কাজল নদীর জলে পর্ব-৩০

0
1170

কাজল নদীর জলে
আফিয়া আপ্পিতা

৩০.
আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই দিনটা বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরিতে কাটায় চয়ন, নয়তো রংতুলির ক্যানভাস নিয়ে আঁকতে ব্যয় করে। আজ এ দুটোর কোনটিই করা সম্ভব নয় চয়নের পক্ষে। সকাল থেকে দৌড়ের উপর আছে। সকাল সকাল ফোন করে বুয়াকে আসতে বলেছে। তারপর মাছের আড়তে গেছে। মায়ের পছন্দের পাবদা, সুরমা, আর ট্যাংরা মাছ নিয়েছে, সাথে তাদের বাবা- ছেলের পছন্দের ইলিশ আর রূপচাঁদা মাছ। মাছ বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে বুয়াও এসে পড়েছে। সারারাত ঝুম বৃষ্টির পর সকালের দিকে পরিবেশ শান্ত হয়েছে। এখন পরিবেশ বেশ স্বাভাবিক আছে। মেঘ চিরে সূর্য উঁকি দিয়েছে। বাসায় মাছ রেখে সবজি বাজারে গিয়েছে। বেছে বেছে কয়েকপ্রকার শাক সবজি নিয়ে এসেছে। বাসায় ফিরে কিচেনে গিয়ে বুয়াকে শাক সবজি সব দিয়ে কী কী রান্না করবে তা বলে দেয়। তারপর এক্সাট্রা বেড রুমের দিকে এগোয়। কাল রাতে ডিনার শেষে সুরলা এখানে এসে ঘুমিয়েছে।

ভেজানো দরজা খুলে দেখে সুরলা বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। চয়ন গিয়ে মৃদুস্বরে ডাকে,
“করলা বেগম উঠে পড়ুন। রাজ্য কার্য সব ভেসে গেল বলে।”
গভীর ঘুমে মগ্ন সুরলার কানে যায় না সে কথা। ভালো ভাবে ডেকে ও যখন ওঠানো যায় নি তখন চয়ন হ্যাচকা টান দিয়ে ওঠিয়ে বসায়। তারপর তেলাপোকার কথা বলে ঘুম ছাড়ায় সুরলার চোখ থেকে। সুরলা বিরক্ত চোখে তাকালে চয়ন হেসে বলে,
” বাবা মায়ের ফ্লাইট এগারোটায়। বারোটার মধ্যে এসে পৌঁছাবেন তারা। অলরেডি দশটা বেজে গেছে। কত কাজ বাকি। এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমালে হবে! ”

“আমি কী করব? কোন কাজই তো পারি না।” আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হতাশ গলায় বলে সুরলা।
“ঘর গুছাও, বুয়াকে সাহায্য করো। এগুলো তো পারবে। ওঠো, কুইক। নাস্তা করে কাজে নেমে পড়ো। ”
তাড়া দিয়ে চলে যায় চয়ন। সুরলা ওঠে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে যায়। কুকিজের বৈয়াম থেকে একটা কুকিজ নিয়ে চিবোতে চিবোতে বুয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বুয়া তখন ফ্লোরে বসে বটি দিয়ে মাছ কাটছে। সেদিকে খানিক পরখ করে বলে,
“আমি কী আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আন্টি?”

চল্লিশোর্ধ্ব বুয়া সকিনা বেগমের মনোযোগ ভগ্ন হয় সুরলার কথায়। চোখ উঠিয়ে তাকান কথকের দিকে। সুরলাকে দেখে ভ্রু কুঁচকান। না চেনায় প্রশ্ন করেন,
” তুঁই হন?”
চট্টগ্রাম ভাষার সাথে পরিচিত নয় সুরলা। তাই বুয়ার ভাষা বুঝতে পারে নি। উলটো প্রশ্ন করে,
“কী বলছেন?”
বুয়া আবার প্রশ্ন করে, “তুঁই হন? চয়ুইনের কিতা লাগো?বইন?”

সুরলার মনে হয় বুয়া কোন স্পেনিশ ভাষা বলছে। সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রান্নার খোঁজ নিতে চয়ন আসে রান্না ঘরে। সুরলা বলে,
“উনি কী যেন বলছেন আমি বুঝতে পারছিনা।”
চয়ন বুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“খালা, আপনি কিছু বলছেন ওকে?”

