#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#সিলিভিয়া_ফারাশ
#অন্তিম_পর্ব
সময়টা আজ থেকে সাত আট বছর আগের। সাইরাহ্ তখন তার স্বপ্নের ভার্সিটে প্রথম পা রেখেছে। দুচোখে আকাশচুম্বী স্বপ্নের মেলা। জুবান তখন ভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারে। সারা শরীর কালো বোরকা আর নিকাবে ঢাকা সাইরাহ্ খুব সহজেই জুবানের নজরে পড়ে গেল। সাইরাহ খুব চুপচাপ। ভার্সিটি আসে আর যায়। মাঝের সময়টুকু বইয়ে ডুবে থাকে। ভার্সিটির সাথে তার সম্পর্ক ক্লাস রুম আর লাইব্রেরি প্রর্যন্তই। সাইরাহ্কে ইমপ্রেস করার অনেক ট্রাই করেছে জুবান। কিন্তু মেয়েটা তার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। শুধু তার সাথেই নয় ভার্সিটির কোনো ছেলের সাথেই কথা বলে না সে। একদিন জুবান সাইরাহর পথ আগলে ধরলো। জেদ ধরে বসল তার সাথে কথা না বললে এক পা যেতে দিবে না। সাইরাহ্ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ তখন জীবনের প্রথম কাউকে চর মেরে বসলো সে। চর মেরে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো। ব্যস এর পরই জুবান নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলো সাইরাহর সাথে সে এমন কিছু করবে যা আগে কোনো মেয়ের সাথে করেনি। এর পর একটা বছর কি না করেছে সাইরাহকে প্রেমের ফাঁদে ফাশাতে? নিজের জান জীবন লাগিয়ে দিয়েছে সাইরাকে শুধু মাত্র এটা বিশ্বাস করাতে যে সে আর আগের মতো নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ছেলেটিই এখন জুবান ইমজাত। বোকা সাইরাহ জুবানের ফাঁদে পা দেয়। কিন্তু প্রেম হারাম তাই কিছুতেই প্রেম করবে না সে। বিয়ের আগে ফিজিক্যাল রিলেশনর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল জুবান। শুরু হলো জুবানের নতুন নাটক। সাইরাহকে বিয়ে করার জন্য ওঠে পড়ে লাগলো সে। সাইরাহ্ বাবা মাকে ছাড়া কিছুতেই বিয়ে করবে না। জুবান বোকা মেয়েটাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলল। নিজের ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে বিয়ের কথা লুকিয়ে রাখলো। সামনে তার সাথে কি হতে চলেছে সেটা এক বিন্দুও টের পেলো না মেয়েটা। জুবান সাইরাহ্কে নিয়ে সেই বাড়িতে ওঠে যেতাটে তুরকে নিয়ে গিয়েছিল। দু আড়াই বছর সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। জুবান খুব নিখুঁত অভিনয় করে গেছে সাইরাহর সাথে। আর কয়েকদিন পরই তো জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিবে মেয়েটাকে। হয়তো সাইরাহর পরিণত এতো করুণ হতো না যদি না জুবায়ের ইমজাত কাজের বাহানায় জুবানকে ছয় মাসের জন্য বিদেশ পাঠাতো। জুবান বিদেশ যাওয়ার পর পরই সাইরাহ্ জানতে পারলো সে এক মাসের প্যাগনেন্ট। মাতৃত্বের স্বাদ যে কতো মধুর সেটা সেদিন বুঝতে পেরেছিল মেয়েটা। জুবানকে জানানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি তখন। বিদেশি গিয়ে জুবান নতুন নতুন মেয়েদের মধ্যে ডুবে থাকতো। সাইরাহর কথা একটুও মনে আসতো না তার। ছয় মাস পর প্রথমেই সে সাইরাহর বাড়িতে আসলো। অনেক হয়েছে এই মাথায় উঠানোর নাটক। সময় এসে গেছে এবার সাইরাহ্কে মাটিতে ফেলার। আজকেই সবকিছু জানিয়ে সারপ্রাইজড করে দেবে তাকে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছে সে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলো। ঢিলাঢালা পোশাকের উপর দিয়েও সাইরাহর পরিনত পেট স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সাইরাহ্ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো জুবানকে। জুবান এতটাই অবাক হলো যে তার হাত থেকে লাগেজটা পরে গেলো। সাইরাহ্ লাজুক হেসে জুবানকে জীবনের সবচেয়ে খুশির সংবাদটা দিতে প্রস্তুত হলো। ভাবলো জুবান খুশিতে হয়তো এখনি লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা এতো সুন্দর নয়। জুবানকে জানানোর পর সাইরাহর বাহু খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো জুবান,
” প্যাগনেন্ট মানে? আমি তো ছয় মাস ধরে বাহিরে।”
সাইরাহ্ পচন্ড অবাক হলো। প্রিয় মানুষটির এমন অচেনা প্রতিক্রিয়া দেখে বিশ্বাস করতে চাইলো না সে। নিজেকে সামলিয়ে বলল,
” আমি সাত মাসের প্যাগনেন্ট জুবান। আপনি যাওয়ার পর জানতে পেরেছি আমি এক মাসের প্যাগনেন্ট। আপনার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমাদের প্রথম সন্তান আসছে। আপনি খুশি হননি?”
