কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা
২৪.
বাসে এক সিটে পাশাপাশি বসে আছে চয়ন-সুরলা। তাদের গন্তব্য, চট্রগ্রাম। সুরলা ঘোর অমন থাকা সত্ত্বেও চয়ন তাকে নিয়ে যাচ্ছে। পরিবারের সবাই চয়নকে সমর্থন করছে। যখন সে সবাইকে তার মতামত জানায় তখন চয়ন বিস্মিত নয়নে চেয়ে বলে, “আমার সাথে যাবে বলে একটু আগে খুশিতে জড়িয়ে ধরেছিলে, খুশিতে লাফাচ্ছিলে রীতিমতো। এখন আবার কী হল তোমার?মত পাল্টালে কেন?” চয়নের এমন মিথ্যে কথায় সবার সামনে ভীষণ লজ্জিত হয় সুরলা। কী মিথ্যুক! এটা সে কখন বলেছে? সে যদি এখন বলে আমি এমন কিছু করি নি, তবে চয়ন হয়তো বলবে, এখন সবার সামনে স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছো। বড়রা সবাই বিশ্বাস ও করবে চয়নের কথা। মিথ্যা বলায় দক্ষ সে। সন্দেহের অবকাশ নেই যেন। নিতু, নিলয় মুখ চেপে হাসে।সুরলার লজ্জা যেন আরো বেড়ে যায়। সবাই কী ভাবছে তাকে? তাও নিজেকে ঠিক রাখে সে। লজ্জায় নেতিয়ে না গিয়ে বলে,
“আমার মতামত পরিবর্তন হয়েছে, আমি যাব না।”
চয়নের সুরলাকে সতর্ক করে বলে,
“আমি গেলে ফোন দিয়ে মিস করছো বলে কান্নাকাটি করতে পারবে না কিন্তু! আমি জানি, আমি বেরুনোর পরপরই তুমি ফোন দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন আমাকে ব্যাক করতে হবে। তাই বলি কী? এখনই চলো আমার সাথে, ভার্সিটি খোলা হওয়া অবধি থেকো, তারপর চলে এসো না হয়?”
শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে একের পর এক মিথ্যা বলে যায় চয়ন। এমন কথা বলে যে লজ্জায় সে উত্তর দিতে পারে না, পালিয়ে রুমে চলে আসে। পরিবারের সবাই তাকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দেয় চয়নের সাথে। বাসায় থাকাকালীন সময়ে চয়ন বলছিল ফ্লাইটে যাবে। কিন্তু বাসা থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে না গিয়ে বাস কাউন্টার চলে যায়। সুরলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে চয়ন হেসে বলে,
“অনেকদিন বাসে যাই না, তাই মত পাল্টিয়েছি। ”
সুরলা বুঝে যায়, তাকে বাড়তি কষ্ট দিতেই সল্প বৈমানিক ভ্রমণে না গিয়ে দীর্ঘ ভ্রমণকে বেছে নিয়েছে। কাইন্টার থেকে দুটো টিকেট নেয় চয়ন। সাড়ে আটটার বাসে যাবে তারা। বাসে ওঠে আগে উইন্ডো সিট দখল করে বসে। অগত্যা সুরলাকে পাশে বসতে হয়। যে যেখানে যে গাড়ি করে যাক, উইন্ডো বা ডোর সাইডেই বসে সবসময়। আজ উইন্ডো সিটে বা বসায় অস্বস্তি হচ্ছে। এখন রাত আটটা, বাস ছাড়বে আরো পনেরো মিনিট পর। সুরলার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে, সেই দুপুরে মা জোর করে কয়েক লোকমা বিরিয়ানি খাইয়েছে, তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। অস্বস্তি আর ক্ষিধেতে হাসফাস করছে সুরলা। পাশে বসা চয়ন তা লক্ষ্য করলেও কিছু বলে না। কানে ইয়ারফোন গুজে সিটে চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয়। ক্ষিধের তাড়ানায় থাকতে না পেরে ওঠে দাঁড়ায় সুরলা। হ্যান্ড ব্যাগে কিছু টাকা আছে, ওটা দিয়েই কিছু কিনে আনবে। বাস ছাড়তে আরো দশমিনিট বাকি আছে। এর মাঝে কিছু কিনে নিয়ে আসতে পারবে। ভাবনা মতো বাস থেকে নেমে পড়ে। বাস কাউন্টারের পাশে একটা দোকানে যায়। নিজের পছন্দমতো চকলেট চিপস কিনে। টাকা দিতে গিয়ে নিতুকে ধন্যবাদ দেয়। মেয়েটা অন্যসময় ঝগড়া করলেও কাল থেকে একবারে ভদ্র হয়ে গেছে। আসার আগে তার ব্যাগে কাপড় গোছানো থেকে শুরু করে হ্যান্ড ব্যাগটাও গুছিয়ে দিয়েছে। মায়ের থেকে টাকা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিয়েছে। সুরলাকে বলে দিয়েছে, টাকা দিয়েছে, লাগলে খরচ করতে পারবে। সুরলা তখন ভেবেছে অল্প কয়েকটাকা হবে। এখন দেখে হাজার তিনেক টাকা দিয়েছে।
.
