ওহে প্রিয় পর্ব- ৪৮

0
2420

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৮
___________________
চারদিক থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের ধ্বনি। ঠিক সে মূহুর্তে সাবা ম্যাম এর বাসার সামনে গাড়ি থামলো হ্যাভেনের৷ পুরো জার্নির সময়টাই আহি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো৷ স্মৃতি চারণ করছিলো সে মানুষ’টার যে মানুষ’টা অল্প কিছুদিনেই স্বকীয় করে নিয়েছিলো তাকে৷ গাড়ি থামতেই ডুকরে ওঠলো আহি। হ্যাভেন আবারো হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো তাকে৷ অদৃষ্টে গভীর চুম্বন একে দিয়ে নম্র সুরে বললো,

-‘ আমি এখানেই আছি। তুমি ভিতরে গিয়ে দেখে এসো ম্যাম’কে। তারপর তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসে আমি জানাজায় শামিল হবো। ‘

কথাটি বলেই নিজ হাতে আহির চোখের পানি মুছে দিলো হ্যাভেন। শাড়ির আঁচল সিটে বিছানো ছিলো। পিছন দিক দিয়ে আঁচল টেনে ডানপাশ অবদি কাঁধ ঢেকে দিলো। এক হাতে আহির এক গালে আলতো ছুঁয়ে মৃদুস্বরে বললো,

-‘ যাও। ‘

গাড়ির ডোর খুলে বাইরে বের হতেই পিছনে আরো দুটো গাড়ি দেখতে পেলো আহি। তার মধ্যে একটি গাড়ির ডোর ঘেষে মাথা নিচু করে দু’হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি। হ্যারির অমন কাতর ভণিতা দেখে বড়সড় এক ধাক্কা খেলো আহি৷ বুকের ভিতরটা হঠাৎই কেমন মোচড়ে ওঠলো তার৷ এক ঢোক গিলে হ্যারির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আশেপাশে চোখ বুলালো৷ পরিচিত, অপরিচিত অসংখ্য মুখ দেখতে পেলো সে। তাদের ভীরেই দু’জন ক্লাসমেট ছিলো। তারা ওকে দেখেই এগিয়ে এলো এবং ভিতরে নিয়ে গেলো।
.
রাত ন’টায় হ্যাভেন আর হ্যারি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এক সঙ্গে বাড়ি ফিরলো। হ্যাভেন রুমে এসে দেখলো খয়েরি রঙের সূতি একটি শাড়ি পরে গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আহি। ভিতরে এসে খাবার গুলো ট্রি টেবিলের ওপর রেখে বাথরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পোশাক পাল্টে নিলো সে। আহি তখনো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। হ্যাভেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

-‘ খাবার এনেছি। দুপুর থেকে কারো খাওয়া হয়নি। তুমি ওঠলে আমাদের সুবিধা হতো। ‘

কথাটি বলেই পিছন ঘুরে ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো হ্যাভেন৷ আহি চুপচাপ ওঠে বসে শাড়ি ঠিক করে নিয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করে নিলো৷ হ্যাভেন মৃদু হেসে বিছানার এক কোণায় বসে হ্যারি’কে কল করে তাদের রুমে আসতে বললো। আজ তারা তিনজন রুমেই ডিনার সারবে৷ হ্যারি আসতে আসতে আহি নিচ থেকে প্লেট, গ্লাস আর জগে পানি নিয়ে এলো। সব কিছু রেডি করে হ্যাভেনের দিকে তাকাতেই হ্যাভেন মুচকি হেসে সোফায় গিয়ে বসলো। হ্যারিও এসে হ্যাভেনের পাশে বসলো। আহি দাঁড়িয়ে ছিলো হ্যাভেন ওকে ইশারায় বাসতে বললে সে বলে,

