কাজল নদীর জলে
—-আফিয়া আপ্পিতা
৩২.
বারান্দার মাঝামাঝিতে রাখা বিন ব্যাগটায় হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে সুরলা। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। নড়ার শক্তিটাও যেন নেই। কারো সাহায্য পাওয়ার আশাটা শূন্যের কোটায়। পুরো ফ্ল্যাটে একদম একা সে। আজ সকালেই বখতিয়ার সাহেব স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। তাদের এয়ারপোর্ট অবধি এগিয়ে দিয়ে এসেছে চয়ন। তারপর এয়ারপোর্ট থেকে অফিস চলে গেছে। চিবাদের যাওয়ায় বেশ মন খারাপ হয়েছে সুরলার। পুরো দশদিন থেকে তারা। এই দশটা দিন হাসি আনন্দে কেটেছে সুরলার। কত সুন্দর মুহূর্তে কেটেছে তাদের! তাদের গমনে সুরলা বিষন্ন ছিল। দরজা দিয়ে ভেতরে আসতেই হু হু করে কান্না এসে গেছে যেন। তারা ঢাকায় পৌঁছার পর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে মন হালকা করেছে। তখনি শুরু হয়েছে পেটে ব্যাথা। যন্ত্রণায় সারা বেলা চটপট করেছে। কিচেন, বেডরুম খুজেও একটা হটব্যাগ খুঁজে পায় নি।
এখন প্রায় গোধূলি লগ্ন, দুপুরের শেষ প্রহরে যে এসে এই জায়গায় বসেছে এখন অবধি নড়েনি। চয়ন ফিরে সন্ধ্যার পর। চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের লক খুলে ভিতরে এসে ড্রয়িংরুমে চোখ বুলায়। তার চোখ খুঁজছে সুরলাকে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরলে ড্রয়িংরুমে আবিস্কার করতো সুরলাকে। চয়ন টাইয়ের নাট ঢিলে করতে করতে গেস্ট রুম, কিচেন এক্সট্রা বেড চেক করে। কোথাও নেই। ধীর পায়ে এগোয় নিজের রুমের দিকে। রুমেও সুরলার সাড়াশব্দ নেই। কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে প্রথমে ওয়াশরুম চেক করে তারপর বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দায় গিয়ে সুরলাকে হাটুতে মুখ গুজে বসে থাকতে দেখে কপালে আঁকা চিন্তার ভাজ গাঢ় আকার ধারণ করে । হাতে পরা ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলে,
“কী হয়েছে করলারানী? এই ভরসন্ধ্যায় এভাবে বসে আছো কেন?”
চয়নের কথায় সুরলা মুখ তুলে। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকায় চয়নের পানে। চোখ জোড়া বর্ষার পুকুরের মতো পানিতে থৈথৈ করছে। চোখ মুখেও কেমন অসুস্থতার চাপ ভাসছে। কেঁদেছে সম্ভবত। সুরলার সেই দৃষ্টি চয়নকে যেন এলোমেলো করে দিয়েছে। সে ঝড়ের বেগে সুরলার কাছে যায়, সুরলার সামনে বসে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
“কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
সুরলা কী বলবে খুঁজে পায় না। ছলছল চোখে চেয়ে থাকে শুধু। চয়ন আবার বলে, “বাবা, মা, চিবাকে মিস করছো? এই জন্য কাঁদছো?”
সুরলা মাথা নাড়ে। চয়ন আবার জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কাঁদছো কেন? বলো?”
সুরলা পেট চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে। চয়ন অস্থির হয়ে সুরলার মাথায় হাত রাখে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
“কী হয়েছো কিট্টি? কাঁদছো কেন বলো আমায়? পেটে ব্যাথা করছে?”
