এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫৩

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ৫৩
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

আমার প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে আনভীরের ‘কেয়ারিং’ নামক অত্যাচার যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে গিয়েছে এবার। এটা করো না, ওটা করো না, এটা খাও, ওটা খাও আরও কতো কি। শুধু আনভীর না , মা-বাবা , শিউলি ভাবি, আজরান ভাইয়া সবাই অতিরিক্ত কেয়ার টাইপ টর্চারে আমার মতো মাসুম মেয়েকে ফালাফালা করে ফেলেছে। আমাদের বেডরুমে এখন আমার জামাকাপড় কম, বেবির জামা-কাপড় খেলনা বেশি। যেদিকে আমার চলছে মাত্র চার মাস। সবই আমার পাগল বর সাহেবের কেরামতি। আজরান ভাইয়া তো সরাসরি আনভীরকে বলে দিয়েছে, আমার যত্নের কোনো ক্রুটি হলে আমার সামনে উনাকে চড় থাপ্পড় মারতেও দু’বার ভাববে না, ধমকানো তো দূরের কথা। শিউলি ভাবি এর আগে পড়ে গিয়েছিলো বলে আমার সময়ে পুরো ঘরে ওয়াটারপ্রুফ কার্পেট মুড়িয়ে দিয়েছেন। নুড়ী আপা আমার পেছনে চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত। আনভীর আগে ভার্সিটিতে ক্লাস এটেন্ট করে টিচার্স রুমে ওভারটাইম কাজ করতেন, কখনও কলিগদের সাথে এদিক ওদিক যেতেন। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও সরাসরি বাসায় এসে পড়েন। তারপর ফ্রেস হয়ে বাচ্চা ছেলেদের মতো আমার কোলে মাথা রেখে গল্প করতে থাকেন বেবির সাথে।

এইতো কিছুদিন আগের কথা। ভার্সিটির এক প্রফেসরের মেয়ের বার্থডে অনুষ্ঠান থেকে আসার সময় আমার জন্যও কেক নিয়ে এসেছেন। উনি বলেছেন আগে নুড়ী আপা যেই ফলগুলো কেটে দিয়েছে ওগুলো শেষ করার জন্য। কিন্ত আমি আমার সিদ্ধান্তে অনঢ়। আগে কেক খাবো মানে কেকই খাবো। উনি ইতিমধ্যে শার্ট প্যান্ট পাল্টে একটা হাফ হাতা টিশার্ট আর ট্রাউয়ার পড়ে শুয়ে পড়লেন আমার কোলেমাথা রেখে। তারপর পেটে মুখ গুঁজে বললেন,

-দেখেছো চ্যাম্প! তোমার পিচ্চি মাম্মিটা কতো পাজি। আমার একটা কথাও শুনছে না। এখন ধমক দিলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেদে ফেলবে। তুমি জলদি বের হয়ে আমার দলে যোগ দাও। তারপর ফাদার-চ্যাম্প দুজন মিলে তোমার পাজি মাম্মিটাকে সাইজ করবো।

আমি উনার কথা শুনে চোখ তাকিয়ে তাকালাম। বললাম,

-এখনই আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন ওকে?

-হুম। এখন থেকেই মিশন স্টার্ট করছি। এখন দূরে না সরালে পরে আমি তোমার কাছাকাছি আসবো কখন? আর যাই হোক, তোমায় নিয়ে কম্প্রোমাইজ আমার পক্ষে ইম্পসিবল।যতই আমাদের বেবি হোক না কেনো? আহি ইজ অনলি মাইন এন্ড উইল বি মাইন ফরেভার❤️

আমার ঠোঁট কোলে আচমকা একটা স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। ক্লান্ত লাগছে উনাকে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। অবিন্যস্ত চুলগুলো কপালে আছড়ে পড়াতে বিপদজনক লাগছে উনাকে। ঠোঁট নাড়িয়ে যেভাবে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছেন নিমিষেই আমার হৃদয় কাপিয়ে দিতে বাধ্য। আনভীরের মধ্যে পরিবর্তনটা আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে আমার কাছে। আমি কথা না বাড়িয়ে আলতো হাতে উনার অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলাতে থাকলাম।