-‘ আমার খিদে নেই। আপনারা খেয়ে নিন আমি একটু ঘুমাতে চাই। ‘

কথাটি বলেই বিছানার দিকে এগুতে যায় তখনি হ্যাভেন হাত টেনে জোর করে তার পাশে বসিয়ে দেয়। বলে,

-‘ অল্প হলেও খেতে হবে। দুপুর থেকে কিছু খাওনি আহি। জেদ না করে খেয়ে নাও। ‘

বাধ্য হয়ে অনিহা থাকা সত্ত্বেও খেতে বসলো আহি। সেই সাথে লক্ষ্য করলো হ্যারি’কে। ছেলেটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ম্যাম’কে পছন্দ করতো হ্যারি। হয়তো মন থেকে ভালোও বাসতো। যা সম্ভব হওয়ার ছিলো তাই সম্ভব হয়নি সেখানে হ্যারির অনুভূতি নিছক বাচ্চামি ছাড়া কিছুই মনে হলো না আহির৷ তাই খাওয়া শেষে হ্যারি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আহি বাঁধা দিলো। বললো,

-‘ কিছু সময় বসে যাও কিছু কথা বলবো। ‘

চারদিকে এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হ্যাভেনের দিকে তাকাতেই হ্যাভেন মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো বসে যেতে। ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে চুপচাপ সোফায় বসলো হ্যারি। আহি বিছানায় হ্যারির সম্মুখীন হয়ে বসলো। হ্যাভেন তার মায়ের সঙ্গে কথা ফোনে কয়েক মিনিট কথা বলে কেটে দিয়ে হ্যারির পাশে গিয়ে বসলো। আহি তার দৃষ্টিজোড়া মেঝেতে স্থির রেখে বললো,

-‘ সাবা ম্যাম’কে আমি খুব বেশীদিন চিনিনা। তবে তার সম্পর্কে অনেকটা জানি। তার থেকেও বেশী তার সম্পর্কে অনুভব করতে পারি। ‘

চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো আহির৷ গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও সে বলবে এই কথাগুলো। কারণ সে চায় না সাবা ম্যাম’কে নিয়ে হ্যারির কোন আফসোস থাকুক বা এমন কোন অনুভূতি থাকুক যা থাকা অনুচিত। যে অনুভূতি কষ্ট দেবে নির্মলকে। নির্মল নামক শ্রদ্ধেয় সে পুরুষটির আজ হয়তো সুখের সময়। তার এই সুখ’টাতে কেউ আফসোসের শ্বাস না ফেলুক এটিই চায় আহি। তাই সাবা,নির্মলের সেই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্ত বিবরণ আজ সে আবারো স্মরণ করলো সেই সাথে সামনের এই দু’জন মানুষ’কে জানালো প্রেম কি? ভালোবাসা কি? সাবা এবং নির্মল কে? কেন তারা তার হৃদয়ে এতোখানি জুড়ে রয়েছে? সাবা ম্যাম শুধু সাবা ম্যাম নয়। নির্মল শুধু সাবা ম্যাম এর হাজব্যান্ড, ভালোবাসার মানুষ বা তাদের দুজনের বড় ভাই নয়। তাদের দু’জনের যে হৃদয় নিংড়ানো এক পরিচয় রয়েছে।