সকিনা বেগম সুরলাকে ইশারা করে বলে,
“এই মেইফোয়া হন? তুঁআর বইন?”
সকিনার কথা শেষ হতেই বুয়া কি বলছে তা জিজ্ঞেস করে সুরলা। চয়ন উত্তর দেয়,
“উনি আমাকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে।” কথাটা বলতেই সুরলা চয়নের দিকে তাকায়। চয়ন কী উত্তর দেয় সেটা দেখতে। চয়ন ও তাকায়। কী উত্তর দিবে ভেবে পায় না। বিয়ে হলেও সে এই সম্পর্কটা নিয়ে দ্বিধায় আছে, যার কারণে তার উত্তরটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে বুয়া যখন জিজ্ঞেস করে সুরলা চয়নের বোন কি-না তখন অদ্ভুতভাবে একটা খারাপ লাগা কাজ করছিল চয়নের। সুরলা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চয়নের দিকে। অপেক্ষা শুধু তাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়া। চয়ন কী তাকে অস্বীকার করবে? প্রশ্নটাও ঘুরছে মস্তিষ্কে।

তখনি মৃদু স্বরে চয়ন বলে,
” আমরা বিবাহিত। ” বাবা মা আসলে তখন যদি বুয়া না জানার ভান করে তবে মায়ের সন্দেহ হবে। তাই বলে দিয়েছে চয়ন। সুরলা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে, “ঘুরিয়ে বলবে, তাও সোজাসাপটা বলবে না, ‘ও আমার স্ত্রী।’ বদলোক একটা। ” চয়নের পানে রাগত দৃষ্টি ফেলে। বুয়া তখন অবিশ্বাস্য চোখে সুরলার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না বাচ্চামেয়েটা চয়নের বউ। তার এই অবিশ্বাস্য চাহনির পিঠে চয়ন বলে,
“খালা, ও কাজ পারে না। টুকটাক শিখিয়ে দিয়েন। ”

বুয়া সায় জানায়। চয়ন রুমে ফিরে যায়। সুরলাও বুয়ার সাথে কাজে নেমে পড়ে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ রুম থেকে চয়নের ডাক পড়ে। সাড়া দিয়ে রুমে যায় সুরলা। দেখে চয়ন খাটের কিনারায় শুয়ে বই পড়ছে। সুরলা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ডেকেছেন কেন?”
বইয়ে মুখ গুজে রেখে চয়ন জবাব দেয়,
“রেড়ি হয়ে নাও ।”
“কোথায় যাব?” পালটা প্রশ্ন করে সুরলা।
“কোথাও না।”
“তবে রেড়ি হব কেন!”
সুরলার কথায় চয়ন মুখের সামনে থেকে বই নামায়। গম্ভীরমুখে বলে,
“তোমার গেট আপ দেখে কেউ বলবে, তোমার বিয়ে হয়েছে? বিবাহিত মেয়েদের মাঝে আলাদা একটা ভাব থাকে। তোমার নিজের মাঝে সেই ভাব আনা দরকার।”
সুরলা ও হেসে পিঞ্চ মারে,
“আসোলে, আমি বিবাহিত কুমারী তো তাই বিয়ের কোন চিহ্ন বহন করি না। আমার স্বামী স্ত্রীবিমুখ মানুষ, আমার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই তার। তবে বিবাহিতদের আলাদা সেই ভাব কার জন্য আনব, বলুন? ”

সুরলা মাঝে মাঝে এমন সব কথায় চয়নকে আটকে দেয় যে চয়ন কী প্রতিক্রিয়া দিবে ভেবে পায় না। চয়নের নিরবতা দেখে পিঞ্চ মেরে সুরলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে খালামণির ভিডিও কল। চয়নের পাশে বসে ফোন রিসিভ করে সুরলা। কুশল বিনিময় শেষে রেহানা বলেন,
“হ্যাঁ রে সরু, শুনলাম আজ নাকি তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি চট্রগ্রাম যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ।
” শুন, ভদ্রভাবে থাকবি, সুন্দরভাবে কথা বলবি ওদের সাথে। ” রেহানা উপদেশ দেন সুরলাকে। সুরলা ভেংচি কেটে বলে,
“আমি সবসময় ভদ্রভাবেই থাকি। ”
“তোর ভদ্রতা দেখা হয়ে গেছে আমার। এটা কী পরে
আছিস? তুই না নতুন বউ?”
সুরলা নিজের দিকে তাকায় একবার। টপ আর প্লাজো পরে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এটা খারাপ কী? নতুন বউয়ের সাথে এই ড্রেসের কী সম্পর্ক?”
“শালীনতার সম্পর্ক। শুন, তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে ওসব টপ জিন্স পড়বি না। শাড়ি বা থ্রি-পিস পরে নতুন বউয়ের মত চলবি। ”

