কাননে_এত_ফুল (পর্ব-৩) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#কাননে_এত_ফুল (পর্ব-৩)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৫.
পাখির কিচির মিচির শব্দে আমার ঘুমটা যখন ভাঙে তখন ভোর ছয়টা। সূর্যের আলো তীর্যক ভাবে নেই তবে চারিদিক ফকফকা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শোয়া থেকে উঠে বসার পর খেয়াল করলাম যে আমি মৃদুল ভাইয়ের রুমে। তারমানে রাতে যে ঘুমিয়েছি সেই ঘুম থেকে এখন সকালে উঠলাম। মা চলে গেছে হয়তো। আমাকে ডাকেনি কেন? মৃদুল ভাইয়ের রুমে এমনিতে তেমন আসা হয়না আর এবার ঘুমিয়েই পড়লাম। কী অদ্ভুত! বিছানা থেকে উঠে মৃদু পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। মৈত্রী আপুর রুমে এসে কিছুক্ষণ তার বিছানায় বসে ঘুম ভাব কাটালাম। মৈত্রী আপু হলো মিফতা আর মৃদুল ভাইয়ের বড় বোন। আমার আপা এবং মৈত্রী আপু সমবয়সী। আমার আপার বারো বছরের ছোট আমি। মিফতা ভাইয়ের দুই বছরের বড় আপা আর আপার একবছরের বড় মৈত্রী আপু। আর আমার বড় খালামণির ছেলে মেয়ে গুলো আরো বড়। তাদের নিজেদেরই আমার সমান বাচ্চা আছে। বদমাইশ গুলো যখন পাবলিক প্লেসে আন্টি আন্টি করে তখন ইচ্ছা হয় সবগুলোকে কষে চড় মারতে। কিন্তু আমি তা করিনা। এমন বিভৎস ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ কখনোই করা হয়নি আমার।

মৈত্রী আপুর রুমে আমার থ্রী পিস আছে। আপুর নিজেরও অনেক জামা আছে। আমরা প্রায় সময় এখানে আসি তাছাড়া মা বাবা কোথাও গেলে এখানে এসে আমাকে থাকতে হয়। বারবার ব্যাগ টানি দেখে খালামণি বলল কয়েক সেট জামা এখানেই রেখে দিতে। মৈত্রী আপুও বলল তার রুমে আমার অবাধ চলাফেরা করার অনুমতি আছে। তাই আমি এটাকে আমার আরেকটা রুম মনে করি।

ফ্রেশ হয়ে নামাযটা পড়ে নিলাম। মা আবার নামাযের জন্য খুব বকাঝকা করে। তাই পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন না পড়লে নিজেরই কেমন খারাপ লাগে। রুম থেকে বের হয়ে দেখলাম মিফতা ভাইয়ের রুমের দরজা একটু মেলে রাখা হয়েছে। আমিও ভাবলাম একটু উঁকি দিয়ে দেখি। রেসলার টা আছে কিনা! গতকালকের ব্যাপারটা আমি মাথা থেকে ঝেরে ফেলেছি। যা হয়েছে সব এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। আর তাছাড়া আমি আহামরি কিছুও দেখে ফেলিনি যে এটাকে বড় ইস্যু করব। বেশ বুঝদার মেয়ে তো আমি!

মিফতা ভাইয়ের রুমের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলাম মৃদুল ভাই হাত পা মেলে শুয়ে আছে। একটা বিছানা তার একারই লাগে। এটা আবার কেমন কথা! সে মিফতা ভাইকে জায়গা দেয়নি নাকি? মিফতা ভাই কই? নিচতলায় আরো দুই তিনটা রুম আছে। সেগুলো তে আবার যায় নি তো? পেছন ফিরতেই চমকে গেলাম। মিফতা ভাই আমার একেবার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
-“কী ভাই! ঘুম ভালো হলো?”
-“তোর জন্য আর ভালো ঘুমটা হয়নি। তবে শুধু ঘুম হয়েছে।”
-“কেন? আমি আবার কী করলাম!”
-“ছাদে আয় তো!”
-“না। এখন বাসায় যাব। কলেজে যেতে হবে।”
-“আজ শুক্রবার।”
-“তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই হলো। বাসায় গিয়ে আবার ঘুম দিব।”
-“আর ঘুমানোর দরকার নেই। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আবারও সেই আগের শেইপে চলে যাবি।”
-“আমাকে কি অপমান করা হচ্ছে নাকি?”
মিফতা ভাই হাসলেন। তারপর রিনরিনে গলায় বললেন,
-“উহু! একটুও না। আগে চল ছাদে চল।”
-“না না। পরে একদিন।”