-‘ ভালোবাসার অনেক সংজ্ঞা আমরা শুনেছি। ভালোবাসার অনেক সংজ্ঞা আপনি আমায় দিয়েছেন হ্যাভেন৷ কিন্তু ভালোবাসার যে সংজ্ঞা আমি জানি তা আপনারা কেউ জানেন না। আপনারা সবাই কয়েকটি লাইনে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছেন। আর আমি জেনেছি কারো হৃদয়বিদারক হাহাকার গুলোকে। যা কেবল নিখুঁত ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। লায়লীর গায়ের বর্ণ কালো ছিলো তবুও সে মজনুর কাছে সবচেয়ে রূপবতী নারী ছিলো। আমরা লায়লী মজনুর প্রেম কাহিনী শুনেছি। জেনেছি ভালোবেসে তাদের অমরত্বের কথা। লায়লী, মজনু,রাঁধা,কৃষ্ণ অমর হয়ে আছে তাদের অভাবনীয় প্রেমের দ্বারাই৷ এদের সবার প্রেম কাহিনী আমরা সকলের মুখে মুখে শুনেছি৷ টিভি’তে তাদের কাহিনীগুলো অন্যদের করা অভিনয়ের মাধ্যমে দেখেছি। কিন্তু এমন একটি প্রেম কাহিনী আমি জানি এমন একটি হৃদয়বিদারক ভালোবাসার পরিণাম জানি যা আমাকে সেই মানুষ’টি বলেছে যে মানুষ’টির সাথে ঘটেছে হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো। যে মানুষ’টির অগণিত দীর্ঘশ্বাসের কিছু দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়েছি আমি৷ ‘

হ্যাভেন, হ্যারি দু’জনই আহির দিকে বিস্ময়ান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে৷ আহি তাদের দৃষ্টি’কে গুরুত্ব না দিয়ে বলতেই থাকলো,

