#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
সময়ের গতিধারায় কেটে গেলো আরো দু সপ্তাহ! আভার এখন পুরোটাই সুস্থ, বলা চলে। শুধু, অতিরিক্ত হাঁটা চলা করলে পায়ে সামান্য ব্যথা হয়। তবে, ব্যথাটা ক্রমশ সহনীয়!
আভার সুস্থতার উপর ভিত্তি করে মিনহাজের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো, পাঁচদিন পর। মিনহাজের কথামত, ডেস্টিনেশন ওয়েডিং হবে। আসলে, এই ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের প্ল্যানটা আভার। অনেকদিনের শখ তার, ভাইয়ের বিয়ে খুব ধুমধাম করে আয়োজিত হবে। সেজন্যেই, সবাই ব্যাগ-ট্যাক বাঁধাই করে বেরিয়ে পড়লো, কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সেখানে, হোটেল বুক করা হয়েছে সবার জন্যে।
আভাদের বাসার নিচে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই একে একে গাড়িতে উঠছে। বাড়ীর পুরুষেরা, সবগুলো গাড়িতে ব্যাগপত্র রাখছে।
এবার, যাত্রা শুরু করার পালা! সব কাজিন, আর আভার বন্ধুরা একটা গাড়িতে উঠলো। একজন আরেকজনের উপর একদমই ঢলে পড়ছে। গাড়িতে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই বসার। তবুও, তারা বসবে। যত কষ্টই হোক, সবাই একসাথে জার্নি করার মজাটাই আলাদা! আভা সব কাজ শেষ করে গাড়ির দরজা খুললো। সঙ্গেসঙ্গে গাড়ীর মধ্যে এমন গাদাগাদি অবস্থা দেখে, আভার চোখ চড়কগাছ! সাথী খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
— ” এই আবা, তুই জিজুর গাড়িতে করে চলে যা। এখানে জায়গা নেই, দেখছিস না? ”
আভা সবার দিকে একনজর চোখ দিলো। একজনের কোলের উপর আরেকজন বসে আছে। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে খুব! কিন্তু, এতেই খুশি তারা! সবার কথার ভাঁজে, গাড়ির প্রতিটা কোণা মুখরিত! আভা তবুও দাঁত খিঁচালো। বললো,
— ” আমি কেনো উনার ওর গাড়ি করে যাবো। দেখি, বের হ তুই। আমি বসবো এই গাড়িতে। বের হ! ”
আভার কথা শুনে সাথীর মুখটা চুপসে গেল। মুখখানা যদি এক বেলুন হতো, তবে চুপসানোর সেই করুন শব্দও কানে আসতো! তারা গাড়ীর ভিতর থেকে মুখ দেখালো। এবং, স্বভাবসুলভ খোঁচা মারলো,
— ” তোমারে জামাইর সাথে বসতে দিসি, তাই ভাল্লাগেনা, তাইনা? একটা থাপ্পর মারবো, শরীর গিয়ে পড়বে আহনাফ জিজুর গাড়িতে। ঢং কম করো। যাও এখন! ”
আভা তারার কথা শুনে চোখ রাঙালো। এই মেয়েটা কেনো বুঝতে পারছে না, আহনাফের সাথে আভার ঝগড়া চলছে। তাও, যেনো তেনো ঝগড়া না। একদম, জবরদস্ত ধরনের ঝগড়া। দুজনেই যেন পণ করে বসে আছে, ‘ অপরপক্ষের সাথে যেঁচে কথা বলাটা পাপ! ঘোর পাপ! ‘ আর সেই পাপকে প্রশ্রয় দিয়ে আহনাফের গাড়িতে উঠবে ও? অসম্ভব! কোনোমতেই না! আভা নাছোড়বান্দার মত বললো,
— ” এই সাথী, তুই নাম। নাহলে, আজকে আমি তোর ওই ব্রেইনলেস মাথাটা এক মাইর দিয়ে ফাটিয়ে ফেলবে। নাম তুই। ”
সাথী যেনো শুনলই না সেকথা! বরং, আভার ওমন শক্তপোক্ত ধমকিকে এককথায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সিনথিয়ার সাথে কথা বলতে লাগলো। আভা আর কোনো উপায় খুঁজে পেলো না। গাড়ির দরজা ধাম করে লাগিয়ে বিড়বিড় করলো,