সময় দেখতে চোখ খুলে চয়ন। সময় দেখে পাশে তাকাতেই আবিস্কার করে সুরলা নেই। কপালে ভাজ পড়ে তার, গেলে কোথায় মেয়েটা? বাসায় ফিরে গেল না তো? পথে কোন বিপদ হলে সবাই তো তাকেই দোষারোপ করবে। বাসে চোখ বুলিয়ে সুরলাকে পায় না। বাস থেকে নেমে পড়ে সে, শত লোকের ভীড়ে সুরলাকে চোখে পড়ে না। চয়নের নিজের প্রতিই রাগ হয়, সে কিভাবে ভুলে গেল এই মেয়ের চল-চাতুরী? এখন মেয়েটাকে কোথায় পাবে সে? এদিক ওদিক খুঁজে ও যখন পায় না, তখন ফোন বের করে সুরলার নাম্বারটা ডায়াল করে। ফোন সুইচঅফ হওয়ার বার্তা পায়। আবারো খোঁজে নামে, পুরো কাউন্টার তন্নতন্ন করে খুঁজে শেষে সুরলাকে একটা দোকানের সামনে আবিস্কার করে। এক হাতে স্ন্যাকস ভর্তি প্যাকেট, অন্য হাতে চকলেট বার। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চকলেট খাচ্ছে সে। সুরলাকে দেখে চয়নের রাগ হয়। নিজের রাগ দমন করে সুরলার কাছে যায়। সুরলা তখন চকলেট খেতে খেতে কিছু একটা ভাবছে। চয়ন আন্দাজ করছে, সুরলা এখান থেকে পালানোর কথা ভাবছে। চয়নের ভাবনাকে সঠিক প্রমাণ করে বাসের দিকে না গিয়ে উল্টোপথে হাটা ধরে সুরলা। চয়ন গিয়ে তাকে আটকায়। হাত ধরে এক প্রকার টেনে বাসে ওঠায়। সুযোগ ফেলে যাতে আর পালাতে না পারে তারজন্য সুরলা উইন্ডো সিটে বসিয়ে দেয়। নিজে পাশে বসে বলে,
“তুমি এতটা ভীতু রাক্ষস তা বাস থেকে না নামলে বুঝতেই পারতাম না। কিভাবে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলে ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আমার।”
বলে হেসে দেয় চয়ন। একে তো পালাতে পারে নি, তারউপর চয়নের এমন কথায় মেজাজ বিগড়ে যায় সুরলা।
চয়নের দিকে রাগত চোখে তাকিয়ে বলে,
“আর একটা কথা বলবেন, এই জানালা দিয়ে লাফ দিব আমি। বলব আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। আমার কিছু হলে আমাদের পরিবার আপনার কী হাল করবে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন?”
চয়ন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। এই মেয়েটা তাকে হুমকি দিচ্ছে! একে তো পালানোর চেষ্টা করেছে, তারউপর ধরে আনায় আবার রাগ দেখাচ্ছে! ভাবতেই অবাক লাগে চয়নের। ইচ্ছে করে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এই বাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে ভেবে চুপ থাকে। সুরলা জানালার দিকে ফিরে চিপস খেতে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে দুটো চকলেট আর একটা চিপস খাওয়া শেষ তার। ক্ষিধের মাত্রা বেশি হওয়ায় দ্রুত বেগে খাচ্ছে। সেদিকে এক পলক তাকায় চয়ন। তারপর সিটে গা এলিয়ে দেয়। কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করে আছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে এরিমধ্যে। বাসের ভেতর আলো জ্বলছে, জানালা খোলা। পুরপুরে বাতাস আসছে। আরাম পেয়ে খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে সুরলা। দু’জনের মাঝে আর কথা হয় না, যে যার মত আছে। চয়নের ও চোখ লেগে এসেছে। ঘন্টা খানেক পর কারো ঝাকুনিতে চয়নের ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে সে। তখনি পাশ থেকে কেউ একজন বলে,
“এই ছেলে আমি ডাকছি তোমায়?”
