ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৪

0
2310

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#সিলিভিয়া_ফারাশ
#পর্ব_১৪

(২৯)

“প্রতি রাতের জন্য কত টাকা নাও আমার ছেলের কাছ থেকে? আমি তোমাকে তার চেয়েও বেশি দেব। ওকে ছেড়ে আমার রক্ষিতা হয়ে যাও মেয়ে।”

পঞ্চাশোর্ধ জুবায়ের ইমজাতের মুখে এমন ঘৃন্য কথা শুনে কোনো কিছু চিন্তা না করেই ঠাটিয়ে একটা চর দিল তুর। জুবায়ের ইমজাত আগুন দৃষ্টিতে তাকালো। রেগে গলা টিপে ধরলো তুরের। হিসহিসিয়ে বলল,

” মা* তোর এতো বড় সাহস তুই জানিস কার গায়ে হাত তুলেছিস? তোর হাত আমি ভেঙ্গে দেব। তোদের মতো মেয়েদের কাজই তো এটা। বড়লোকের ছেলেদের নিজের সব দিয়ে হাতে মুঠোয় আনিস। সত্যিটা বললেই গায়ে লাগে তাই না।”

ততক্ষণাৎ চারদিক অন্ধকার করে বিদ্যুৎ চলে গেলো। জুবায়েরের মাথায় কেউ সজোরে আঘাত করেছে। চিৎকার করার সুযোগটাও পায়নি সে। লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। নিকষ কালো অন্ধকার দিয়েই শেকল দিয়ে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

জুবায়ের ইমজাতের জ্ঞান ফেরার পর উনি নিজেকে একটা হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলেন। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন এটা একটা পরিত্যক্ত হসপিটাল। হুট করেই রাগ চেপে গেলো তার। তাকে এই জুবায়ের ইমজাতকে এমন একটা হসপিটালে এডমিট করার সাহস পেয়েছে কে? রাগে গজগজ করতে থাকলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন,

” আমাকে এই হসপিটালের এডমিট করেছে কে? জুবান কোথায় তুমি? আমাকে এই দিন দেখতে হলো আজ? এমন একটা জায়গায় কখনো পা রাখতাম না আমি।”

মাটিতে খসখস শব্দ করে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। জুবায়ের ইমজাত সেদিকে কৌতুহল নিয়ে তাকালো। একটু পর দরজা দিয়ে ডাক্টারের পোশাক পরা একজন প্রবেশ করলো। হাতে গ্লাভস। মুখে মাক্স। মাথায় সার্জারিক্যাল টুপি। গুন গুন করে গান গাইছে ডক্টারটা। জুবায়ের ইমজাত স্পষ্ট শুনতে পেলো গানের লাইনটা। ” ওরা মনের গোপন চেনে না। ওরা হৃদয়ের রং চেনে না।”

জুবায়ের হুংকার দিয়ে উঠলো।

” আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? আর এটা কি ধরনের গান খাইছোস? বন্ধ করো এই গান?”

” গানটা ভালো লাগেনি? আপনার তো এটা পছন্দের গান হওয়া উচিত। আপনার মনের গোপনও তো ওরা জানে না। আচ্ছা বাদ দিন সাইরাহকে চেনেন?”

সাইরাহর নাম শুনেই ঘাবড়ে গেল জুবায়ের। অতীতের কিছু স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

” কে তুই?”

” এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন মেয়েটাকে? সমস্যা নেই আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। সাইরাহ্ হলো সেই মেয়ে যাকে আপনি সাত মাসের প্যাগনেন্ট অবস্থায় ধর্ষন করে ব্রিজে ফেলে গিয়েছিলেন। তারপর রাস্তার কয়েকটা নেশাগ্রস্ত বখাটেকে দিয়ে সারারাত ধরে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এতেও আপনি থামেননি। ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লাঞ্ছিত করতে উলঙ্গ অবস্থায় ব্রিজে ঝুলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আবার টাকা খাইয়ে কেস বন্ধ করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটা ব্যা/শ্যা। সাইরাহর মা বাবাকেও আপনিই মেরে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। কি মনে পড়েছে?”

