ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-৩৩

0
786

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

— ” দুঃখজকভাবে, আপনি মেডিক্যালে চান্স পান নি। ”
কথাটা শুনে আভা পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে ‘ থ ‘ হয়ে গেলো। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো তার। চক্ষে জমলো দু ফোঁটা জল! চোখের সামনে নিজের এতদিনের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হতে দেখলো ও। আভা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— ” আ.আপনি সত্যি বলছেন? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ”
আহনাফ বুঝলো, আভার মন ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। এখন আরো নেগেটিভ কথা বললে হয়তো আভার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাবে। আহনাফ চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত সুরে বুঝালো,
— ” দেখো আভা, তোমার মার্ক খুব ভালো এসেছে। জাস্ট, পয়েন্ট ফাইভের জন্যে সরকারিতে চান্স হয়নি। ওয়েটিংয়ে আসতো। ওয়েটিং আসার কথা ছিল। কিন্তু, কেনো আসলো না, সেটাই বুঝতে পারছি না। এতে মন খারাপ করার কিছু হয়নি। তুমি চাইলে, ঢাকার নামকরা বেসরকারি মেডিক্যালে পড়তে পারবে। চিন্তা করো না। ”
আভা আর শুনলো না। ধাম করে ফোন কেটে দিলো। ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কতশত স্বপ্ন ছিলো তার, এই মেডিক্যাল নিয়ে। কিন্তু, এখন? চোখের সামনে তার হার যেনো খিলখিলিয়ে হাসছে। আঙ্গুল উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, ‘ তুমি হেরে গেছো, আভা। তুমি পারো নি। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। ‘ নিজেকে পরাজিত, ঘৃণিত মনে হচ্ছে। এমন হওয়া কি খুব দরকার ছিলো?
আহনাফ বেসরকারি মেডিক্যালে ক্লাস নিচ্ছিলো। মূলত, মেডিক্যালটা আহনাফের বাবার তৈরি। আহনাফ ঢাকা মেডিক্যালে থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখানেই প্র্যাকটিস করছে। একটু আগে ক্লাস নেওয়ার সময়, দু-তিনজন কথা বলছিলো,অ্যাডমিশন রেজাল্ট নিয়ে। সেটা শুনেই আহনাফ আর দেরি না করে আভার রেজাল্ট দেখে। আভা চান্স পায় নি দেখে, আহনাফ কিছুটা হতবম্ব হয়ে পড়েছিল। আভার মার্ক যথেষ্ট ভালো। শুধু পয়েন্ট ফাইভের জন্যে আভার স্বপ্ন একদম মাঠে মারা পড়লো।
আহনাফ নিজের কেবিনে বসে আছে। হাতে ফোন। আভার ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে, কয়েকবার আভাকে কল করেছে। কিন্তু, বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। আহনাফ একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে, আভার সাথে দেখা করাটা দরকার তার। না জানি, আভা কোন পরিস্থিতে আছে? এই মেয়েটা না যা করে! ওকে কখনো শান্তি দিবে না, পণ করে রেখেছে যেনো! আহনাফ আর দেরি করলো না। লিফট দিয়ে নিচে নেমে, পার্কিং এরিয়া থেকে বাইক বের করলো।
___________________
প্রায় আধ ঘন্টা যাবৎ আভা দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রুমে বসে আছে চুপটি করে। দরজার বাইরে থেকে, সবাই কতবার ডাকলো, তার এক উত্তর, ‘ আমি ঠিক আছি। আমাকে সমবেদনা দিতে হবে না। ‘ আভার মা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আভাকে ডাকছেন বারবার। তার এই কথা,
— ” আভা, মন খারাপ করিস না, মা। বের হ। তোর মার্ক ভালো ছিলো। এত মন খারাপ করিস না। বের হ। ”
জুনায়েদ, রেহানাকে বুঝাচ্ছেন, ‘ আভা নিজেকে সামলালে এমনিই বের হবে। এখন ওকে একা থাকতে দেও। ‘
কিন্তু রেহেনা তা শুনতে একদম নারাজ। উল্টো, তিনি এসব বুঝার পরিবর্তে স্বামীর উপর ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। মেয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে, বাবা সেখানে বলছে ‘ একা ছেড়ে দাও? ‘ কি পাষাণ দিল! আভার বাবা একসময় হাল ছেড়ে মা-মেয়েকে একা ছেড়ে রুমে চলে গেলেন। মিনহাজ বাসায় নেই। আরোহীকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে গেছে। আভার মা পড়েছেন মহা মসিবতে। তিনি জানেন, আভা চেষ্টা করেছে। তিনি নিজে অ্যাডমিশন নিয়ে আভাকে স্ট্রাগল করতে দেখেছেন। কিন্তু, সবই কপাল! আল্লাহ-তায়ালা যা লিখেছেন ভাগ্যে, তাই হবে। ভাগ্যকে খন্ডন করা কারো সাধ্য নেই।

