কাজল নদীর জলে পর্ব-৩৩

0
1241

কাজল নদীর জলে
—–আফিয়া আপ্পিতা

৩৩.
প্রিয়জনের মনোউক্তিকে গ্রাহ্য করে প্রায় ছ’মাস পর আজ আবার রংতুলির ক্যানভাস নিয়ে বসেছে চয়ন। নীলাভ আকাশে রাশি রাশি মেঘের হাসিতে মাখা এই পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় পেইন্টিং স্ট্যান্ড এ পেপার সেট করে লবি চেয়ার নিয়ে বসেছে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা আর্ট প্লেট, হাতে ধরা আর্ট ব্রাশ, তা দিয়েই পেইন্ট করছে পেপারে। সাথে তারুন ব্যানার্জির ‘কাজল নদীর জলে’ গানটা গুনগুনাচ্ছে। এই গানটার অবস্থান তার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। প্রায় অবসরেই আনমনে গুনগুনায়। পেইন্টিং করতে গিয়ে সুর তুলে মৃদু স্বরে গাইছে,
“কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছল-ছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে সরিয়া,
সোনার বরণই মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।

সাঁঝের আকাশে এতো রঙ কে গো ছড়ালো
মনের বিনায় এতো, সুর কে গো ঝরালো।
কারে মালা দেবে বলে
অঝরে বকুল পড়ে ঝরিয়া..
সোনার বরণই মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।”

চয়নের ঠিক বাঁ দিকটায় বিন ব্যাগে গালে হাত দিয়ে বসে আছে সুরলা। তার মুগ্ধঘন দৃষ্টি চয়নের পানে। চয়নের মৃদুস্বরে গাওয়া গানটা তার অতীতের সেই মধুর স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে সে অতীত স্মরণ করে। তার মাঝেই আপনমনে গেয়ে ওঠে চয়নের গাওয়া গানের পরবর্তী পংক্তি,
“মনের ভ্রমর বুঝি গুঞ্জরে অনুক্ষণ
স্মিতির কমল ঘিরে ঘিরে,
যে পাখি হারায় নীড় সুদূর আকাশে
সে কি আসে কভু ফিরে।”

সুরলা কন্ঠে নিজের প্রিয় গান শুনে চমকে যায় চয়ন। বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে সুরলার পানে। সুরলা চোখ বন্ধ করে সুর তুলে একমনে গেয়ে যাচ্ছে গান। সুরলার কণ্ঠটা বেশ চমৎকার ঠেকে চয়নের কাছে। সে পেইন্ট করা থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে সুরলার গান শুনে। সুরলা খানিক থামে তারপর আবার গেয়ে ওঠে,
” শিউলি ঝরানো আজই সন্ধ্যারও বাতাসে
কে গো সাড়া দিয়ে যায় স্বপ্নেরও আভাসে।
কার লাগি দোলে ওঠে,
ক্ষণে ক্ষণে থর-থর এ হিয়া,
সোনার বরণই মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।”

এর পরই থেমে যায়। ব্যাপারটা ভালো লাগে না চয়নের। কী সুন্দর গায়ছিল, থামাল কেন! বিরক্তি থেকেই বলে ওঠে,
“থামলে কেন! কন্টিনিউ করো।”

তড়িৎ স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিরে সুরলা। চোখ খুলে তাকায় চয়নের পানে। চয়নকে বিরক্তিমাখা চেহারায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পায়। ছিঃ ছিঃ এতক্ষণ এই বেসুরো গলায় গান গাচ্ছিলাম! আমি তো ভুলেই গেছি এখানে আমি একা নই আরো একজন আছে। আমার বেসুরো গানে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে, তাই সে বিরক্তিবোধ করছে। সম্ভবত এই কারণেই মজা করে আবার কন্টিনিউ করতে বলছে। এমন ভাবনা সুরলার। সে লজ্জিত গলায় বলে,
“সর‍্যি, আসোলে আপনার গান শুনে অতীতের ছাদকাহিনী মনে পড়ে গেছে। এই গানটা আমি অতীতের স্মৃতিতে ডুবে গাই। আপনাকে বিরক্ত করলাম, সর‍্যি। আর গাইব না।”