জুবান কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে পড়লো। খেলা এভাবে ঘুরে যাবে একবারও ভাবেনি সে। মাথা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সাইরাহ্ ঠান্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জুবানের কপালে হাত রাখলো।
” আপনার শরীর খারাপ লাগছে জুবান? কি হয়েছে আপনার?”
জুবান পানির গ্লাসটা ছুড়ে মারলো মেঝেতে। নিচে পড়ে সাইরাহর মনের মতোই শত খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো কাঁচের গ্লাসটা। জুবান রক্তলাল চোখে তাকালো সাইরাহর দিকে।
” আমার এখন বাচ্চা চাই না সাইরাহ্। তুমি এবোরশন করাবে।”
” আপনি মজা করছেন তাই না জুবান? আমাদের প্রথম সন্তান নিয়ে আপনার কতো স্বপ্ন ছিল। আপনি ভুলে গেছেন?”
” নেকামো বন্ধ কর আর শুনতে পাসনি ওকে আমার চাই না তুই এবোরশন করাবি। আর আজকেই।”
সাইরাহর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। জুবানের গালে হাত রেখে নিজের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
” আপনি এ কথা কীভাবে বলতে পারেন জুবান? ও আমাদের সন্তান। পৃথিবীতে আসার পুরো অধিকার আছে জোহানের। আপনার আর আমার বিয়ের পরের পবিত্র ভালোবাসার চিহ্ন ও। ওকে মেরে ফেলার কথা কীভাবে বলতে পারেন?”
জুবান সাইরাহর হাতটা ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। চিৎকার করে বলল,
” বেহায়া মেয়ে তোকে কতবার বলব তোকে আর তোর বাচ্চাকে আমার চাই না। আর এতো যে বিয়ের কথা বলছিস তোকে আমি কখনো বিয়েই করিনি। আমাদের বিয়েটা নকল ছিল। তোর সাথে বিয়ে না করেই সংসার করেছি আমি। তাই নিজেকে আমার বৌ ভাবা বন্ধ কর। তবে হ্যাঁ আমার রক্ষিতা ভেবে নিজেকে শান্তনা দিতে পারিস।”
সাইরাহ ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। তার রঙিন পৃথিবী এক মূহুর্তেই বর্ণহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভালোবাসা বিশ্বাস ভরসার ভিত এক মূহুর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গিয়েছে। জুবান টেনে তুলল সাইরাকে। তার চেহারা আর আচরণে বন্য হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। সাইরাহ্ কান্নারত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আমার সাথে এটা কেনো করলেন জুবান? কি ক্ষতি করেছিলাম আপনার। কেনো আমার পুরো দুনিয়া আর আখিরাত এক সাথেই ধ্বংস করে দিলেন?”
জুবান সাইরাহকে ছেড়ে ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এই দৃষ্টিতে কোনো ভালোবাসা নেই। নেই কোনো মায়া সহানুভূতি। আছে শুধু বিদ্রুপ।
” তোর দাম্ভিকতা আর নিজেকে বেশি ধার্মিক প্রমাণ করার প্রবণতাই তোর ধ্বংসের কারন। খুব তো বলতি বিয়ের আগে পরপুরুষের সাথে কথা বলাও পাপ। বিয়ের আগে তোর মুখটাও তো দেখতে দিসনি আমায়। বেশি বেশি করছিলি। নে এখন বিয়ে ছাড়াই তোকে প্যাগনেন্ট করে দিলাম। এবার কি করবি তুই? বাইরে কাউকে আমার কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না তোকে। আর তোর কাছে তো কোনো প্রমাণও নেই বিয়ের। সত্যিকার বিয়ে হলেই না প্রমান থাকত। আমি তো তোর সাথে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলেছি। প্রমাণ দিতে না পারলে সবাই তোকে কি বলবে জানিস? ব্যা/শ্যা বলবে। আমাদের সমাজ মেয়েদের মুখের কথাকে কখনো বিশ্বাস করে না বুঝলি?”
