এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় বোনাস_পার্ট

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় বোনাস_পার্ট
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন

-‘ওসব এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে যাও আহি। বিয়ে যেহেতু আমরা করেছি, তাই সেটা মেনে নিতে হবে আমাদের। আফটার অল এত সুইট , কিউট বউটাকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না? আজরান ভাইয়া ঠিকই বলতো , এমন বউ রাগারাগি করার জিনিস না ; আদর করার জিনিস।এখন তুমি যেহেতু গতকাল আমায় পাগল করে দিয়েছো এখন তোমায় শাস্তি দেবো নাকি আদর করবো?’

আমি তৎক্ষণাৎ উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম উনাকে। আমার হৃদস্পন্দন ক্রমাগত যেন বেড়েই চলেছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে উনার এরকমটা করার কারন কি। উনি এবার বললেন,

-‘ভয় পাওয়ার দরকার নেই। জাস্ট মজা করছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, আমি তখনও বলেছিলাম এখনও বলবো, সময় আছে। ঢাকায় ফিরে চলো আমার সাথে। আজ নাহয় কাল তোমায় আমার সাথে ফিরে যেতেই হবে।’

আমি উনার সাথে কথা না বাড়িয়ে এবার রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।কেননা আমি জানি আনভীর মুখে মুখেই মামীকে হ্যাঁ বলেছেন এখানে আজ রাত থাকবেন। তবুও আমি নিশ্চিত উনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করবেন আজকের মধ্যেই আমায় এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে আনভীর তো এর আগে আমায় স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে আমার সাথে উনার কোনো যোগসূত্র নেই। তাহলে এখন এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে যেতে বলছেন কেনো? আমার কাছে উনার নতুন ব্যবহার কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। খুব শীঘ্রই এর কারন জানতে হবে আমায়।

__________________________

মোটামোটি অনেকক্ষণই উনাকে কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে চলেছি আমি। একটাবারের জন্যও আনভীরের মুখোমুখি যাইনি। উনি আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্ত ছোট মামা যেভাবে উনার সাথে শলাপরামর্শ করে চলছেন উনি না পারছেন থাকতে না পারছেন সরে আসতে। ছোটমামা উনার সাথে কথার মাঝখানে বললো,

-‘বুঝলা আনভীর, দেশের জন্য বড় কিছু করার অনেক ইচ্ছা আছে আমার। আমার খুব খারাপ লাগে বেকার ছেলেদের চাকরির জন্য এভাবে হন্য হয়ে ঘুরে বেড়াতে। আমি ভাবছি এ এলাকার সব বেকার যুবকদের নিয়ে একটা সংঘ গড়ে তুলবো। ওরা যেন চাকরির আশায় বসে না থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা পরিকল্পনা করতে পারে সে ব্যাপারে সবাইকে বুঝাবো।আইডিয়াটা কেমন?’

-‘আইডিয়াটা দারুন মামা , তবে আপনি একা সব করবেন কিভাবে?’

-আমি একা কেনো করবো, তুমি আছো না? তাই তো তোমার সাথে আইডিয়াটা শেয়ার করলাম।’