কলিং বেল বেজে উঠলো। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রেহেনা ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে দরজা ছেড়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। এখন আবার কে এলো? দরজা খুলে আহনাফের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে উনি যারপরনাই অবাক হলেন। আহনাফ অস্ফুট সুরে সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
— ” আন্টি, আভা কোথায়? ”
রেহানা দরজা ছেড়ে পাশে দাঁড়ালেন। বললেন,
— ” ভিতরে আসো, বাবা। আভা রুমেই আছে। দরজা বন্ধ করে বসে আছে কখন থেকে। আমি কতবার বললাম, খুললোই না। তুমি একটু দেখো তো। ”
আহনাফ ভিতরে প্রবেশ করলো। আভার মায়ের দিকে চেয়ে আশ্বস্ত করে বললো,
— ” আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি দেখছি। ”
আহনাফ কথাটা বলেই আভার রুমের দিকে পা বাড়ালো। আভার মা, আহনাফের পিঁছু পিঁছু আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে ভাবলেন, মেয়ে জামাই কে একা ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। এই বয়সে আর লজ্জায় পড়ার ইচ্ছে তার নেই। আভার মা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছু বানানো যায় কিনা, আপাতত সেটাই তার মুখ্য চিন্তা! মেয়ে জামাই এসেছে বলে কথা!
আহনাফ আভার রুমের সামনে দাঁড়ালো।এই মেয়ে কি কখনোই শুধরাবার না? পরপর দুবার দরজায় টোকা দিয়ে হাক ডাকলো,
— ” আভা, দরজা খুলো বলছি। ”
ভিতর থেকে আভার কান্নামাখা আওয়াজ ভেসে আসলো,
— ” আমাকে একা থাকতে দিন, প্লিজ। আই নিড সাম পিস। প্লিজ। ”
আহনাফ এবার গলার সুর কড়া করলো। বললো,
— ” আভা, আমি লাস্টবার বলছি। দরজা খুলো। নাহলে, আমি কি করে বসবো আমি নিজেও জানিনা। আই সে ওপেন দ্য ডোর, ড্যাম ইট। ”
আহনাফের ধমক শুনে আভা একপ্রকার কেঁপে উঠলো। এই ছেলে এমন কেনো? এই যে আভা কষ্ট পাচ্ছে, কোথায় এসে নরম গলায় কথা বলবে। তা না! এসেই ধমকা-ধমকি! এই বদ মানুষের কাছে এটাই আশা করা যায়, বৈকি! পুনরায়, ওপাশ থেকে আহনাফের রাম ধমক শুনে আভা ব্যান্ডেজকৃত পা নিয়ে কষ্ট করে দরজা খুললো।
আহনাফ আভার দিকে তাকালো। তার চোখে-মুখে রাগের স্ফুলিঙ্গ! যেকোনো মুর্হুতে, সেই স্ফুলিঙ্গে দাহ হয়ে আভা ছাই হয়ে যেতে পারে। আভা দরজা খুলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, ঠায়। মুখে কুলুপ এঁটে পা দিয়ে মাটি খুটছে। এখনো, কান্নার প্রভাব শরীর জুড়ে। আভার এমন ধ্বংসাত্বক অবস্থা দেখে আহনাফের তুমুল রাগ কমে হুরহুর করে শূন্যের কোটায় নেমে এলো। একদিন কি অবস্থা করেছে চেহারার! চোখ মুখে শুষ্ক মরুভূমির ন্যায়! তবে, এটাই কি ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ? আহনাফ শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” প্রবলেম কি তোমার? এভাবে দরজা বন্ধ করে কি প্রমাণ করতে চাইছো? টেল মি? ”
আভা কিচ্ছু বললো না। বরং, ব্যান্ডেজকৃত পা এক হাত দিয়ে ধরে বিছানায় এসে বসলো। আহনাফ আভার পিছু পিছু বিছানায় বসলো। বেশ কিছুসময় দুজনের মধ্যে চললো, নীরব খেলা! একসময় আহনাফ নীরবতা ভাঙতে যাবে তার আগেই আভা ভেজা কণ্ঠে বলে উঠলো,
— ” আমি হেরে গেছি, আহনাফ! পারি নি আমি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু, পারি নি। আমার এক্সাম ততটা খারাপ ছিলো না। কিন্তু, কেনো এমন হলো? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। ”