খালামণি ও চয়নের মতো কথা বলতে দেখে সুরলা বিরক্তি হয়। বলে,
” আমি জিন্স টপেই কমফোর্ট ফিল করি, আর শাড়ি টাড়ি ক্যারি করতে পারি না। ওসব শাড়ি তাড়ি আমার দ্বারা ক্যারি করা সম্ভব হবে না।”
“তাহলে থ্রি-পিস পরিস। ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিবি।
“থ্রি-পিস, শাড়ি কোনটাই তো আনা হয় নি। নিতু ব্যাগ গুছিয়েছে, সব ওয়েস্টার্ন ড্রেস দিয়েছে।”
রেহানা চিন্তায় পড়ে যান।
” এখন শপিংমলে গিয়ে নিয়ে আয় না হয়।”
“এখন তো সময় নেই, আন্টি আংকেল চলে আসবে কিছুক্ষণ পর। এখন যে কোন একটা পরে নিই, বিকেলে ইমারজেন্সি অনলাইন অর্ডার করে দিব, সকালের আগে বাসায় চলে আসবে।”
“তা পারিস।”
“আমি একটা ড্রেস পরে দেখাচ্ছি তোমায়, তুমি বলো ঠিক আছে কি-না।”

রেহানা সায় জানালে ফোন হোল্ড করে কাভার্ডের কাছে যায়। কাভার্ড থেকে একটা ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়। একটা লাল সাদা কম্বিনেশনর প্রিন্টেড লিলেন কুর্তির সাথে স্কার্ট পরে বের হয়। রেহানাকে দেখিয়ে বলে,
“এটা ঠিক আছে? এটা ছাড়া আর কোন লং কুর্তি নেই। ”
উত্তরে রেহানা মাথায় ঘোমটা দিতে বললে সুরলা ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দেয়। তারপর বলে,
“এবার লাগছে নতুন বউয়ের মতো? আন্টি আংকেল না বকলেই হয়।” সুরলার কথা শুনে বই থেকে চোখ উঠিয়ে এক পলক তাকায় চয়ন। রেহানা ধমকে ওঠেন,
“আন্টি আংকেল কী? শ্বশুর শ্বাশুড়িকে কেউ আন্টি আংকেল ডাকে? উনারা কী ভাববেন?”
“কী ডাকব তবে?”
“মা বাবা ডাকবি। চয়ন তোর মা বাবাকে মা বাবা ডাকে দেখিস না?”
“চয়ন তো মা বাবার অনেকবার দেখা হওয়ায় তাদের সাথে ফ্রি হয়ে গেছে। তাই ডাকতে পারে। আমার সাথে আন্টি আংকেলের দেখা হয়নি ঠিক মত তাই ফ্রি হতে পারি নি।”
“এবার আসলে মা বাবা ডাকবি। ”
“চেষ্টা করব।” সুরলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফোন রাখে রেহানা। সুরলার পাশে থাকায় সুরলা আর রেহানার কথোপকথন পুরোটাই শুনেছে চয়ন। ফোন রাখতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” আমার মা বাবার সাথে ভালোভাবে পেশ আসবে। মা বাবা যদি তোমার কোন আচরণে কষ্ট পায় তবে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না, মনে রেখো।”