“কেন গাইবে না? অবশ্যই গাইবে। তুমি জানো, তোমার গানের গলা কত ভালো? আর এই গানটা আমার ভীষণ প্রিয়। তোমার মুখে আমার প্রিয় গানটা শুনতে ভীষণ ভালো লাগছিল। প্লিজ কন্টিনিউ করো!” অনুরোধ মাখা গলায় বলে চয়ন। সুরলা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমার এই বেসুরো গলার গান ভালো লেগেছে আপনার! লাইক সিরিয়াসলি!”

“যদি তুমি আমার মতো করে তোমার গান শুনতে, তবে বুঝতে পারতে, ঠিক কতটা সুন্দর তোমার গাওয়া গান। আমি তো মুগ্ধ।” চয়নের দৃষ্টি এবং গলা দুটোতেই মুগ্ধটা মাখানো। সুরলা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে, তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার আনমনে গাওয়া গান চয়নকে এতটা মুগ্ধ করেছে। দ্বিধাভরা চাহনি দিয়ে আবার গেয়ে ওঠে,

“কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছল-ছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে সরিয়া,
সোনার বরণই মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।”

তবে এবার সে একা গায় নি, চয়ন ও তার সাথে গলা মিলিয়েছে। দু’জনের দৃষ্টি দু’জনাতেই আবদ্ধ। গান শেষ হতেই চয়ন প্রশ্ন করে,
” আমার মতো এই গানটা তোমারও প্রিয়?”

সুরলা লাজুক স্বরে উত্তর দেয়,
“প্রিয় থেকেও বেশি কিছু। আপনাদের বাসার ছাদে যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন আপনি পেইন্টিং করতে করতে এই গানটা গেয়েছিলেন। আপনার কন্ঠে গানটা বেশ ভালো লেগেছে আমার। বাসায় গিয়ে নেট সার্চ করে এই গানটা খুঁজে বের করে অনেক শুনেছি। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে, আর প্রিয়তা ও অর্জন করেছে। এই গানটা যতবারই শুনেছি প্রতি চরণে প্রতি শব্দে আপনাকে ফিল করেছি, তাই মনের অনেকাংশ জুড়েই এই গানের রাজত্ব বলতে পারেন। ”

সুরলার প্রিয় লিস্টের পুরোটা পরিধিতে চয়ন নিজের বিচরণ খুঁজে পায়। সুরলা এই ছোটো ছোটো অনুভূতি গুলো তার মাঝে আকাশসম ভালোবাসার জানান দেয়। সুরলার সবটা জুড়ে নিজেকে বিচরন করা দেখতে ভালো লাগে চয়নের। কারো প্রথম, শেষ এবং একমাত্র ভালোবাসা হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আজকাল এই ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় চয়নের। সে সুরলার দিকে একটা কোমল চাহনি দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। নীলাভ আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। সেই হাসিটা চোখ এড়ায় না সুরলা। চয়নের এই সুপ্ত হাসিটা তার মুখে হাসি টানে। সে কোমল গলায় বলে,
” অনুভূতিগুলোকে আকাশের কাছে প্রকাশ না করে আমার কাছে ও তো করতে পারেন। অনুভূতির লুকোচুরি খেলা বন্ধ করে প্রকাশ্যে ভালোবাসার স্বীকৃতি দিন। আমি যে মুখিয়ে আছি আপনার মনোউক্তি জানার জন্য!”