চয়ন পাশে তাকায়। দেখে ষাটোর্ধ এক ভদ্রলোক তার দিকে বিরক্তি চোখে তাকিয়ে আছে। চয়ন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কী হয়েছে আংকেল?”
ভদ্রলোক সুরলাকে দেখিয়ে বলে,
“তোমার বোন খোলা জানালা মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে এক্সিডেন্টে হতে পারে। সরিয়ে দাও। পাশ দিয়ে মালবাহী কার্গো, ট্রাক যাচ্ছে। ”
ভদ্রলোকের কথায় চয়ন পাশ ফিরে সুরলার দিকে তাকায়। আসোলেই ঘুমোতে গিয়ে মাথাটা জানালার বাইরে বেরিয়ে গেছে। ভদ্রলোক তখনো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সুরলাকে সরাতে গিয়ে চয়ন বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। ভদ্রলোক বলেন,
” জানালাটা লাগিয়ে দাও, তাহলে আর সেদিকে যাবে না। বাচ্চা মেয়ে ঘুমালে ঠিক থাকে না।”
জানালা বন্ধ করে সুরলার কাধ ধরে জানালা থেকে সরিয়ে সিটে রাখে চয়ন। নড়ে চলে সুরলা আবার ঘুমিয়ে যায়। চয়ন সোজা হয়ে বসে ভদ্রলোককে সৌজন্যবোধ দেখিয়ে বলে,
“ধন্যবাদ আংকেল।”
ভদ্রলোক হেসে বলে,
“তোমার বোনের মত আমার নাতনী আছে। ওকে দেখে নাতনীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। জানালায় মাথা দিয়ে ঘুমোতে দেখে না বলে পারলাম না।তাই তোমার ঘুম ভাঙাতে হয়েছে। কিছু মনে করো না। ”
‘তোমার বোন’ কথাটা শুনতে চয়নের ভালো লাগে না। স্ত্রী হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নিতে না পারলেও আইনগত এবং শরিয়তগতভাবে সুরলা তার স্ত্রী। ভদ্রলোক ভাবছে তারা ভাইবোন। স্ত্রীকে বোন বলাটা মেনে নিতে পারে না যেন। পাশ ফিরে তাকায় সুরলার দিকে। মেজেন্ডা কালার টপসের সাথে এইশ কালার প্যান্ট পরা মেয়েটাকে সত্যিই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। তারউপর সামনে বব কাট আর পেছনে কাধ অবধি খোলা চুলের মাঝে গোলগাল চেহারাটা যেন বয়সটাকে আরো নিচের দিকে নিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে থাকায় একবারেই শান্ত শিষ্ট পিচ্ছি মেয়ের মত লাগছে। অথচ কে বলবে, এই পিচ্ছি দেখতে মেয়েটা স্কুলের কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটির গন্ডি পেরোবে বছর কয়েক পর। এই মেয়ের রগে রগে খেলা করে দুষ্টামি, রাগ, জেদ আর চলনা।
ভদ্রলোকের মুখে ‘তোমার বোন’ কথাটা না শোনার জন্য চয়ন ঘুমের ভান ধরে। নানান কথা ভাবতে ভাবতে চয়ন সুরলার দিকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ে। পথের শেষে গন্তব্য আসে। সুপারভাইজারের ডাকাডাকিতে জেগে উঠে সুরলা চয়ন। গন্তব্য আসায় নেমে যায় চয়ন। তাকে অনুসরণ করে সুরলার নেমে পড়ে। তখন প্রায় মধ্যরাত। চারদিকটা নিস্তব্ধ। নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে সামনে আগায় চয়ন। সুরলাও ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে তাকে অনুসরণ করে।
একে তো অচেনা শহর, তার উপর মধ্যরাত। সুরলার গা ছমছম করছে বারবার। হঠাৎ দূর থেকে একটা কুকুর ডেকে ভেসে আসে। ভয়ে চয়নের হাত খামচে ধরে সে । ‘ঝড়ের কবলে পড়লে মানুষ শত্রুকেও আপন ভাবতে শুরু করে’ এই কথাটার বাস্তবিক রূপ দেখছে যেন চয়ন। সে থেমে যায়। নিজের হাতে দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“রাস্তায় ডাকাডাকি করা কুকুর থেকে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে টিজ করা বখাটেরা অধিক ভয়ংকর হয়। আমি তো ওইসব বখাটেদের থেকেও খারাপ। সে হিসেবে বিপদে আমার সাহায্য পাওয়া আশা করাটা বিলাসিতা নয় কি না মিসেস জুবায়ের আরেফিন? ”