_____________

আজ মামুন ভাইয়া খাগড়াছড়ি থেকে অনেক কিছু নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। আমার শরীরের কন্ডিশন জেনেই আনভীরের চাচি ভাইয়াকে দিয়ে আচার, পাহাড়ি পেপে সহ পাঠিয়েছেন আরও অনেক কিছু। আচারের প্রতি সবসময়েই আমার একটা দুর্বলতা কাজ করতো। আবার এ সময়ে এমনিতেও অনেক টক টক খেতে মন চায়। তাই আচারের কৌটো নিয়ে ড্রইংরুমে সোফায় বসে পড়লাম আমি। অয়নকে ভাবি আমার পাশে একটা কাথাঁ দিয়ে শুয়িয়ে রেখেছে। কি সুন্দর কিউট বেবিটা। ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে যখন আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতহীন মাড়ির সাহায্যে হাসতে থাকে আমার প্রচন্ড ভালো লাগে দেখতে। আমি অজান্তেই আমার পেটে হাত বুললাম। উফফফ! তুমি যে কবে আসবে?

তন্মধ্যেই হতদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন আনভীর। আজ সময়ের আগে বাড়িতে ফিরে আসাতে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। সচরাচর উনি এত দ্রুত বাড়িতে আসেন না। আমার সাথে কোনোরূপ কোনো কথা না বলেই উনি বড় বড় পা ফেলে চলে গেলেন বেডরুমে। আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম। অয়নকে এখানে রেখে যেতেই পারছি না। ভাবি না আসা পর্যন্ত আমি বসে রইলাম অয়নের পাশে। তারপর আমি বেডরুমে গিয়ে দেখি উনি আসলে বেডরুমে নেই, ছিলেন বারান্দায়। সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারে উনাকে ডিভানে শরীর এলিয়ে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক। উনি বসে আছেন চোখ বন্ধ করে, ঠোঁটজোড়া অল্পবিস্তর কেপে উঠছে বারবার। আমি উনার পাশে গিয়ে বসলাম। কপালে হাতের উল্টোপিঠ স্পর্শ করে বললাম,

-আপনার তো জ্বর আসেনি। তাহলে এমন শরীর খারাপ দেখাচ্ছে কেনো?

-অনেক বড় কিছু হয়েছে আহি!

অজানা আশঙ্কায় মোচড় দিয়ে উঠলো আমার বুক। ভয়ে রীতিমতো ঢিপঢিপ শব্দটা দ্বিগুন হারে বেড়ে গিয়েছে। আলো আধারের খেলায় উনার অন্ধকার মুখ দেখে আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা যে হয়েছেটা কি। আমি স্থির হয়ে বসে রইলাম অল্পক্ষণ। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-ক-কি হ-হয়েছে?

-রিপোর্ট এসেছে তোমার আলট্রাসনোগ্রাফির।

নিজের অনাগত সন্তানের ব্যাপারটা উঠতে আমার ভয় যেন আরও জেঁকে বসলো মনে। মনে পড়লো দুদিন আগে আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর সময়কার কথা। অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। তটস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-ক-কি অবস্থা রিপোর্টের? কোনো খারাপ কিছু হয়েছে যে আপনি এত চিন্তিত? প্লিজ বলুন?

নিশ্চুপ রইলেন আনভীর। আমি অধীর হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

-বলছেন না কেনো আনভীর? কি হয়েছে?

-আমাদের টুইন বেবি হবে আহি!

আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে৷ তৎক্ষণাৎ বলা এই কথাটি এখনও আমার মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র ধারন করতে পারেনি৷ ক্রমেই আমি আন্দাজ করতে পারলাম উনার বলা কথাটা। হয়ে গেলাম নিস্তব্ধ।
আনভীর নির্বিকার হয়ে ডিভানে নিজের শরীর ছেড়ে দিয়েছেন৷ নিঃশ্বাসের দরুন ওঠানামা করছে উনার প্রসস্থ বুক। আমি জড়ানো কন্ঠে বললাম,

-আমাদের ট টুইন বেবি হ হবে?

