এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫৪

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫৪
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি আমি আর আনভীর। ডাক্তার কড়া নজরে আমার রিপোর্টগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছে। আনভীর একপাশে বসে আছেন শান্ত হয়ে। টুইন বেবি গর্ভে ধারন করেছি বলে আগের তুলনায় ঘনঘনই এখানে আসতে হচ্ছে আমার। ডাক্তার এবার রিপোর্টগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আনভীর শীতল গলায় বললেন,

-এনি প্রবলেম ডক্টর? আহির হেলথ কন্ডিশন ঠিক আছে তো?

বিস্মিত হলাম আমি।সেই সাথে ডাক্তার নাজনীনও।উনি উনার এত বছরের চিকিৎসার জীবনে আনভীরের মতো উইয়ার্ড মানুষ এ পৃথিবীতে দেখেননি যে কিনা নিজের অনাগত সন্তানদের কথা চিন্তা না করে প্রথমেই নিজের স্ত্রীর কথা জানতে চায়। এদিক দিয়ে আমি হয়তো খুব ভাগ্যবান। কারন আমাদের সমাজে যদি আমরা ভালোমতো খেয়াল করি তাহলে দেখা যাবে একজন পুরুষ মনে করে মেয়েদের জন্মই হয়েছে শুধু সন্তান জন্মদানের জন্য। তারপর তাদের কাজ শেষ।ছেলে সন্তান হলে ভাগ্যবতী মেয়ে হলে সেই স্ত্রী অপায়া। সবাই না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন। সমাজের কথা কি বলবো যেখানে আমাদের পরিবারই ছিলো এর চরম দৃষ্টান্ত ! তবে আনভীর এর থেকে একেবারেই ভিন্ন। উনি কখনোই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিশেষভাবে আরোপ করেননি। এমনকি আলট্রাসনোগ্রাফির সময় যখন আমার টুইন বেবি হবে জানতে পারলেন তখনও ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে চাননি এ ব্যাপারে। এমন যত্নশীল মানুষ কতজনই বা ভাগ্যে পায় আমার মতো?

ডাক্তার নাজনীন দীর্ঘশ্বাসের ইতি টেনে বলে ওঠলেন,

-রিলেক্স মিঃ আনভীর! আহির হেলথের তেমন একটা ইস্যু হয়নি। তবে,,,,,,

‘ইস্যু হয়নি’ শুনে আনভীর যেই না স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন ‘তবে’ কথাটি শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠলেন উনি। মুখের শান্ত দৃশ্য নিমিষেই রূপ নিলো পাহাড় সমান দুশ্চিন্তায়। বলে ওঠলেন,

-তবে? তবে কি ডক্টর নাজনীন?

-আসলে , আপনি তো জানেনই যে টুইন বেবির ডেলিভারি এতটাও ইজি না। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজনের টুইন বেবি হয় আর এদের মধ্যে ৭৫ পার্সেন্টই গর্ভাবস্থায় মিসক্যারেজ হয়ে যায় বা ডেলিভারির সময় বাচ্চা আর মায়ের উভয়েরই লাইফ রিস্ক থাকে। আমি কিভাবে বলবো আসলে বুঝতে পারছি না……..কেননা আপনাকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

মানসিক ভাবে ডাক্তার উনাকে প্রস্তুত থাকতে বলার কথা শুনে মানসিকভাবে আরও অস্থির হয়ে গেলেন তিনি। এমনিতেও বিগত কিছুদিন যাবৎ আমার জন্য ঘুমাতে পারছেন না স্বস্তিতে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম আনভীরের দিকে। যে বড় বড় সিচুয়েশনগুলো সহজেই হ্যান্ডেল করতে পারতো আজ সেই মানুষটা অল্প অল্পতেই এত অস্থির হয়ে যায়? ডাক্তার নাজনীন শান্ত হতে বললেন উনাকে। তারপর বললেন,

