#কালো মেঘে রোদ্দুর (পর্ব:৯)
♡আরশিয়া জান্নাত
কি হলো কিছুই বুঝলাম না! একটু আগে এতো আনন্দ হচ্ছিল আর এখন সবটা কেমন বদলে গেল। অসহ্যকর!
কাঁচের গ্লাস প্লেট সব পরিষ্কার করতে করতে খানিকটা চেঁচিয়েই বলছে পিহু। ঘরদোর পরিষ্কার করতেও যেন অসহ্য লাগছে। তাদের জীবনে সুখ আসে কেমন রোদবৃষ্টির মতো। একটু আগে ভাবছিল বোনের জীবনে দারুণ একটা ভোর এলো বুঝি! সবকিছু কেমন মিরাক্যাল এর মতো ঘটেছে।কিন্তু শেষ মূহুর্তে কি এমন হলো যে আপু বিয়েটাই ক্যানসেল করে দিলো! ঐ হারামজাদার সাথে একা কথা বলতে পাঠানোটাই ভুল হয়েছে। যদি জানতো এমন কিছু হবে পিহু জীবনেও এই ভরা মজলিশে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঐ ব্যাটার কথায় মোহনাকে পাঠাতো না। রাগে কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। মোহনা দরজা আটকে বসে আছে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় মুখের উপর দরজা আটকেছে। মোহনা সচরাচর দরজা আটকে বসে না। সে ঘুমানোর সময়ও দরজা লাগায় না কখনো। কিন্তু যেদিন দরজা লাগায় বুঝতে হবে আজ তার মনে অসম্ভব কষ্ট লেগেছে। এই যেমন বাবা যেদিন মারা গেল ঘরভর্তি মানুষের আহাজারি। আর সে দরজা আটকে বসেছিল। বাবাকে যখন নিয়ে যাচ্ছিল শেষবারের মতো মুখ দেখতে কতবার ডাকলো তাকে; সে দরজা খোলা তো দূর কোনো শব্দটুকু করেনি। পিহু সেদিন বুঝেছিল তার বোন নিজের একান্ত দুঃখগুলো কাউকে দেখায় না।
মোহনা গত এক বছরে লেখা ডায়েরিটাতে আগুন জ্বালিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। তার মনের আবেগঘন লাইনগুলি কলমের কালিতে ফুটে ওঠেছিল যে পাতাগুলিতে; তা ছাই হচ্ছে একটু একটু করে কত দ্রুতগতিতে! মোহনা জানেনা সে কেন এমন করছে, সব তো শেষ হয়নি সে চাইলেই অপেক্ষা করতে পারে সব ঠিক হবে এই প্রত্যাশায় ফের স্বপ্ন বুনতে পারে। কিন্তু তার সিক্সথ সেন্স বলছে এই পথে আর না যেতে। এতোদিন সে বেহায়ার মতো কত কি করেছে, সবসময় অবজ্ঞা পেয়েও পিছু ছাড়েনি। এতোদিনে যার একটুও মনে জায়গা মেলেনি এখন মিলবে? বিয়ে করে জোর করে বোঝা চাপিয়ে দিলে হয়তো সম্পর্কের রেষানলে সে বাধ্য হয়ে তাকে মেনে নিতো কিন্তু সেই মেনে নেওয়া কি মোহনা চেয়েছিল? সে তো সবসময় ভেবেছে এমন একজনকে জীবনসঙ্গী করবে যে মোহনাতে মাতোয়ারা থাকবে। তার মনের পরতে পরতে কেবল সেই থাকবে। আর রাইয়্যান কি না অন্য একজনের জন্য মরিয়া হয়ে আছে! সে অপেক্ষা করে তার ফেরার!
এমন মানুষের হাত ধরাটা কি আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ?
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে তো কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিল তার কাঁধে পরিবারের দায়িত্ব আছে। কেমন স্বার্থপরের মতো নাচতে নাচতে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাচ্ছিল ভাবতেই নিজে উপর রাগ উঠছে তাঁর!