চয়ন ততক্ষণে নিজের চেহারাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। সুরলার দিকে তাকায় এক পলক। তারপর আর্টে মনোযোগ দিয়ে বলে,
“করলা বেগমদের এত কথা জানা ভালো নয়। অন্তর্নিহিত ভালোবাসার আনন্দটা প্রকাশ ভালোবাসায় পাওয়া যায় না। তাই করলা বেগমদের উচিত, কোনদিক না ঘেটে অন্তর্নিহিত ভালোবাসার আনন্দ উপভোগ করা।”

সুরলা ছোটো ছোটো চোখ করে তাকায় চয়নের দিকে। বিনিময়ে চয়ন ক্ষুদ্র পরিসরে হাসে। সেই হাসির মাঝেই পেইন্টিং শেষ করে। হ্যান্ডিং ক্লিপ থেকে পেপার ছাড়িয়ে সুরলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“দেখো কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছো আমার দিকে?কোন ভয়ডর নেই। তোমার নজর লেগে আমার গায়ে ফোস্কা পড়লে এর দায়ভার কে নিবে, হুম?”

পেইন্টিংটা হাতে নেয় সুরলা। চোখ বুলিয়ে বরাবরের মতোই অবাক হয়। চয়নের গভীর মনোযোগ দিয়ে পেইন্টিং করা আর চয়নের দিকে সুরলার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা রঙ তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে কাগজে। এই দৃশ্যটা একবারেই জীবন্ত, অনুভব করছে সুরলা। চয়নের দক্ষ হাতের নিপুণ অঙ্কন দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না সুরলা। মুগ্ধ চোখে চায় একপলক চয়নের পানে। তারপর চয়নের প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“নজর যেহেতু আমার, সেহেতু এর সাইড ইফেক্ট পূরণের দায়ভার ও আমার। আর আমার ভালোবাসাময় দৃষ্টিতে মুগ্ধতা মাখানো আছে। আমার দৃষ্টি সূচালো হিংস্রতামাখানো নয় যে আপনার গায়ে ফোস্কা পড়বে। এর পর ও যদি ফোস্কা পড়ে তবে ভালোবাসা দিয়ে ফোস্কা ফুটিয়ে সুস্থ করে তুলব। আমার কাছে আবার আপনার জন্য ভালোবাসার অভাব নেই। ”

“কিভাবে সারাবে? নমুনা দেখাও তো একটু আধটু। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ” চয়নের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। দৃষ্টি ধারালো আর গভীর। এই দৃষ্টি আর হাসিটা বেশ অর্থবহ। সুরলাকে কত কী ইঙ্গিত দিচ্ছে যেন। সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সুরলা চোখ সরিয়ে বলে,
“অভদ্র, অসভ্য, অশ্লীল।”

চয়ন ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা বজায় রেখে গেয়ে ওঠে,
“অভদ্র হ‌য়ে‌ছি আমি তো‌মা‌রি কারণে ,
তাই কা‌ছে আসো না, আরো কা‌ছে আসো না
ইশ কথা ব‌লো না, কোন কথা ব‌লো না
অভদ্র হ‌য়ে‌ছি আমি তোমা‌রি কারণে , তাই
কা‌ছে আসো না, আরো কা‌ছে আসো না।”

চয়ন স্বজ্ঞানে গানের লিরিকে ভুল করেছে। ‘প্রেমে’ শব্দের পরিবর্তে কারণে ব্যবহার করেছে। যাতে তার অনুভূতিটা কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে। চয়ন হুটহাট এমন রোমান্টিকতা দিয়ে সুরলাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা সুরলার। কোন রকম পালিয়ে গেস্ট রুমে গিয়ে মুখ লুকোয়। সুরলা পালানো দেখে চয়ন হেসে একাকার। ভালোই জব্দ হয়েছে মেয়েটা।

“করলাবেগম বের হয়ে আসুন।”
সন্ধ্যার পর চয়ন গেস্টরুমের দরজায় নক করে। দরজা আটকে ভেতরে তখনো বসে আছে সুরলা। চয়নের কথায় সুরলা চেঁচিয়ে বলে,
“আপনি লোকটা বড্ড খারাপ, আমি বের হবো না।”

চয়নের চোখ যায় পাশের দেয়ালে। একটা তেলাপোকা বসে আছে। চয়ন দরজায় ফিরতি নক করে বলে,
“দেয়ালে একটা তেলাপোকা বসে আছে। আমি এখন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি একা একা বাসায় তেলাপোকার সাথে থাকো। আমি তো ভালা না তেলাপোকা লোইয়্যা থাইকো।”