-হুম, আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট এসেছে।

আমার চোখে মুখে প্রকাশ পেলো এবার নতুন এক আভা। বিগত কয়েকদিন ধরেই আমার অবস্থা অনেকটাই খারাপ ছিলো। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বমি আর পেটের আকারটাও সময়ের তুলনায় বড় হওয়াতে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো আনভীরের। তাই আনভীর চেকাপ করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আমায়। তবে আমার যে টুইন বেবি হবে এটা একেবারেই আমার ধারনায় ছিলো না। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার পেট স্পর্শ করলাম আবার৷ কেননা এখানে এখন দুটো প্রাণের উপস্থিতি টের পাচ্ছি।

আমায় তুমুল অবাক করে দিয়ে আনভীর হাঁটু দিয়ে বসে পড়লেন আমার পেটের কাছটাতে। তারপর কামিজের ওপর দিয়ে গভীরভাবে নিজের অধরের আদ্র স্পর্শ করালেন। আমি নিষ্প্রভ। উনি আমার কোলে মাথা রেখে শীতল গলায় বললেন,

-আমার পাগলাটে ফিলিংসের তোমার কোনো ধারনা আছে আহি! ছোটবেলা থেকেই টুইন বেবির প্রতি আমার অন্যরকম একটা ভালোলাগা ছিলো। আর আজ আমি টুইন বেবির বাবা হতে চলেছি জানতে পেরে আমি যেন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লাম। ইসস! আহি, তোমায় এই ছোট্ট পেটে কিভাবে আমার আমার দুটো চ্যাম্পকে রাখবে তুমি? সুইটহার্টস! জলদি তোমরা বের হয়ে পাপার কাছে আসো৷ মা’কে বেশি কষ্ট দিও না কেমন?

আমি নির্বাক হয়ে রইলাম উনার কথায়৷ আমি জানি উনি ওপর দিয়ে হাসিখুশি থাকলেও ভেতর ভেতর চিন্তায় পাগলপ্রায়৷ আর যাই হোক, টুইন বেবি নেওয়ার মতো হেলথ কন্ডিশন আমার হয়নি৷ আর টুইন বেবির সময়ে অনেক প্রবলেমই নাকি হয়৷ মায়ের লাইফ রিস্ক ও থাকে। আমি তপ্তশ্বাস ছাড়লা। এসব কথা ভাবলে আমিও উনার মতো অধিক শোকে কাহিল হয়ে যাবো। আপাদত সময়টি হচ্ছে ভালোভাবে কাটানোর সময়৷
.
.
দিনেক দিন আনভীর আরও যত্নশীল হয়ে উঠেছেন আমার প্রতি। টুইন বেবি হবে জানার পর তো সেই মাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ উনি এমন একটা কান্ড করছেন যে এই পৃথিবীতে আমিই প্রথম নারী যার টুইন বেবি হবে। আমিও যে কম যাচ্ছি এমন ধারনাটা ভুল। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু দ্বারাই উনাকে অতিষ্ঠ করে তুলছি। যখন তখন দুস্প্রাপ্য আবদার করছি আর উনি যদি পূরণ করতে না পারেন, তারপরই জারি করি ‘মিশন ইগ্নোরেন্স’, কেননা আনভীর আর যাই হোক, আমার এড়িয়ে চলাটা কখনোই সহ্য করতে পারেন না।
সেদিন রাতে উনি বাহির থেকে আমার জন্য ক্লিয়ার থাই সুপ নিয়ে এসেছিলেন। কারন দুপুরে আমি যা খেয়েছি সবই বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। পরন্তু শিউলি ভাবি আমার এ অবস্থা আনভীরকে বলতেই উনি সুপ নিয়ে আসেন আমার জন্য৷ কিন্ত খাওয়ার প্রতি একদন্ডও মন ছিলো না আমার। উনি শত চেষ্টা করে চলছেন এমনকি আমি খেলে আমায় আর বেবিকে কিসিও দিবেন বলেছেন আমার হেলদোল নেই৷ পরে আমায় জোর করে খাওয়ানো মাত্রই আমি উনার ওপর বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। তবে আনভীর কিছু বললেন না আমায়। বরং নীরবতার সাথে সবকিছু পরিষ্কার করে শুয়িয়ে দিলেন খাটে।