সাইরাহ কান চেপে ধরলো। জুবান হসপিটালে না গিয়ে তার ডক্টর ফ্রেন্ডকে কল করলো। ডক্টর জানালো এখন কোনো ভাবেই এবোরশন করানো সম্ভব না। অনেক সময় জটিলটার কারনে সাত মাসেই বাচ্চা প্রসব হয়ে থাকে। সেখানে একটা পরিণত শিশুকে এবোরশন করার কথা ভাবা মানে শিশুটিকে মেরে ফেলা যা আইনত আর ধর্ম মোতাবেক অপরাধ। জুবান কল কেটে দিল। হসপিটালে নিলে ঝামেলা হতে পারে। তাই তাকেই কিছু করতে হবে।
সাইরাহ্ রুমে বসে বসে কান্না করছে আর নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে। জীবনের হিসেব মিলাতে বসেছে সে। সাইরাহ্কে দেখে জুবানের এতো রাগ হলো। এই মেয়েটার জন্যই এখন নানাবিধ সমস্যায় পড়তে হবে তাকে। এই ঝামেলার মূল কে এখানেই উপড়ে ফেললে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। জুবান জানো/য়ারের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়লো সাইরাহর উপর। মেয়েটা কাকুতি মিনতি করে বলল,
” আমার সন্তানকে মারবেন না জুবান। আমি ওকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। প্রয়োজনে এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। তাও আমার বাচ্চাকে মারবেন না। ওকে নিজের প্ররিচয়ে বড় করব আমি। ওর বাবার পরিচয় কখনো কেউ জানবে না। দোহাই আপনার।”
হঠাৎ জুবানের কিছু একটা হলো সে উঠে চলে গেলো। সাইরাহর পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। বিছানা থেকে মোবাইলটা কুড়িয়ে নিল সে। কারো মোবাইলে কল দিল কিন্তু ওপাশের ব্যক্তি রিসিভ করলো না। সাইরাহ্ সবকিছু জানিয়ে ভয়েস মেইল আর শর্ট ভিডিও করে সেন্ড করে দিল। কান্নার চোটে কথা বলতে পারছে না সে। বাবার সাথে কথা শেষ করে ঘরে ফিরে আসলো জুবান। সাইরাকে টানতে টানতে বাইরে এনে গাড়িতে তুলে দিল। মাফিকে বলল খুব সাবধানে বাড়ি পৌঁছে দিতে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। সাইরাহ পেছনের সিটে বসে বিলাপ করে কাঁদছে। কি হয়ে গেলো তার সাথে? এখন বাবা মায়ের সামনে কীভাবে মুখ দেখাবে সে? এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছে আল্লাহ। সাইরাহ্ মনে মনে চিৎকার করে বলল, ” আল্লাহ আমার এই কলঙ্কিত মুখ আমার বাবা মাকে দেখানোর আগেই তুমি আমাকে উঠিয়ে নাও। এই কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না।” সাইরাহর কথাটা হয়তো সৃষ্টি কর্তা কবুল করে নিলেন। এতসব কিছুর মাঝে সাইরাহ খেয়াল করলো না মাফি বাড়ির দিকে না গিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে। একটু পর একটা বিলাস বহুল বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো মাফি। সাইরাহ্কে বলল এটা জুবানের বাবার বাড়ি। এক মূহুর্তের জন্য আশার আলো দেখলো সে। জুবায়ের ইমজাতের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকলো। গর্ভের সন্তান তো এই বংশেরই। কিন্তু জুবায়ের তাকে সহানুভূতি দেখানোর বদলে তার সাথে আরও ঘৃণ্য আচরণ করলো। ছেলের সন্তানের মায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ল নরপ/শুর মতো। সেই রাতে তার চিৎকার বাড়ির প্রতিটি সদস্য শুনতে পেয়েছিল কিন্তু কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। সোফিয়া বিছানায় শুয়ে চোখের জলে বালিস ভেজালো। চাইলেও কিছুই করতে পারবে না সে। জুবায়ের ইমজাত নিজের চাহি/দা মিটিয়ে আবার মাফির হাতে তুলে দেয় সাইরাহকে। ব্রিজের উপর ফেলে দিতে বলে। তখনো সাইরাহর গর্ভের সন্তান জীবিত ছিল। হয়তো মাকে এই নরপ/শুদের ভিরে একা করে চলে যেতে চাইছিল না শিশুটি। সাইরাহ হাত পা নাড়াতে পারলেও উঠে বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারছিল না। মাফি তাকে টেনে হিচরে গাড়িতে উঠালো। সাইরাহকে ব্রিজে ফেলে দেওয়ার আগে নিজেও একবার পৌরুষত্ত ফলালো। সাইরাহর বাচ্চাটা ততক্ষণে আর নেই হয়তো হসপিটালে নিলে ছোট্ট সোনামণিটা বেঁচে যেত। সাইরাহ ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করলো তাকে যেনো হসপিটালে নিয়ে যায়। মাফি ক্রুর হেসে সাইরাহর ক্ষতবিক্ষত দেহে বাজে ভাবে হাত বুলাল। তারপর ব্রিজের উপর ছুড়ে ফেলে দিল। যাওয়ার সময় জুবায়ের ইমজাতের কথা মতো একদল নেশা খোরকে টাকা দিয়ে গেলো সাইরাহর উপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর জন্য। ঐ চারটা নেশা খোর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাইরাহর উপর। সাইরাহর প্রাণ পাখিটা তখনো ডিপডিপ করছিলি। মনে মনে আল্লাহর কাছে বলছিল আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিচ্ছি। তুমি এই মুখোশধারী শয়তানদের উপর গজব নাজিল করো। তাদের ধ্বংস করো। অসুস্থ পৃথিবীটাকে আবার সুস্থ করে দাও আল্লাহ। আল্লাহ গো সারাজীবন আমি নিজেকে কঠোর পর্দার আড়ালে রাখলাম। কোনো মহিলা মানুষকেও আমার চেহারা দেখাইনি। সেই আমার সাথেই কেন এতো অবিচার হলো? তোমার বান্দা চরম অপমানিত হয়ে দুনিয়া ছাড়ছে। তুমি তাদের বিচার করো আল্লাহ। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। সব ছলনা। সবাই ছলনা করে। মিথ্যা ভালোবাসার নাটক করে শুধু মাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য।শুনো সবাই তোমরা কাউকে কখনো ভালোবেসো না। ভালোবেসে আমার মতো ঠকে যেও না।
আমি এক সদ্য সন্তান হারা মা। সর্বোশ্য হারা নারী। পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সবাইকে অভিশাপ দিচ্ছি। এই পৃথিবী ধ্বংস হোক। সকল জানো/য়ার ধ্বংস হোক। আমার মতো কোনো মেয়ের যেনো এভাবে দুনিয়া ছাড়তে না হয়।”
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহূর্তে চোখের পানি ফেলে বলল,
” জোহান বাবা। মা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না বাবা আমার। মাকে মাফ করে দিও ছেলে। তোমাকে দুচোখ ভরে দেখা হলো না। আদর করা হলো না। জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া হলো না। তুমি এমনি এক মায়ের গর্ভে জন্মেছে যে মা কলঙ্কিত। ধর্ষিতা। তোমার মায়ের বোকামোর জন্যই এই দুনিয়াতে আসার আগেই অসীম কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে তোমাকে। মাকে মাফ করে দিও বাচ্চা। পরপারে অবশ্যই তোমার সাথে দেখা হবে মায়ের। তোমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবো আমি। অনেক অনেক আদর করবো। দুজনে একসাথে থাকবো। ওখানে কোনো বেই/মান থাকবে না। কোনো জানো/য়ার থাকবে না।”
বোনের কথা বলতে বলতে তুরের চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি মাটিতে পড়লো। ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা।
” জানেন শাহ্ জুবানের ব্যপারে সবটা জানতাম আমি। সাইরাহ সবকিছু শেয়ার করতো আমার সাথে। আমার কথাতেই জুবানকে সুযোগ দিতে রাজি হয়েছিল সে। আর আমার কথাতেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। আমি যদি জানতাম জুবান আমার প্রাণ প্রিয় বোনের সাথে এমন কিছু করবে তাহলে তখনই দেশে ফিরে গিয়ে খুন করতাম জানো/য়ারটাকে। জানেন সাইরাহ যখন আমার কাছে কল করত তখন সারাক্ষন জুবানকে নিয়েই কথা বলত। ও যে জুবানকে কতটা ভালোবাসতো সেটা বলে বুঝানো যাবে না। যেদিন সাইরাহ মারা গেলো সেদিন সকালে আমাকে কল দিয়েছিল ‘ও’। জুবানের ব্যপারেই কথা বলছিল। জুবান যখন তাদের সন্তানের কথা জানতে পারবে তখন কি করবে? কত খুশি হবে? খুশিতে লাফিয়ে উঠবে এগুলোই বলছিলো আমাকে। বরাবরের মতোই আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি কি তখন জানতাম ওর সাথে এটাই আমার শেষ কথা হবে। কলিং বেলের শব্দ পেয়ে ও কত খুশিই না হয়েছিল মেয়েটা। আমাকে ভিডিও কলে রেখে মোবাইলটা এমন জায়গায় সেট করেছিল যেখান থেকে দরজা সহ পুরো ড্রয়িং রুম দেখা যাবে। দরজা খুলতে যাওয়ার আগে বার বার করে বলছিল। দেখিস এখন জুবান কি পাগলামিটাই না করবে। ওকে সেদিন দেখে মনে হচ্ছি দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ বোধহয় এমনি হয়। সাইরাহ্ দরজা খুলেই জুবানকে জড়িয়ে ধরলো। এতটুকু দেখেই আমি মোবাইল রেকর্ড মুডে রেখে স্টাডি রুমে চলে যাই। তখন আমার ফাইনাল এক্সাম চলছিল। পড়া শেষ করে যখন ফিরেছি তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ বোনটা মোবাইলে অনেকগুলো কল দিয়ে রেখেছে। ভয়েস আর ভিডিও পাঠিয়েছে। ভিডিও গুলো দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। এলোমেলো চুল। চোখ কালো হয়ে গেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। গাল গলায় রক্ত জমে আছে। বোনটা আমার কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিল না। আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিল। ভিডিওতে ও আমাকে সবটা জানিয়েছে সাথে বলেছে এটাই হয়তো ওর সাথে শেষ কথা। ওর কাছে সন্দেহ হচ্ছিল হয়তো আর বাড়ি ফেরা হবে না তার। ম্যাসেজ গুলো বেশিক্ষণ আগের নয়। আমি কল করার আগেই সাইরাহর কল এলো। আমি চিৎকার করে ওকে ডাকলাম। কিন্তু ও আমার কোনো ডাকে সারা দিল না। আমি শুধু ওর গুঙ্গানি আর কাকুতি মিনতি গুলো শুনছিলাম। একজন মা জীবনের শেষ মুহূর্তেও নিজের সন্তানকে বাঁচাতে কতই না চেষ্টা করেছিল সেদিন। সেদিন আমার চিৎকার করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। মাফি ওকে ব্রিজে ফেলে দেওয়ার সময় মোবাইলটা সাইরাহর হাত থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। নরপ/শুদের হামলে পড়া আর বিশ্রি ভাষায় কথা বলা ছাড়া আর সাইরাহর গলার শব্দ আর একবারের জন্যও শোনা যায়নি।