সুরলাকে মিসেস জুবায়ের আরেফিন সম্বোধন করে চয়ন যেন এক পৈশাচিক আনন্দ পায়। সে এই কথাটার সাহায্যে সুরলাকে মনে করিয়ে দিতে পারে যে মানুষটাকে সে সবার সামনে খারাপ প্রমাণ করেছে আজ সে সেই মানুষটার স্ত্রী।
সুরলা চয়নের হাত ছেড়ে দেয়। সে আর ভয় পাবে না, কারো সাহায্য ও লাগবে না। সকালটা হোক কোনভাবে, তারপর বাস ধরে এখান থেকে ঢাকায় ফিরে যাবে না। চয়ন সামনে আগায়। সুরলা গো ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদূর যেতেই একটা সিএনজি পায়। ওঠতে গিয়ে দেখে সুরলা কাছেপাশে নেই। ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে দূরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সুরলাকে চোখে পড়ে। সিএনজি নিয়ে সেদিকে গিয়ে সুরলার সামনে দাঁড়ায়। গাড়িতে বসে থেকেই সুরলাকে ওঠতে বলে। সুরলা না শোনার ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে। চয়নের মেজাজ বিগড়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে সুরলার কাছে গিয়ে এক ধমক দেয়,
” গাড়ি ওঠতে বললাম কথা কানে যায় নি? এইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও গাড়িতে ওঠো।”
চয়নের আকস্মিক ধমকে কেঁপে ওঠে সুরলা। তাও নিজের কথা অনড় থাকে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি যাব না।”
“এই রাতদুপুরে তোমার এইসব নাটক দেখার জন্য টিকেট কেটে পপকণ নিয়ে বসে নেই আমি। রাত অনেক হয়েছে, বাসায় ফিরতে হবে। সকালে আবার অফিসে যেতে হবে। তাই আমি চলে যাব। আর আমি যাওয়ার পরপরই তুমি একদল দুইপায়ী কুকুরের শিকার হতে পারো। তুমি যদি সেটাই চাও তবে থাকো। আমি যাই, কাল পত্রিকার শিরোনামে দেখা হবে। ”
একরাশ বিরক্ত নিয়ে কথা গুলো বলে গাড়ির দিকে হাটা ধরে। সুরলা খানিক ভাবে, তারপর পত্রপত্রিকায় দেখা সংবাদের কথা মনে ওঠে। এই অচেনা জায়গা একা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মুহুর্তে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। যেখানে দুধের শিশু অবধি আজকাল দুইপায়ী কুকুর থেকে রক্ষা পায় না সেখানে সে তো একটা যুবতি। সামান্য জেদের বেশে এখানে থাকা নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে চয়নের সাথে থাকা অধিক নিরাপদ হবে। এইসব ভেবেই সেও ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগোয়। চয়ন সিএনজির এক পাশে বসে আছে। সুরলা গিয়ে অন্য পাশে ওঠে। চয়ন সিএনজির রটের দরজাটা লাগাতে লাগাতে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
“এত নাটক করে কী হলো? সেই তো এসেই পড়লে। এই রাতদুপুরে শুধু শুধু নাটকটা না করলে এ হতো। ”
সুরলা কোন প্রতুত্তরে করে না চয়নের কথার। চুপচাপ বসে থাকে সারাপথ।
★
বন্দরটিলার খানজাহান কলনিতে থাকে চয়ন। একটি ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় তার ফ্ল্যাট। সিএনজি বাসার সামনে এলে ভাড়ামিটিয়ে কান্ত পায়ে এগোয় সিড়িঘরের দিকে। চারদিক চোখ বুলাতে বুলাতে সুরলাও আসে পেছু পেছু। ফ্ল্যাটে ডুকে হাতের ব্যাগ রেখে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। এত লম্বা জার্নিতে শরীর যেন ভেঙে আসছে। ড্রয়িংরুমেই সদর দরজা। দরজার প্রবেশ পথে এসে ব্যাগ রেখে দাঁড়িয়ে যায় সুরলা। চয়নের বাসার ঠিক কোথায় তার একটু গা এলিয়ে দেয়ার জায়গা হবে ভেবে পায় না। চয়নকে জিজ্ঞেস করতে ও অস্বস্তি লাগে। চয়ন বাঁকা উত্তর দিবে নিশ্চিত। চয়নের চোখ যায় সুরলার উপর। হেসে স্বাগত জানিয়ে বলে,