এমনই চলছিলো দিনকাল।আনভীর সকালে আমায় খাবার খাইয়ে চলে যান ভার্সিটিতে। তারপর রাতে এসে কোলে মাথা পেতে শুয়ে থাকেন। কখনও কখনও অয়নকে নিয়ে খেলা করতে থাকেন খাটে। এটা সত্য যে বাবা হওয়ার আনন্দে সেই গোমরামুখো আনভীর অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছেন। আগে যেই মানুষটা আমায় ধমকের ওপর রাখতো, এখন পারলে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখেন আমায়। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো আমার যত্ন নেন। হুটহাট মুড সুয়িং, উনাকে উত্যক্ত করা এসব করে কি মজা পাচ্ছিলাম কে জানে? এখন প্রায় মধ্যরাত। বাহিরে আঁধারে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে আছে৷ আমি ড্রসিংটেবিলের ওপর বসে খুব মনোযোগ দিয়ে শেভ করছি উনার খোচা খোচা দাড়ি৷ চরম বিরক্ত আনভীর। মাঝরাতে এভাবে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমার এমন কাজে চরম বিরক্ত না হয়ে কি উপায় আছে? আনভীর বলে ওঠলেন,

-আজীবন শুনেছি মাঝরাতে প্রেগন্যান্ট মেয়েরা বরের কাছে কত কিছু খাওয়ার আবদার নিয়ে বসে। আর তুমি? আবদার হলো আমার দাঁড়ি শেভ করবে৷ এত ছোট ছোট দাঁড়ি কেউ শেভ করে?

-শেভ করবো না কি করবো হ্যাঁ? আপনি যখন আমার কোলে মাথা রাখেন ,আপনার ওই পিপড়া সিপাহীগুলো পেটে বিঁধে আমার। তাই শেভ করে দিচ্ছি। আর আপনি জানেন না, এই দাঁড়িতে আপনাকে কত মারাত্নক লাগে? তাই ছোলা মুরগি বানিয়ে রাখবো। যাতে অন্য কেউ আমার বেবি দুইটার পাপার দিকে নজর দিতে না পারে।

অসাবধানতাবশত রেজার দিয়ে আমি খানিকটা কেটে ফেললাম উনার গালের কাছটা। হয়তো এটা হওয়ার কথাই ছিলো। এত ছোট ছোট দাঁড়ি সেভ করলে তো কাটবে , এটাই স্বাভাবিক। একটু রক্ত বেরোচ্ছে উনার গাল থেকে। আনভীর এবার আহতসুরে বললেন,

-দিলে তো আমার গাল কেটে।

উনি কথা না বাড়িয়ে আমায় কোলে তুলে খাটে শুয়িয়ে দিলেন। কানের কাছে হিসহিসিয়ে বললেন,

-অনেক পাগলামি হয়েছে আহি জান। এবার কিউট বেবির মতো ঘুমিয়ে পড়ো। ঠিকাছে?

-হুম।

-কিছু খাবে এখন। খেলে বলো আমি নিয়ে আসছি।

-উহু। আপনি আমার পাশে ঘুমান তো ! আমি আপনাকে খাবো!

সশব্দে হেসে দিলেন আনভীর। লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন আমার পাশে।আমিও কথা না বাড়িয়ে উনার বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লাম। তারপর তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

এই গল্পটা অনেকের কাছেই নিছক গল্প নয়।এটা হলো একরাশ অনুভূতির প্রকাশ যা বলে বুঝানো হয়তো অসম্ভব। আমি আনভীর আর আহি চরিত্রটি এমন ভাবে লিখার চেষ্টা করেছি যিতে আপনাদের চোখের সামনেই সেটা প্রকাশ পাবে আর যেটা কম বেশি সবাই ধারন করতে পারবে। যদি গল্পটা শেষ হয়ে যায় তবে মিস করবেন ওদের?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here