সুরলা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলে,
“একটা হট ওয়াটার ব্যাগের ব্যবস্থা করতে পারবেন? ”
পেটব্যাথার সাথে হট ওয়াটার ব্যাগের কী সম্পর্ক বুঝতে পারে না চয়ন। ফিরতি প্রশ্ন করে, উত্তর পায় না। শেষে সায় জানিয়ে কিচেনে যায়। কিচেন কেবিনেটের সবচেয়ে উপর তাকে থেকে হট ওয়াটার ব্যাগ বের করে। সুরলা ওতদূর কাছ পায়নি তাই চোখে পড়েনি বোধহয়। পানি গরম করে ভরে হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে যায় রুমে। সুরলাকে ব্যাগটা দিয়ে বলে,
” চলো , আমরা হাসপাতালের যাব।”
সুরলা নড়ে না, শুধু মাথা নাড়ায়। যার অর্থ সে হাসপাতালে যাবে না। পেট চেপে চোখ মুখ খিচে বসে আছে সে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। ব্যাথাতুর চেহারাটা রক্তিম হয়ে আছে । সকালে ও কত প্রাণবন্ত দেখে গেল হুট করে কী হলো যে এমন চটপট করছে ভেবে পায় না চয়ন। সুরলার এমন চটপট দেখতে পারছে না সে। এর কারণ এবং প্রতিকার দুটোই জানতে হবে। এই ভেবে রুমে এসে নিতিকাকে কল দেয় চয়ন। রিসিভ হতেই কোন ভণিতা ছাড়া সুরলার অবস্থার কথা জানায়। নিতিকা খনিকেই সমস্যা বুঝতে পারে। উত্তর জানা থাকলেও বলতে পারে না। এমন সেন্সেটিভ বিষয় নিয়ে ছোট বোনের বরের সাথে আলাপ করতে বাধছে তার। তাই কল কেটে ম্যাসেজে জানিয়ে দিয়েছে। ম্যাসেজ পড়ে চয়ন বুঝতে পেরেছে।
সুরলার পাশে গিয়ে বসে। মৃদুস্বরে বলে,
“লাঞ্চ করেছিলে?”
সুরলা মাথা নাড়ায়। চয়ন ফিরতি প্রশ্ন করে,
“সকালে নাস্তার পর থেকে কিছুই খাওনি?”
এবারও মাথা নাড়ায় সুরলা। চয়ন বুঝতে পারে মেয়েটার যন্ত্রণার মাঝে পুরো দিন কেটেছে। সে বিরক্তিচোখে চেয়ে বলে,
“পুরো একটা দিন গেল, নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে চটপট করছো। আমাকে একটা কল দিয়ে বললে আমি কী আসতাম না? কল দিলে কেন আমায়? সবসময় নিজে যা ভালো বুঝো তাই করো। ”
সুরলা চুপ থাকে। চয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে যায়। সকালে মায়ের রান্না করে দিয়ে যাওয়া ফ্রিজভর্তি বিরিয়ানির এক বক্স নামিয়ে ওভেনে গরম করে নেয়। তারপর প্লেটে সাজিয়ে রুমে যায়। সুরলার পাশে বসে, শার্টের হাতা গুটিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“এখন চুপচাপ খাবারগুলো শেষ করবে, কোন বাড়তি কথা শুনব না আমি। এই খাবার শেষে হট মিল্ক খাবে। খালি পেটে হট মিল্ক খাওয়া ঠিক হবে না, তাই আগে ভারী কিছু খেতে হবে।”
ভাত গুছিয়ে লোকমা তুলে চয়ন, সুরলা মাথা নেড়ে অন্যদিকে ফিরে যায়। ব্যাথায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে আর সে আসছে খাবার নিয়ে। সুরলাকে খেতে না দেখে চয়ন এক ধমক দেয়। সেই ধমকে কেঁপে ওঠে কান্না থামায় সুরলা। তারপর ভীত চোখে তাকিয়ে মুখ খুলে। একপ্রকার জোর করেই খাবার খাইয়ে দেয় চয়ন। তারপর হট মিল্কের পুরো গ্লাস ও শেষ করায়। সুরলাকে কোলে করে রুমে এনে শুইয়ে দেয়। সে পাশে শুয়ে বলে,
“আমি মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা করো। ঘুমালের পেইন ফিল হবে না।”