— ” সবকটা স্বার্থপর! ‘
অন্যান্য গাড়ি বেরিয়ে পড়েছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। শুধুই, আহনাফের গাড়িই বাকি আছে। আভা গটগট পা ফেলে আহনাফের গাড়িতে উঠে বসলো। দরজা ধাম করে বন্ধ করে চুপচাপ সামনে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ আভার এমন রাগ দেখে আড়ালে মিটমিটিয়ে হাসলো। গাড়ি চালু না করে খুব রয়ে সয়ে পকেট থেকে সেন্টার ফ্রুট বের করে মুখে পুড়ল। বেশ খানিকসময় পাড় হয়ে গেলো। গাড়ি চালু করার নাম নেই, আহনাফের। আভা একসময় বিরক্ত হলো। সেই বিরক্ত যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালো, তখন আভা আহনাফের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
— ” গাড়িতে ঘুমানোর ইচ্ছা আছে? ”
আহনাফ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ, না! আভা কণ্ঠে রাগের আভাস নিয়ে বলে উঠলো,
— ” তো গাড়ি চালাচ্ছেন না কেনো? ”
আহনাফ বাঁকা হাসলো। যা দেখে আভার রাগে শরীর জ্বলে অঙ্গার হলো। এই ছেলে নির্ঘাত মাথায় কোনো বদ বুদ্ধি আঁটছে! আহনাফের বাঁকা হাসি মানেই, আস্ত এক বদ বুদ্ধির কারণ! আভা আর কিছু বলবে তার আগেই আহনাফ গাড়ি চালু করলো। আভা মুখের কথা গলাধঃকরণ করে জানালার দিকে মুখ করে বসে রইল চুপচাপ।
গাড়ি শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আভা মোবাইল থেকে গান ছেড়ে কানে হেডফোন গুঁজে দিলো। এবার শান্তি!
হঠাৎ গাড়ির স্পিড বাড়তে লাগলো! ধীরে ধীরে গাড়ীর স্পিড একশো ক্রস করলো। আভা গানের জগৎ ছেড়ে বাইরে তাকালো। ইয়া আল্লাহ! এত স্পিড! মুহুর্তের মধ্যে যেকোনো অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে! আভা পাশ ফিরলো। আহনাফ একহাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, অপরহাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করছে। তার চোখ-মুখ অত্যন্ত স্বাভাবিক। আভা আহনাফের ওমন বেপরোয়া ভাব দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
— ” গাড়ীর স্পিড কমান। ”
আহনাফ স্পিড কমালো না। বরং, তার উল্টোটা করলো। স্পিড বাড়িয়ে আরামসে মুখের সেন্টার ফ্রুট চিবুতে লাগলো। গাড়ীর এহেন স্পিড দেখে, আভার ভয়ে আত্মা লাফাচ্ছে। যেখানে, গাড়ীর স্পিড আশি ক্রস করলেই আভা ভয়ে জান শুকিয়ে যায়, সেখানে এই মুহূর্তে স্পিড একশো দশের উপরে। আভা ভয়ার্ত চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। বললো,
— ” পাগল হয়ে গেছেন আপনি? গাড়ীর স্পিড কমান। আমার ভয় করছে। প্লিজ, স্পিড কমান। ”
আহনাফের চোখে কোনো ভয়-ডর নেই। সে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে গাড়ী চালাচ্ছে। আভা পুনরায় একই কথা বললে আহনাফ এক অদ্ভুত কথা বলে বসে,
— ” স্পিড কমাবো এক শর্তে! ”
আভা কোনো দিগ্বিদিক চিন্তা করার অবকাশ পেলো না। উদ্ভান্তের মত বলে উঠলো,
— ” বলুন, বলুন কি শর্ত! আমি সব শর্ত মানবো। সব! ”