-‘ নির্মল সাবা’কে ভালোবাসে এটি আমায় অবাক করেনি। দিনের পর দিন সাবার প্রত্যাখ্যান সহ্য করেছে এটাও আমায় অবাক করেনি। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ বিদ্রোহ করে একসময় সাবা অনুভব করলো সে নির্মল নামক পাগল পুরুষ, প্রেমিক পুরুষ’টাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখানেও আমি অবাক হইনি। নিজের মনের কথা নির্মল’কে জানানোর পূর্বে মেয়েটা যখন সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে গিয়ে মা’কে জানাবে। সে সিদ্ধান্তটির কথা জেনে তার ওপর দ্বিগুণ শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছিলো কিন্তু অবাক হইনি। গ্রামে গিয়ে যখন কঠিন কিছু পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো মেয়েটা৷ জন্মদাতা পিতার অজস্র গালি হজম করলো। বাড়ির লোক, পাড়ার লোকদের ঘৃণ্য দৃষ্টি, ঘৃণ্য আলোচনার স্বীকার হলো একটু খারাপ লেগেছিলো, একটু ব্যাথিত হয়েছিলো মন। জোর পূর্বক অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো মেয়েটার। বুকের ভিতর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিলো হায় হায় বিয়েটা হয়ে যাবেনা তো? নির্মল জানতে পারলে কি হবে? সাবা জানাতে পারবেতো নির্মল কে তার অনুভূতির কথা? সাবার চিঠিটা ঠিক সময় পৌঁছাবে তো নির্মলের কাছে? চিঠি পাওয়া মাত্র নিশ্চয়ই নির্মল হন্যে হয়ে ছুটে আসবে তার সবা’কে উদ্ধার করতে? তখনো বুঝতে পারিনি আমি যে গল্পটা সম্পর্কে অবগত হচ্ছি এ গল্পটা কারো তৈরি করা মিথ্যা গল্প নয়৷ এ গল্পটা কারো কল্পনার রাজ্যে কল্পিত নয়৷ আর না এ গল্পটা কোন বইয়ের পাতায় লেখা উপন্যাস মাত্র। আমি যে গল্পটা পড়ছি সে গল্পটা আমার পরিচিত অতি শ্রদ্ধেয় সাবা ম্যামের জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব চিত্র, নির্মম সত্য। খুব খুশি হয়েছিলাম মেয়েটার সাহসীকতা দেখে৷ যা সে মূহুর্তে কিছুটা সিনেম্যাটিকও লেগেছিলো। লাল শাড়ি পরিহিত রমণী’টি তার প্রেমিক পুরুষের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য এতোটাই মরিয়া হয়ে ওঠেছিলো যে পায়ের জুতাটাও পরার সময় পায়নি৷ খালি পায়ে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বুকে জরিয়ে বিক্ষিপ্ত চেহেরায় বেরিয়েছিলো মেয়েটি। ঝড়,বৃষ্টির পরোয়া করেনি। পরোয়া করেনি পায়ে কাঁটা বিঁধলো নাকি পাথরের ঘষায় পা রক্তাক্ত হলো। উদ্দেশ্য তার একটাই ছিলো তাকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরতে হবে। তাকে ফিরতে হবে তার নির্মলের কাছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! অভাগী সাবা মেয়েটা যখন বাসে গুটিশুটি হয়ে বসে সময় গুণছে। বুকের ভিতর চলছে তীব্র উত্তেজনা। পত্রবাহক আজরাইলের ন্যায় হাজির হলো নির্মলদের বাসায়। নির্মল হৃদয়ের সেই নির্মল পুরুষ’টি তার প্রিয়তমার চিঠিটি পায় সন্ধ্যায়। ঘুমন্ত নির্মলের ঘুম ভাঙে কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠেই সদর দরজা খুলে চিঠিটি পায়। চিঠিতে লেখা প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দেয়। অবাক তখনো হইনি। অবাক হয়েছি তখন যখন নির্মল চিঠির পাতায় তার প্রিয়তমার বিয়ের সংবাদ’টি পায়। এবং জানতে পারে যে মূহুর্তে সে চিঠিটি পেয়েছে ঐ দিনের ঐ ক্ষণটিই নির্ধারণ করা হয়েছে তার প্রিয়তমার অন্যত্র বিবাহের। হয়তো বিবাহ সম্পন্নও হয়ে গেছে। তার রাগিনী, তার প্রিয়তমা অন্য একটি পুরুষের নামে পাঠ করেছে তিন কবুল। যারা এমন অনুভূতির সম্মুখীন হয়নি তারা কখনো বুঝতে পারবে না৷ তারা পারবে না কখনো অনুভব করতে। অনুভূতি’টা ঠিক কতোভাবে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে? ঠিক কতোরকম আয়োজন করে বক্ষঃস্থলে রক্তক্ষরণ ঘটায়? আমরা অনুভব করতে পারবো না কখনো। কিন্তু নির্মল আমাদের সহ গোটা পৃথিবীকে জানিয়ে গেছে কতোখানি পুড়েছিলো তার হৃদয়। মস্তিষ্কের চূর্ণবিচূর্ণের পাশাপাশি হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যন্ত্রণাগুলোর কথা নির্মল ডক্টরের মাধ্যমে জানিয়ে গিয়েছিলো গোটা পৃথিবীতে। অবাক আমি তখন হয়েছিলাম যখন জানতে পারলাম। সাবা মেয়েটা নির্মলের বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছিলো। কিন্তু পারেনি নির্মলের কাছে পৌঁছাতে। পারবে কি করে? সে অন্যপুরুষের বউ হওয়ার সংবাদ পাঠিয়ে আয়োজন করে বিয়ে করবে আর নির্মল চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? থাকেনি তো সহ্য করতে পারেনি৷ একই সঙ্গে হার্ট এট্যাক আর ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিল তার। এবং ঘটেছিলো নির্মম মৃত্যু। অবাক হয়েছিলাম, বুকের ভিতর ব্যাথা করছিলো এটা ভেবে, একটা পুরুষ একটা নারী’কে কতোখানি ভালোবাসলে তার বিয়ের সংবাদ পেয়ে তাকে হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে হার্ট এট্যাক, ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যায়? ‘

দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো হ্যারির। হ্যাভেন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আহির পানে। সেই সাথে মনে প্রশ্ন জাগলো তারা’তো এসব জানেনা। যদি এসব সত্যি হয় তাহলে সাবা ম্যাম কেনো নির্মলের বউ’য়ের পরিচয় পেয়েছে সর্বত্র? আহির কথা অনুযায়ী নির্মলের সঙ্গে সাবার বিয়ে হয়নি। তাহলে কেনো সাবা ম্যাম নিজেকে চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ দাবি করতো? কেনো নির্ঝর সাবা’কে ভাবি বলে সম্বোধন করতো?