আমার ডাক্টারি ডিগ্রি নেওয়ার আর একটা মাত্র পরীক্ষা বাকি ছিল তখন। ফ্রেন্ডসরা বলছিল আর একটা এক্সাম আছে। তোর ক্যারিয়ার উজ্জ্বল। রেজাল্টের পর এখানেই চাকরি হয়ে যাবে। লেটার মার্ক পেয়ে পাস করেছিস এতো দিন। এই এক্সামটা না দিলে তোর ক্যারিয়ার শেষ। তীরে এসে এভাবে তরী ডুবাস না তুর। কিন্তু আমি ওদের কীভাবে বুঝাব আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বোনের এই অবস্থায় আমি কীভাবে পরীক্ষা দিব? সেদিন বাংলাদেশের টিকিট পাই না আমি। টিকিট পাই দুদিন পরের। আপনাকে বুঝাতে পারবো না সে দুদিন আমার কি অবস্থা হয়েছিল। ফেসবুকে বোনের ছিন্ন ভিন্ন লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। রসিয়ে রসিয়ে বিভিন্ন শিরোনাম দিয়ে খবর ছাপানো হচ্ছিল। প্রায় সবগুলোই নেগেটিভ শিরোনাম। তিন দিন পর আমি যখন বাসায় আসি তখন সব শেষ। আমার মা বাবা বোন কেউ নেই। আমার রেখে যাওয়া হাসিখুশি পরিবারটা আর নেই। প্রতিবেশীরা আমার নিষ্পাপ বোনের চরিত্র নিয়ে নানান কথা বলছে। সবাই সবটা না জেনেই কালি লেপে দিল সাইরাহর চরিত্রে। আমি চাইলে জুবানের বিরুদ্ধে সব রকম প্রমাণ নিয়ে থানায় যেতে পারতাম। কিন্তু এতে কোনো লাভ হতো না।টাকার কাছে এইসব প্রমাণ কিছুই না। তবুও যদি কেস করার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো আমার পরিণতিও আমার মা বাবা বোনের মতো হতো। কোনো অপরাধ না করেই তারা আজ সমাজের চোখের অপরাধী অথচ যারা প্রকৃত অর্থে অপরাধী তারা ঠিকই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তখন একেবারে পুরে ছাই হয়ে গিয়েছিলাম তখন ফিনিক্স পাখির মতোই সেই ছাই থেকে নতুন তুরের জন্ম হলো। সব প্লান সাজিয়ে ফেলেছিলাম আমি কিন্তু সমস্যা করলো জুবান। সে কোনো একটা কাজে বিদেশ চলে গেলো। আসলে কোনো কাজে নয় গা ঢাকা দিতেই পালিয়েছিল সে। জুবান ফেরার পর জুবায়ের ছুটি কাটাতে বিদেশ যায়। এভাবেই সবাই একসাথে দেশে ফেরার পর থেকেই আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করলাম আমি।”
তুরকে অদ্ভুত রহস্যময়ী লাগছে। চোখে জল ঠোঁটে বিষাদময় প্রসান্তির হাসি।
শাহরিন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার নিজের চোখ দিয়েও পানি গড়িয়ে পরছে। তারা এখন সাইরাহ আর ওর বাবা মায়ের কবরের সামনে বসে আছে। শাহরিন বলল,
” তোমাকে এই সবকিছুতে সায়ন সাহায্য করেছে তাই না?”
” নাহ্ সায়ন এসবে জড়িত নয়।”
” তাহলে ওর সবকিছুতে এতো গোপনীয়তা কীসের? আর ঐদিন তোমাকে কিডন্যাপ করেছিল যে।”
” সায়ন সবকিছুতে গোপনীয়তা বজায় রাখতো কারণ সে একজন আন্ডার কভার ডিটেকটিভ। ঐদিন সায়ন টাকার বিনিময়ে ছাড়া পায়নি। সে নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে ছাড়া পেয়েছে। আপনার মতোই তার উপর এই কেসের তদন্তের দায়ভার পরেছিল। আমি সবকিছু জেনেই তার এপার্টমেন্টে উঠি। যেনো তার গতিবিধির উপর লক্ষ রাখতে পারি। আর তাকে পথভ্রষ্ট করতেই নিজের প্রতি দূর্বল করেছিলাম। নিয়তির পরিহাসে আমি নিজেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম।
সায়নের সাথে যতবার আমার দেখা হয়েছে সবই আমার প্ল্যান ছিল। সেদিন জুবান প্রপোজ করার পর আমি চার নাম্বার ধর্ষ/ককে দেখতে পাই। সুযোগ বুঝে ঐ ধর্ষ/ককে তুলে নিয়ে ল্যাবে চলে আসি। সেদিন সায়ন আমার সত্যিটা জেনে ফেলে আর আপনিও সেখানে পৌঁছে যান যার কারণে কিডন্যাপের নাটকটা সাজাতে হয়েছিল।”
” আচ্ছা তাহলে সায়ন যখন জানতে পারলো তুমিই আসল খুনি। তখন সে তোমাকে এরেস্ট না করে সাহায্য করলো কেন?
” আপনি তো এখন জানেন আমিই খুনি তবুও আমাকে এরেস্ট করছেন না কেন?”
তুরের কথায় যুক্তি আছে। শাহরিন আজ একই সাথে সাইরাহ আর তুরের কাহিনী শুনে কষ্ট জর্জরিত পাশাপাশি এতো রহস্যময় একটা কেস সমাধান করতে পেরে খুশিও। এতো দিন মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা সব প্রশ্নের ঝুলি উল্টে দিচ্ছে তুরের সামনে। মেয়েটার মধ্যে এতো রহস্য লুকিয়ে আছে এতো দিন বুঝেও বুঝতে পারেনি সে।
” আচ্ছা তোমাদের বাড়ির এই ল্যাবটা কি সাইরাহর মৃত্যুর পর তুমিই বানিয়েছ নাকি আগে থেকেই ছিল?”