সুরলার মাথায় পরম যত্নে বিলি কেটে দিচ্ছে চয়ন। আরাম পেয়ে সুরলার চোখে ঘুম নামে। চেহারায় এখনো ব্যাথার আভা। চয়ন সুরলার দিকে তাকিয়ে দেখে সুরলা ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। যাক, কিছু সময়ের জন্য হলেও মেয়েটা কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। চয়ন জানতে পেরেছে এই সময়টা সুরলা ভয়ানক কষ্টের মাঝে পার করে। শোনার পর থেকেই মায়া হচ্ছে তার। এই সময়টা সত্যিই কষ্টকর প্রতিটা মেয়ের জন্য। অনেক ছেলে এইসব ব্যাপার নিয়ে মজা করে। এটা চয়নের পছন্দ নয়, চয়নের মনোউক্তি হলো, এই কঠিন সময়টা সঙ্গ আর সাহস যোগাতে হয়, যাতে তাদের কষ্টটা কিছুটা হলেও লাঘব পায়। এই যে এখন সে সুরলা এত কষ্ট পাচ্ছে এর উপর যদি সে আরো মজা নিত তবে শারীরিক কষ্টের সাথে সুরলা মানষিক কষ্ট ও পেতো। তখন দুটো একসাথে সহ্য করা আরো বেশি কষ্টসাধ্য হতো। এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। মজা নেয়ার মতো কোন ব্যাপার নয়।
সময় তখন রাত দশটা। চয়ন ওঠে ফ্রেশ হয়ে সুরলার খাওয়া প্লেটে নিজেও ডিনার করে নেয়। তারপর সুরলার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে সকালে চয়নের আগে সুরলার ঘুম ভেঙেছে আজ। চোখ খুলে নিজেকে চয়নের বুকে আবিস্কার করে। কাল রাতে চয়নের কেয়ারের কথা মনে পড়তেই মুচকি হাসে। মানুষটা তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। মুচকি হেসে ওঠে ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় যেতে নেয়। সকালটা কাছথেকে দেখবে আজ। ঘুমানোর ফলে ব্যাথার তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে কিছু সময়ের জন্য। হুটহাট শুরু হবে আবারও। বারান্দায় যেতে গিয়ে কী ভেবে আবার বেড়ে ফিরে আসে, চয়নকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়ে।
তারপর চয়নের বুকে মাথা রেখে নিজের পিঠে চয়নের হাত রেখে বলে,
“এভাবেই সারাজীবন আমাকে আঁকড়ে রাখবে, তোমার বুকবালিশে আমাকে ঘুমাতে দিবে, আমার বিষন্নতায় সঙ্গ দিবে। তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতে শুধু আমার ভালোবাসাময় স্মৃতির জায়গায় দিবে, সেখানে কোন অতীতের জায়গা দিবেন না। তুমি মানুষটা শুধু আমার, কথাটা সবসময় মাথায় রাখবে ঠিক আছে?”
ঘুমন্ত চয়ন থেকে কোন উত্তর আসে না। সুরলা মাথা তুলে চয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আরো একটা কথা মনে রাখবে। তা হলো, তোমার কিট্টি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তোমার ও কিট্টিকে ভালোবাসতে হবে। মনে থাকবে?”
এবারও চয়ন থেকে উত্তর আসে না। সুরলা চয়নের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আলতো করে চয়নের গাল ছুঁয়ে বলে,
“আমার বরটা কত কিউট! ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি।”
সুরলার ছোঁয়ায় চয়ন নড়ে ওঠে। সুরলা চোখ বন্ধ করে নেয়। খানিক পরে পেটে ব্যাথার তীব্রতা অনুভব করে। সুরলা চোখ মুখ খিচে দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে থাকে। হটব্যাগটা দরকার এই মুহূর্তে। কিন্তু হটব্যাগ এখন কুল ব্যাগে পরিণত হয়েছে। ব্যাথায় টিকতে না পেরে ওঠে পড়ে সুরলা। কিচেনে গিয়ে চুলোয় পানি বসায়। শ্বাশুড়ি আর বুয়ার কাছ থেকে এই ক’দিন রান্নার বেশ কিছু অংশ আয়ত্ত্ব করে নিয়েছে। আজকাল আর হাত পুড়েনা। চুলোয় পাতিল বসিয়ে সিঙ্কের পাশে চোখ মুখ খিচে দাঁড়িয়ে আছে সে। ব্যাথাটা হজম করার চেষ্টায় মগ্ন। মিনিট পাঁচেক পরে চুলো বন্ধ করার শব্দে চোখ খুলে তাকায়। দেখে চয়ন চুলো থেকে পানি নামিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগে ভরছে। সুরলা এগিয়ে গিয়ে বলে,
” আপনি ওঠে এলেন কেন? দিন আমাকে দিন, আমি করে নিতে পারব।”
নিজের কাজে মগ্ন থেকে চয়ন বলে,
“আমাকে জাগিয়ে হটওয়াটারের কথা বললে আমি কি এনে দিতাম না? একা ওঠে এলে কেন!”
“আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই বিরক্ত করিনি।”
“আমার ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ যখন আমার গাল ছুঁয়ে ভালোবাসার বাণী শুনায়, আমাকে খেয়ে ফেলার মনস্থ করে, তখনো কিন্তু আমি বিরক্ত হই। ”
সুরলার দিকে না তাকিয়ে বলে চয়ন। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে সুরলা। লোকটা কী বদ, ঘুমের ভান করে আমার কথা শুনছিল! বদলোক একটা! চয়ন চোখ তুলে তাকায় সুরলার পানে। চেহারায় বিষন্নতার পাশাপাশি লজ্জার আভা দেখে সে। মুচকি হেসে বলে,
” আবার লজ্জা পাচ্ছে দেখো! যেকাজে দ্বিধা থাকার কথা সে কাজে দ্বিধা নেই আর যেই কাজে দ্বিধা থাকার কথা নেই সেই কাজে তার হাজার দ্বিধা কাজ করে। অদ্ভুত! ”
সুরলা তখনো মাথা নিচু করে রেখেছে। চয়নের পানি ভরা শেষ। লাল মকমল কাপড়ে মোড়ানো ওয়াটার ব্যাগটার সাদা ক্যাপ লাগিয়ে সুরলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আমার বিরক্তির পরিধি জেনে নিবে, অতি প্রয়োজনীয় কাজে আমি বিরক্ত হই না। আর এই মুহুর্তে তোমার চেহারা থেকে ব্যাথার আভা সরানো আমার জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় কাজ। মনে থাকবে?”
সুরলার মতই টেনে বলে চয়ন। ওয়াটার ব্যাগ হাতে নিয়ে সুরলা ঠোঁট চেপে লাজুক হেসে মাথা নাড়ে।
★
সকাল সাড়ে নয়টা, সোফায় বসে টিভি দেখছে সুরলা। চয়নের মতে, মাইন্ড ডাইভার্ট করলে পেইন ফিল হবে না। তাই টিভি ছেড়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিচে গেছে নাস্তা আনতে। বুয়া রান্নাঘরে কাজ করছে। আজ সরকারি ছুটি, তাই চয়ন অবসরে আছে। টিভিতে ফ্রেন্ডশিপ স্পেশাল একটা গান চলছে। গানটা দেখে সুরলার মনে পড়ে তার বন্ধুদের কথা। পিয়াম রাশনার সাথে কথা হয়না অনেকদিন। আজ কথা বলা যাক। সুরলা ঝটপট তাদের তিনজনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভিডিও কল দেয়। ঘুমে বিভোর রাশনা ফোন তুলে না, পিয়াম ফোন তুলে। সুরলাকে দেখে বলে,
“বিবাহিত মহিলা কী অবস্থা আপনার? দিন কাল কেমন যায়?”
” স্বামী, সংসার নিয়ে ভালোই যাচ্ছে ।” হেসে বলে সুরলা। পিয়াম জিজ্ঞেস করে,
“চয়নের বিহেভিয়ার চেঞ্জ হয়েছে? রাফ বিহেভ করে এখনো?”
“না একবারেই চেঞ্জ হয়ে গেছে, রীতিমতো ভালোবাসতে শুধু করেছে।” লাজুক হেসে বলে সুরলা। পিয়াম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
” এটা তো হওয়ারই ছিলো, এত ভালোবাসা কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে। কটা দিন বাদে দেখবি,তোর প্রেমে মগ্ন হয়ে পূর্ব পশ্চিমে তোকেই দেখবে। আমি সবসময় দোয়া করি, তোরা অনেক ভালো থাক। ”
সুরলা হাসে ফিরতি।
পিয়াম সতর্ক করে দেয়,
“এবার ঢাকা এলে কিন্তু ট্রিট দিবি, লুকিয়ে বিয়ে করে দাওয়াত ও দিস নি। এর শাস্তি সরূপ তোর বরের পকেট খালি করব।”
“করিস।”
সুরলা পিয়ামকে পরখ করে দেখে বলে,
“এই সাত সকাল ফরমাল লুকে যাচ্ছিস কই?”
