ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-২৭

0
818

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_২৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” বাচ্চা কয়টা নিবে, বউফ্রেন্ড? ”

মাথার ঠিক উপরে যেনো বজ্রপাত হলো আভার। চোখের আকৃতি বিশালকার করে তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। বাচ্চা! আভা কি উল্টাপাল্টা কোনো প্রশ্ন করলো, যার উত্তরস্বরুপ আহনাফ বাচ্চার কথা টানলেন? নাহ! সেরকম কোনো কথা তো মনে পড়ছে না। আভা এক নিঃশ্বাস আটকে সহস্র দ্বিধা নিয়ে জিগ্গেস করলো,
— ” বাচ্চা, মানে? ”

আহনাফ আভার থেকে চোখ সরিয়ে প্লেটে চামচ নেড়েছেড়ে বললো,
— ” মানেটা হলো, আমাদের বিয়ে তো একদিন হবেই। তো বিয়ের পর বাচ্চা মানে বেবি কয়টা নিবে? ”

আভার এই মুহুর্তে হাত-পা ছড়িয়ে আহনাফকে গালি দিতে মন চাচ্ছে। যে গালি শুনলে, আহনাফ কানে হাত রেখে বলে উঠবে, ‘ ছেড়ে দে মা; কেঁদে বাঁচি । ‘ কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, আভা তো সেরকম কোনো গালি জানে না। তবে? গালির অভাবে আহনাফের এই ঠোঁটকাটা স্বভাব কি ওকে সারাটাজীবন সহ্য করতে হবে? ইয়া আল্লাহ! রক্ষা করো! ধৈর্য্য দাও! আহনাফ আভাকে চুপ থাকতে দেখে খেতে খেতে আভার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— ” বাচ্চার কথা জাস্ট শুনেই এই অবস্থা! বাট, আই অ্যাম হেল্পলেস। আই লাইক বেবি’স। সো, আদর করার জন্যে নিজের বাচ্চা তো একটা লাগবেই। তাইনা? ”

আভার আর সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে কতদূরের ব্যাপার। এখনই এসব নিয়ে কথা না বললেই কি চলছিল না? আভার এই মুহুর্তে পাতালে লুকিয়ে পড়তে মন চাচ্ছে! কিন্তু, ‘ পাতাল ‘ বলতে তো কিছু অস্তিত্ব নেই। তাহলে? কোথায় যাবে ও? কোথায় লুকাবে? আহনাফ এবার চেয়ার টেনে আভার পাশে এসে বসলো। চামচ রেখে হাত দিয়েই বিরিয়ানি মাখিয়ে এক লোকমা তুলে আভার মুখের সামনে ধরলো। স্বাভাবিক সুরে বললো,
— ” হা করো! ”

আভা ‘ হা ‘ করলো। আহনাফ আভাকে খাইয়ে দেওয়ার সাথে সাথে, নিজেও খেতে লাগলো। খাওয়ার মাঝখানে আহনাফ আরো এক অদ্ভুত কথা বলে বসলো,
— ” তোমার শরীরের যা হাল, তাতে আমার সবল বাচ্চারা তোমার এই ছোট্ট পাখির মত পেটে থাকবে কি করে? বাবা হিসেবে আমি তো সেই চিন্তায় শেষ! এখন থেকেই বেশি করে খাও! তোমার পেটে থাকাকালীন আমাদের বাচ্চার যাতে কোনো অসুবিধা না হয়! ”

আভার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কান দুটো গরম হয়ে লাল রং ধারণ করেছে। আহনাফের মুখে বাচ্চার কথা আর শুনা যাচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আহনাফ আভার থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হলো? খাবে তো ঠিকমতো? ”

