#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
পর্ব ০৫
#সিলভিয়া_ফরাশ
(১০)
দ্বিতীয় লাশটা পাওয়া গেলো শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মলে। দুটো খুন যে এক জনই করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আগের বারের মতোই এইবারও একই উপায়ে এবং একই ভাবে লাশটা ঝুলিয়ে রেখে গেছে খুনি। অদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে এই মলের শ’খানেক সি সি ক্যামেরার মধ্যে একটা ক্যামেরাতেও খুনি কিংবা লাশটাকে দেখা যায়নি। পুলিশ প্রসাসন এবার নড়েচড়ে বসেছে। পূর্বের কেসের কোনো কুলকিনারা না করতে পেরে কেসটা যখন বন্ধ করে দিবে দিবে ভাব ঠিক তখনই দ্বিতীয় খুনটা হয়েছে। এবার আর হেলা করার কোনো উপায় নেই। এই কেসের তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে তরুণ অফিসার শাহরিন এর উপর। অফিসার শাহরিন এখন নাম করা সেই শপিং মলে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা সিল করে দেওয়া হয়েছে। লাশ নামানো হচ্ছে। শাহরিন তার সহকারী জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সবকিছু দেখার পর হতাশ হতে হয় তাদের। এখানে কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। খুনি কীভাবে কোনো প্রমাণ না রেখে মার্ডার করতে পারে। জুনিয়র অফিসার সামির বিরক্ত হয়ে বলল,
” স্যার এই ব্যাটা খুনি কিন্তু অনেক চালাক। দেখুন কোনো ক্লু রাখেনি। এই খুনি চাইছেটা কি স্যার? কেন এই খুন গুলো করছে সে?”
শাহরিন সামিরের কথা শুনল কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে এখনও খুব মনোযোগ সহকারে জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করছে। কীভাবে এতো নিখুঁত ভাবে সবকিছু করছে খুনি? কোনো জায়গায় কোনো ক্লু নেই। খুনি যত চালাকই হোক না কোনো, কোনো না কোনো ক্লু তো থেকেই যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই শাহরিনের নজর গেল লাশটা যেখানে ঝুলছিল তার ঠিক নিচে দেয়ালের কোনে লাল রঙের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। সার্চ করার সময় এটা মিস হয়ে গেছে বোধহয়। শাহরিন এগিয়ে আসল। জিনিসটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার।
“ক্লু পেয়ে গেছি সামির।”
সামির হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে এলো। শাহরিনের ক্লু দেখে চেহারাটা মলিন হয়ে গেল তার।
“ক্লু কোথায় স্যার? এটা তো রক্তজবা।”
” হুম এটা রক্তজবা। আর এটাই ক্লু। থানায় চলো সামির আগের কেসের ফাইলগুলো একটু দেখতে হবে।”
শাহরিন থানায় বসে আছে। প্রথম লাশের ছবি গুলো চেক করতে করতেই একটা ছবি দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে শাহরিনের। তার মানে তার অনুমানই ঠিক। সামির রক্তজবা ফুলটা নেড়েচেড়ে দেখছে। এটা কীভাবে ক্লু হতে পারে? এটাতে কোনো ক্লু আছে কীনা পরীক্ষা করে দেখছে সে।
” সামির দেখো। আর তোমার হাতের ফুলটা স্বাভাবিক ফুল। এটাতে অস্বাভাবিক কিছুই পাবে না।”
শাহরিনের বাড়িয়ে দেওয়া ছবিটা দেখল সামির তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল,
” এখানেও রক্তজবা স্যার। তার মানে রক্তজবার সাথে আসলেই এই কেসের কোনো যোগসূত্র আছে। কিন্তু স্যার একটা প্রশ্ন ছিল।”
সামিরের এমন প্রশ্ন করার স্বভাব ভালো লাগে শাহরিনের। ছেলেটা এই লাইনে নতুন। এটাই তার প্রথম কেস। সামির যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। যতক্ষন না সে পুরো ব্যপারটা বুঝতে পারে।
” একটা নয় দুটো প্রশ্ন করো সামির।”
” স্যার প্রথম কেসে তো আমরা রক্তজবা ফুলটা মিস করে গিয়েছিলাম। তাহলে আপনি মলে এই ফুলটা দেখে বুঝলেন কীভাবে যে এটা কেসের সাথে জড়িত?”