চয়নের মৃদু ধমকে সুরলা কেঁপে ওঠে। এই লোক তাকে কী ভাবে! সে খারাপ? যে কি-না শুধু মানুষকে কষ্ট দেয়! সবসময় উল্টোপাল্টা ভাবনা তার। বদ লোক একটা। বিড়বিড় করে সুরলা । কলিংবেল বেজে ওঠে। আরেকবার সুরলাকে সতর্ক করে রুম থেকে বের হয় চয়ন। নিজেকে একবার আয়নায় দেখে সুরলাও যায় পেছু পেছু। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে বখতিয়ার আহমেদ, জোবায়েদা, চিবা সোফায় বসে আছে। চয়ন তাদের ব্যাগ নিয়ে গেস্ট রুমে রাখছে। সুরলা শ্বশুর শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে সালাম দেয়। সালামের উত্তর নিয়ে বসতে বলে তারা। চিবা তো সুরলাকে দেখে লাফিয়ে উঠেছে যেন। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে।
“ভাবিইই কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি ভালো তো?” হেসে বলে সুরলা। চিবা সুরলার গাল টেনে ফিসফিস করে বলে, “বিয়ের পর তুমি আরো কিউট হয়ে গেছো। ঘটনা কী?” সুরলা লাজুক হাসে। জোবায়েদার পাশে গিয়ে বসে। জোবায়েদা সুরলাকে জড়িয়ে ধরে। হেসে বলে,
“কেমন আছে আমার ছোট্ট মেয়েটা?”
জোবায়েদার কথায় সুরলার মনে পড়ে তার মা খালার কথা। তার মা খালাও তাকে দেখলে এমন আগলে নিত। মুহুর্তেই সুরলার মনে পড়ে, এটা ও তার মা-ই। আরেক মা।
সে হেসে বলে,
“ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন মা? জার্নি করে অসুস্থ বোধ করছেন না তো?” জোবায়েদা হেসে নেতিবাচক উত্তর দেয়। সুরলা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি কেমন আছেন বাবা? আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো?”
“ভালো আছি,আর আসতেও কোন সমস্যা হয়নি।” হেসে বলেন বখতিয়ার সাহেব। মেয়েটার মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনে ভিতরটায় প্রশান্তি বয়ে গেল যেন। টুকটাক কথা বলে সুরলা নাস্তা পানি আনতে যায় কিচেনে। বুয়ার তৈরি করে রাখা কয়েকপদ জুস আর স্ন্যাকস ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে যায়। ব্যাগ রেখে চয়ন ও এসে বসে সোফায়। সুরলা ট্রে সেন্টার টেবিলে রেখে সবার হাতে গ্লাস তুলে দেয়। মিষ্টিভাষায় সবার সাথে পেশ আসছে। মা বাবা বলে এমন ভাবে মিশে গেছে যেন এরা সত্যিই তার বাবা মা। ব্যাপারটা চয়নকে বিস্মিত আর অবাক দুটোয় করেছে। একটু আগে না রুমে দায়সারা আচরণ করছিল!

হালকা নাস্তা শেষে সবাই ফ্রেশ হতে যায়। চিবা এক্সট্রা বেডে আর মা বাবা গেস্ট রুমে। সুরলা রুমে না গিয়ে কোমরে কাপড় বেধে কাজে নেমে পড়েছে । কিচেন প্লেট রান্না করা ভাত তরকারী সব এনে রাখছে টেবিলে । লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। লাঞ্চ তৈরি করার তাগাদা আছে তার। বুয়া সব তৈরি করে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন বাকি কাজ একা হাতে করতে হবে। সোফায় বসে সুরলাকে লক্ষ্য করছে চয়ন। এই মুহুর্তে সুরলার মাঝে বাচ্চামোর চেয়ে একটা বউ বউ ভাব বেশি দেখতে পাচ্ছে সে। সুরলার মাঝে একটা সংসারি ভাব এসে গেছে। সকাল অবধি চয়নের মনে হয়েছে আর যাই হোক সুরলার দ্বারা সংসার সামলানো হয়ে ওঠবে না। এখন সুরলার সংসারি ভাব দেখে মত পল্টেছে। সুরলা পারবে সংসার সামলাতে।

খেতে বসে বখতিয়ার সাহেব সুরলাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
” তুমি আমাকে চিনতে পারো নি তাই না? তোমার সাথে কিন্তু আমার আগেই দেখা হয়েছে। ”

সুরলা বুঝতে পারে না শ্বশুরের কথা। এর আগে বখতিয়ার সাহেবের সাথে তার দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চয়নের দিকে তাকায়। চয়নে নিজেই বুঝতে পারছে না। সুরলা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন বলে,
“আমার জানামতে, আমাদের বিয়ের দিনই আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছে। এর আগে আপনাকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। কোথায় দেখা হয়েছে?”

“বছরখানেক আগে এক ব্যাক্তি সুগার ফল হয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে নিলে তোমরা দুইতিনজন ছেলেমেয়ে মিলে তাকে হেল্প করো। বাড়ি যেতে সাহায্য করো। মনে আছে?”
সুরলা মনে করার চেষ্টা করে। খানিক ভাবতেই ওই ঘটনা মনে পড়ে। তবে সাহায্যকৃত মানুষটার চেহারা মনে পড়ে না। সুরলা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে,
“ওই ব্যক্তি আপনি ছিলেন?”