আভা শুধু মাথা নেড়ে ‘ হ্যাঁ-বোধক ‘ উত্তর দিলো। আহনাফ মুচকি হাসলো।
_________________________
একটা ক্যাফেতে মিনহাজ আর আরোহী বসে আছে। ওরা ক্যাফেতে এলো প্রায় অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু, সেই কখন থেকে আরোহী চুপচাপ বসে আছে। মুখ দেখেই মনে হচ্ছে,তার মন খারাপ! মিনহাজ আরোহীর মন খারাপের কারণ জানার কয়েকবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। আরোহী গুম মেরে বসেছে তো বসেছেই! কোনো কথা নেই মুখে। একসময় মিনহাজ বিরক্ত হলো। টেবিলে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। কাঠের টেবিলে মিনহাজের পুরুষালি হাতের থাপ্পড়ের আওয়াজ রীতিমত কাঁপিয়ে তুলেছে চারপাশ। আরোহীও একটু কাঁপলো। মিনহাজের রাগ ভয়ংকর! সেটা আরোহী জানে। তবুও,বারবার নিজের বোকামো কাজ দ্বারা মিনহাজকে রাগিয়ে তুলে। মিনহাজ রেগে আরোহীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
— ” সমস্যা কি? কখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো। যদি মনব্রত পালন করার কথাই ছিল, তাহলে বাসায় করতে। এখানে কেনো? কতোদিন পর দেখা হলো, এখন এসব না করলে চলছে না? ”

আরোহী একবার মিনহাজের দিকে তাকালো। ছলছল করছে তার চোখ’দুটো। আরোহী উজ্জ্বল ফর্সা চেহারার অধিকারী। চোখের আকৃতি, কাব্যিক ভাষায় হরিণীর মতন। সেই ডাগর ডাগর চোখে জখন জল আসে, মিনহাজ তা দেখে উদভ্রান্ত হয়ে যায়। শত রাগ একদম পানি হয়ে উড়ে যায়। এবারও তাই হলো! আরোহীর চোখে পানি দেখে মিনহাজের রাগ কমে আসলো। যে নিজের চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিজেকে সামলালো। অতঃপর আরোহীর পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। আরোহী মাথা নিচু করে আছে। মিনহাজের দিকে তাকালো না অব্দি! রাগ হয়েছে খুব! ওর মন খারাপ করেছে, কিন্তু মিনহাজ ওকে এভাবে ধমক দিলো কেনো? নাহ! আর কথা বলবে না এই রাগী লোকটার সাথে!
মিনহাজ আরোহীর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আরোহীর দিকে তাকালো। মেয়েটা বড্ড অভিমান করেছে,সেটা ওর মুখে স্পষ্ট! মিনহাজ আরোহীর গালে একহাত রাখলো। আরোহী আর পারলো না, রাগ করে থাকতে। মিনহাজের দিকে তাকালো ও। মিনহাজ আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” মন খারাপ কেনো? কেউ কিছু বলেছে? আমায় বলো! না বললে আমি বুঝবো কি করে? ”

আরোহী দুচোখ মুছে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললো,
— ” আমি বিয়ে করবো না! ”

মিনহাজ স্তব্ধ হয়ে গেলো। বিয়ে করবে না, মানে? মিনহাজ যতটুকু আরোহীকে চিনে, আরোহী নিজ থেকে কখনোই এই বিয়েতে মানা করবে না। ওদের বিয়ে নিয়ে আরোহীর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিলো। তাহলে, এখন? মিনহাজের রাগ তরতর করে কপাল বেয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো। তবে, নিজেকে সামলালো সে। আরোহীর দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” বিয়ে করবে না কেনো? আমায় বিয়ে না করার কারণ কি? ”

আরোহী থেমে থেমে বললো,
— ” তোমাকে বিয়ে করবো না কেনো? একশোবার করবো। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়! ”