মিফতা ভাই শুনলেন না। হাত টানতে টানতেই ছাদে নিয়ে এলেন। ছাদে খালু বসার জন্য ভালো ব্যবস্থা করেছেন। সোফা আছে, দোলনা আছে। বৃষ্টি আসলে ছাতা মেলে দেওয়া হয়। ইয়া বড় বড় ছাতা। সাদা রঙের। ভালোই লাগে দেখতে। বসতেও মজা আছে। চারিদিকে কত রঙের ফুল। ফুলের ঘ্রাণ! আহা! মিফতা ভাই আমাকে বসিয়ে ছাদের মধ্যেই করা ছোট রুমটিতে ঢুকলেন। রুমটায় ছোট একটা খাট আছে, চেয়ার টেবিল আছে, চা-কফি বানানোর সামগ্রী আছে। মিফতা ভাই এখানে অফিসের কাজ করেন। তাই এসব ব্যবস্থা করেছেন।
কিছুক্ষণ পরেই মিফতা ভাই হাজির হলেন দুইটা কাপ নিয়ে। আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
-“নে ধর!”
আমি নিলাম। তারপর তিনি আমার সামনের সোফাতে বসলেন। আমি দেখলাম দুধ চা দিয়েছেন। আমি দুধ চা খাইনা অনেকদিন হলো। কাল যখন খালামণিকে যাও বললাম চা দিতে তা আর খাওয়া হলো না। আমার এখন অভ্যাসে গ্রীন টি আছে। তবে দুধ চা তো আমার নেশা। তাও আবার মিফতা ভাইয়ের হাতের। আমাকে চায়ের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে মিফতা ভাই বললেন,
-“কীরে? ডায়েট এখনো ভাঙিস নি? তোর প্রিয় চা। আর সেটা খেতেই এত দ্বিধা!”
-“অনেকদিন খাওয়া হয়নি তো।”
-“জানি। অনেক তো ওজন কমিয়েছিস। আর কত? এবার এসব রাখ তো! আমি শুরু থেকেই এসব করতে মানা করেছিলাম।”
-“আমিও মানা না শুনে ভালো করেছি। আমার ত্রিশ কেজি কমেছে। ভাবতে পারো? আগে তো আমার চেহারার কাট, বডি স্ট্রাকচার কিছুই বোঝা যেত না। আমারও তো ভালো লাগতো না। খারাপ লাগতো খুব। সব মেয়েগুলো কী সুন্দর স্লিম ফিট। আর আমি? আমি একটা চালের বস্তা।”

মিফতা ভাই হো হো করে হাসলেন। আমার তা দেখে রাগ হলো খুব। তবে কিছুই বললাম না। মিফতা ভাই বলল,
-“নিজেকে নিজেই এভাবে বলছিস?”
-“সবাই বলতো।”
-“সবাই বলবে দেখে তুইও বলবি? আর আমি কখনো কিছু বলেছিলাম তোকে!”
আমি ভাবলাম। মিফতা ভাই কখনোই কিছু বলত না। এমনকি বাবা আর মাও কত কথা বলতো। কিন্তু আমার মিফতা ভাই কখনো এসব বলেনি। মৃদুল ভাই তো দেখা হলেই “এই মুটকি” বলে ডাক দিত। এখনও ডাকে। বদমাইশটা তো আমার পিছু ছাড়েই না। সারাক্ষণ জ্বালায়। আমাকে চুপ থাকতে দেখেই মিফতা ভাই বললেন,
-“আমার কিন্তু আগের অর্নিকেই বেশি ভালো লাগত। আমার আবার দুর্বলতা আছে গোলুমলুদের প্রতি।”
মিফতা ভাইয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম মনে হলো। মিফতা ভাইও এমন কথা বলতে পারে ধারণাই ছিল না। আমি কেমন চোখ মুখ কুঁচকে ফেললাম। মিফতা ভাই আমতা আমতা করে বললেন,
-“আমার পছন্দ থাকতে পারেনা নাকি? আমারও পছন্দ আছে।”
-“কিন্তু! নিতুন আপু তো খুব স্লিম গোলুমলু না।”
মিফতা ভাই কিছুটা রেগে গেলেন বোধ হয়। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-“নিতুন আসছে কোথা থেকে?”
-“কেন? আমাদের উপর তলা থেকে।”
আমার জবাবে মিফতা ভাই কেমন হতাশ হয়ে গেলেন। তবে কী সে নিতুন আপুকে পছন্দ করেনা? তাহলে তার এত চিঠি নেয় কেন? আর যখন যা চায় তখন তা দেয় কেন?
-“শোন অর্নি! আমার আর নিতুনের মধ্যে কিছুই নেই।”
-“আমি কী বলেছি কিছু আছে?”
-“তাহলে ওর কথা তুলছিস কেন?”
-“এমনেই।”