“ডেটে যাচ্ছি।”
“তুই আর ডেট কেমনে কী? মেয়েটা কে?” প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসে সুরলা। পিয়াম লাজুক স্বরে বলে,
“আমার ক্রাশ অদিতি, তিনদিন আগে প্রপোজ করেছি। কাল হ্যাঁ করেছে আজ প্রথম ডেটে যাচ্ছি।”
“ট্রিট কিন্তু দিয়ে দিবি!”
“সে না হয় দিব। তার আগে বল কেমন লাগছে আমায়?” ফোন দূরে নিয়ে নিজেকে দেখায় পিয়াম।
সুরলা সুইট সাইন দেখিয়ে বলে,
” বেশ সুন্দর লাগছে, একদম ফিদা ফিদা ভাব। কারো নজর না লেগে যায়!”
পিয়াম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসে। চয়ন মাত্র বাসায় ফিরেছে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছে তার দিকে পিঠ করে সোফায় বসে সুরলা কোন ছেলের সাথে কথা বলছে। সুরলার শেষের কথাটা তার কানে এসেছে। পিয়ামের হাসিটাও চোখ এড়ায়নি তার। কেন যেন তার রাগ হলো ভীষণ। বেশ শব্দ করে সদর দরজা লাগায়। সুরলা চমকে তাকায়। দেখে চয়ন অগ্নী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। চয়নের মতি গতি ভালো ঠেকে না সুরলার কাছে। আবার পিয়ামের সামনে না কিছু করে বসে। তাই দ্রুত কথা শেষ করে কল কেটে দেয়। চয়ন ততক্ষণে সেন্টার টেবিলের উপর নাস্তা রেখে সুরলার পাশে সোফায় বসেছে। সুরলা বলে,
“মুখটা এংরি বার্ডের মতো বানিয়েছেন কেন? কী হয়েছে? রাস্তায় আবার এক্সের দেখা পেয়েছেন?” সুরলার কথাটা রগড়মাখা। চয়ন কন্ঠে গম্ভীরতা মাখিয়ে বলে,
“ছেলেটা কে ছিল?”
“কোন ছেলে?”
“একটু আগে যার সাথে ভিডিও করে হেসে হেসে কথা বলছিলে? আর যাকে দেখে ফিদা হচ্ছিলে?” ক্ষিপ্ত গলায় বলে চয়ন। চয়নের রাগের কারণ সে কোন ছেলের সাথে কথা বলেছেম এর মানে চয়ন জেলাস? জেলাসী থেকেই রাগ করছে! ভাবতেই মৃদু হাসে সুরলা।
তারপর আগুনে ঘি ঢেলে বলে,
“একটু আগে পিয়ামের সাথে কথা বলছিলাম। ওকে দেখে তো আমি ফিদা। কী হ্যান্ডসাম লাগছিল তাই না? হায় মে মারজাবা।”
চয়নের দৃষ্টিতে তীক্ষ হয়। দাঁত চিবিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলে,
“এত ফিদা হলে আমার সামনে এসে ভালোবাসার ঢং করো কেন? যাও ওর কাছে। ওকেই ভালোবাসার বাণী শুনাও।”
“সত্যিই যাব? আপনি অনুমতি দিলে আমি ওকে আসতে বলব। পিয়াম এসে নিয়ে যাবে আমায়। ” খুশি হওয়ার ভান করে সুরলা। চয়ন ক্ষিপ্ত গলায় বলে,
” আসোলে তোমরা সব মেয়েই একরকম। তোমাকে ভালো ভেবে আমার ভুল হয়েছে। তুমি ও অনন্যার মতোই। একজনের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে অন্যজনের সাথে যাবার মনস্থ করো। আমি তোমায় আটকাব না, খুব দ্রুত ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দিব। তারপর যেখানে যাওয়ার যাও। তবে দয়া করে আমার স্ত্রী থাকা অবস্থায় যেও না, ‘চয়নের বউ অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছে’ এই রটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আমার সম্মান যাবে। যেতে যেতে অন্তত আমার সম্মানটা বাঁচিয়ে যাও!” বলে ওঠে দাঁড়ায়।
সুরলা দেখে অবস্থা বেগতিক। মজা করতে গিয়ে সাজা হয়ে যাচ্ছে। চয়ন রীতিমতো তাকে অনন্যার সাথে তুলনা করে ডিভোর্সের কথা ভাবছে। এই ব্যাপার এখানেই সমাধান করতে হবে, না হয় রাগে চয়ন সত্যিই ডিভোর্স দিয়ে দিবে। সুরলা চয়নের হাত ধরে আটকায়। বলে,
” আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন অথচ স্বীকার করেন না কেন!”