সুরলা বিশ্বাস করে না। ভাবে, চয়ন তাকে মিথ্যা বলছে। সে বেরুবে না বলে গোঁ ধরে বসে থাকে। একটা টিস্যুর মাধ্যমে তেলাপোকাটা গেস্ট রুমে ছেড়ে দেয় চয়ন। ছাড়তে দেরি সুরলার বেরুতে দেরি নেই। গেস্ট রুমের সামনে ট্রাইজারের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা সুরলার দৌড়ে এসে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ার। সে মনে মনে কাউন্ট করছে। দশ নয় আট সাত ছয়… এর পরই সুরলা এসে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। তেলাপোকা থেকে বাঁচার আকুতি জানায়। চয়ন সুরলার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসে। দুষ্টু স্বরে বলে,
“আমার থেকে পালাতে চাইলে এমনি হবে। তোমার মনে রাখা উচিত, বাসাটা আমার। আমি তোমার সাথে সাথে তেলাপোকাদের ও থাকতে দিয়েছি। তাই তারা আমার মনোভাব বুঝে কাজ করে। আর যাবে গেস্টরুমে?”

চয়নকে ঝাপটে রেখেই সুরলার জবাব, “কখনোই যাব না।”
“তবে আমাদের বেডরুমে চলো।” চয়নের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলছে। সুরলার কানে যে আবারো ভিন্ন ইঙ্গিত আসে। নিশ্চিত হতে মাথা তুলে প্রশ্ন করে,
“বেডরুমে কেন! সোফায় বসে টিভিও তো দেখতে পারি আমরা।”
“আজকাল তোমার মাথায় কি সারাক্ষণ বাসর টাসর টাইপ চিন্তা ভাবনা ঘুরে? যেভাবে প্রশ্ন করলে সেটাই মনে হচ্ছে আমার।” চয়নের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। সুরলা চয়নের বুকে মৃদু আঘাত করে চোখ রাঙিয়ে বলে,
“এই ভরসন্ধ্যায় তো আর ঘুমাব না, তাই বেডরুমের যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করছিলাম। আপনি সবসময় পাঁচ লাইন বেশি বুঝেন। ”
চয়ন হো হো করে হেসে দেয়। সুরলাকে নিয়ে বেডরুমের দিকে আগাতে আগাতে বলে,
“ঘুমাব কেন!”
“তাহলে কী করব?”
“রেড়ি হয়ে বেরুব।”
“কোথায় যাব?”
” ডিনারে যাব। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

সুরলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে ড্রেসিং সিটারে বসে মুখে প্রসাধনী মাখছে। আজ সে চয়নের দেয়া বেগুনী থ্রি-পিস পরেছে। এশ কালার শার্ট আর হোয়াইট প্যান্ট পরে রেড়ি চয়ন। এখন খাটের কিনারায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনের চোখ বুলাচ্ছে। মূলত, সে সুরলার ফেসবুক আইডি, ইন্সটাগ্রাম আইডি চেক করছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছে, এই ছবিটা কবেকার,এই ছবিতে তোমার পাশে কে। সুরলাও এক পলক তাকিয়ে জবাব দিচ্ছে। ল্যাপটপে চোখ বুলানোর মাঝেই চয়নের ফোন বেজে ওঠে। বাবা-২ অর্থ্যাৎ শ্বশুর ফোন করেছে। রিসিভ করে বেশ বিনয়ের সাথে কথা বলে চয়ন। কথা শেষ করে সুরলাকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীরমুখে বলে,
” তোমার সমস্যাটা কী বলো তো?”
সুরলা চমকায়, পেছু ফিরে বলে,
“আমার আবার কী সমস্যা থাকবে?”
“তোমার সেমিস্টার ফাইনালের যে ডেট পড়েছে সেটা আমায় বললে না কেন! বাবা না বললে তো জানতেই পারতাম না।” চয়নের কন্ঠে রাগ মাখানো। সুরলার দায়সারা জবাব,
“ওহ! এই ব্যাপার? আমি তো ইচ্ছে করে বলিনি।”
“কেন!”
“আমি এক্সাম দিব না তাই।”
“কেন দিবেনা জানতে পারি?” দাঁত চিবিয়ে বলে চয়ন। সুরলা ধীর কন্ঠে বলে,
“আমি সংসার করব, এখানেই থাকব। এসব পড়ালেখার জন্য আপনার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারব না। বিয়ের পর কত মেয়েরাই পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়ে সংসার সামলায় আমি পড়ালেখা বন্ধ করে ও সংসার সামলাব।”