জুবায়ের ইমজাত ঘামছেন। এতো কিছু জানলো কীভাবে লোকটা? কে সে? কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

” ক-কে? কে তুই? এতো কিছু কীভাবে জানলি?”

“যদি বলি আমি সাইরাহর খুব কাছের কেউ। খুব বেশি কাছের।”

” আমার প্রথম থেকেই এই মেয়েটার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। এখন দেখছি আমার সন্দেহ ঠিক। ঐ মেয়েটা আসলেই একটা প্রস্টিটিউড।”

ডক্টর ট্রে থেকে একটা ছু/রি তুলে নিল। আচমকা জুবায়ের ইমজাতের ঠোঁটে আড়াআড়ি ভাবে চালিয়ে দিল সেটা। ঠোঁট দুভাগে ভাগ হয়ে ঠোঁটের পিচ রঙা অংশ দৃশ্যমান। যন্ত্রণায় চিৎকার ও করতে পারলেন না তিনি। সরু ছু/রি নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে পুনরায় জুবায়েরের হাতে ছু/ড়ি চালিয়ে দিল। গলগল করে র/ক্ত ছিটকে পড়লো সাদা এপ্রোনটায়। জুবায়ের চিৎকার করে বলছে,

” আমাকে ছেড়ে দে। তা না হলে এখান থেকে ছাড়া পেলে তোকে মে/রে ফেলব আমি।”

” আমাকে মা/রতে হলে আগে এখান থেকে ছাড়া পেতে হবে কু/ত্তা/র বা/চ্চা।”

কথা শেষ করে নিজের কাজে মনোযোগ দিল ডক্টর।নিপুণ হাতে জুবায়েরের হাতের আঙ্গুল থেকে শুরু করে কনুই পর্যন্ত চামড়া তুলে নিল সে। জুবায়ের চিৎকার করছে। বাঁচার জন্য শত কাকুতি মিনতি করছে। চামরাটা পাশে একটা তরলে চুবিয়ে জুবায়েরের দিকে তাকালো সে। তার চেহারায় বিষাদ নেমে এসেছে।

” সাইরাহ ঠিক এভাবেই কান্না করেছিল তাইনা? বাঁচার জন্য এভাবেই ছটফট করছিল। তখন ওর কথা শুনেছিলি তুই? তখন তো ঠিকই নরপ/শুর মতো খুবলে খুবলে খেয়েছিলি তাকে। কী অপরাধ ছিল মেয়েটার? কেন একটা হাসিখুশি পরিবারকে ধ্বংস করে দিলি?”

” দেখ তুই যা চাইবি তাই হবে। তবুও আমাকে মারিস না। ছেড়ে দে আমায়। প্রাণ ভিক্ষা দে।”

” যা বলব তাই করবি? তাহলে নিজের সব অপরাধ শিকার কর।”

জুবায়ের ইমজাত কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন। পরে যা হবে দেখা যাবে আগে এই মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে তো বাঁচুক। মোবাইল ক্যামেরার সামনে নিজের সব অপরাধ শিকার করে নিলেন এক লহমায়। মুক্তির আশায় ডক্টরের দিকে তাকালো। ডক্টরের মুখের পেশি শক্ত হয়ে গেছে। একটা কৌটো খুলে লাল টকটকে মরিচের গুঁড়া আর লবন ডলে দিল ক্ষত স্থানে। চেঁচিয়ে বলল,

” তোর এতো সহজে মৃত্যু নেই। আমি তোকে জানে মার/ব না। তীলে তীলে মারব তোকে।”

(৩০)

জেনারেটর থাকতেও লাইট চলে যাওয়ার পর সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। কেন এমনটা হলো বুঝতে পারলো না জুবান। নিজের হাতের মুঠোয় থাকা তুরের হাতের দিকে তাকালো সে। কারেন্ট চলে যাওয়ার পর খুব জোরে একটা চিৎকার মেরেছিল তুর। ততক্ষণাৎ জুবান ছুটে গিয়েছিল। মেয়েটা সেই তখন যে হাতটা ধরেছিল এখনও ছাড়েনি। জুবান তুরের শুভ্র হাতটা তুলে আলতো করে চুমু খেলো। রুমাল দিয়ে তুরের মুখের ঘাম মুছে দিলো।