“আমি চলে যাওয়ার পর বাবা শহর থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এখানে চলে আসেন। বাবা নিজেও একজন ছোটোখাটো চিকিৎসক ছিলেন। উনার নিজের একটা হসপিটালের খুব শখ ছিল। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি জব করে বাবাকে এইসব জিনিস গুলো কিনে দিয়েছিলাম। এই বাড়ির নিচে আন্ডার গ্ৰাউন্ড আগেই ছিল। তাই সবকিছু ভালোভাবে রাখা গিয়েছিল। বাবা নিজের স্বপ্নের হসপিটালের মতো করেই নিজ হাতে খুব যত্ন নিয়ে সবটা সাজিয়েছিল। কথা ছিল আমি ফেরার পর দুজনে মিলে একটা হসপিটাল খুলব। বাবা এই ল্যাব বানিয়েছিল মানুষের জীবন বাঁচাতে আর নিয়তির পরিহাস দেখুন শাহ্। আমি এখন মানুষের জীবন নিতে এই ল্যাব ব্যবহার করছি।
শাহরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
“মানুষের নয় মানুষরূপী জানো/য়ারদে জীবন নিচ্ছ তুমি। ওদের জীবন নেওয়ার মাধ্যমেও অনেকের জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছ।
তুর নিরবে হাসলো।
” সায়ন তোমাকে অনেক ভালোবাসে জানো?”
” জানি।”
” সবকিছু জেনেও জুবানের সাথে এংগ্যাজমেন্ট করেছ কেন? আর ঐ জানো/য়ারটাকে তো আরও আগেই মে/রে ফেলতে পারতে। তাহলে এতো দিন অপেক্ষা করেছ কেন? আর এংগ্যাজমেন্টের নাটক করার মানে কি?”
” জুবানকে খুব সহজেই মা/রতে পারতাম আমি। চাইলে এতো কিছু না করে প্রথমেই অন্য মেয়েদের মতো তার কাছে রাতের সঙ্গী সেজে খুব সহজেই তাকে মে/রে ফেলতে পারতাম। কিন্তু এতে করে কখনোই জুবায়ের ইমজাতের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারতাম না আমি। জুবান শুধু জুবায়ের ইমজাতের কাছে পৌঁছানোর একটা সিড়ি মাত্র। শুধু মাত্র জুবায়ের জানো/য়ারকে মারার জন্যই এতো কিছু করেছি আমি। আমার সাথে চলুন শাহ্ আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।”
তুর ওঠে শাহরিন কে নিয়ে ল্যাবে গেলো। জুবায়ের ইমজাতের পচন ধরা দেহের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
” ঐ যে জানো/য়ারটা। জানো/য়ারের বাচ্চাটাকেও কিছুক্ষণ পর এখানে নিয়ে আসব।”
শাহরিন স্তব্ধ হয়ে গেলো। জুবায়েরের গা থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। শরীরের উপর মাছি ভনভন করছে। গায়ের চামরা গরুর চামরার মতো তুলে নিয়েছে। পুরুষাঙ্গ আর হাতের আঙ্গুল গুলো এসিড দিয়ে ঝলসানো। জিব কেটে তরলে পরিপূর্ণ কাঁচের পাত্রের চুবিয়ে রেখেছে। তুরের মুখে এখনও হাসি খেলা করছে। শাহরিন এক সেকেন্ডের জন্য থমকালো। সে এমন একটা ভয়ঙ্কর খুনির সাথে একা দাঁড়িয়ে আছে ভেবেই বুক কেঁপে উঠলো। তুর শাহরিনের মনোভাব বুঝতে পারলো। গম্ভীর গলায় বলল,
” আপনি ভয় পাচ্ছেন কেনো শাহ্? আমি নিরপরাধকে শাস্তি দেই না। আপনারও কি এমন কোনো অতীত আছে?”
শাহরিন তাড়াহুড়ো করে বলল,
” না না আমার এমন কোনো অতিত নেই। আচ্ছা জুবায়ের কি মারা গেছে?”
” ধর্ষকদের এতো সহজে মৃত্যু নেই। আপনার আর কিছু জানার আছে?”