সুরলার কথায় চয়ন বিস্মিত। এই মেয়ে বলে কী! যে কি-না ঠিক মতো এক কাপ কফি বানাতে পারে না সে নাকি পড়াশোনা ক্যারিয়ার ছেড়ে সংসার করবে। আজব ব্যাপার। বিছানা ছেড়ে সুরলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় চয়ন। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” তোমার কি আমাকে গাঁয়ের মানুষ মনে হয় যে, তুমি পড়ালেখা বন্ধ করে সংসার করার মনস্থ করবে আর আমি বাহবা দিব?”
“তো কী করবেন?”
“ঘর থেকে বের করে দিব এসব উলটোপালটা চিন্তা মাথায় আনলে। আমার বাসায় কোন অশিক্ষিতের জায়গায় নেই।” চয়নের কড়া জবাব।

“আপনি জায়গা না দিলে আমি শ্বশুরবাসায় চলে যাব। ”
সুরলা তখনো দায়সারা। বিরক্তিতে চয়ন স্পষ্ট বলে দেয়,
” আমার কোন বাসায় তোমার জায়গা হবে না। এরপর তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার নিজের আর খালামণির বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিবে। তবে আমি বলব, আমি তা হতে দিব না। পড়াশোনা বন্ধ করলে কোথাও জায়গা হবে না তোমার। দুই একদিনের মাঝে আমি তোমাকে ঢাকা দিয়ে আসব। মন দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিবে। আমি তোমার ভালো রেজাল্ট দেখতে চাই। ”

সুরলা জেদ চাপে। এই লোকের সাথে থাকার জন্যই সে পড়ালেখা বন্ধ করতে চাচ্ছে। কোথায় তাকে বাহ্বা দিবে, তা-না সে উলটো কড়া কথা শুনাচ্ছে! দিব না পরীক্ষা, গোল্লায় যাক পড়ালেখা, দেখি কী করে এই বদলোক। জেদ নিয়ে সুরলাও স্পষ্ট বলে দেয়,
“আমি এক্সাম দিব না, আর পড়াশোনাও করব না। এতে যদি কেউ আমায় কোন বাসায় আশ্রয় না দেয় আমি যেদিকে চোখ যায় সেদিকে বেরিয়ে যাব।”

রাগের ফুল্কি আঁকে চয়নের চোখে। এই মেয়ে গোঁ ধরে বসে আছে, সে পড়াশোনা করবেনা। এসব পাগলামীর মানে কী! এই মেয়ের মাথায় সংসারে ভুত চাপল কিভাবে! আমারই ভুল হয়ে একে চট্টগ্রাম নিয়ে এসে। আদরে আদরে বাদর বানিয়েছি আমিই। এখন ফল ভুগো। এসব ভেবে চয়ন ক্ষুদ্ধ গলায় বলে,
“ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে দিব একদম। এত উল্টোপাল্টা চিন্তা আসে কোথা থেকে? বেশি লাই পেয়ে মাথায় ওঠে গেছ। আমি কিন্তু স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, পড়াশোনার ব্যাপারে কোন হেয়ালি আমি মেনে নিব না। আমি কালই তোমাকে ঢাকা রেখে আসব। পরীক্ষায় দিয়ে ভালো রেজাল্ট আনতে পারলে চট্রগ্রাম আনব। না হয় সারাজীবন তুমি তোমার বাবার বাসাই থাকবে। আমার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে পারবে না। আমার ঘরমুখো হতে পারবে না। আমি তোমার এই বাচ্চামো জেদ মেনে নিব না কখনোই। কথাটা মনে রেখো।”