সামিরের এমন বোকা বোকা প্রশ্নে হাসি পেলো শাহরিনের।
” এই মলের এই ফ্লোরটা স্টোর রুমের মতো সামির। মালের গোডাউন টাইপ। সাধারণ মানুষের এখানে আসা বারন। রক্তজবা ফুল এখানে আসবে কোথা থেকে বলো? তাও আবার এমন বীভৎস লাশের পাশে?”
সামির বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল স্বভাব সুলভ প্রশ্ন করে বসল,
” কিন্তু স্যার খুনি এই রক্তজবা ফুল গুলো রেখে কি বুঝাতে চাইছে?”
(১১)
সায়ন নিজের সবচেয়ে পছন্দের ফুল গাছটিতে পানি দিচ্ছে। আজ সে ভিশন খুশি। রক্তজবা গাছটা পুরো রক্তের মতো লাল হয়ে রয়েছে ফুলে ফুলে। সায়ন খুশি মনেই কয়েকটা ছবি তুলে নিল ফুলের তারপর ফেবুতে নিজ ওয়ালে পোস্ট করে দিল,
” হে প্রিয়তমা রক্তজবা। আপনাকে আমি রক্তের মতোই ভালোবাসি। রক্ত ছাড়া যেমন বেচে থাকা অসম্ভব তেমন আপনাকে ছাড়াও আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব। রক্তের মতো আমার প্রতিটা শিরা উপশিরায় শুধু আপনারই বাস রক্তজবা।”
ছিমছাম গোছানো একটা ড্রয়িং রুমে বসে আছে তুর। রুমে বেশি আসবাব না থাকলেও খুব গোছানো সবকিছু। আজ ভার্সিটিতে যায়নি সে। সোজা সবুরের কোচিং সেন্টারে গিয়েছিল কিন্তু ওখানে গিয়ে জানতে পারল সবুর দুদিন ধরে কোচিং সেন্টারে আসছে বিধায় সবুরের বাড়িতে এসেছে সে। এখানে এসেও সবুরকে পায়নি। সবুরের মা রান্না ঘর থেকে চা নিয়ে তুরের পাশে সোফায় বসল।
” আন্টি সবুর ভাইয়া কোথায় গিয়েছে কিছু জানেন? বা কখন ফিরবে?”
সবুরের মা হুট করেই মুখে আঁচল চেপে কান্না করে দিলেন। কান্নারত কন্ঠে বললেন,
” গত পরশু রাত থেকে আমার ছেলেটা বাড়ি ফিরছে না গো মা। মোবাইলও বন্ধ। এমন কোনো জায়গা বাদ নেই যেখানে ওকে খুঁজি নি। থানায়ও গিয়েছি। উনারাও ছেলেটার কোনো খোঁজ দিতে পারল না। পুলিশরা বলেছে আমার ছেলের কোনো শত্রু আছে কীনা বা কাউকে সন্দেহ করি কীনা? তুমিই বলো মা। আমার ওমন ভালো ছেলের শত্রু থাকবে কোথা থেকে? ও তো কোনো দিনও কারো ক্ষতি করেনি। সবসময় মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই দেখো এই অচেনা শহরে তোমাদেরও তো কত সাহায্য করেছে। আমার ছেলেটা এমনি নিঃস্বার্থ ভাবে সবার উপকার করে গেছে। সেটা নিজের ক্ষতি হলেও। জানো মা গো আমার মায়ের মন কেমন কু গাইছে। ছেলেটা আমার ঠিক আছে তো? বাপ মরা ছেলে আমার। কত কষ্ট করে মানুষ করেছি। যখন একটু সুখের মুখ দেখলাম তখনই ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে গেলো। তুমি একটু দোয়া করো মা গো। আমার ছেলেটা যেনো ঠিক থাকে। আল্লাহ না করুক ওর যদি কিছু হয় আমি বাঁচতে পারব না।”
মহিলার কান্না দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো তুরের। সবুরের মাকে কোনো ভাবে সান্তনা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে। সবুরের মা তো আর নিজের ছেলের এমন ঘৃন্য রূপের কথা জানেন না। উনার ছেলে নিঃস্বার্থ সাহায্যের মূল্য যে কীভাবে আদায় করে তা যদি উনি জানতেন। ছেলের এমন জঘন্য কার্যক্রমের কথা জানলে নিশ্চয়ই এর চেয়েও বেশি কষ্ট পেতেন। কিন্তু সবুরের কী হলো? কোথায় গেলো সে? নাকি কোনো ভুক্তভোগী জানো/য়ারটাকে শেষ করে দিয়েছে। তুরের আফসোস হলো। নিজের হাতে জানো/য়ারটাকে শাস্তি দিতে পারলে শান্তি পেত সে। তোয়ার আর সবুরের মায়ের কান্নারত চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। তুরের অনেক কান্না পাচ্ছে। চারদিকে মানুষের মুখশ পরা এতো হায়/না কেন? যারা মানুষের মুখশ পরে প্রতিনিয়ত নারীদেহ ছিঁড়ে খুঁড়ে খাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় উৎপেতে থাকে।