” সব বুঝলাম কিন্তু রক্তজবার রহস্যটা তো সমাধান হলো না।”
তুর শব্দ করে হেসে উঠলো।
” আপনি একটা গর্ধব শাহ্। আপনাকে আমার কাছে পৌঁছানোর জন্য অনেক ক্লু দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আপনি ঐদিন সামিরকে বলছিলেন না যে,’এটা একটা সাধারণ ফুল। এতে কোনো ক্লু নেই।’ আপনার কথাই ঠিক। আমি আপনাদের মনোযোগ সায়নের দিকে ঘুরাতে চাইছিলাম। সায়ন রক্তজবা ফুল অনেক পছন্দ করে। আর আমাকেও প্রথম দিন রক্তজবা বলে ডেকেছিল। এর জন্যই আমি সেখানে একটা করে রক্ত জবা রেখে আসতাম। যাতে আপনাদের সন্দেহ সায়নের উপর থাকে।”
“আমি মোটেও গর্ধব নই। বরং তুমি অতিরিক্ত চালাক। যদিও বা আমি সবকিছু দেড়িতে বুঝতে পেরেছি। তোমার উপর আমার প্রথম সন্দেহ হয় যখন সায়নকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তুমি আমাকে শাহ্ বলে ডেকেছিলে। আর আমাকে কেবল মাত্র খুনিই শাহ্ বলে সম্মেধন করতো। সায়ন যদি খুনি হতো তাহলে সেই আমাকে শাহ্ বলে ডাকত। তখন থেকেই আমার খটকা লাগা শুরু হয়েছিল।”
” সাইরাহর বাড়ি থেকে যে রাত বিরেতে সাইরাহর বাবার আত্মা অর্থাৎ পুরুষ মানুষের চিৎকার ভেসে আসে। আর সাইরাহকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে সাদা পোশাক পরে ওর কবরের সামনে ঘুরা ঘুরি করতে দেখা যায় এই ক্লুটাও আমিই আপনাকে দিয়েছিলাম। মনোযোগ দিয়ে শুনলে সবটা বুঝতে পারতে শাহ্।”
তুর রহস্যময় একটা হাসি দিল। শাহরিন তাকিয়ে বলল,
” তোমার সবকিছুতেই রহস্য তুর। হাসিতেও রহস্য। আচ্ছা আরেকটা কথা জানার ছিল। এই সবকিছু তো তুমি একা করতে পারবেন না। নিশ্চয়ই কেউ হ্যাল্প করেছে তোমাকে। তোমার সহযোগি কে? আর তোমার ভাষ্যমতে তোমরা দুই বোন তাহলে তোয়া কে?”
” তোয়ার যখন চার বছর বয়স তখন কোনো এক অজানা কারণে তোয়ার বাবা ওর মাকে খুন করে নিজেও ফাঁসিতে ঝুলে পরে। ওর বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিল। দুই পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি। তোয়াকে দেখার মতো কেউ ছিল না। তখন থেকে আমাদের কাছেই থাকে মেয়েটা। আমি স্কলার শীপ পেয়ে কানাডা যাওয়ার সময় সব কাগজপত্র রেডি করে, ওকেও সাথে নিয়ে যাই। এখানে থাকলে হয়তো ওর পরিণতিও সেম হতো। আর রইলো আমাকে কে সাহায্য করেছে? সেটা না হয় অজানাই থাক।”
” আবারও রহস্য। তুমি আগা গোড়া পুরোটাই একটা রহস্য।”
” থাক না কিছু রহস্য। আচ্ছা আপনি তো সবকিছু জানলেন। এখন কি আমাকে এরেস্ট করবেন?”
“আমাদের দেশের আইনে ধর্ষকদের কোনো শাস্তি নেই। এদেশ আর দেশ নাই বুঝলে? এটা এখন ধর্ষকদের দেশ। ওদের শাস্তি দিতে তোমার মতো তুরদেরই প্রয়োজন। তোমার শেষ শিকার জুবান তাই না? যাও তোমার শিকার নিজে থেকেই শিকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ”
“একটা মজার ব্যপার জানেন শাহ্? জুবান ভাবছে আমি ওর ফাদে পা দিয়েছি। ও আমাকে নিজের জালে ফাসিয়েছে। অথচ বোকাটা জানেই না। আমি নিজেই ওর জালে ধরা দিয়েছি। আর ও আমাকে নয় আমি ওকে নিজের জালে বন্দি করেছি। এখন জুবান আমার অপেক্ষায় আছে। কিছুক্ষণ পর আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। বধুবেশে এক ভয়ঙ্কর মৃত্যু দেব তাকে। সে বর বেশে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ভাবছে আজকে আমাকে মিথ্যা বিয়ে করে নিজের প্ল্যান সাকসেসফুল করবে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছে সে। আমাকে নাকি একমাসের মধ্যে বিছানায় নেবে।”
খিলখিল করে হেসে উঠলো তুর। পরক্ষনেই গম্ভীর হয়ে বলল,
” জানেন যেদিন জুবান আমাকে প্রপজ করার জন্য নিতে এসেছিল। সেদিন সে আমার জন্য একটা উপহার এনেছিল। আমার বোনের সবচেয়ে পছন্দের শাড়িটা এনেছিল সে। কতটা বর্বর হলে কেউ এই কাজ করতে পারে। তবে এতো দিন পর বোনের স্মৃতি আর গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে কিছুটা ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। জুবান ভালোবেসে প্রথম উপহার দিয়েছিল বলে সবসময় খুব যত্ম সহকারে আলমারিতে তুলে রাখতো সাইরাহ্। মাঝে মাঝেই নামিয়ে আমার সাথে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলতো। সাইরাহ্ মারা যাওয়ার পর আমি পুরো সাইকো হয়ে গিয়েছিলাম জানেন। সারাক্ষন অপরাধ বোধে ভুগতাম। ইশ্ সেদিন যদি ভিডিও কল থেকে ওঠে না যেতাম। হয়তো আমার বোনটা বেঁচে থাকত।”
তুর চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে মুচকি হাসলো। ভিডিও ক্লিপটা শাহরিনের হাতে দিয়ে পরবর্তী শিকারের দিকে এগিয়ে চলল,
শাহরিন পেছন থেকে ডেকে বলল,
” জুবানকে শাস্তি দিয়ে তুমি তো সায়নের কাছে কনাডা চলে যাবে। কিন্তু আমাদের দেশের তো তোমার প্রয়োজন তুর। তুমি কি আর দেশে ফিরবেন না?”