“হাত ছাড়ো, যাকে ধরার তাকে ধরো। আমার সামনে আদিখ্যেতা দেখাতে আসবে না।” হাত ছাড়িয়ে সুরলার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে চয়ন। সুরলা হেসে ফোন হাতে নেয়। পিয়ামকে ফিরতি ভিডিও কল দেয়। তারপর চয়নকে টেনে বসায় পাশে। চয়ন রেগে তাকায়।
সুরলা হেসে বলে,
“আপনার জেলাসির রহস্য উন্মোচন হবে এখন। আপনার যার জন্য আমাকে ভুল বুঝে ডিভোর্স অবধি চলে গেছেন সে আমার বন্ধু। ভাইয়ের মতোই বন্ধু। ওর সাথে কথা বলায় আপনার রাগ দেখে আমার ভালো লাগছি। কী পরিমাণ জেলাস হলে মানুষ এতটা রিয়েক্ট করে সেটা দেখতেই মজা করছিলাম। এ ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্বাস না হলে এখন পিয়ামের সাথে কথা বলে দেখুন।”
চয়ন রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিয়াম কল রিসিভ করে। বিরক্ত স্বরে বলে,
“প্রথম ডেটে যাচ্ছি, এত বিরক্ত না করলে তোর হচ্ছিল না? শান্তিমত ডেটটাও করতে দিবি না নাকি!”
সুরলা চয়নের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“এই তুই আমাকে কী ভাবিস?”
“মানে কী?”
“মানে তোর সাথে আমার কী সম্পর্ক?”
” অনেক কষ্টে ক্রাশকে পটিয়ে প্রথম ডেটে যাচ্ছি, তুই আজাইরা কথা বলে মাথাটাকে এলোমেলো করিস না। কুল থাকতে দে, আমি অদিতির সাথে কিভাবে কথা বলব সেটা ঠিক করছি। বিরক্ত করবি না একদম। তোর সব আজগুবি কথার জবাব পরে দিব, এখন ফোন রাখ।” বিরক্ত নিয়ে বলে পিয়াম। ফোনটা সুরলার মুখের সামনে ধরায় চয়নকে দেখতে পারছে না পিয়াম।
সে কল কাটতে নেয়, সুরলা চেঁচিয়ে বলে,
” আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কল কাটবি তো অদিতি তোর সাথে ব্রেকাপ করবে, আমি অভিশাপ দিলাম। ”
“এই তুই আমার বন্ধু না-কি শত্রু হ্যাঁ? বন্ধু প্রথম ডেটে যাচ্ছে গুডলাক জানাবি তা না করে অভিশাপ দিচ্ছিস?” পিয়ামের কন্ঠে রাগ।
“অভিশাপ ফিরিয়ে নিব যদি উত্তর দিস। সারাদিন আর বিরক্ত করব না তোকে, প্রমিজ”
খুশিমনে পিয়াম উত্তর দেয়,
“তুই আমার বন্ধু বোন সুখ দুঃখের সাথী সব। তোকে আমি আমার বোন ভাবী, বন্ধু ভাবী, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবী, আমাকে পথের দিশা দেখানো নাবিক ভাবী। আর…
” আর?” উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে সুরলা। পিয়াম হেসে বলে,
” লিলিফুট হয়েও সুপারী গাছের উপর ক্রাশ খাওয়া পাগল ভাবী, যে কি-না ক্রাশ টেক্সটের রিপ্লাই দিতে দেরি হওয়ায় ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ভাসাতে পারে, ক্রাশকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাটতে গিয়ে রাস্তায় উষ্ঠা গেছে গুষ্টি ভুলে যেতে পারে। যে কি-না ক্রাশকে গালি দিয়ে নিজেই নিজেকে বকতে পারে। যে কি-না ক্রাশকে খুঁজে পেয়ে খুশিতে নাঁচতে গিয়ে কাজিনের খোঁচা খেয়ে কাজিনের চুল টেনে ছিড়তে পারে। এক কথায় পাগল ভাবী আমি তোকে, চয়নের প্রেমে পাগল মেয়ে। হয়েছে? নাকি আরো শুনবি? ”
