#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫৬ {অন্তিমের পূর্বাংশ}
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
বাচ্চা দুটোকে কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিলাম আমি। আমার পুরো পৃথিবী কেমন যেন থমকে আছে। চোখ দুটো হয়ে ওঠেছে নিষ্প্রভ। বাচ্চা দুটো একেবারে একরকম , সেই যে বড় বড় চোখ, ঘন আখিপল্লব, খাড়া নাক , পুরু ঠোঁট , গৌরবর্ণের গায়ের রঙ, ঠিক আনভীরের মতো। অপার নয়নে দুজন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এতক্ষণ কাদো কাদো ভাব থাকলেও আমার কোলে আসার পর চোখে-মুখে বিস্ময়। এটাই তো মা হওয়ার সবচেয় বড় প্রাপ্তি। আমার চোখে অশ্রু ভর করলো আনন্দে। প্রাণভরে আমি আমার দুজন নূরকে চুমুতে ভরিয়ে দিলাম। হাসপাতালে আমার খাটের পাশে বসা ভাবির চোখেও সুখের হাসি। আমার কাছে এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু। ভয়াবহ যন্ত্রাণাগুলোর কথা মনে পড়লেই আমার গায়ে হিম ধরে যায়। সিজারের অপারেশনের পর প্রথম ২৪ ঘন্টা একেবারেই জ্ঞান ছিলো না আমার। জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। পাশেই একটা ছোট বেবি বেডে দুটো বাচ্চা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো। পরে ভাবি তাদের আমার কোলে দিতেই ওরা জেগে যায়। অদ্ভুতভাবে কান্নাও করে না দুজনে, বরং অপার পানে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
আমার হঠাৎ মনে পড়তে থাকলো তখনকার ঘটনাগুলো। আসলে অপারেশনের আগে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। এসময় আমার খুব প্রয়োজন ছিলো কারও শান্তনাবাণী শোনার জন্য। আনভীর আমার সাথে ছিলেন ঠিকই তবে উনি নিজেও প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছেন। এমনকি আমার থেকেও বেশি। চোখমুখ হয়ে ওঠেছে রক্তিম লাল। আমার মাথায় পজিটিভ চিন্তা থেকে নেগেটিভ চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো বেশি। কেননা ডক্টর স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন একেতো কমপ্লিকেশনস দ্বিতীয়ত বেবিদের পজিশন চেন্জ হয়ে গিয়েছে। আজ আমার কিছু হয়ে গেলে ওদের সামলাবে কে? আমি যেই ভয়াবহ অবস্থায় ধিক্কার, অপয়া মেয়ে হিসেবে বড় হয়েছি বাবা থাকা সত্বেও , আমি চাইনা আমার সন্তান এ অবস্থায় পড়ুক। আমি কাতর কন্ঠে ডাক দিলাম আনভীরকে। শ্বাস টেনে বললাম,
-আমার কিছু হয়ে গেলে বেবি দুটোকে ফেলে ফেলে বড় করবেন না আনভীর, প্লিজ! আমি চাইনা আমার মতো ওদের অবস্থা হোক। আপনি যদি বিয়ে করেন কেউ আপনাকে বাধা দিবে না, তবুও ওদের একা রেখে চলে যেয়েন না। না পারলে শিউলি ভাবির কাছে দিয়েন। ভাবির প্রতি এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে সে আর যাই হোক , আমার চাচির মতো আমার সন্তানদের অবহেলা করবে না। আপনি তাহলে……
আমায় আর কথা বলতে দিলেন না আনভীর। আমার বাম গেলে সজোরে চড় মারতেই আমি থমকে গেলাম। পুরো কেবিন নিস্তব্ধ। মা আর ভাবি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আনভীরের রাগান্বিত মুখশ্রীর দিকে। যেই আনভীর, যেই আনভীর যখন আমায় হেয় করতেন তখনও আমার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত দেননি সেই আনভীর আজ আমার এই পরিস্থিতিতে চড় মারবেন তা ছিলো আমাদের সবার কল্পনার বফইরে। আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। উনি তেজি গলায় বললেন,
-আর একটা বুলশিট কথা বলবা আমিই মেরে ফেলবো তোমায়। এই মেয়ে! এসব কথা বলতে তোমার বুক কাপে না? তুমি ভাবলে কি করে আমি তোমায় ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে সংসার করবো? লিসেন, আমার জীবনে তুমিই প্রথম নারী আর তোমাকেই শেষ নারী হিসেবে রাখতে চাই। এই আনভীর রেজওয়ান খান এক নারীতেই সন্তুষ্ট। তোমার কিচ্ছু হবেনা বুঝেছো? আর বেবিদেরও কিচ্ছু হবে না।
আনভীর এবার কেদে দিলেন বাচ্চাদের মতো। উনাকে এতটা ভেঙে পড়তে আজই দেখেছি আমি।শিউলি ভাবি আর মাও চোখের পানি বিসর্জন করছেন এবার। অবশেষে আমায় নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে। যাওয়ার আগে আনভীর নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া দিয়ে অজস্র চুমু খেলেন আমার ক্লান্ত মুখে। অতঃপর অপার পানে তাকিয়ে রইলেন আমায় নিয়ে যাওয়ার দিকে।
________
আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছিলেন, শত কমপ্লিকেশনসের পরেও আমার প্রাণভোমরা দুটোকে আল্লাহ সহি সালামত পৃথিবীতে এনেছেন। হ্যাঁ, টুইন বেবি হয়েছে আমার। একজন ছেলে আর একজন মেয়ে। প্রথমে দেখলে বোঝা যাবেনা কারন দুজন দেখতে অবিকল তাদের বাবার মতো।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশে তাকালাম আনভীরকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। পেয়েও গেলাম উনাকে। উনি কেবিনের এক কোণে ছোট্ট সোফায় ঘুমিয়ে আছেন বাচ্চাদের মতো। শরীর অবসন্ন। চুলগুলো একেবারেই অগোছালো। দেখলে মনে হবে কত রাত যেন ঘুমুতে পারেনি শান্তিমতো। আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম শিউলি ভাবির দিকে। জিজ্ঞেস করলাম,
-উনি এভাবে ঘুমিয়ে আছেন কেনো ভাবি?