বখতিয়ার সাহেব ইতিবাচক জবাব দেন। তারপর হেসে বলেন, “ওই ঘটনার পর তোমাদের অনেক খুঁজেছি, একটা ধন্যবাদ দেয়ার জন্য ও খুঁজে পাই নি। স্রষ্টার লিলা দেখো, যাদের খুঁজেছি তাদের একজনকে আমার ছেলে আমার কাছে এনে হাজির করেছে। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আর চয়নের কাছে কৃতজ্ঞ তোমার মতো মানবদরদী একজনকে বিয়ে করে আমার বাড়ির সদস্য করার জন্য। দোয়া করি, সদা সুখে থাকো তোমরা। সবসময় একে অপরের পাশে থেকো।”
বখতিয়ার সাহেবের কৃতজ্ঞমাখা কথায় চয়ন সুরলা একে অপরের দিকে তাকায়। সুরলা মনে প্রাণে চায় শ্বশুরের দোয়া কবুল হোক। সে চয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনার দোয়া কবুল হোক।”

খাওয়ার মাঝে চয়নের খেয়াল হয় তার পাশে বসা সুরলা খাচ্ছে না। কিছু একটা ভেবে শুধু খাবার নাড়াচাড়া করছে। চয়ন সুরলার কাছে ঘেষে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
“না খেয়ে বসে বসে কী ভাবছো?”

সুরলা তাকায় চয়নের পানে। ফিরতি প্রশ্ন করে,
“আমি যে বাবাকে ভুলে গেলাম, দেখেও চিনতে পারিনি। এর জন্য বাবা কি কষ্ট পেয়েছেন?” অপরাধী গলা সুরলার।চোখে মুখে অসহায়ত্বের চাপ। যেন সে কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। সুরলার এই নিষ্পাপ মন মানুষিকতা অবাক করে চয়নকে। এই ছোট্ট কারণে মেয়ে অপরাধে ভাসছে!
চয়ন বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবা, তোমার পুত্রবধূ তোমাকে ভুলে যাওয়ার অপরাধের অনুশোচনায় নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে বসে আছে। তুমি যদি কষ্ট পেয়ে থাকো তবে ওকে ক্ষমা করো।”

বখতিয়ার সাহেব ইলিশ মাছের মাথাটা বেছে খাচ্ছিলেন। ছেলের কথা শুনে মাথা উঠালেন। সুরলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,
“তুমি ভুল ভাবছো। আমি একটুও কষ্ট পাই নি। বছর খানেক আগে এক পলক দেখায় মনে রাখার কথাও নেই। ”
জোবায়েদা সুরলার দিকে মায়াভরা চোখে তাকিয়ে বলেন,
“এই সামান্য কথা নিয়ে তুমি খাওয়া ছেড়ে ভাবতে বসে গেলে! তোমার বাবা তোমার আচরণে কষ্ট পান নি, উনি তোমাকে পেয়েই বেশি খুশি হয়েছে।”
চিবা হেসে বলে,
“আমার সফট হার্টেড ভাবি, এতদিকে ধ্যান না দিয়ে খাও।”
সুরলার চোখে মুখে তবুও অপরাধের ছোঁয়া। সে কিভাবে ভুলে গেল। তার ভোলার অপরাধে কি চয়ন তাকে ছেড়ে দিবে? সে তো বলেছে তার বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিলে তার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। সুরলা চয়নের রিয়েকশন দেখতে চয়নের দিকে তাকায়।
চয়ন সুরলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
“দেখেছো বাবা কিছু মনে করেনি। তুমি সবসময়ই দুই লাইন বেশি বুঝো। নাও এবার খাওয়া শুরু করো।”

চয়নের হাসি সুরলাকে স্বস্তি দেয়। যাক ও কিছু মনে করেনি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খেতে আরম্ভ করে।