তুর মুচকি হেসে বলল,
” ফিরব। যখনি দেশে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাবে তখনি আমি ফিরব। তাদের শাস্তি না দিলে যে সাইরাহরা শান্তি পাবে না। সাইরাহ্ শান্তি পাবে না।”
শাহরিনের চোখের সামনে দিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো তুর। শাহরিন জুবায়ের ইমজাতের গায়ে এক ধলা থুতু ছিটিয়ে দিল।
সমাপ্ত
পরিশিষ্টঃ ১
বধু বেশে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে তুর। কাঙ্খিত মানুষটিকে না দেখে রাগ হলো তুরের। কোথায় গেলো ডিটেকটিভ সাহেব? উনার রক্তজবা যে এসেছে উনার কোনো খেয়াল আছে? সায়ন তুরের পেছনে এসে দাঁড়ালো কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” রক্ত জবা আমাকে বিশ্বাস করে এতোদূর চলে আসলেন? যদি আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি?”
সায়ন নিছক মজা করে বলল। কিন্তু তুর খুব গম্ভীর ভাবে বলল,
” তাহলে জুবানের মতো আপনাকেও খুন করে ফেলব সায়ন। আমার কাছে বিশ্বাসঘাতকদের জন্য কোনো প্রকার ক্ষমা নেই। তাদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু।”
সায়ন হুট করেই তুরের কপালে একটা চুমু খেলো।
তুরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
” আপনার রাগান্বিত চেহারা রক্তজবার মতোই। আর জানেন তো আমার কিন্তু রক্তজবা অনেক পছন্দের। তবে আপনার থেকে বেশি নয়। বধু বেশে আপনাকে দেখে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আমার। বাড়ি যাওয়ার আগে চলুন কাজী অফিসে গিয়ে শুভ কাজটা সেরে ফেলি।”
” জনসম্মুখে এসব কি হচ্ছে জিজু? একটা জলজ্যান্ত মানুষ যে পাশে দাঁড়িয়ে আছি আপনার খেয়াল আছে?”
তোয়ার কথায় চমকে উঠলো সায়ন। সত্যিই তো বাচ্চাটা যে পাশেই আছে সেদিকে তো খেয়াল করেনি সে। লজ্জায় পড়ে গেলো বেচারা। সায়নকে লজ্জা পেতে দেখে দু’বোন এক সাথে হেসে উঠলো। সায়নও তাদের হাসিতে তাল মেলালো।
পরিশিষ্টঃ ২
সকাল থেকেই তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশে। বিশিষ্ট সংসদ সদস্য জুবায়ের ইমজাত ও তার ছেলে তরুণ রাজনীতিবিদ জুবান ইমজাতে বিভৎস লাশ পাওয়া গেছে ব্রিজে ঝুলন্ত অবস্থায়। এর আগে যে লাশ গুলো পাওয়া গিয়েছিল সে লাশগুলো জুবান আর জুবায়ের লাশের কাছে কিছুই না। এতো ভয়ঙ্কর ভাবে কেউ খুন করতে পারে? যারা লাশ নামাচ্ছিল তাদের গায়েও ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে। শাহরিন ব্রিজের নিচে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ওদের লাশ দেখছে আর হাসছে। জুবায়ের আর জুবানের কুকির্তির শিকারোক্তির ভিডিও দুটো এক ক্লিকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল সে। ভাইরাল হতে দুমিনিট সময়ও লাগলো না। কিছুক্ষণ আগেও যারা বাপ ছেলের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করছিল এখন তারাই গালাগাল দিচ্ছে। ভিডিও দুটোয় জুবান আর জুবায়েরের শিকারোক্তির পাশাপাশি ওদের উপর যে পাশবিক নির্যাতন চলেছে তারও কিছু ঝলক দেখা গেছে। ভিডিওর শেষে যান্ত্রিক গলায় ধর্ষকদের জন্য কিছু সতর্কবাণী দিতে ভুলেনি তুর। ভিডিওতে বলা হয়েছে ধর্ষকরা যদি নিজে থেকে আত্মসমর্পণ না করে তাহলে তাদের অবস্থাও এদের মতোই হবে। সেই থেকে দলে দলে ধর্ষকরা থানায় এসে আত্মসমর্পণ করছে। আমাদের চারপাশে যে এতো এতো ধর্ষক ঘুরে বেরায় সেটা জানা ছিল না শাহরিনের। এদের মধ্যে সমাজের উচ্চ স্তরের কিছু মুখোশধারী ভালো মানুষও আছে। যাদের সবাই পিউর ভালো মানুষ বলেই জানত। হুট করেই শাহরিনের তুরের গাওয়া গানের লাইন মনে পড়ে গেলো।
” ওরা মনের গোপন চেনে না।”
আসলেই জুবান জুবায়ের সায়ন আর এই মুখোশধারী ভালো মানুষদের মনের গোপন তো আমরা কেউ জানতাম না। এমনকি তুরের মনের গোপনও কি জানতে পেরেছিল ওর আসে পাশের মানুষরা?
সমাপ্ত
(এটা অমার লেখা প্রথম গল্প। নিতান্তই শখের বসে গল্পটা নোটপ্যাড থেকে ফেসবুকে শেয়ার করা। কাঁচা হাতের লেখা হিসেবে গল্পটা কেমন হয়েছে আপনাদের সবার মন্তব্য আশা করছি। এতো দিন পাশে থেকে গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।)