ভাবি হেসে দিলেন ফিক করে যেন আমি খুবই মজার কোনো কথা বলছি। আমি বোকা বনে গেলাম। ভাবি কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলে ওঠলেন,
-আর বলো না আহি তোমার পাগল বরের কীর্তিকলাপ। তোমার অপারেশনের পুরো টাইম পাগলামি করেছে বাইরে দাঁড়িয়ে। আধঘন্টা হতে না হতেই হসপিটাল পারলে মাথায় তুলে ফেলে যে এত সময় লাগছে কেনো। আজরান টেনে আনভীরকে বেঞ্চে বসাতে পারেনা। খালি একই কথা, ‘আমি আহির কাছে যাবো’ , পরপর দুবার অজ্ঞান হতে হতে বেঁচে গেসে। পরে বাবা বাধ্য হয়েই একপ্রকার ধমক মারে আনভীরকে। তবুও যেন ওর খেয়াল নেই। শেষমেষ বিশ্বাস করো, একেবারেই কেদে ফেলে বাচ্চাদের মতো। আনভীরকে আর যাই হোক, এমন অবস্থায় কখনোই দেখিনি আমি। পুরোই বেসামাল হয়ে পড়েছিলো ও। আজরান শুধু পারেনাই আনভীরকে কষিয়ে দুটো চড় মারতে। তুমিই বলো, এমন দামড়া ছেলে , যে কি-না বাপ হবে সে যদি বউয়ের অপারেশনে এমন কাহিল হয়ে যায় তবে কি হবে বলোতো?
ঘটনা এখানে থাকলেও হয়তো পারতো। যখন শুনেছে যে বেবিরা আর বেবিদের মা তিন জনেই সেফ আছে পরে খুশিতে সেন্সলেস হয়ে যায়। এ নিয়ে কি হাসাহাসি আমাদের মধ্যে। তোমার চোখ খোলার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় ও তোমার আর বেবিদের সাথে ছিলো। একটু আগে বাবা আর আমি জোর করে ঘুমাতে বললাম ওকে। আর দেখো, সোফায় শুতে না শুতেই ঘুম।
আমি বাকরুদ্ধ। আমি জানতাম উনি পাগলামি করবে তবে সেই পাগলামিটা যে অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যাবে তা ভাবাও অসম্ভব ছিলো আমার সাপেক্ষে। আমি আবার তাকালাম অদূরেই ঘুমিয়ে থাকা আমার বর সাহেবের দিকে। দিন দিন উনি যেন আরও বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন আমায় নিয়ে। আল্লাহ হয়তো এজন্যই দোয়া কবুল করেছেন আমার। কেননা আমার যদি কিছু হয়ে যেতো , আনভীরও নিঃশেষ হয়ে যেতেন। এমন মানুষ কজনেরই বা ভাগ্যে জুটে? ভাবতেই ঠোঁটকোলে মুচকি হাসি ছাড়িয়ে পড়লো আমার।
____________
বেবি দুজনের নাম রাখা হয়েছে আহিয়ান আর আনহি। বোঝাই যাচ্ছে যে নামদুটো আমার আর আনভীরের সাথে মিল করে রাখা নাম। দুটো নামই আনভীর রেখেছেন খুবই ভেবেচিন্তে। আহিয়ান আর আনহি এর জন্ম হয়েছে আজ ৪০ দিন প্রায় ছুঁই ছুঁই।
তবে আমি এবার আনভীরের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। সেদিন উনি হসপিটালে আমায় ঠাস করে যেই চড়টা মেরেছিলেন তা ভুলার মতো নয়। উনি আমার সেই অবস্থায় কিভাবে মারতে পারলেন নির্দয়ের মতো? আমি যেই প্রশ্নগুলো করেছিলাম আদৌ সেগুলো ভুল ছিলো? অনেকে এগুলো আমার বোকামি বললেও একমাত্র আমার মতো মা হীনা মেয়েই বলতে পারবে এর কষ্ট। সমাজে বেঁচে ছিলাম কোনোরকম। বাবাও আমায় না জানিয়ে অনত্র বিয়ে করে সংসার করছিলেন , তাহলে বেবিদের নিয়ে ভয় হওয়াটা কি আমার স্বাভাবিক নয়?