আনভীর কোনোমতে ঠোঁটচেপে হাসলেন। আমি বুঝেছি মহাশয় ভালোই ফ্যাসাদে পড়েছে। তবে আমি একদন্ডের জন্যও উনার মুখোমুখি হলাম না। ছোটমামা যেই , একদিনের মধ্যেই উনাকে বাসায় ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। বিষয়টা ভাবতেই আমার মনে পৈশাচিক আনন্দ ফুটে ওঠলো। আজ মামীর সাথে মটরশুটির ডাল রান্না করা শিখেছি আমি। যদিও ছোটবেলা থেকেই কাজের হাত আমার বড্ড পরিপক্ক , তবে রান্নার বিষয়টা এখনও ভালোমতো সামলে ওঠা হয়নি। আজ মামীর সাথে ইলিশ ভূনা, গরুর মাংস , চিংড়ীর মালাইকারী আরও হরেক রকম পদ রান্না করা হয়ে গিয়েছে। এগুলো পরিবেশনের সময়ই আনভীরের মুখোমুখি হতে হলো আমাকে। তবে আমি উনাকে খুব সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে চলেছি ।
.
.
এখন দুপুরের প্রহর কাটিয়ে দীপ্তমান বিকেল। মামুদের ছাদে ছোট মামা বাহারি পদের গাছ লাগিয়ে পুরো বাগান করে রেখেছেন। মামীর এ নিয়ে অনেক বিক্ষোভ যে এ গাছগুলোর জন্য সে ঠিকমতো কাপড় শুকাতে পারে না। কিন্ত ছোট মামা তো ছোট মামাই। উনার মাথায় একবার একটা ভূত ঢুকলে উনি তা করেই ছাড়েন। একবার পরিবেশ সংরক্ষণের এক সেমিনারে গিয়ে উনি পরিবেশে গ্রীণহাউস গ্যাসের প্রভাব কমাবেন বলে নিজের লক্ষ্যকে স্থির করেন। পরে বড় মামু থেকে সাড়ে সাতহাজার টাকা নেন শুধুমাত্র গাছ কিনে বপন করার জন্য। ছয় মাস হতে না হতেই উনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এখন বেকার যুকদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করলেন। এসব কিছুই ছাদে বসে আমায় বলছেন ছোটমামা। আমি উদগ্রীব হয়েই উনার প্রতিটা কথা শুনছি। হঠাৎ মামী আমায় ডাকতেই পরে মামাকে একা রেখে অগত্যা রান্নাঘরে যেতে হলো আমায়। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘আমায় ডেকেছিলে?’

মামী আমার হাতে চায়ের ট্রে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘তোর বড় মামুর রুমে নিয়ে যা। আনভীর আর তোর মামু কথা বলছেন ওখানে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে ট্রে টি নিজেরহাতে নিয়ে চলে গেলাম বড় মামুর ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজার ঠিক কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি উনাদের কিছু কথা শুনেই পা থামিয়ে দেই। মামু এবার আনভীরকে বললেন,

-‘তোমার আর আহির মধ্যকারসম্পর্কটি আমি একটু হলেও আন্দাজ করতে পারি আনভীর। যতই হোক , একটা বাজে পরিস্থিতির সাপেক্ষেই তোমাদের বিয়ে হয়েছে।’

আনভীর নিশ্চুপ।মামু এবার বললেন,

-‘একটা কথা বলি আনভীর। আহি বাচ্চা একটি মেয়ে। উনিশে পা দিয়েছে বেশিদিন কিন্ত হয় নাই। তবুও এই জীবনে ওর মা মারা যাওয়ার পর অনেক অমানুষিক যন্ত্রণার স্বীকার হয়েছে ও। আমি অনেকবার আহিকে দত্তকে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে কোট কাচারি সবকিছু আমি বিচরণ করেছি। কিন্ত আহির যেহেতু বাবা আছে এবং সে সাবলম্বী আহিকে লালন পালনের জন্য তাই ওকে দত্তক নেয়াটা সম্ভব হয়নি আমার। এসবের জন্য আহির বাবা আমাদের সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ,,,,,,(কিছুটা দম ফেলে),,,,,আহি অন্য চারপাঁচটা মেয়ের মতো এতটা স্ট্রং না আনভীর। মা’হীনা মেয়ে যার কাছে বাবার ছায়াও ছিলো না তাই নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতো। আমি চাই না যে বিয়ের পরেও ও এসব কষ্টে ভুগুক।’

