কাজল নদীর জলে শেষ পর্ব-

0
1986

কাজল নদীর জলে
—আফিয়া আপ্পিতা

৩৫.
কন্ঠটা অতি পরিচিত ঠেকে সুরলার কাছে। এই কন্ঠীমানবের বিচরণ তার হৃদয়ের নিগূঢ়ে। সুরলার অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ” চয়ন!”
সেই মুগ্ধঘন স্বরটা ভেসে আসে আবারও, “হ্যাঁ, চয়নই এসেছে করলা বেগমের দ্বারে।”

তড়িৎ পেছনে ফিরে সুরলা। চয়নের কন্ঠ কানে যেতেই ভূতের ভয় কেটে গেছে। পেছু ফিরতেই চয়নের বুকে বাড়ি খায়। নিজেকে সামলে চয়নের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। চয়নের গভীর দৃষ্টি তার পানে। সুরলার বিশ্বাস হয়েও যেন হচ্ছেনা এতদিন বাদে চয়ন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সত্যতা যাচাই করতে, চোখ কচলে ফিরতি তাকায় সে। হ্যাঁ, এখনো চয়নই দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সুরলার তাকানো দেখে চয়ন ছোট্টো করে বলে,
“সর‍্যি।”

এই ক্ষমা প্রার্থনাসূচক উচ্চারিত শব্দটাই সুরলাকে পুরোনো সব কথা মনে করিয়ে দেয়। কিভাবে চয়ন তাকে ধমকেছে, তার অনুভূতিকে মূল্যহীন করেছে, তার ফিরে আসায় বিন্দাস লাইফ লিড করেছে সবটা চোখে ভাসে যেন। সিন্ধুকভর্তি জমানো রাগ আর ক্ষোভেরা তালা ভেঙে বেরিয়ে আসার আকুতি জানায়। সুরলা তাদের নিজ হাতে মুক্তি দেয়, তারা নয়া উদ্যমে বেরিয়ে আসে। সুরলার চেহারায় রাগের আভা ফুটে ওঠে, গলাটা হয়ে ওঠে ক্ষিপ্ত,
” কেন এসেছেন এখানে? বিন্দাস লাইফ লিড করা শেষ? নাকি এখনো বাকি আছে! সেটার শো অফ করতে আসছেন?”

চয়ন সুরলার গালে আলতো করে ছুঁয়ে কিছু বলতে চায়। সুরলা এক ঝটকায় হাত ঝেলে ফেলে তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে কড়া গলায় বলে,
“দূরে থাকুন। আপনার মতো হার্টলেস মানুষকে দেখলে আমার রাগ আসে। অসভ্য লোক! এতদিন একটা কোন খোঁজ নেই খবর নেই এখন এসেছে আদিখ্যেতা দেখাতে। আমি চট্রগ্রাম থেকে চলে এসেছি সেই খুশিতে উনি পার্টি করেছেন, বন্ধুদের সাথে চিল করেছেন। এখন আমার কাছে কেন এসেছেন? বন্ধুরা সব হাওয়া হয়ে গেছে! যান বন্ধুদের নিয়ে চিল করুন, ব্যাচলর লাইফ লিড করুন।”

“আমি তো এসব তোমার জন্য করেছি।” কাতর গলায় বলে চয়ন।”
সুরলা প্রতিবাদ করে ওঠে মুহুর্তেই,
” মোটেও আমার জন্য এসব করেননি, সব নিজের জন্য, নিজের মন থেকে করেছেন। আপনি কখনো আমায় ভালোই বাসেন নি। বাসলে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারতেন না। চট্রগ্রাম থাকতে ভালো সাজার অভিনয় করেছেন, এখনো করছেন। আপনি পুরনো সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানুষটাই আছেন, যে কি-না নিজের এক্সের কথা ভেবে কাউকে কষ্ট দিতে দ্বিধা করে না। আপনি একটা হার্টলেস মানুষ, নিষ্ঠুর, জঘন্য।”

চয়ন আবারও সুরলাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, ” সর‍্যি তো! আমাকে কথা বলার সুযোগ দাও। আমার এইসব করার পেছনে কারণটা বলতে দাও, প্লিজ কিট্টি!” চয়নের অনুরোধ সুরলার মন অবধি যায় না। অভিমানে মনটা যে ঢাকা পড়েছে! অভিমান গুলো দলা বেধে রাগে পরিণত হয়েছে। রাগটা এখন মাথাচাড়া। খানিকটা চেঁচিয়ে চয়নকে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে,
“আপনার কোন কথা শুনব না আমি, চলে যান এখান থেকে। বন্ধুদের সাথে বিন্দাস থাকুন। আপনার কো সর‍্যি আমি গ্রহন করব না। আপনার সর‍্যিকে আমি….