“হুম, বাই। অল দ্যা বেস্ট।” ফোন কাটে সুরলা। সে ভেবেছিল পিয়াম দুই এক কথায় বন্ধুত্ব বা বোনের সম্পর্ক বুঝাবে। কিন্তু পিয়াম যে এভাবে রহস্যের ভান্ডার খুলে বসবে ভাবেনি সে। চয়নের সামনে তার পাগলামি গুলো সামনে আসায় লজ্জা হচ্ছে খানিক। পাশে বসা চয়নের দিকে তাকায়। সে চয়ন রেগে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুরলা লজ্জা সংবরণ করে ভ্রু কুঁচকে বলে,
” দেখলেন তো, পিয়াম আমাকে কী ভাবে? আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কোন সম্পর্ক নেই আমাদের। আমি এবং পিয়াম একে অপরকে ভাইবোনের মতো বন্ধু ভাবি, তা নিজে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। তাও মুখ লটকিয়ে রেখেছেন কেন?”
চয়ন নিশ্চুপ। মুখটা তখনো গম্ভীর। সুরলা চয়নের হাত ধরে বলে,
” আমি শুধু আপনার জেলাসী দেখে মজা নিচ্ছিলাম, আর কিছুই নয়। ও ডেটে যাচ্ছিল, কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করায় আমি ওই কমেন্ট করেছি। সেটা বোনের দৃষ্টি থেকেই। ব্যাপারটাকে অন্যদিকে নিবেন না প্লিজ!”
“আমি চাইনা কারো আচরণে আমার অতীত মনে পড়ুক, সে সেটা কারো মজা বা সিরিয়াসে। কথাটা মাথায় রাখবে।” গম্ভীরমুখে বলে চয়ন। সুরলা নিজের অজান্তে চয়নের অতীত টানায় অনুশোচনায় ভুগে। চয়নকে মানাতে কান ধরে বলে,
“সর্যি, আর বলব না। এইবারই শেষ। ”
চয়ন গম্ভীরতা বজায় রেখে উঠে চলে যায় রুমে। সুরলা হটব্যাগ হাতে অনুসরণ করে তাকে। চয়ন সোজা বারান্দায় চলে যায়। সুরলা খাটে হেলান দিয়ে বসে। এতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকায় পেটের ব্যাথা অনুভব না হলেও এখন বেশ টের পাচ্ছে। চোখ মুখ খিচে পেটে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। খানিক পরেই মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পায়। চোখ খুলে দেখে চয়ন তার পাশে বসা। চোখে মুখে গম্ভীরতা ভেসে আসছে। ঠোঁটের কোণে হাসিটা মিস করছে সুরলা। চয়নের ব্যাথা নিয়েও মুচকি হাসে সুরলা। চোখ মুখ খিচে রেখেই বলে,
“সর্যিই, আর এমন হবে না। প্লিজ একটু হাসুন, আপনাকে গম্ভীরভাবে মানায় না। হাসলে সুন্দর লাগে আপনাকে। আপনাকে হাসতে দেখলে আমার গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে।”
সুরলার কথার কিভাবে যেন রাগ পড়ে যায় চয়নের। চেহারা থেকে গম্ভীরতা সরে যায়। সুরলার মাথায় বিলি কেটে বলে,
” নিজে ব্যাথায় কারতাচ্ছে, তাও পড়ে আছে আমার হাসির চিন্তায়। তোমার কষ্ট দেখে আমার হাসি আসছে না।”
” এই কষ্টময় মুহুর্তে আমি প্রতি মাসে বয়ে বেড়াই। এটা নতুন নয়। আপনার এতদিকে ধ্যান দিতে হবে না, আপনাআপনিই সেরে যাবে এ ব্যাথা। আপনি হাসুন, আপনার হাসিটাকে মিস করছি।” আবদারের সুরে বলে সুরলা। চয়ন কৃত্রিম হাসি দেয়। সুরলাও মৃদু হাসে। চয়ন হুট করেই বলে,
” নিতুর সাথে তোমার চুল টানাটানির রহস্য আজ বুঝতে পারলাম। সামান্য একটা কারণে কেউ এমন করে?”