মিফতা ভাই বিরক্ত হলেন। আমার কাছেও সব অদ্ভুত লাগছে। আজকের মিফতা ভাই কেমন যেন! সে রাগ করছে, বিরক্ত হচ্ছে, তার পছন্দ অপছন্দের কথা বলছে। কই! আগে তো এমন কিছুই হতো না। তার মধ্যে এমন কিছুই দেখিনি আমি। চায়ে চুমুক দিলাম। আহ! সেই স্বাদ। কতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম আমার এই ভালোবাসাটাকে। চায়ে চুমুক দিতেই খেয়াল করলাম পাশের বিল্ডিং অর্থাৎ অবন্তী আপুদের বিল্ডিংয়ের ছাদে রেসলার ডাম্বেল উঠিয়ে কসরত করছে। আমি হা করে তাঁকিয়ে রইলাম। কী বডি! মিফতা ভাই আমার দিকেই তাঁকিয়ে ছিলেন। আমি হঠাৎ তার দিকে তাঁকাতে সে অপ্রস্তুত বোধ করলেন। হাসফাস করতে লাগলেন। আমি সেসবে পাত্তা না দিয়ে বললাম,
-“ভাইয়া? অবন্তী আপুদের ছাদে রেসলার কী করে?”
মিফতা ভাই ভ্রু কুঁচকে ফেলেন আমার কথা শুনে। আমি আঙুল দিয়ে ইশারা করতেই পেছন ফিরে দেখেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
-“ওটা অভ্র। অবন্তীর ভাই ছোটটা।”
-“তাই নাকী? আগে তো দেখিনি! কোথায় ছিল সে?”
-“ও চট্টগ্রাম মেডিকেলে ডাক্তারি পড়ত। এখন সে ডাক্তারি পড়া শেষ করে একজন পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার হয়েই এসেছে।”
-“ডাক্তার! এই মিফতা ভাই! আমার মা নিশ্চয়ই আমাকে ডাক্তারের সাথে বিয়ে দিবে তাই না?”
-কিহ!”
মিফতা ভাই জোরে চিৎকার দিল। খেয়াল করলাম ঐপাশ থেকে ডাক্তারটাও এদিকে তাঁকালো। মিফতা ভাইকে ডেকে বলল,
-“মিফতাহুল! কী হয়েছে রে?”
-“কিছুনা।” ভাই বললেন,

আমিও চিৎকার করে বললাম,
-“এই রেসলার! না মানে ডাক্তার! মিফতা ভাই হার্ট এট্যাক করেছে। আপনি কী স্পেশালিস্ট?”
ঐপাশ থেকে ডাক্তারটা “হোয়াট” বলে চেচিয়ে উঠল। তারপর দেখলাম দৌড়ে সিঁড়ি ঘরে চলে গেল। মিনিটের মধ্যেই সে ছাদে মানে এই ছাদে উপস্থিত। মিফতা ভাইকে ধরে বললেন,
-“এই তুই ঠিক আছিস?”
মিফতা ভাই কি বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। আমার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে আছেন। আমি পাত্তা দিলাম না। মিফতা ভাইয়ের বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখালাম,
-“এইখানে এট্যাক হয়েছে। আপনি হার্টের ডাক্তার তো?”
ডাক্তার কেমন বিচলিত হয়ে বললেন,
-“আমি তো আই স্পেশালিস্ট।”
-“চোখের ডাক্তার?”
-“হ্যাঁ!”
-“তাহলে দেরি করছেন কেন? দেখুন তো। মিফতা ভাইয়ের চোখ দেখুন।”
-“মানে? হার্ট এট্যাক করলে চোখ দেখব কেন?”
-“হার্ট এট্যাক! কী! হার্ট এট্যাক কখন করল? ছিঃ কি বলছেন?”
-“তুমিই তো বললে।”
ডাক্তারের মুখে তুমি শুনে আমি গলে গেলাম। বুকে হাত দিয়ে বললাম,
-“আরে না না। হার্ট এট্যাক তো আমি করেছি। ভাইয়ের হয়েছে আই এট্যাক।”
ডাক্তার এবার হতভম্ব হয়ে গেল। সে মিফতা ভাইকে ভালো করে দেখলেন। মিফতা ভাই ঠিকই আছেন। শুধু আমার আকস্মিক করা পাগলামিতে অবাক হয়ে গেছেন। আমার এই রূপ দেখে সে তাজ্জব। ডাক্তার হয়তো এবার আমার ইয়ার্কি ধরতে পারলেন। সে ধমকে উঠল,
-“ফাইজলামি হচ্ছে? এসব নিয়ে কেউ ফাজলামি করে?”
-“আমি করি। দেখতে চাইছিলাম আপনি ডাক্তার হিসেবে কতটা যোগ্য। না, আপনি ভালোই আছেন। অল দ্য বেস্ট।”
এই বলে ডাক্তারের কাধে দুইটা চাপড় মেরে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। ডাক্তার বসা ছিল বলেই তার কাধের নাগাল পেলাম। নইলে তো পারতাম না।

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here