-‘আপনি ভুল ভাবছেন মামা। আমিও চাই যে আহি নিজেকে সাবলম্বী করুক। এন্ড আমি জানি যে ও খুব আবেগী ধনের মেয়ে। তাই ওর সাথে এমন কোনো আচরণ করতে আমি চাই নি যাতে ও পড়ালেখা ছেড়ে ক্ষণিকের আবেগে হারিয়ে যাক। ওর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছি আমি মামা। ওর পড়ালেখা থেকে শুরু করে সব কিছুর প্রতি আমার নজরছিলো। তবে একজন হাসবেন্ট হিসেবে যেটা আমি করিনি তা হলো নিজেকে ওর কাছে প্রিয়জন করে তোলা। কেন করিনি জানেন? যাতে ও পড়ালেখা বাদ দিয়ে শুধু আমায় নিয়ে যেন চিন্তা না করে। ভালোবাসার মতো ক্ষণিকের ভালোলাগা যেন ওর পড়ালিখার ক্ষতি না করে। আমি ওর সাথে স্ট্রিক্ট হয়েছি শুধুমাত্র ওকে বুঝানোর জন্য যে আহিকে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেললে চলবে না। এককথায় ওর মনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য যা করার দরকার সেই সবটুকু রেসপন্সিবিলিটি আমি পালন করেছি।’

-‘বিয়ের সম্পর্ক দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকে না আনভীর। আমি সরাসরি তোমায় তাই প্রশ্ন করবো।,,,,,,,,তুমি কি আহিকে ভালোবাসো?’

আনভীর থমকে গেলেন। সেই সাথে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমিও। মামুর মতো আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি উনার উত্তরটি শোনার উদ্দেশ্যে। আনভীর এবার তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললেন,

-‘আহিকে আমি ভালোবাসি কি-না তা আমি জানিনা মামা ,তবে আহিকে আমার প্রয়োজন।’

আমার আর কিছু শোনার বাকি থাকলো না আর। যা উত্তর জানার তা পেয়েই গিয়েছি। উনি উনার প্রয়োজনীয়তার তাগিদে আমায় নিতে এসেছেন শুনতেই চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নীলুর কাছে গিয়ে বললাম ট্রে টা দিয়ে আসতে। তারপর আমি নিজেকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখলাম। দোষ আমারই। উনার ব্যবহারে আমি বেশি আশা করে ফেলেছি। আমি শুধুমাত্র উনার প্রয়োজনীয়তা, আর কিছুনা !!!

____________________

রাত ১ টা বাজে প্রায়। বিছানায় নির্ঘুমে রাত কাটছে আমার। ঘরে আমি একা। আনভীর নেই। উনি চলে গিয়েছেন আমায় একা রেখে। বলতে গেলে উনাকে চলে যেতে আমি বাধ্য করেছি। সন্ধ্যার সময় আনভীরের সাথে ভয়াবহ মনোমানিল্য হয় আমার। উনি জেনে গিয়েছেন যে আমাদের চুক্তির ব্যাপারটা মাকে বলেছি আমি। উনি এই নিয়ে অজান্তেই আমার সাথে একটু রাগারাগি করে ফেলেন। আমি শান্ত হয়েই উনার সব কথা শুনছিলাম। তবে উনি যখন পুনরায় আমায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জোড় করলেন নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারিনি আমি। প্রখর গলায় জিঙ্গেস করলাম,

-‘কেনো যাবো আমি আপনার সাথে? আমি আপনার প্রয়োজনীয়তা বলে?’

-‘কথা অন্যদিকে ঘুরিও না আহি। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। মা যদি বুঝেন যে তুমি আর আসবে না তাহলে বাবাকে সব সত্য বলে দিবে। যা আমি চাচ্ছি না।’

-‘কিন্ত আমি চাই না আপনার সাথে ফেরত যতে। আমার আপনার দায়বদ্ধতা বা প‍্রয়োজনীয়তা কোনোটাই হওয়ার ইচ্ছে নেই। বাই দ্য ওয়ে মিঃ আনভীর? আমি আপনার কেমন প্রয়োজনীয়তা ? মানসিক নাকি শারীরিক? তো সেটা তো চাইলে আপনি আগেই ভোগ করতে পারতেন আমার ওপর জোর খাটিয়ে। এখন এমন করছেন কেনো?’