থেমে পাশে তাকায়। বিছানায় থাকা টেডিবিয়ার আর বুকির দিকে নজর যায়। টেডিবিয়ার আছাড় মারে ফ্লোরে।
” এইসব নিয়ে এসেছেন আদিখ্যেতা করতে! অপমান করে আবার সর‍্যি বলতে আসছে! এ যেন জুতা মেরে গুরুদান। আপনার সর‍্যিকে আমি কুচি কুচি করি।” বুকিতে তাজা গোলাপ ছিল। একটা নিয়ে ছিড়তে শুরু করে। তারপর চয়নের সামনেই ছুড়ে মারে ফ্লোরে। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে চয়নের। সুরলার দিকে তেড়ে এসে কাধ চেপে ধরে শক্ত করে।
ধমকে ওঠে,
“একদম চুপ, আর একটাও বাজে কথা যেন না শুনি। সেই কখন থেকে একা বকবক করে যাচ্ছো। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছো না। সমস্যা কী তোমার? আমাকে রাগাতে ভালো লাগে? আমার হিংস্রতাকে আমন্ত্রণ জানাতে ইচ্ছে করে? আমার ভালো থাকাটা তোমার সহ্য হয় না?”

সুরলা চয়নের বাধন থেকে ছুটে যেতে চেষ্টা করে। ফিরতি ধমক দেয় চয়ন,
“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো, নড়াচড়া ও করবে না। আমার পুরো কথা শুনবে, আমি কথা বলতে বললে তখন কথা বলবে। নয়তো নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ব নাকে। তুমি আসোলে ভালো কথা শুনার মানুষ নও, ধমক ছাড়া কথা শুনো না। আমি এখন কোমল আছি, আমাকে কোমল থাকতে দাও, হিংস্র করো না। এমনিতেই গত একটা মাসে এক মুহূর্তের জন্য শান্তি দাও নি আমায়। আমার সব শান্তি কেড়ে বিরহ উপহার দিয়েছো। ”

নিকোটিনের ধোঁয়ার কথায় চয়ন রেগে তাকায়। কত বদলোক। তাকে আবার হুমকি দিচ্ছে! শেষ কথা শুনে প্রশ্নবোধক চাহনি দেয়। সে কিভাবে চয়নের শান্তি কেড়েছে! সুরলার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির জবাবে চয়ন ধীর গলায় বলে,
” তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার, তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ, বিন্দাস লাইফ লিডের শো অফ এসবের পেছনে ছিল তোমার পড়ালেখা। তুমি আমার কথা ভেবে ভেঙে পড়ছিলে, সারাদিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে কাঁদতে শুধু। সামনে পরীক্ষা, তুমি পড়ালেখায় ছিলে অমনোযোগী। এভাবে চলতে গেলে তুমি রেজাল্ট খারাপ করতে সেই সাথে অসুস্থ ও হয়ে পড়তে। এসব আমার ভালো লাগত না। যাতে তুমি আমার কথা মাথা থেকে নামিয়ে পড়ালেখায় মন দিতে পারো তাই এই টুকটাক অভিনয় করেছি। ফোন দিয়ে সেদিন যখন কাঁদছিলে, তখন আমার ভিতরটা ফেঁটে যাচ্ছিল যেন। আমি নিজেই ঠিক থাকতে পারছিলাম না। তাও নিজেকে শক্ত করে অভিনয় করেছি।”

চয়নের কথায় সুরলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। ভাবছে চয়নের লজিকে তার কান দেয়া উচিত না-কি নয়! চয়নের গলা এতক্ষণে নরম হয়ে এসেছে। নরম গলায় বলে,
“আর সেদিন ভিডিও কলে বলা বন্ধুর পার্টির কথা ছিল মিথ্যা, বানোয়াট। কফি আর পপকর্ণ এ হাত ও দেয় নি আমি। বিষন্নমনে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার অবস্থানটা যদি তুমি টের পেতে! আমার ইন্সটা ফেসবুকে পোস্ট করা ছবি গুলো সব আমাদের বিয়ের আগের তোলা। তোমার বিষন্নতায় ঘুরতে যাবার কথা বা বিন্দাস থাকার কথা মাথায় আসেনি। গুগল ড্রাইভ থেকে নিয়ে আপলোড দিয়েছি, আমি জানতাম তুমি ঠিক অন্যকারো আইডি দিয়ে চেক করবে। চেক করে যাতে তোমার মাঝে জেদ সৃষ্টি হয় তাই চেয়েছিলাম আমি। দেখো, আমি সফল ও হয়েছে। ধ্যানজ্ঞান দিয়ে পড়াশোনা করে এক্সাম দিয়েছে, আর তা বেশ ভালোভাবেই। আমার ভূত মাথা থেকে না নামলে সম্ভব হতো না।”