-দেখুন। আহির কনসিভ করার মন শারীরিক পরিপক্বতা থাকলেও টুইন বেবি হওয়ার মতো হেলথ কন্ডিশন এখনও ওর হয়নি। বিষয়টা আপনাদের কাছে চমকপ্রদ বলতে পারেন। ওইযে বললাম না, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে একজনকে পাওয়া যায় যে টুইন বেবির জন্ম দৃেয়। আহিও ওই ১০০ জনের মধ্যে একজন। আহির হেলথ কন্ডিশন মোটামোটি ভালো তবে বেবিদের না। এর জন্য বুঝতেই পারছেন যে আহির অবস্থাও বেশিদিন ভালো থাকবে না। ডেলিভারির সময় ওর হয়তো চরম চ্যালেন্জিং এর মুখোমুখি হতে পারে। সিজার তো আরও রিস্কি হবে ওর জন্য।

এতটুকু শুনেই আনভীরের হাত পা পাথর হয়ে গেলো জমে। ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাপছে যেন কিছু বলতে চাইছেন তবে গুছিয়ে বলতে পারছেন না। ডাক্তার এবার বললেন,

-আহির প্রতি প্রচুর প্রচুর এককথায় প্রচুর কেয়ার নিতে হবে আপনার। আর আহি, নিজের জন্য না হলেও এটলিস্ট বেবিদের জন্য তোমায় নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে হেলফেল করা যাবে না। তোমার যত্ন নেওয়ার জন্য শুধু মিঃ আনভীরকে নয়, তোমাকে নিজেও স্টেপ নিতে হবে। শক্ত রাখতে হবে নিজেকে। তুমি কি বুঝতে পারছো যে আমি কি বলতে চাইছি?

-হ হ্যাঁ।

মিনমিনিয়ে বললাম আমি। আনভীর আরও কিছুক্ষণ ডাক্তার নাজনীনের সাথে কথা বলে বেরিয়ে এলেন চেম্বার থেকে। উনাকে অগোছালো লাগছে। চোখেমুখে চিন্তার পাহাড়। উনাকে দেখে আমার নিজের মনেও ভয় ঢুকে গেলো, নিজের জন্য না, আমার ভেতরে বেড়ে ওঠা দুটি প্রাণের জন্য। ডাক্তার বলেছেন যে বেবিদের আপাদত যেই কন্ডিশন, মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতটুকু শুনে আমার নিজেরও প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছিলো। আনভীর গাড়ি চালাচ্ছেন খুবই সাবধানে। তবে উনি শান্ত হয়ে বসে নেই। বার বার উদ্রেকে ‘চ’ শব্দটি বের করছেন মুখ দিয়ে। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এবার। এই প্রাণ দুটোর একটি ছাড়াও আমার বাঁচা অসম্ভব। আমি কাদো কাদো হয়ে আনভীরকে জিঙ্গেস করলাম,

-আমার , আমার ভয় হচ্ছে আনভীর। বেবি দুটোর কিছু হয়ে যাবে নাতো? আমি তো মরেই যাবো তাহ……….

আমায় কথা বলতে না দিয়েই আনভীর হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমায়।আমি নিস্তব্ধ। উনার আগ্রাসী হাতের গভীর স্পর্শ নাড়িয়ে দিচ্ছে আমার মনের ভেতরকে। উনি তপ্তকন্ঠে বললেন,

-মরার কথাটা মুখে এনো না প্লিজ! এমনিতেও কিছুক্ষণ আগে আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছি আবার তোমার চোখের পানি আর ব্যাগ্র কন্ঠ শুনে আরও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবো আমি। এমন কথা ভুলেও মুখে এনো না প্লিজ!

আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো বললেন আনভীর। কি নিঃসংকোচ উনার এসব বাচ্চামো ! আমি যেন উনার নতুনত্ব রূপে দিনকে দিন অবাকের আরও এক ধাপে এগোচ্ছি। উনি এবার আমার চোখের পাতায় গভীরভাবে স্পর্শ করলেন নিজের ঠোঁটজোড়া। তারপর গাড়ির ইন্জিন স্টার্ট করে পুনরায় রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাসায় উনি আজ কারও সাথেই তেমন একটা কথাবার্তা বলেননি। তবে সবাইকে কঠোরভাবে জেরা করে বলেছেন যাতে আমার যত্নে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়। আমায় অভয় দেখালেও প্রচন্ড ভয় পেয়েছেন আনভীর। বারবার একটি কথাই বলছেন ভাবিমণির মতো নির্মম অবস্থায় উনি কখনোই দেখতে পারবেন না আমাকে। ভাবিমণির সেই অবস্থাটা উনাকে যেই ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলো, এখন আমার সময়ে ভয়ের মাত্রাটা আরও দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে উনার। ভার্সিটি এখন হাফ টাইম ক্লাস করিয়েই বাসায় ছুটে আসেন। আমার জন্য ঘন্টায় ঘন্টায় এ খাবার ও খাবার নিয়ে আসেন যাতে শরীরে পুষ্টির কোনো ঘাটতি না থাকে। মাঝে মাঝে ব্যাথার দরুন আমি ঘুমাতে না পারলে উনিও জেগে থাকেন আমার সাথে। যেই মানুষ কুসংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলো আজ সেই মানুষ সন্ধ্যায় বারান্দায় যেতে দেয়না, ভরদুপুরে বাহিরে বের হতে দেয় না আরও কত কি! উনার এসব ছোটখাটো পাগলামি দেখে হাসিও এসে পড়ে মাঝেমধ্যে।

একদিন রাতে ঘুমাচ্ছিলাম হুট করেই অস্থির হয়ে উঠে পড়লাম আমি। কেননা আমি খুবই ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমার বাচ্চা দুটো হুট করেই কোথাও যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে। আমি বেসামালাভাবে হাত বুলালাম পেটে। আনভীরকে কাদতে কাদতে বললাম,

-আমার! আমার বেবির দুটোর কিছু হয়েছে আনভীর! আপনি প্লিজ আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। আমি একটু আগেই ওদের উপস্থিতি টের পাইনি। বেবি এখন কিকও মারছে না দেখেন?

আমি তারপর আনভীরকের হাতটাও বেসামালভাবে পেটে রাখলাম। উনি আমার কাছে এসে ক্রমাগত শান্ত করার চেষ্টা করছেন । বলছেন যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। ক্রমেই আমি শান্ত হলাম। নিঃশ্বাস ফেলছি ঘনঘন। আনভীর আমায় নিজের কাছে টেনে আলতো ভাবে চুমু খেলেন ঠোঁটে। জড়ানো কন্ঠে বললেন,

-ওটা স্বপ্ন ছিলো আহি। বেবিদের কিছুই হয়নি। এইযে দেখো , বেবি কিক মারছে।

আনভীর আমার পেটের কাছে কান পাতলেন। আবার বললেন,

-আমার চ্যাম্প দুটো তোমার মতো দুষ্টু হবে বুঝলে? আমি কতবার বলাম মাম্মামকে কষ্ট দিতে না। কিন্ত শুনলোনা। মাম্মামের মতো পাপাই কে ইগ্নোর করে শুধু।

আমি কথা বললাম না। আসলে ভয়টা এখনও কাটেনি। আনভীর আমার এখনও চিন্তিত দেখে কোলে নিয়ে বারান্দার দরজা খুলে কাছের সোফায় বসে পড়লেন। তবে বাহিরে গেলেন না। চাঁদের ম্লান আলোয় সুন্দর লাগছে উনাকে। উনি এবার এগিয়ে এলেন আমার কাছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-তোমার চিন্তা দূর করার উপায় আমার কাছে। সেটা হলো টাইট একটা কিস করা। আফটার হলো প্রেগনেন্ট হওয়ার পর তোমায় আরও কিউট লাগে। দেখলেই শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। এখন তোমার কাছে অপশন আছে আহি মেরি জান ! কিস চাও নাকি আদর চাও?
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম পাঠকবাসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here