আনভীরের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠলো আমার কথায়। খুব কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছেন। কিন্ত আমি নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছি। উনার তখনকার কথায় আমার মাথায় শুধু শারীরিক প্রয়োজনীয়তাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। উনি এবার তৎক্ষণাৎ একটা সিদ্ধান্তনিয়ে ফেললেন। বলে ওঠলেন,

-‘আমাদের বিয়ের দিন মানুষদের নোংরা কথা আমায় যতটা না হার্ট করেছিলো তার থেকেও বেশি হার্ট করলো আমায় তোমার কথাটি। তুমি এখানেই থাকো আহি। যতদিন খুশি থাকো। আমি আর জোর করবো না এটলিস্ট শারীরিক প্রয়োজনীয়তা কথাটি শোনার পর। আমি চলে যাচ্ছি।’

আনভীর একমুহুর্তের জন্যও থাকলেন না এখানে। সবাই বারবার জিঙ্গেস করছিলো যে উনি হঠাৎ কেনো ফিরে যাচ্ছেন তবুও আমরা দুজনের কেউই কিছু বললাম না। আনভীরের এমন শীতল প্রতিক্রিয়া আমায় ভাবিয়ে তুললেও আমি নিজেকে শক্ত করে রাখলাম। উনার জন্য মনের কোঠায় শূণ্যতা সৃষ্টি হলেও সারাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলাম। সেই ঘটনার আজ চারদিন হতে চললেও আনভীর একটাবারের জন্যও কল করেনি আমায়। আমি অধীর আগ্রহী হয়ে বসে ছিলাম উনার ফোনের জন্য । জানিনা কেন। তবে উনার গম্ভীর কন্ঠ শোনার জন্য আমার কান যেন তৃষ্ণার্ত হয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা উনি কি একটাবারের জন্যও মনে করলেননা যে উনার ব্যবহারে আমি ঠিক কেমন কষ্টটা পেয়েছিলাম? শুধু নিজের রাগ আর ইগোর কথা ভেবে এভাবে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করাতে অভিমানটা আমার আরও চাড়া দিয়ে উঠলো।মনে হতে থাকলো সবকিছু কেমন যেন বিষাক্ত।

________________________________

সকালে আমার ঘুমটা ভেঙেছিলো নীলুর ধাক্কাধাক্কিতে। বিগত কিছুদিন ধরে নির্ঘুমে রাত কাটানোর জন্য প্রায়ই সকালে উঠতে দেরি হয়ে যায়। তাই এসময়ে নীলুর কন্ঠে আমি বেশ বিরক্ত হলাম । ঘুমুঘুমু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘কি হয়েছে?’

-তুমি জলদি উঠো।

নীলুর দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠ। এমন কন্ঠ পেয়ে তৎক্ষণাৎ উঠে বসি আমি। নীলুকে চিন্তিত লাগছে। চোখমুখ ফ্যাকাসে। কমাগত শুকনো ঢোক গিলছে। আমি তাই ওর গালে হাত স্পর্শ করে জিঙ্গেস করলাম,

-‘তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কি হয়েছে?’

নীলু ভয়ার্ত গলায় বললো,

-অ অপূর্ব ভাইয়া এসেছে আপু!

আমার চোখের ঘুম উড়ে গিয়ে নিমিষেই স্থান করলো ত্রাসের রাজত্ব। অপূর্ব ভাইয়া এসেছেন — কথাটি কানে আমার নুপুরের ন্যায় বাজছে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম ক্রমাগত। কিন্ত হঠাৎ এভাবে এখানে আসলেন কেনো ভাইয়া?
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ

বোনাস পার্ট দিয়ে দিলাম। এবার খুশি তো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here