়েটি কে মিঃ আনভীর? আপনার বোন হয়?

আমার চোখ রীতিমতো বেরিয়ে আসার উপক্রম। আনভীর তো শুকনো কাশি দিতে দিতেই কাহিল হয়ে গিয়েছেন। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম আনভীরের দিকে। আনভীর অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললেন,

-ও কোনো বাচ্চা মেয়ে না মিস রোজনীল। আমার ওয়াইফ। মিসেস আহি আনভীর খান। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম ওর কথা।

মিস রোজনীল যেন কোনো ক্রমেই বিশ্বাস করতে পারলেন না উনার কথা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-বলেন কি মিঃ আনভীর? আপনি তো বলেছিলেন যে আপনার ওয়াইফ আমাদের ভার্সিটিরই ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে পড়ছে। আহিকে দেখে তো মনেই হয়না যে এমন কিউট বাচ্চা টাইপ মেয়ে আপনার ওয়াইফ। আমি তো প্রথমে আপনার বোন ভেবেছিলাম। সরি ! সরি!

আমার গলা ছেড়ে ভ্যা ভ্যা করে কাদতে মন চাচ্ছিলো উনার কথা শুনে। পিচ্চি পর্যন্ত তো ঠিক ছিলো তাই বলে বোন বানিয়ে দিবে? মিস রোজনীল এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠলেন,

-তুমি অনেক লাকি আহি এমন সুইট একটা হাজবেন্ড পেয়েছো। পিচ্চি বউ হলে এই একটা মজা। বরের অনেক আদর পাওয়া যায়। আনভীর বিবাহিত বলেই বেঁচে গেছে। আজ ব্যাচেলর হলে আমি ঠিকই উনাকে আমার ফাঁদে ফেলে দিতাম।

উনি এ কথা বলেই খিলখিলিয়ে হাসছেন এবার। আর আমার রীতিমতো দাউদাউ করছে মাথা।আমার সামনেই আমার বরকে ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি! এজন্যই, এজন্যই আমি কখনও চকলেট টাইপ ছেলেদের বিয়ে করা তো দূরের কথা, প্রেমও করতে চাইনি। আনভীরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর আমি মোটামুটি শিউর ছিলাম আর যাই হোক, এমন চকলেট, ঠোঁটকাটা টাইপ লোককে তো ইন্নাল ইল্লাহ হয়ে গেলেও বিয়ে করবো না। আর কপাল আমার! সেই লোকটাই আমার ভাগ্যে চেপে বসেছে। আনভীর আমার রেগে থাকা আড়নজরে দেখে বিদায় দিতে চাইলো মিস রোজনীলকে। কিন্ত মিস রোজনীল তো ছাড়বার পাত্রী নন। আমাদের নিজের বাসায় নিয়ে এককাপ চা না খায়িয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। অনেক কষ্টে উনাকে ম্যানেজ করলেন আনভীর। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই মিস রোজনীল আনভীরকে বলে ওঠলেন,

-আপনাকে এই প্রথম ক্যাজুয়াল লুকে দেখলাম মিঃ আনভীর। বলতে হবে অনেক সুন্দর লাগছে আপনাকে।