আহনাফ আভার কথা শুনে ব্যথিত হলো। একজন স্টুডেন্টের কাছে, অ্যাডমিশন এক্সাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা সে বুঝে। সেক্ষেত্রে, আভার এমন করে ভেঙে পড়া যুক্তিযুক্ত! কিন্তু, একটু আগে আভা আহনাফকে নাম ধরে ডেকেছে, অন্যমনস্ক থাকায় ব্যাপারটা আহনাফ প্রায় ভুলেই গেলো। সে আলতো করে আভার হাত নিজের মুঠোয় পুড়ে নিলো। আভা এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ ছোট্ট করে এক শ্বাস ফেলে বললো,
— ” ভুলে যাও এসব। সরকারি মেডিক্যালে পড়তে পারো নি ত কি হলো? জীবনে একজন ভালো ডাক্তার হতে পারাটাই কি মুখ্য নয়? আর কে বলেছে, তুমি হেরে গেছো? বেসরকারি থেকে ডাক্তার হও, আর সরকারি থেকে। দিনশেষে তুমি একজন ডাক্তার। সেটাই তোমার পরিচয়। এখন এসব নিয়ে মন খারাপ করে না, লক্ষ্মীটি। ভুলে যাও এসব। ওকে? ”
আহনাফের ওমন কথা শুনে কে মন খারাপ করে থাকতে পারে? ঠিক তাই, কেউ পারে না। তেমনই, আভাও পারে নি। আহনাফের দিকে চেয়ে আভা আলতো হাসলো। তবুও, যেনো দুঃখ সারে নি তার। মনে স্পষ্ট কিছু কষ্ট, চোখে ছলছল কিছু জল! তবুও, তার মুখে স্নিগ্ধ এক হাসি। আভার হাসিটা তবুও আহনাফের ভালো লাগলো। আহনাফের বুকের উপর থেকে এবার যেনো পাথর সরে গেলো। প্রিয়তমার হাসি যেনো শুধু হাসি নয়, আস্ত এক সুঁচ। হৃদয়কে ছিঁড়ে একদম এফোর-ওফোঁড় করে দেয়।
______________________
অবশেষে, সকল হারকে উপেক্ষা করে এবার শুধু জিতের পালা! আভার বাবা আর আহনাফের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আভাকে, আহনাফদের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হলো। পড়াশোনার ফাঁদে পড়ে, এবার থেকে সপ্তাহে ছয়দিন হবে, প্রিয়তমের সঙ্গে দেখা।আভার এই হার কি অন্য এক সুখকর জিতের কারণ? আভা-আহনাফ তবে কি এখন আরো কাছাকাছি আসতে চলেছে?

#চলবে
নোট ১: নেক্সট, নাইস, কমেন্ট করলে পরবর্তি পর্ব দেরি করে দিবো কিন্তু, হুহ! আর যদি গঠনমূলক কমেন্ট করেন, তবে আগামী পর্ব ফটাফট পেয়ে যাবেন😀
নোট ২: আগেই জানিয়ে দেওয়া ভালো, গল্পটা একটু বড় হবে। যদি এতে কেউ ধৈর্য্যহারা হন, তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী!

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/243805137664054/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here