সুরলাকে বিশ্বাস করাতে চয়ন গুগল ড্রাইভে গিয়ে ফাইল খুঁজে সব ছবি দেখায়, সাথে ডেট ও। তাতে সুরলার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতার মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার পরিবর্তে অভিমান এসে ভীড় জমাচ্ছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলে,
“তারপর ও আপনি নিষ্ঠুর, আমার সাথে একটাবার যোগাযোগ করেননি, এসে দেখে অবধি জাননি।। আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করেননি, কোন খোঁজ নেননি। একটু ও মিস করেননি আমায়?”

“তুমি মা আর চরণকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবে আমি খোঁজ নিয়েছি কি-না। তুমি তো জেদের বশে ব্লক দিয়ে আমাকে সব যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলে। দিনে অন্তত বিশবার মাকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছি। এই একটা মাস স্পাইয়ের মতো চরণ তোমাকে ফলো করেছে। তুমি কোথায় যাচ্ছো, আসছো, ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছো কি-না, এক্সাম ভালো হয়েছে কি-না এসব খবর কানে আসতো প্রতিনিয়ত। অনেক কষ্টে ছুটি নিয়ে দুই দিন তোমার ভার্সিটির সামনে তোমাকে দেখেও গেছি, এসব তোমার চোখে পড়বে না। তোমার চোখে পড়বে শুধু আমার রুড বিহেভ গুলো। তোমার ভালো চেয়ে তোমাকে নিজের থেকে দূরে সরাতে গেলাম। এতে তুমি আমাকেই শত্রু বানিয়ে দিলে! কী কপাল আমার! ”

চয়নের স্বরে ও অভিমানের ছোঁয়া। যা স্পর্শ করেছে সুরলাকে। তার মানে চয়ন সত্যিই এসেছিল, আমি ভুল দেখিনি! পুরো ব্যাপারটা একবার ভাবে সুরলা। নিজের বোকামিই বেশি ধরা পড়েছে। চয়ন যা করেছে ভালোর জন্যই করেছে, হয়তো পথটা অদ্ভুত ছিল, অদ্ভুত মানুষের চিন্তাভাবনা ও অদ্ভুত হয়। যাই হোকে, এর পেছনে আমার ভালোরই উদ্দেশ্য ছিল আর সফল ও হয়েছে। কত ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। রেজাল্ট ও ভালো আসবে আশা করা যায়। এবার প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলের চিন্তা ছেড়ে ঘরোয়া দ্বন্দ্বের ফলাফল টানা যাক। এই মান অভিমান পর্ব চুকানো যাক। মানুষটা তার কথা রেখেছে, ঠিক শেষ পরীক্ষার দিন এসে হাজির হয়েছে। এইসব ভাবনার মধ্য দিয়ে সুরলার মন থেকে মান অভিমানরা পালাতে শুরু করেছে। সুরলা চয়নের দিকে তাকায়, চয়ন তার পানেই চেয়ে আছে। সে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। সুরলার চোখ থেকে অভিমানের বাতি নিভতে দেখে মুচকি হাসে চয়ন।

সুরলা গালে হাত রেখে আলতো গলায় বলে,
” করলা বেগমকে কি তার বর একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? বিবি গরিলা আক্তার কি পারে না বরকে ক্ষমা করতে? ”

“না পারে না।, করলা আর গরিলা বেগমের বর আস্ত একটা স্ত্রীবিমূখ বদলোক, যার কাছে তার পড়ালেখাই সব। এই পড়ালেখার জন্য সে স্ত্রীকে দূরে সরিয়ে দিতে দু’বার ভাবে না। ” ভেংচি কেটে অন্যদিকে ফিরে বলে সুরলা। চয়নের বাঁকা হেসে বলে,
“এতদিন তো খুব প্রতিবাদ করতে, আমাকে এই নামে ডাকবেন না, আমার নাম ব্যাঙ্গ করবেন না। আজ দেখো, নিজেই নিজের নামকে ব্যাঙ্গ করছো, করলা আর গরিলা হিসেবে মেনে নিচ্ছো নিজেকে। নট বেড তেলাপোকা বেগম।”

সুরলা বিস্মিত চাহনি দেয়, এই সিরিয়াস মুহুর্তে ও এই বদলোকের মজা করতে হবে! সুরলা চোখ রাঙিয়ে বলে,
“আপনি আসলেই একটা বদ, কোথায় স্ত্রী রাগ করেছে তার রাগ ভাঙাবেন, প্রপোজ টপোজ করবেন। তা-না উলটো মজা করছেন!”