রাত বারোটা বাজতে চলল সুরলা এখনো রুমে আসেনি। বিরক্তিতে চেয়ে আছে চয়নের মুখ। সুরলাকে দিয়ে মশারী টাঙাবে ভেবে নিজে মশারী না টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছে। এখন মশা রীতিমতো তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজকাল মশার উৎপাত যা বেড়েছে। সারাদিন অবসরের পর বৃষ্টির দলের নুপুর পায়ে আবারও নেমেছে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। চয়ন দরজার দিকে তাকায়। সুরলা এখনো আসছে না। দুপুরের পর থেকে চিবা আর সুরলা একসাথে হাসি আড্ডায় মেতে আছে। কখনো কখনো আবার তার বাবা মাও যোগ দিয়েছে। আজ চয়ন একটা কথা ভালো করে বুঝেছে, তা হলো সুরলার মাঝে মানুষের খনিকেই আপন করে নেয়ার ক্ষমতা আছে। চিবারা এসেছে একদিন ও হয়নি। অথচ তাদের সাথে সুরলা আচরণ যেন অতি পরিচিত তারা। সুরলা আর চিবাকে দেখে যে কেউ বলবে তারা বান্ধবী। হাসি ঠাট্টায় উপচে পড়ছে, অল্প কিছুক্ষণেই সবার মন জয় করে সবাইকে আগলে নিয়ে রীতিমতো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো একটাবারের জন্যও রুমে আসেনি সুরলা। এটা পছন্দ হচ্ছে না চয়নের। বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতেই ঘুমিয়ে যায় সে। শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় হুট করেই। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় খাটের কিনারায় শোয়া সুরলার দিকে চোখ যায় চয়নের। গুটিসুটি মেরে বিড়াল ছানার মতো ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝেই চোখের পাপড়ি নড়ে ওঠছে খানিক পর পর। গোলাপি ঠোঁটজোড়ার মাঝে ফাঁক রেখে ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে মানুষকে নিষ্পাপ আর সুন্দর লাগে। সুরলাকেও সুন্দর লাগছে। চয়ন ঘুম ঘুম চোখেই চেয়ে আছে সুরলার দিকে। আকস্মিক সুরলা নড়ে ওঠে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। এতে চয়নের দৃষ্টি ভগ্ন হয়। চয়ন খেয়াল করে সুরলা খাটের একবারে কিনারায় গিয়ে শুয়েছে। আর একটু নড়লেই পড়ে যাবে। চয়ন সুরলাকে মৃদুস্বরে ডাকে,
“এই? পড়ে যাবে তো! খাটের মাঝে আসো। ”

ঘুমে মগ্ন সুরলার কানে যায় না সে কথা। সে তার অবস্থানেই অবিচল থাকে। চয়ন হাত বাড়ায় সুরলাকে কাছে টেনে নিতে। যদি সুরলার ঘুম ভেঙে যায় তখন সুরলা কি ভাববে এটা ভেবে আবার হাত ঘুটিয়ে নেয়। অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। পড়লে পড়ুক তার কী! কাছে টানতে গেলে যদি টের পায় তাহলে ঘটনা টেনে লম্বা করবে, তারপর মজা নিবে। এমনিতেই আজকাল কথায় কথায় আটকাচ্ছে তাকে। অন্য পাশ ফিরেও শান্তি পায় না। মন বলে, মেয়েটা পড়ে গেলে ভীষণ ব্যাথা পাবে। কোমরে চোট ও লেগে যেতে পারে। জেনেও একটা মেয়েকে এমন বিপদের ফেলা উচিত নয় তার। মন মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে রীতিমতো চয়ন চাপা পড়ছে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে হুট করে পাশ ফিরে সুরলাকে কিনারা থেকে মাঝে নিয়ে আসে চয়ন। চয়ন আর সুরলার মাঝে ফুটখানেকের দূরত্ব। এক পর্যায়ে সুরলা ঘুমের ঘোরে নড়ে চড়ে এসে পড়ে চয়নের বুকে। চয়ন চমকে ওঠে তাকায়। তার বুকে মাথা এক হাত দিয়ে ঝাপড়ে ধরে কী শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে মেয়েটা! রীতিমতো তাকে কোলবালিশ বানিয়ে দিয়েছে। চয়ন সরাতে চেয়েও পারে না। সুরলা ভীষণ শক্ত করে ঝাপড়ে আছে তাকে। চয়নের বুকের বাঁ পাশটা ভারী হয়। অতীতে কোন একসময় এই বুকটায় অনন্যার বাস ছিল। ধোঁকা দিয়ে চলে গিয়ে বুকটাও খালি করে দিয়েছে। তারপর থেকে তার বুকের পাঁশটায় শূন্যতা বিরাজ করেছে। চৈত্র মাসে যেমন নদী শুকিয়ে পানির জন্য খা খা করে তেমনি তার বুকের বাঁ পাশটাও ভালোবাসার জন্য খা খা করেছে। আজ এতটা বছর বাদে তার বুকটা ভারী হয়েছে। বুকের বাঁ পাশটার শূন্যতা গুলো যেন আলোতে ছায়ার মতো মিলিয়ে দিচ্ছে। চয়নের সুরলার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে, এই মেয়েটাকে কী আগলে নেয়া উচিত? এই মেয়ের মাঝেই কী তার বুকে বয়ে যাওয়া শূন্যতার পূর্ণতা লুকিয়ে আছে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here