দু’হাতে নিজের অশ্রুকণা মুছে নিয়ে আহি বললো,

-‘ প্রথম অবাক হয়েছিলাম নির্মলের মৃত্যু’তে। দ্বিতীয় বার অবাক হলাম মাঝরাতে নির্মলের লাশ বুকে জরিয়ে আর্তনাদ আহাজারি শেষে যখন ফজরের আজান দেয় নির্মলের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ম্যামের বলা সেই কথাগুলো জানতে পেরে। যেখানে ম্যাম নির্মলকে ওহে প্রিয় সম্বোধন করেছিলো। তার প্রিয়র নামে তিন কবুল বলে নিজেকে তার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করেছিলো। আহাজারি করতে করতে বলেছিলো এপারে তাদের মিলন ঘটেনি ওপারে যেনো সে নির্মলের পদস্থলে হলেও একটুখানি ঠাঁই পায়। ম্যাম সেদিন আত্মত্যাগ করেছিলো। অনেক বড় একটি ত্যাগ। যা হয়তো আর কোন নারীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। সেদিন থেকেই নির্মলের স্ত্রীর অধিকার পায় সে৷ এমন বিয়েও হয়? বরের লাশ বুকে জরিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলা তিন কবুলের বিয়ে। সত্যি অবাক হয়েছিলাম। আর শেষ অবাক টা হলাম আজ যখন জানতে পারলাম ম্যাম আর নেই। ঘুমের ঘোরে স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু ঘটেছে তার।

সাবা, নির্মল এই দু’টো নর নারী’র থেকে ভালোবাসার কয়েকটি মানে আমি বুঝেছি। ভালোবাসা হচ্ছে একটা আফসোস। ভালোবাসা হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। ভালোবাসা মানেই অসম্পূর্ণতা। ভালোবাসা মানেই সাবা নির্মল। লাভ দ্যাট মিনস,

Love এর পূর্ণরূপ –

L= Lakes Of Sorrows ( দুঃখের সাগর )
O= Ocean Of tears ( অশ্রু মহাসাগর )
V= Valley Of Death ( মৃত্যু উপত্যকা )
E= End Of Life ( জীবন শেষ )।
____________________
পরেরদিন সকালে রুবিনাকে ফোন করে সকলকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলে হ্যাভেন৷ যেহেতু ঢাকা ব্যাক করেছে আর ওখানে যাবে না সে। তাছাড়া তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এবং সভাও রয়েছে এ সপ্তাহে। সব শুনে রুবিনা জানায় দু’দিনের ভিতরেই তারা ফিরে আসবে৷ মায়ের সাথে কথা শেষে মুচকি হাসে হ্যাভেন এবং সিদ্ধান্ত নেয় রুবিনা ফিরলেই আহির প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাবে। তারপর আহিকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে৷

সকালের নাস্তা শেষে হ্যাভেন আর হ্যারির জন্য দুপুরের রান্না বসিয়েছে আহি। তখনই রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো হ্যাভেন। কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্না করছে আহি। গরমে ঘেমে গলা বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। ফর্সা কোমড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে হ্যাভেন৷ চোখ বুজে রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে এক ঢোক গিললো সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে পকেটে এক হাত গুঁজে দিয়ে ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,

-‘ আগামীকাল বা পরেরদিন সবাই ফিরবে। ও বাড়িতে যা ফেলে এসেছো তোমার প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে আসুক। তারপর না হয় তোমায় বাবার বাড়িতে রেখে আসবো।’

চমকে পিছন তাকায় আহি। চোখেমুখে আতংক স্পষ্ট তার। এতোটাই আতংকিত হয়েছে সে যে হাতে থাকা তরকারির চামচটা হাত ফসকে নিচে পড়ে যায়। এবং ঝনঝন শব্দ করে ওঠে। প্রচন্ড হাসি পায় হ্যাভেনের৷ তবুও নিজেকে সংযত রেখে চোখেমুখে সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে তুলে এগিয়ে এসে শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করে,