” প্রপোজ ছাড়াই বিয়ে সংসার সব হয়ে গেছে। ক’দিন বাদে কিট্টির পেট থেকে বাচ্চাও চলে আসবে। সেই বাচ্চা থেকেও বাচ্চা হবে, মানে আমাদের নাতি পোতি হবে। তারা আমাদের লাভ স্টোরি জানতে চাইবে। তখন বলব, ” আমরা স্বামী স্ত্রী, বাবা মা দাদা দাদি হওয়ার জন্য প্রপোজ নামক কোন প্যাকেজ নেই নি। বিনা প্যাকেজে সব পার করে এসেছি। ভ্যালেন্টাইনে ফুল কিনে প্রপোজ করো, তারপর লাভের চাপ দিয়ে রিলেশনে যাও। এতসবে আমরা ছিলাম না। তিনবার কবুল আর নীল কাগজে একটা সাক্ষর করে দিয়েছি, বাকিসব আপনাআপনিই হয়ে গেছে। আমার নাতি পোতিরা বাহবা দিবে শুনে। তাই আমি বলিকি এসব প্রপোজ টপোজের ঝামেলার দরকার নেই। তুমি আমার সাথে চট্রগ্রাম যাবে, তারপর দেখবে বাসর, বাচ্চাকাচ্চা সব হাজির, বিনা অনুমতিতেই। ” চয়নের ঠোঁটের কোণে সেই বিখ্যাত হাসি। সে সুরলাকে লাজুক করছে।

সুরলা চয়নের বুকে মৃদু আঘাত করে বলে,
” তুমি একটা অভদ্র, অশ্লীল, অসভ্য।”

সুরলাকে নিজের সাথে আকঁড়ে নেয় চয়ন। আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে মানে মনের পর্দা পুরোটা পরিস্কার। সুরলার কানের কাছে মুখ নিয়ে সুর তুলে,
” অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে,
তাই কা‌ছে আসো না, আরো কা‌ছে আসো না
ইশ কথা ব‌লো না, কোন কথা ব‌লো না। ”

চয়নের সুর ধারালো ঠেকে সুরলার কাছে। কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সুরলা ছুটতে চায়। বাধা দিতে চয়ন বলে,
” এই লুকোচুরি খেলাটা অনেক হয়েছে করলা বেগম, এর সমাপ্তি লগ্ন এসে গেছে। এতদিন আমার উপর জেদ ধরে পড়ালেখাকে সময় দিয়েছিলে,এবার পড়ালেখার জেদ ধরে লুকোচুরি খেলা বাদ দিয়ে আমাকে সময় দিবে। আমার কাছেপাশে থাকবে সবসময়। আমি কেমন স্ত্রীবিমূখ মানুষ তাও দেখা উচিত তোমার। আমার জন্য আবার তোমার ভালোবাসার কমতি পড়ে না, আমি দেখি তোমার ভালোবাসার মাত্রা কেমন।” বিখ্যাত হাসি চয়নের।

সুরলা চয়নের ধারালো কথার শিকড় থেকে বাঁচতে বলে, “মা বাবা সরল কেউ বাসায় নেই, সবাই আমাকে রেখে কোথায় গেছে কে জানে! সরো মাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করি।”

চয়ন তার কপাল চুলকে বলে, ” আমাদের দুই পরিবার একসাথে ডিনারে গেছে। এখন কাউকে পাবেনা তুমি।”
“আপনি জানতেন?” বিস্মিত প্রশ্ন সুরলার।
“আমিই তো পাঠিয়েছি।” দায়সারা জবাব চয়নের। সুরলা বিস্ময় নয়নে চেয়ে বলে,
“কেন!”
“প্রথমত, আমি তোমাকে একা চাচ্ছিলাম, বাবা মা থাকলে স্পেচ পেতাম না। তা ছাড়া দুই লাইন বেশি বুঝা আর বাড়তি রিয়েক্ট করা মানুষ তুমি, আমাকে দেখে হৈ-হুল্লোড় করে পুরা বাসা মাথায় তুলতে। সে আমার অজানা নয়। শেষে, আমারই নাক কাটা যেত। তাই তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে যত ঝড় সব আমার উপর বয়ে যায়, কেউ টের অবধি না পায়। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের রেসিপশনের ডেট ফিক্সড করতে পাঠিয়েছি। এটা মূলত বাহানা ছিল। ”