— ” বলো, আভা একটা নির্বোধ মেয়ে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণে, আহনাফ কষ্ট পাচ্ছে। দি নির্বোধ বালিকা আভার উচিত, তার সব দোষ স্বীকার করে, সব রাগ ভুলে, আবারও আহনাফের সাথে কথা বলা। বলো এখন! ”
আহনাফের কথা শুনে আভার প্রচন্ড রাগ লাগলো। কি সাংঘাতিক লোক! আভা মুখ ফুলালো। বললো,
— ” কক্ষণো বলবো না। আপনি দোষ করেছেন তাই আমি রাগ করেছি। সো, আমি এসব বলবো না। ”
— ” ওকে, ফাইন! ”
আহনাফ ভাবলেশহীন ভাবে কথাটা বলেই গাড়ীর স্পিড বাড়াতে শুরু করলো। আভা পড়লো মহাফ্যাসাদে! এই ছেলে এত শেয়ানা কেনো? কখনই, নিজের দোষ স্বীকার করবে না। আর আভা যখন রাগ করে, তখন তো আরো না। বরং, সব দোষ আভার ঘাড়ে চেপে, নিজেকে মহান সাজিয়ে, কতশত অদ্ভুত উপায়ে আভার রাগ ভাঙাবে! এবারও তাই হলো। কিন্তু, আভা এবার কিছুতেই নিজের দোষ স্বীকার করবে না। বারবার, ও আহনাফের কাছে হেরে যাবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু, আভার এই ভয়ঙ্কর পণ বেশিক্ষণ টিকলো না। বরং, আভার ভয়ার্ত মন সেসব পণকে জলাঞ্জলি দিলো। আভা জানালার দিকে তাকালো। আহনাফের গাড়ি বারবার ওভারটেক করছে। নিঃসন্দেহে, পরিস্হিতি ভয়াবহ! আর আভা ভয়ও পাচ্ছে। আভা একসময় চোখ খিঁচে একদমে বলে ফেললো,
— ” আভা একটা নির্বোধ মেয়ে। তার নির্বুদ্ধিতার কারণে আহনাফ কষ্ট পাচ্ছে। দি নির্বোধ বালিকা আভার উচিৎ, সব দোষ স্বীকার করে, সব রাগ ভুলে আবার আহনাফের সাথে কথা বলা। বলে দিয়েছি? এবার হয়েছে, শান্তি? এখন তো গাড়ির স্পিড কমান। প্লিজ! ”
আহনাফ বাঁকা হাসলো। ধীরে ধীরে গাড়ীর স্পিড কমে এলো।এবার, আভার প্রাণে যেনো পানি এলো। আভা সিটে হেলান দিয়ে লম্বা, লম্বা নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আহনাফ তা দেখে হাসলো শুধু। গাড়ির সামনে থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। আভা বোতল দেখে চক্ষে স্ফুলিঙ্গ নিয়ে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বরাবরের মতন, ভাবলেশহীনভাবে বললো,
— ” শ্বাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছো। পানি খাও। ঠিক হয়ে যাবে। ”
আভা পানি নিলো না। বরং, ত্যাড়াভাবে বলে উঠলো,
— ” আপনি জানেন, আপনি একজন প্রচন্ড খারাপ লোক? ”
আহনাফ হাসলো। আভার কোলে পানির বোতল রেখে দিয়ে বললো,
— ” আর তুমি সেই খারাপ লোককেই ভালোবাসো, মিস বউফ্রেন্ড! ”
আভা স্তব্ধ হয়ে গেলো। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হলো, অজস্র! আভা তো কখনো বলেনি আহনাফকে নিজের অনুভূতির কথা! তাহলে,আহনাফ তা জানলেন কি করে? তবে কি আহনাফ অন্তর্যামী?
— ” প্রেমিকার মন পড়তে পারে না যে ছেলে, সে আবার কিসের প্রেমিক? ”
পাশ থেকে আহনাফ বলে উঠলো। আভা চুপ হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোনে ফুটলো গোলাপের ন্যায় এক হাসি! ইশ! কি সুন্দর সে হাসি! আহনাফ তো পাগল হয়ে গেলো! এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে আনলো আহনাফের বুকে!
#চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/245070997537468/?app=fbl