মিনহাজের মনে হচ্ছে, ও পাগল হয়ে যাচ্ছে। আরোহীর এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা, তার বোধগম্য হচ্ছে না। মিনহাজ জিজ্ঞেস করলো,
— ” তাহলে? মেইন কারণ কি? ”
— ” আমার ফ্যামিলি। বিয়ের পর, ওদের ছেড়ে আমি থাকবো কি করে? ছোট থেকে যে বাসায় বড় হয়েছি, সেই বাসা ছেড়ে অপরিচিত এক বাসায় সারাজীবন থাকবো কি করে? আমার ভয় লাগছে খুব। আমার মনে হচ্ছে, আমি এসব পারবো না। এই সংসার-টংসার আমার জন্যে নয়। ”

মিনহাজ মন দিয়ে আরোহীর কথা শুনলো। সম্পূর্ণ কথা শোনার পর ওর অযথাই হাসি পেলো। তবে, হাসলো না সে। প্রেমিকা যেখানে মন ভার করে বসে আছে, সেখানে প্রেমিক কি করে হাসে? মিনহাজ আরোহীর গালে হাত রেখে বুঝালো,
— ” বিয়ের আগে সবারই এমন মনে হয়।ওই পরিবার থেকে তোমার বাবা মাকে ছেড়ে আসতে কে বলেছে তোমাকে। প্রতি সপ্তাহে একবার আসবে নিজের বাবার বাড়ি। আর বাকি রইলো সংসার! সেটা করার জন্যে আমি আছি। বিশ্বাস নেই আমার উপর? ”

আরোহী অপলক তাকিয়ে রইলো মিনহাজের দিকে। মুখ দিয়ে না বললেও, মনে মনে ভাবলো, এই মানুষটাকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। কোনো জড়তা নেই।
____________________
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েছে আহনাফ আর আভা। আহনাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। হসপিটাল থেকে জরুরি কল এসেছে। আভা একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ রাস্তার ওপারে দেখলো, একটা আইস্ক্রিম পার্লার।সেটা দেখে, আভার মনটা খুশিতে যেনো নেঁচে উঠলো। আভা একবার আহনাফের দিকে তাকালো। এখনো কথা বলছেন। হয়তো , খুব বেশি দরকারি কথা! আভা আর ভাবলো না। আইস্ক্রিম খেতে, নিজেই রাস্তা পাড় হতে লাগলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একদম আকস্মিক! আভা ডান দিকে একটা ট্রাক আভার দিকেই ধেয়ে আসছে। ট্রাকের ড্রাইভার মাতাল থাকায় গাড়ি বেসামালভাবে চালাচ্ছে। কোনো দিক-বেদিক চিন্তা করছে না। আভা যখন রাস্তা পাড় হয়ে ঠিক মাঝরাস্তায় এসে গেছে, তখনই ট্রাকটা খুব স্পিডে আভার শরীরের উপর দিয়েই চলে গেলো। সঙ্গেসঙ্গে আভা জোরে এক চিৎকার করে এক ছিটকে গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়। পিচ ঢালা রাস্তায় ছিটকে পড়তেই মাথাটা ফেটে গড়াতে লাগলো, লাল রক্ত! পাশ থেকে তুমুল শব্দ শুনে আহনাফ ফোন কানে রেখেই তাকালো পাশে। একটু দূরে আভাকে রক্ত মাখা অবস্থায় দেখে আহনাফের মাথা রীতিমত ঘুরে গেলো। আভা রাস্তায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। সারা শরীরের রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। মাটিতে শরীর ছেড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করছে ও। আভার স্কুল ব্যাগ রক্ত লেগে রাস্তার একপাশে পড়ে আছে। নিজের প্রেয়সীকে এভাবে রক্তাক্ত দেখে আহনাফের মাথা কতক্ষণ হ্যাং হয়ে রইলো। যখন চারপাশ থেকে মানুষের শোরগোল কানে ভেসে আসলো, তখনই আহনাফের টনক নড়ল। কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনটা জোরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেললো। দামী ফোন এক গাছের সাথে লেগে দু টুকরো হলো। আহনাফ পাগলের মত রাস্তা বেয়ে আভার দিকে দৌঁড় লাগালো।

#চলবে
এই ব্যাপারে লেখিকা নির্দোষ!

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/238045174906717/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here