সুরলা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। চয়ন হেসে বলে,
“দেখো, আমি তোমার জন্য কত কী করছি?আমার বন্ধ বান্ধব জানলে আমাকে মজনু বলে উপাধি দিবে। তুমি তো মূল্য দিলে না, আর না দিলে ভালোবাসা। হায়! এ দুঃখ কোথায় রাখি!”

আফসোসের ভান করে চয়ন। সুরলা ভেংচি কেটে খানিক দূরে সরে যায়। তারপর খানিক আগে ফেলে দেয়া টেডিবিয়ারটা তুলে নেয় ফ্লোর থেকে। চয়নের দিকে তাকিয়ে ফিরতি ভেংচি কেটে টেডিবিয়ারটাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। চয়ন বিড়বিড় করে,” আমার থেকে টেডিবিয়ার বেশি মূল্য পাচ্ছে। যে-চে আবার সতিন ডেকে আনলাম না তো! আল্লাহ! রক্ষা করো। ”

সুরলা টেডিবিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চয়ন পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করে। সুরলার পেছনে হাটুগেটে বসে। মৃদু ডাকে,
“কিট্টি!”

তড়িৎ পেছু ঘরে সুরলা। চয়নকে হাটুগেটে আংটি হাতে বসে থাকতে দেখে চমকায়। চয়ন তাকে প্রপোজ করবে ভাবতেই খুশিতে মনটা যেন নেচে ওঠে। চয়ন ততক্ষণে বলা শুরু করেছে,
“প্রপোজ নামক এইসব প্যাকেজ পুকেজে আমি কোন কালেই বিশ্বাসী ছিলাম না । এখনো যে আছি তাও না। শুধুমাত্র তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে হাটুতে ভর দিয়ে বসে এইসব নিব্বা নিব্বির কাজ করতে হচ্ছে। বিয়ে শাদী তো হয়ে গেছে, সংসার ও বাদ থাকে নি। বিয়ের সমন্ধীয় অসম্পূর্ণ সব কাজ ও সম্পূর্ণ করতে চাই। তোমাকে জীবনের শেষ সময় অবধি করলা বেগম, বিবি গরিলা আক্তার, তেলাপোকা বেগম বলে ক্ষেপানোর অনুমতি চাই। অনুমতি দিবে করলা বেগম?”

চয়নের প্রপোজের ধরণ দেখে সুরলা হাসি কান্নার ধরণ ভুলে গেছে যেন। এটা কোন ধরনের প্রপোজ ছিল! আদৌ প্রপোজ ছিল! এভাবে মানুষ প্রপোজ করে! এই অদ্ভুত মানুষের সব কিছু অদ্ভুত তাই বলে প্রপোজের ধরণটাও অদ্ভুতই হবে! রীতিমতো হা করে তাকিয়ে আছে চয়নের পানে। চয়ন হেসে বলে,
“আমাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে উষ্ঠা খেয়ে গুষ্ঠি ভুলে যাওয়ার মন মানষিকতা সম্পন্ন মানুষটা আর যাই হোক আমার অনুমতি অগ্রাহ্য করতে পারবে না, তা আমি জানি।”

সুরলাকে কোন কথার সুযোগ না দিয়ে আংটি পরিয়ে দেয় চয়ন। তারপর বলে,
“সিনেমার মতো এবার কি প্রপোজের পর জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিতে হবে?”
উত্তরে সুরলার প্রশ্ন,
“এটা কী ছিল!”
“প্যাকেজ, মানে প্রপোজ ছিল।” বসা থেকে ওঠতে ওঠতে বলে চয়ন। সুরলা চাপাশ্বাস ছেড়ে বলে,
” তুমি মানুষটা সত্যিই অদ্ভুত। ”