আনভীর আমায় বহুবার সরি বলেছেন , তবে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। তবুও আনভীর থামেননি। কয়েকদিনে পাশে ছায়ার মতো ছিলেন আমার। বেবিদের রাতে সামলানো আমার একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। উনি জেগে ছিলেন আমার সাথে। আমি যখন একজনকে ফিডিং করাতাম তখন অন্যজনকে সামলাতেন উনি। আবার সকালেই জলদি উঠে ভার্সিটি যেতে হতো বলে মা কে বলতেন সকালে আমার পাশে থাকতে। বাবা এখন অফিসে যান কম বেবিদের সাথে সুযোগ পেলে সময় কাটান বেশি। কিন্ত রাত হলেই তো হয় সমস্যা, আহিয়ান আর আনহি দুজন কম্পিটিশনে কান্না কাটি শুরু করে। পরে ওদের সামলানো অনেক কষ্টের হয়ে যায়। আজকেও গণহারে কাদছে দুজনে। আমি আনহিকে কোলে নিয়েছি আর আনভীর নিয়েছেন আহিয়ান কে। একপর্যায়ে দুজনেই ঘুমে ঢুলে পড়লো ধীরে ধীরে। আমি ওদের দুজনকে আস্তে করে খাটের মাঝখানে শুয়িয়ে দিলাম।আমি পাশ দিয়ে শুয়েই পড়ছিলাম উনি হাত টেনে রিডিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন আমায়। আমি প্রশ্নবোধক চোখে তাকালাম উনার দিকে। নির্বিকারে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হলো?
উনি হাঁটু ভর করে বসলেন আমার কাছে। তারপর পকেট থেকে বার্ন ক্রিম বের করে সন্তর্পণে লাগিয়ে দিতে থাকলেন হাতে। আমি মৌনতা কাটালাম। তবে চোখে মুখে বিস্ময়। দুপুরেই বেবিদের গোসলের জন্য গরম পানি করার সময় অসাবধানতা বশত হাতে গরম পাতিলের ছ্যাকা খেয়েছিলাম। উনি হয়তো কোনোভাবে দেখেছেন আগে পরে। উনার এই জিনিসটা প্রচন্ড ভালোলাগে আমার। ছোট ছোট বিষয়গুলো উনি খুব গভীরভাবে কেয়ার করেন। সবশেষে চিন্তা করেন আমার জন্য। আনভীর হঠাৎ আমায় প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে আমায় বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। আমার পেছন বরাবর নিজেও শরীর এলিয়ে আঁকড়ে ধরলেন আমার কোমড়। সন্তর্পণে চুলে মুখ গুজলেন আমার। আমি ঘুমন্ত নিনির্মেষে তাকানোর চেষ্টা করলাম উনার দিকে। উনি জড়ানো গলায় বললেন,
-তুমি ঘুমাও আহি। আমি এখানেই তোমার সাথে ঘুমাবো। আই শ্যুড ফিল ইউ এভরি সেকেন্ড মাই ডিয়ার ওয়াইফি। এক পাও এখান থেকে তাই নড়বো না।
.
.
.
.
.
~চলবে…..ইনশাআল্লাহ
[ভুলক্রুটি মার্জনীয়]
নোটবার্তা: আগামীকাল অন্তিম পর্ব দেওয়া হবে। আপনাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারনা হয়েছিলো যে আমি বোধহয় স্যাড কিছু দিবো। আমি কিন্ত এমন কিছুই বলিনি কারন প্রেগনেন্ট হলেই মানুষ মারা যায় না। তাছাড়া ‘আনভীর-আহি’ সুন্দর অনুভূতিসম্পন্ন একটি গল্প। এখানে আর যাই হোক অপ্রত্যাশিত কিছুই মানায় না। আনভীর আহি এমন দুটো চরিত্র যা সবাই কল্পনা করতে পারবে। যাই হোক আগামীকাল অন্তিম পর্ব দিচ্ছি এন্ড ইয়েস, খুবই , খুবই, খুবই বিশেষ কিছু থাকবে। ততক্ষণ সবার জন্য ভালোবাসা রইলো।
বাই দ্য ওয়ে, বেবি দুটোর নাম পছন্দ হয়েছে তো?
Gopota onek onek onek sundor chilo.R baby dutor name o khub sundor.