-আপনিও কম সুন্দর না কিন্ত ! তাই শুধু শুধু আমার প্রশংসা করতে হবে না।

আমার রাগ আর পায় কে। একপ্রকার হতদন্ত হয়েই উনাকে ছেড়ে আমি এগিয়ে গেলাম। আমার এগোনো দেখে আনভীরও দ্রুত উনাকে বিদায় জানিয়ে পিছু পিছু এলেন আমার। আমি অনড়।আমি যদি কারও সাথে কথা বলতাম ভালোই তো ক্ষেপে যেতেন। উনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত পরিমাণ হিংসা যে আমায় নিজের ছোট্ট কিউট ভাতিজার সাথে দেখলেও উনার ভালোলাগে না। আর আজ উনি ওই রোজনীল মিসকে কমপ্লিমেন্ট দিলেন যেদিকে আমার আদৌ মনে পড়ছেনা যে উনি কখনও আমায় কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন কি না। একে তো বোন নামক বিভ্রান্তি আবার মিস রোজনীলের সাথে উনার কথা শুনে রাগে ক্ষোভে আমার কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সারাত আমি উনার সাথে কথা বললাম না। এমনকি রাতে আজরান ভাইয়াকে জোর করে উনার সাথে ঘুমাতে বলে আমি ভাবি আর অয়ন কিউটুসটার সাথে ঘুমাতে গেলাম। রাত পেরিয়ে সকাল হলো, ভার্সিটি যাওয়ার পথেও আমি নির্বিকার। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আনভীরের সাথে আমার কথা হয়নি যেহেতু এখানে আমাদের সম্পর্ক স্টুডেন্ট স্যার এর মতো। তবে উনি যেই হারে ফোন দিচ্ছে , বুঝলাম উনার এখন অফ টাইম। আমি তাই তপ্তশ্বাস ছেড়ে লাইব্রেরি থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম তখনই মুখোমুখি হলাম আনভীরের। হয়তো আমার উপস্থিতি এখানে জেনেই ছুটে চলে এসেছেন। উনি এবার শীতল কন্ঠে বললেন,

-ফোন ধরছো না কেনো?

-শুনিনি তাই।

আমাদের টাইম যেহেতু শেষ তাই উনার সাথে পার্কিং সাইডে আমি যেতে থাকলাম। সেখানে যাওয়া মাত্রই উনি চেপে ধরলেন আমার হাত। থমথমে গলায় বললেন,

-ভার্সিটিতে ছিলে বলেই বেঁচে গিয়েছো তুমি। অনত্র হলে আমায় কল রিসিভ না করার ফল সুদে আসলে বুঝিয়ে দিতাম। এত স্টুপিড কেনো তুমি? গতকালের সামাণ্য ঘটনার জন্য এমন রাগ করতে লাগে?

-সামাণ্য ঘটনা?

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি আমি বললাম।

-কোনটা সামাণ্য ঘটনা মনে হয় আপনার? আপনি উনাকে, ওই রোজনীল মিসকে কিভাবে আমার সামনে সুন্দর বলতে পারলেন আপনি যেখানে আমাকে তো কখনোই সুন্দর বলেননি? আর মহিলাটা কত্তো বড় বজ্জাত। আমার সামনেই আপনাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ধান্দা! আপনি কি হিসেবে সুন্দর বলেন উনাকে?

-আরে আমি তো ভদ্রতার খাতিরে জাস্ট বলেছি। উনি যেহেতু আমায় নিয়ে মন্তব্য করেছেন এজ অ্যা ডিসেন্ট পারসন হিসেবে আমাকেও তো তা বজায় রাখতে হবে তাইনা?

উমি পুরোটা পথে ড্রাইভ করছেন আর বুঝাচ্ছেন আমায়। আমিও কোনোরূপ কোনো কথা বাড়ালাম না। উনি বাড়ির লিফ্টের মধ্যেও একনাগাড়ে শান্তনা দিচ্ছেন আমায়। শেষমেষ ধৈর্যহারা হয়ে বললেন,

-আরে এতে রাগ হওয়ার কি হয়েছে আহি? আমি তো উনাকে জাস্ট সুন্দর বলেছি। এর বেশি তো কিছু বলিনাই। আমি তোমায় ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর কল্পনাও করিনা মেয়ে। তো এসব করার কোনো মানে আছে?

উনি জীবনেও বুঝবেন না একজন মেয়ের এই কষ্টটা যখন হাজবেন্ট তার ওয়াইফের সামনে অন্য মেয়েকে সুন্দর বলে। একটা উচিত শিক্ষা এবার উনাকে দিতেই হবে। ভাগ্য হয়তো সহায় ছিলো আমায়। বাড়িতে গিয়েই দেখলাম ধ্রুব ভাইয়া এসেছেন অয়নকে দেখতে। আমায় মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেলো। আনভীরকে বললাম,

-আপনি দেখতে চাচ্ছিলেন না যে আমার এত রাগের কারন কি? এখনইই দেখাচ্ছি……….

তারপর ধ্রুব ভাইয়াকে বলি,

-আরে ধুব ভাইয়া,,, হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ। আপনাকে আজ তো অনেক সুন্দর লাগছে?

আনভীরের মুখের রঙ ক্রমান্বয়েই পাল্টাতে লাগলো। ধ্রুব ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন,

-এই প্রথম আমার লুকের প্রশংসা করলে তুমি আহি!