“আমি করি।” হেসে বলে সুরলা। চয়ন ও হেসে বলে,
“আমার জন্য পাগলামী না করলেও পারতে।”
“আপনার জন্য পাগলামী করেছি বলেই আপনাকে পেয়েছি।” কোমল গলায় বলে সুরলা। চয়ন হেসে ওঠে বলে, “আচ্ছা!”
কিছু সময় মানুষের মনে হয়, প্রিয়জনের হাসিমাখা মুখটা দেখলে সব ব্যাথা নিঃশব্দে সহ্য করা যায়। এই মুহুর্তে সুরলার ঠিক তাই মনে হচ্ছে। সে অপলক তাকিয়ে থাকে চয়নের পানে। চয়নের হাসির আড়ালে থাকা অস্থিরতা দেখতে ভালো লাগছে তার। এই অস্থিরতা সে সময় দেখতে চায়। সুরলা চয়নের বুকে মাথা রাখে। মৃদুস্বরে বলে,
“ভীষণ ভালোবাসি।”
সুরলার মৃদুস্বরে বলা কথাটা কান এড়ায় না চয়নের। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। অতীতে ভালোবাসার মানুষটার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনে যেমন ফিল হয়েছে আজও তেমনি ফিল হচ্ছে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় সে। ঠোঁটের কোণে হাসির দলেরা উঁকি দিয়েছে। আজকাল চয়নের অবাক লাগে, না চাইতেও মেয়েটা একটু একটু করে কিভাবে তার মনটা দখল করে নিচ্ছে, নিজের মাঝে জমিয়ে রাখা অগাধ ভালোবাসা ছুঁয়ে দিয়ে তাকেও ভালোবাসতে বাধ্য করছে যেন। এই যে পিচ্ছি মেয়েটার চেহারা থেকে হাসিটা সরলেই তার মাঝে অস্থিরতা তৈরি হয়, কারণ জানতে, এর প্রতিকার করতে মন আঁকুপাঁকু করে। এই অস্থিরতা ততক্ষণে শেষ হয় না যতক্ষণ না মেয়েটার ঠোঁটের কোণে হাসি ফিরে আসে। সুরলাকে যে সে ভালোবাসতে শুরু করেছে সেটা এতদিন বিশ্বাস না করলেও একটু আগে পিয়ামের সাথে কথা বলতে দেখে নিজের মাঝে ফুটে ওঠা রাগ দেখে বুঝতে পেরেছে। সুরলা যখন পিয়ামের সাথে হেসে কথা বলছিল তখন সে এক মুহুর্তের জন্য ভেবেছে অনন্যার মতো সুরলাও তাকে ধোকা দিয়ে ছেড়ে চলে যাবে। তার ভিতরটা হারানোর ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল বলেই সুরলাকে ওতগুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যখন সুরলা নিশ্চিত করল পিয়ামের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই আর পিয়াম ও তা প্রমাণ করল তখন চয়নে খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করেছে। তার মনে হয়েছে, এর থেকে বেশি খুশি আর কখনো হয় নি। তাও যাতে আর কখনো এমন মজা না করে তাই গম্ভীরতা ভান করে থেকেছে। কিন্তু এই পুচকে মেয়েটা সেটা কখনোই হতে দিবে না। নিজের অসুস্থতার মাঝেও নানান কথায় ফেলে তাকে হাসিয়ে ছেড়েছে। নিজের অসুস্থতা থেকে চয়নের হাসিটা তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাগলী একটা! কথাগুলো ভেবে আনমনে হাসছে চয়ন। নিজের অজান্তেই সুরলাকে আকঁড়ে ধরেছে।
চলবে…