তুরের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশটাও মন খারাপ করে রয়েছে। তুর কান্না করতে না পারলেও আকাশটা ঠিকই কান্না করে দিল। আকাশের কান্নায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তুর বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে চলেছে।
” শুনেছি বর্ষায় প্রেমিকাকে কদম দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ না করলে নাকি সুপ্রেমিক হওয়া যায় না? তাই তোমার জন্য একগুচ্ছ কদম নিয়ে এলাম রসগোল্লা। আমি তোমাকে ঠিক রসগোল্লার মতোই ভালোবাসি রসগোল্লা।”
পরিচিত কন্ঠ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো তুর। জুবান দুই হাঁটু মুড়ে বসে আছে। হাতে একগুচ্ছ সাদা কদম। ফুল গুলো উদ্ভুত ভঙ্গিমায় বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে। জুবানকে ঠিকঠাক দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। সে তো ভেবেছিল আগামী এক সপ্তাহ জুবান তো দূর তার ছায়াকেও দেখতে পাবে না। ডোজটা কি তাহলে কম পড়ে গিয়েছিল??
তুরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রতবোধ করল জুবান।
” কি হলো? আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি? আসলে আগে কখনও কাউকে প্রপোজ করিনি তো তাই একটু নার্ভাস। ভুল হলে কিছু মনে করো রসগোল্লা।”
জুবানের কথা শুনে তাচ্ছিল্য করে হাসল তুর।
” যে ছেলে রোজ রাতে নতুন নতুন নারীদেহে মত্ত থাকে তার মুখে এইসব মানায় না জুবান।”
তুরের কথা শুনে জমে গেলো জুবান। তুর এসব জানলো কীভাবে? তরুন রাজনীতিবিদ সে। দেশের ম্যাক্সিমাম তরুণ ভোটাররা সব তার সাপোর্টে। জুবানের সাপোর্টারদের একটা বড় অংশ হলো তরুণীরা। যারা বেশিভাগ জুবানের সৌন্দর্যের প্রেমে মত্ত। জুবান পুরো দুনিয়ার সামনে একটা আদর্শ। আর আড়ালে নর্দমার কীট। নারীদেহে আশক্ত। প্রতিদিন নতুন নারী না হলে চলে না তার। জুবানের এই আসক্তির কথা বিশ্বস্ত কয়েকজন ছাড়া আর কেউই জানে না। তুরের এসব জানার কথা নয়। জুবান বিষ্ময় নিয়ে তুরের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখে সবসময় একটা রহস্যময় হাসি খেলা করে। জুবানের ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসলো তুর।
” চুপ করে আছেন কেন জুবান? কী ভাবছেন আমি এই কথা জানলাম কীভাবে? আমি আরও অনেক কিছুই জানি।”
কী জানে তুর? জুবান উঠে দাঁড়ালো। প্লান ‘A’ কাজ না করলে সবসময় সময় প্লান ‘B’ রেডি রাখে জুবান। এখন প্লান ‘A’ ফেইল্ড তাই প্লান ‘B’ মোতাবেক তুরের কাছে এসে মুখে রুমাল চেপে ধরে জুবান। কিছুক্ষণ বিড়াল ছানার মতো ছটফট করল তুর। বড় বড় নখ দিয়ে জুবানকে জখম করতে ভুলল না। ব্যস মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে জুবায়ের প্রসস্থ বুকে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা। জুবান ক্রুর হাসল। তুরের গালে চুমু খেয়ে বলল,
” এবার তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না রসগোল্লা। তুমি এখন জুবানের কারাগারের অসহায় বন্দিনী। তোমার এই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য তুমি নিজেই দায়ী। আমি তো তোমাকে ভালোবেসে রানী বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু….।”
চলবে…..