” তোমাকে সবসময় এভাবেই আগলে রাখবো রসগোল্লা।”

” আপনার বাবা খুব খারাপ জুবান। অনেক বেশি খারাপ।”

তুর এতোই আস্তে কথা বলল যে তার অতি নিকটে দাঁড়ানো জুবানও শুনতে পেলো না। জুবায়ের ইমজাত না থাকলেও এংগ্যাজমেন্ট এ কোনো বিঘ্ন আসেনি। জুবানের মোবাইলে তিনি ম্যাসেজ করে দিয়েছেন জরুরি কাজের জন্য বেরিয়ে গেছেন। ফিরতে সময় লাগবে।

তুর জুবানের সাথে সুইমিং পুলের সামনে বসে আছে। তুরের হাত জুবান মুঠোবন্দী করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। জুবানের দ্রুত বেগে চলা হার্টবিট অনুভব করতে পারছে তুর। রাতের নিস্তব্ধতা আর ঠান্ডা হাওয়া শরীরে কাপন ধরাচ্ছে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।

” সাইরাহ্ কে জুবান?”

সাইরাহর নাম শুনে চট করে হাত ছেড়ে দিল জুবান। বিষ্ময় নিয়ে তুরের শীতল চেহারার দিকে তাকালো। তুরের দৃষ্টি পানিতে নিবন্ধ।

” তুমি সাইরাহর ব্যপারে জানো কি করে?”

” আপনি ভয় পাচ্ছেন কেনো জুবান? আমি তো অফিসার শাহরিনের কাছ থেকে মেয়েটার ব্যপারে জানতে পারলাম। শুনেছি ওর সাথে নাকি আপনার প্রেম গঠিত সম্পর্ক ছিল।”

তুরের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচল জুবান।

” সাইরাহ নামের মেয়েটার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। শাহরিন একটু বাড়িয়ে বলেছে বুঝলে রসগোল্লা।”

” সাইরাহর সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক ছিল না?”

তুরের গলাটা অন্যরকম শোনা গেলো। জুবান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

” শাহরিন দেখি আমার সংসারে আগুন ধরাচ্ছে রসগোল্লা। আর শুনো তুমি কি জেলাস?”

তুর অন্য দিকে মুখ ঘুরালো। জুবান শব্দ করে হেসে দিল। রসিকতা করে একটা গান ধরলো সে। ” তোমার কেনো জ্বলেরে বন্ধু তোমার কেনো জ্বলে?”

তুর জুবানের দিকে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে আচমকা ধাক্কা মারলো তাকে। তাল সামলাতে না পেরে পানিতে পড়ে গেলো জুবান। তুর খুব সিরিয়াস ভাবে বলল,

” আপনার এমন কোনো অতিত আছে যেটার কথা আমি জানি না বা আপনি গোপন করছেন?”

” উফ্ রসগোল্লা এই ঠান্ডায় পানিতে ফেলে মেরে ফেলার প্ল্যান করছো নাকি? আর ম্যারি জান আমার অতীত সম্পর্কে সবকিছুই তোমাকে বলেছি আমি। কিছুই লুকাইনি।”

” যদি কখনো আপনার এমন কোনো অতীত আমার সামনে আসে যার ব্যপারে আমি জানি না তাহলে আপনাকে নিজের হাতে ভালোবাসাময় মৃত্যু দেব আমি।”

তুর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। জুবান বলল,

” তোমার হাতে মরতে পারাও ভাগ্যের ব্যপার রসগোল্লা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”

চারদিক অন্ধকার করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। তুর রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই জুবানের চোখের আড়াল হয়ে গেলো। জুবানের শত ডাকেও পেছন ফিরে তাকালো না সে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here