সুরলা ছলছল চোখে তাকায়। এই সামান্য পড়ালেখার জন্য চয়ন তাকে নিজের থেকে আলাদা করার কথা ভাবছে! তাও কি-না সারাজীবনের জন্য। যেই মানুষটার জন্য সে নিজের জীবন দিতে রাজি, সেই মানুষটা কি-না পড়ালেখা জন্য তাকে ছাড়তে রাজি হয়ে গেছে! পড়ালেখা দিয়ে তার ভাগ্য মূল্যায়ন করছে! পড়ালেখা করে কী হবে? এই জীবনে চাকরি বাকরি ক্যারিয়ার গড়ার কোন লক্ষ্য তো ছিল না আমার। তবে পড়ালেখা তার জন্য বাধ্যতামূলক কেন! সুরলা উঠে দাঁড়িয়ে চয়নের চোখে চোখ রেখে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে,
“আপনি পড়ালেখার জন্য আমাকে ছেড়ে দিবেন! তাও সারাজীবনের জন্য! এটা আপনি বলতে পারলেন?”

সুরলার অভিমান ভরা এই গলা, এই কথা, এই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা চয়নকে ছুঁয়ে দিতেই সে নরম হয়ে গেল। সুরলার গালে আলতো করে হাত রেখে আলতো গলায় বলে,
” তোমার অর্থহীন চিন্তাভাবনার জন্যই তো আমি এমন কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। পড়ালেখা নিয়ে আমি ভীষণ সিরিয়াস, আমার জীবনের হাজার ঝড় এসেছে কিন্তু কখনো পড়ালেখায় হেলা করিনি। আমি চাই না তুমি ও করো। পড়ালেখা করে একটা ভালো রেজাল্ট এনে সুন্দর একটা ভবিষ্যত সাজাও। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট আনো। আমি সেদিন বিকেলেই নিয়ে আসব আমার কাছে। প্রমিজ!”

চয়নের আলতো ছোঁয়ায় সুরলাও আরো বেশি গলে গেল যেন। চয়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই বলে,
“আমি আপনাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারছি না। এই সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে পেছন ফেলে যেতে পারব না।”

চয়ন সুরলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তুমি, আমি, এই সংসার সবই সবসময় থাকবে। আমাদের সুন্দর মুহুর্তে গুলো যেকোন সময় হতে পারে, তোমার পরীক্ষার পর এলে তখনো হতে পারে। আচ্ছা, তোমার সময় আরো কমালাম, শুধু এই সেমিস্টার ফাইনালটা শেষ করো। শেষ পরীক্ষার দিনই আমি ঢাকা গিয়ে নিয়ে আসব তোমাকে। মাঝে আর ক’টাদিন মাত্র। এই ক’দিন আমার উপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে স্টাডিতে দাও। আমাকে মিস করলে ভিডিও কলে দিবে। ক’টা দিনেরই তো ব্যাপার, দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আর জেদ করো না, প্লিজ কিট্টি! ”

সুরলা খানিক ভাবে তারপর বলে,
” সত্যি নিয়ে আসবেন তো!”
” বাবা বলছিল, আমাদের বিয়েটা যেহেতু একবারেই ঘরোয়া ভাবে হয়েছে, লোক জানাজানি হয় নি। তাই একটা রেসিপশন করতে। আমার মতামত জানতে চেয়েছেন, আমি হ্যাঁ না বলিনি এখনো। যদি তুমি আমার কথা মেনে চলো তবে আমি বাবাকে হ্যাঁ বলব। তোমার এক্সামের পরই হবে আমাদের রেসিপশন, ফার্স্ট নাইট ডট ডট ডট। ” চয়নের সেই ভিন্ন ইঙ্গিত। সুরলা এবারো বুকে আলতো করে আঘাত করে বলে,
“অসভ্য।”
” অল্পস্বল্প অসভ্য হওয়া খারাপ না। এখন চলো ডিনারের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার ফিরতে গিয়ে রাত হবে।”

অবশেষে সুরলা রাজি হলো। তবে তার মনে খুঁতখুঁত রয়ে গেছে। সে খুব করে চাইছে চয়ন তাকে না যেতে দিক। চোখ মুখে নিজেকে তৈরি করে নিয়ে সুরলা ডিনারের উদ্দেশ্যে চয়নের সাথে বের হয় । সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে চয়নকে পটানোর উপায় বের করে। চয়নের একহাত জড়িয়ে নেয়। কোমল গলায় প্রশ্ন করে,
” আমি চলে গেলে তুমি আমাকে মিস করবে না?”