-‘ একি ভয় পেয়ে গেলে? উপস ঘেমে-নেয়ে কি একটা অবস্থা করে ফেলেছো মুখটার। রান্না শেষ করে শাওয়ার নিয়ে নাও কেমন? আমি একটু বের হবো ঘন্টা খানিক পরেই ফিরে আসবো। ‘

ছলছল চোখে হ্যাভেনের দিকে তাকিয়ে রইলো আহি। তাকে কেন বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে আসবে হ্যাভেন? সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাগ, অভিমান, অভিযোগের ঝামেলা চুকিয়ে এবার সংসারে মন দেবে। ভালোবেসে আপন করে নেবে এই ঘর সংসার এবং সংসারের মানুষগুলোকে।

হ্যাভেন চলে যাওয়ার জন্য পিছন ঘুরে দরজার কাছ অবদি যেতেই কাঁপা কন্ঠে আহি ডেকে ওঠলো,

-‘ হ্যাভেন। ‘

থেমে যায় হ্যাভেন পিছন ঘোরার সময়টুকুও আহি দেয়না তাকে ছুটে এসে পিছন থেকেই জাবটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
.
রাত দশটা। ডিনার শেষে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ফোনে গেমস খেলছে হ্যাভেন। তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো আহি। আড়চোখে আহিকে দেখামাত্রই চোখ কপালে ওঠে গেলো হ্যাভেনের৷ এটারই ভয় পাচ্ছিলো সে। সারাদিনের পরিস্থিতিতে যতোটা পারে ধারণা করে নিয়েছিলো৷ এবার একদম সিওর হয়ে গেলো। কিন্তু এমন করলে তার সব প্ল্যান যে মহাসমুদ্রে আছড়ে পরবে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেলো হ্যাভেনের৷ চোখ বন্ধ করে কয়েকদফা শ্বাস ছেড়ে। ফোন অফ করে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। কিছু সময়ের ব্যবধানে কালো রঙের নাইটি পরিহিতা আহি লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে হ্যাভেনের পাশে গিয়ে বসলো। হ্যাভেনের কাঁধে আলতো হাত ছুঁইয়িয়ে ‘হ্যাভেন’ বলে ডাকতেই হ্যাভেন চোখ বুজে রুদ্ধশ্বাসে বললো,

-‘ ঘুমিয়ে পড়ো আহি। ‘

আহি প্রচন্ড অস্থির হয়ে হ্যাভেনকে তার দিকে ফেরালো৷ ড্রিম লাইটের আলোতে আবেদনময়ী আহিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে হ্যাভেন। সেই সাথে আহির প্রতিটি ঘন নিঃশ্বাসের তীব্র আঘাত পড়ছে তার কর্ণকুহরে। প্রচন্ড অস্থিরতার সঙ্গে ওঠে বসলো হ্যাভেন। সে সুযোগে আহিও তার দিকে এগিয়ে এসে চোখ বন্ধ করে তার বক্ষঃস্থলে মাথা গুঁজে এক নিঃশ্বাসে বললো,

-‘ আমি আপনার সান্নিধ্য চাইছি। আপনি আমায় ফেরাতে পারেন না হ্যাভেন। ‘

কথাটি বলেই মাথা তুলে প্রচন্ড আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে আচ্ছন্ন দৃষ্টি তে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে হ্যাভেনের কপালে চুমু খেলো। হ্যাভেন কিছু বলতে উদ্যত হতেই আহি এক আঙুলে তার ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরে সে অবস্থায়ই নিজ ওষ্ঠ ছুঁইয়িয়ে দিলো আঙুলে চাপা ওষ্ঠদ্বয়ে।

চলবে…।
ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here