-তো করবো না, আপনাকে আসলেই সুন্দর লাগছে। আর আজ ব্লু টিশার্টে তো আরও চমৎকার। একেবার শাহিদ কাপুর টাইপ।

লাজুক হাসলেন ভাইয়া। আনভীর শীতল কন্ঠে আমার হাত চেপে বলে ওঠলেন,

-ভেতরে চলো।

বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই! আমি শুধু আনভীরকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমার তখন কেমন লেগেছিলো। কিন্ত উনি এবার রুমে এসে আমায় অবাক করে দিয়ে টেনে আমায় দেয়ালের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-রিভেন্জ নিতে চাও তুমি আহি , যার জন্য এমন করলে?

-আমি কেমন করলাম আবার? আমি জাস্ট দেখালাম যে আমার কেমন লেগেছিলো কালকে।

-আমি কি মিস রোজনীলকে এমন বলেছি যে উনাকে ব্লু ড্রেসে ক্যাট্রিনা তো অন্য ড্রেসে কারিনার মতো লাগছে। আর তুমি তো রীতিমতো ওই হাবলা কে শাহিদ কাপুরের সাথে তুলনা করলে। হাউ সিলি গার্ল ইউ আর!

আমি নিশ্চুপ। আসলে উনার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার ওপর আছড়ে পড়াতে তখন অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছিলো। তারপর সময় ঘনিয়ে রাত হয়ে গেলো কিন্ত আনভীর আর তেমন একটা কথা বললেন না আমার সাথে। এমনকি রাগ ভাঙানোরও চেষ্টা করলেন না। আমি বুঝলাম না উনার কি হয়েছে। শেষমেষ ধৈর্যহারা হয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম উনি ডিভানে বসে আনমনে ফোন স্ক্রল করছেন। আমি উনার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম মোবাইলটা। উনি জিজ্ঞেস করলেন,

-এভাবে নিয়ে নিলে কেনো আহি….আমি দেখছিতো।

-অনেকক্ষণ মোবাইল দেখেছেন আপনি। এবার রাখুন।

-তো কি করবো আমি?

-আমাকে………আমাকে দেখুন।

চট করেবলে ফেললাম আমি। আনভীর চোখ সরু করে ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি হাসলেন। তারপর ওপর থেকে নিচে চোখ বুলিয়ে বললেন,

-উহ্! ভেবেছিলাম তোমার সাথে রাগ হওয়ার ভান করবো তা আর পারলাম কই। এভাবে আমার সামনে আসলে আমার কেনো, যেকোনো ছেলেরই মাথা খারাপ হবে। মাই হট ওয়াইফি!

লজ্জায় কান গরম হয়ে গিয়েছে আমার। আমি ভেবেছিলাম কই উনি রেগে আছেন আর হলোটা কি। আমি অস্বস্তি নিয়ে সরে আসতেই উনি হাত টেনে আমায় নিজের কাছে বসিয়ে দিলেন। কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-আমায় সিডিউস করে কোথায় যাচ্ছো মিসেস আহি? এত সহজে তো আজ নিস্তার পাবে না। এমনিতেও পরপর তুমি আমার কতগুলো কথা অমাণ্য করেছো। আবার ধ্রুবকে বলেছো যে নীল রঙে ওকে শাহিদ কাপুর টাইপ লাগে। আমিও তাহলে কেমন টাইপ সেটা দেখিয়ে দেই?

-দরকার নাই। আমি ধ্রুব ভাইয়াকে শাহিদ কাপুর বলি বা আপনাকে ডিপজল বলি, আপনার কি হুহ? যান ওই মিস রোজনীলের কাছে।

উনি এবার আমায় কোলে তুলে খাটে নিয়ে গেলেন। পাশের লাইটের সুইচ নিভিয়ে দুষ্টু হেসে বললেন,

-তুমি থাকতে মিস রোজনীল কেনো? তোমার মতো পিচ্চি বউ আদর করার জিনিস, রাগ করার জিনিস না। এখন রাগ করোনা। কাম ফাস্ট মিসেস আহি , লেটস লাভ টুগেদার!❤️
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

group:
❤️কায়াভ্রমর❤️-{Stories of Kayanat Afrin}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here