চয়ন থেমে যায়। সুরলার দিকে তাকায়। আপনি থেকে একবারে তুমিতে নেমে গেছে! আর নিজ থেকে হাত জড়িয়ে নিয়েছে। ঘটনা কী! কোথাও এই মেয়ে তাকে পটানোর ধান্দায় নেই তো! হতে পারে। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে চয়ন আবার হাটা ধরে। সিড়ির দিকে নজর ফেলে গম্ভীর স্বরে বলে,
” আমার কাছে পড়ালেখার কাছে এই মিস টিস ঠুনকো মনে হয়। আগে পড়ালেখা তারপর বাকি সব।”

চয়নের জবাবে সুরলা হতাশ। ফিরতি চেষ্টা করে। আদুরে গলায় বলে,
“না গেলে হয় না?”
” আমি আগেই আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। মাথা থেকে এসব উদ্ভট চিন্তা বাদ দিয়ে সিড়ি বেয়ে নামায় মন দাও। আমাদের দেরি হচ্ছে।”

এবারো হতাশ সুরলা। মনে মনে চয়নকে রাজি করানোর চেষ্টায় মত্ত হয়ে দীর্ঘপথ পেরিয়ে চলে গেছে রিভারভিউ রেস্টুরেন্টে। খেতে বসে ও সুরলা চয়নকে পটানোর কম চেষ্টা করে নি। চয়নের হাতের উপর হাত রেখে বলে,
“শুনো না?”
” পড়ালেখা বন্ধ, ঢাকা না যাওয়া এসবের বাইরে কোন কথা থাকলে বলো।” খাবারে সম্পূর্ণ মনোযোগ চয়নের। সুরলা ত্যক্ত গলায় বলে,
“এমন করো কেন!”
“আমি এমনই, সে তো নতুন নয়। ”
“বিয়ের পর মানুষ স্ত্রীকে কাছপাশে রাখে আর উনি আমাকে দূরে পাঠানোর ধান্দায় আছেন। স্ত্রীবিমুখ লোক একটা।” ভেংচি কেটে বলে সুরলা। চোখ তুলে সুরলার দিকে এক পলক তাকায় চয়ন। তার হাসি পায় ভীষণ। মুখ চেপে হাসে ও। সুরলা ভাবে চয়ন গলে যাচ্ছে। সে ভালোবাসামিশ্রিত দৃষ্টি ফেলে বলে,
“ভালোবাসি তো!”

এই একটা কথা কানে বাজলে চয়নের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। সেই হাসি দিয়েই চয়ন বলে,
“জানি মিসেস। এই ভালোবাসা নিয়েই আপনাকে ঢাকা থাকতে হবে কিছুদিন।”
আবারো হতাশ সুরলা। এত রোমান্টিকতা যেন চয়নকে স্পর্শই করতে পারছে না। সুরলা ক্ষিপ্ত চাহনি দেয়। চয়ন হেসে বলে,
“তোমার কী মনে হয় তোমার চালাকি আমি ধরতে পারব না? সেই সিড়িতে হুটহাট আপনি থেকে তুমিতে নেমেছো, পুরোটা সময় ধরে উপচে পড়া রোমান্টিকতা দিয়ে আমাকে পটাতে চাইছো। তবে কী জানো, পড়ালেখার ব্যাপারে আমি একটু বেশি কঠোর। এসব রোমান্টিকতা ছুঁতে পারে না আমায়। তুমি কাল যাচ্ছো এটাই শেষ কথা।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here