চয়ন ওঠে দাঁড়িয়ে সুরলাকে একটানে নিজের বুকে নিয়ে এসেছে। সুরলার গালে আলতো হাত রেখে কোমল গলায় বলে,
” আমি অদ্ভুত, কারণ আমার এসব প্রপোজ টপোজ ফর্মালিটি মনে হয়। তোমার ক্ষেত্রে আমি কোন ফর্মাল বিহেভ করা পছন্দ করি না। কারণ, আমার মনলিপির মূখ্যকথা , আমার মনমাঝে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মানুষটা হচ্ছো তুমি। আমার অনুভূতি যার জন্য নিয়ন্ত্রণহারা, সেই মানুষটাও তুমি। আমার মন যার চোখের জ্বলে অস্থির হয়, সেই মানুষটাও তুমি। যার ভালোবাসার পাশাপাশি রাগ ক্ষোভ অভিমানকেও আমি কেয়ার করি, সেই মানুষটাও তুমি। আমার মন যাকে সারাজীবনের জন্য আঁকড়ে ধরে রাখার প্রতিজ্ঞা করেছে, সেই মানুষটাও তুমি।
আমার মন যাকে আমার সংসার এবং আমার জীবনের বাতি হিসেবে সারাজীবনের জন্য চায়, সেই মানুষটাও তুমি। আমার মন যাকে কখনো হারানোর কথা ভাবতে পারে না, সেই মানুষটাও কিট্টি। যেই মানুষটাকে সবসময় মনে হয় সে, আমার একান্তই আমার, আমার কিট্টি, এই কিট্টি নামধারী মানুষটাও তুমি। এসব মনলিপিতে নোট করে রাখা মানুষকে আর যাই হোক প্রপোজের আশ্রয় নিতে হয় না। ”

এবার যেন সুরলার অবাক হওয়ার পালা। এই প্রথম চয়ন তার সামনে নিজের অনুভূতির ভান্ডার খুলে বসেছে। চয়নের বলা প্রতিটা কথা সুরলার কানে বাজে, ভালোলাগার জন্ম দেয়। চয়নের অনুভূতিগুলো খুব কাছ থেকে অনুভব করে। হৃদস্পন্দন বাড়ছে ক্রমাগত। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। তার হাসিটা চওড়া হয়, যখন চয়ন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বহুপ্রত্যাশিত যাদুকর শব্দটা উচ্চারণ করে,
“ভালোবাসি।”

সুরলার হৃদস্পন্দনের মাত্রা শত ছড়াবার উপক্রম। চয়নের দিকে একবার লাজুকমাখা চোখে তাকিয়ে চয়নের বুকে মুখ লুকোয়। চয়ন ফিরতি বলে,
“ভীষণ ভালোবাসি, বিবি গরিলা বেগম ওরফে করলা বেগম কিট্টিকে, একের ভেতরটা সবটাকে।”

চয়নের ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড বলার ধরণটাও অদ্ভুত। ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড বলতে গিয়েও চয়ন তার ঐতিহাসিক দুষ্টুমি বাদ দিবে না। এটা স্বাভাবিক হলে কী হতো! এমনটা চয়নের বুকে মাথা রেখেই ভাবে সুরলা। পরক্ষনেই তার ভাবনার ধরণ পালটে। সে ভাবে, অদ্ভুত হোক আর যাই হোক, এই মানুষটা তো আমারি। এই ভেবে চয়নকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে,
“আমি ও ভালোবাসি।”

চয়ন সুরলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ঠোঁটের কোণে সেই ভিন্ন অর্থবহ হাসি টেনে গভীর গলায় বলে,
“তো, প্রমাণ করো। ”

“অসভ্য, অশ্লীল, অভদ্র।” চয়নের মনোউক্তি বুঝতে পেরেছে সুরলা। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। চয়নের ঠোঁটের কোণের এই হাসিটা আজ সরবার নয়।
” চারদিকের মানুষ আমায় ভদ্রই জানে, শুধুমাত্র তুমিই জানো অভদ্র। এর অর্থ একটাই, অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে।” আবার গেয়ে ওঠে চয়ন। সুরলা মুখ না উঠিয়েই বলে,
“যেমনই হোক আমার-ই।”

চওড়া হেসে চয়ন ও সায় জানায়,
“যেমন হোক করলা বেগমেরই।”

সমাপ্ত…

দেখতে দেখতে সমাপ্তিলগ্নের এসে গেল গল্পটা। এতদিন যারা সাথে থেকে ধৈর্য্যসহকারে পড়েছেন তাদের ধন্যবাদ জানাই। পুরো গল্পটা পড়ে কেমন হয়েছে তা জানাবেন। আমার পাঠক গ্রুপে রিভিউ দিবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here