“আসুন মিসেস জুবায়ের। স্বাগত এই জঘন্য লোকের সংসারে। ”
দুর্বল পায়ে ভেতরে আসে সুরলা। সোফার কাছে এসে বলে,
“বিশ্বাস করুন, এই মুহূর্তে আপনার সাথে ঝগড়া করার মতো বিন্দুমাত্র এনার্জি আমার নেই। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, ঘুম ও পেয়েছে। আপনার এই ফ্ল্যাটে আমার জন্য কোন রুমটা বরাদ্দা করেছেন তা দেখিয়ে দিন।”
চয়ন সোজা হয়ে বসে। ডানপাশের একটা রুমের দিকে ইশারা করে দুষ্টু হেসে বলে,
“এই রুমটায় তোমার জঘন্য বর অর্থ্যাৎ আমি থাকি। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে এক রুমে থাকতে হয়। সে হিসেবে তুমি ওই রুমেই যাও। বিয়ের পরে কাজ গুলোও না হয় সেরে নিলাম। কী বলো?” আবার বাঁকা হাসে চয়ন। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় সুরলার মুখ। লোকটা শুধু জঘন্য নয় অসভ্য ও। সুরলার বিরক্তকর চেহারা দেখে চয়ন শব্দ করেই হেসে দেয়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
” আমি খারাপ মানুষ, খারাপ কাজে আগ্রহী বেশি। কাল তো বাসর টাসর হয় নি, আজ হবে নাকি?” চয়নের ইঙ্গিত ভীষণ বাজে লাগে সুরলার। সে রাগত স্বরে বলে,
“আপনি শুধু জঘন্য নন, অসভ্য ও। ভীষণ বাজে লোক।”
বলে এদিক ওদিক চেয়ে বাম পাশের একটা রুমে ডুকে যায়। চয়নের রুম ছাড়া অন্য যে কোন রুমে থাকবে সে। যাওয়ার আগে লাগেজ ও নিয়ে গেছে। সেকেন্ড দুয়েক পরই ফিরে আসে আবার। তাকে দেখে চয়ন উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে রীতিমতো। তার হাসির কারণ, সুরলা লাগেজ নিয়ে যেই রুমে ডুকেছে সেটা ছিল ওয়াশরুম। রাগে দরজাটা ও খেয়াল হয়নি তার। ওয়াশরুমের দরজা অন্যান্য দরজা থেকে একটু ব্যাতিক্রম থাকে। চয়নের হাসি দেখে সুরলা রেগে বলে,
“এখানে সার্কাস চলছে? এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন?”
চয়ন হাসতে হাসতেই বলে,
“সার্কাস দেখেও এত মজা পাই নি,যতটা না আজ পেয়েছি। তোমার অবস্থা দেখে একটা প্রবাদ মনে পড়ছে, ‘যাকে ভাবলাম হিরো, সে আসোলে জিরো’। ”
“দেখুন একদম মজা নিবেন না। এই জায়গায় আমি নতুন, কিছু চিনি না তাই ভুলে ওয়াশরুমকে বেডরুম ভেবেছি। এর জন্য এমন হাসা লাগে?” এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে সুরলা। চয়ন তার রগড় বজায় রাখে,
“এটিটিউড দেখিয়ে গেলে, ফিরে এলে কেন? থাকতে পারলে না ওয়াশরুমে? ওয়াশরুমটা কিন্তু বড় আছে। আমি বলি কী? তুমি ওখানেই থেকে যাও। কাল আমি একটা সিঙ্গেল খাট বসিয়ে দিব ওয়াশরুমে, সাথে একটা মিনি ফ্রিজ। তারপর তুমি ওয়াশরুমেই খাবে, হজম হওয়া খাবারকে মলে পরিণত করে কমোডে ফেলবে, তারপর সেখানেই ঘুমিয়ে যাবে। ”
গা ঘিন ঘিন করে ওঠে সুরলার। নাক মুখ কুঁচকে নেয়। এই বদলোকের রগড়ের পাল্লায় পড়লে এখানেই তাকে বমি করতে হবে। ঘুমে সুরলার চোখ ভেঙে আসছে। পুরো জার্নিটা ঘুমিয়ে এলেও ঘুম শেষ হয় না তার। শুধু ঘুম পাচ্ছে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত ও লাগছে। এই ক্লান্তি কাটানো আর এই বদলোকের রগড় থেকে বাঁচার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে, ঘুম। সুরলা সোফার দিকে এগোয়। কোন রুমে যাবে না, এখানেই ঘুমাবে সে। এই ভেবে একটা কুশন নিয়ে তিন সিট সোফায় শুয়ে পড়ে।
চলবে…