আসলেই তার আবেগী হওয়াটা মানায় না। তার যে এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি,,,,,,,
আজাদ সাহেব মুখ ভার করে বসে রইলেন। নিজের বোকামির জন্য আজ এতোকিছু হলো ভাবতেই লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। কোথায় ভেবেছিল মা বেটাকে সারপ্রাইজ দিবে উল্টো সে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেল। এই মেয়েকে নাকি তার ছেলে চিনেই না ঠিকঠাক আর সে কিনা ভেবেছে,,, শিট! তবে মেয়েটাকে আসলেই বেশ পছন্দ হয়েছিল তার। যদি ইলহাম বয়সে ছোট না হতো ওর জন্যে হলেও নিয়ে আসতো সে।
শীতলকুঠিতে আজ কারোই মন ভালো নেই।
_________________
ঘুম থেকে ওঠে চায়ের পানি বসিয়ে মেইল চেক করা রোজকার রুটিন মোহনার। কতজায়গায় সে রোজ সিভি জমা দেয় হিসেব নেই। একটা ভালো মানের চাকরির জন্য কত জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছে। কোথাও স্যালারি পোষায় না তো কোথাও রেফারেন্সের অভাব! এখন যেখানে জব করে সেটা মোটামুটি ভালো স্যালারি। এক্সট্রা করে টিউশন করার দরকার পড়েনা এতেই খেয়ে পড়ে চলে যাচ্ছে। সমস্যা একটাই তা হলো ম্যানেজারটা সুবিধার না। লোকটার তাকানোতেই কেমন গা ঘিনঘিন করে।
একটা মেইল দেখে মোহনার চোখ আটকে গেল। জেআই গ্রুপ অফ কোম্পানি থেকে ইন্টারভিউর ডেট দেওয়া হয়েছে। এই কোম্পানিতে জব পাওয়া মোহনার বহুদিনের স্বপ্ন। এই কোম্পানিতে স্টাফদের অনেক ফ্যাসিলিটিস দেওয়া হয়। কোম্পানিটার মালিক নাকি অসম্ভব ভালো মানুষ। মোহনার যদি একবার এখানে জব হয় তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে সময় লাগবে না।
ইয়া আল্লাহ একটু ফিরে তাকাও এবার যেন টিকে যাই প্লিজ প্লিজ!!
মিস মোহনা
অচেনা গলায় নিজের নাম শুনে খানিকটা অবাক হয়েই পেছনে তাকালো মোহনা। ছেলেটা দম নিতে নিতে বললো, আপনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই এতো ফাস্ট হাঁটেন!
আপনাকে ঠিক চিনলাম না?
চেনার কথাও না! সেই কবে একটা ডেলিভারি দিয়েছিলাম। একটা ডেলিভারিম্যানকে মনে রাখা অসম্ভব বটে!
মোহনা কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে আপনার বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছিল বলেছিলেন যে?! আপনি এখনো আমাকে মনে রেখেছেন!!!
ছেলেটা মাথা চুলকে মিনমিন করে বললো, আপনাকে ভোলা সম্ভব হয়নি আর,,
কিছু বললেন?
না না আসলে আপনাকে হোয়াটস এপে নক করেছিলাম অনেকবার কিন্তু আপনি রেসপন্স করেননি। তাই আর যোগাযোগ হয়নি। আমিও আর সাহস করে চেষ্টা করিনি। তবে আপনার খবর ঠিকই রেখেছি।
কি বলেন! আমার খবর রাখেন? কিন্তু কেন?
না আসলে আচ্ছা বাদ দিন না ভালো আছেন?
জ্বি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
ভালো আছি। এখন আরো বেশি ভালো আছি। আপনার বোনের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছিল তো? আজকে তো আপনার ইন্টারভিউ আছে তাই না?
মোহনা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো, আপনি এতো খবর পেলেন কোথায়?
ছেলেটা বোকার মতো হেসে বললো, মিস মোহনা আমি জানিনা আমি কি সব বলছি। আপনার সামনে এসে আসলে এমনসব কথা বলছি যা বলা উচিত না। আমার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।এসব মাথায় রাখবেন না। আর শুনুন আজকে ইন্টারভিউতে টাইমলি এটেন্ড থাকবেন আর কনফিডেন্টলি রিপ্লাই দিবেন। আমার বিশ্বাস আপনার জবটা হয়ে যাবে গুড লাক। সী ইউ সুন।
ছেলেটা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। মোহনা তাকে পিছু ডাকলো- আরেহ আপনার নামটা তো বলে যান!
ছেলেটার কথাবার্তা অদ্ভুত তো। সে কি করে জানলো বোনের অপারেশনের কথা আর ইন্টারভিউর কথা তো বাসায় পর্যন্ত কাউকে বলেনি সে জানলো কিভাবে?
মোহনা চটজলদি ফোনের ডাটা অন করে হোয়াটস এপ চেক করলো। তলানিতে পড়ে থাকা নাম্বারটা সেভ করতেই তার নাম শো করলো জুনায়েদ ইসলাম রাফি। ইনবক্স ওপেন করতেই দেখে লাস্ট মেসেজ আট মাস আগে করেছিল। সে মেসেজ সীন পর্যন্ত করেনি! আহারে ছেলেটা!
আচ্ছা ছেলেটা তাকে মনে রেখেছ কেন? ঐ এক্সিডেন্টটার জন্য নাকি অন্য কিছু? সেও কি মোহনার মতোই পাগলামি করছে? সে যেমন রাইয়্যান পিছে ঘুরেছে খোঁজখবর রেখেছে এই রাফি ছেলেটাও কি সেই উদ্দেশ্যে,,,?? না না বোধহয় একটু বেশিই ভাবছে সে। এমন হবে কেন? সবাই তো তার মতো পাগল না।
।
।
।
উফ আমার আসলেই আক্কেল জ্ঞান হবেনা। হুট করে গিয়ে এতোকথা একসঙ্গে বললে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিবে? কেন যে সে বোকামিটা করলো! এমনিতে তার এতো কথা বলার অভ্যাস নেই কিন্তু মোহনার সঙ্গে কথা বলার ছুতো খুঁজতে এমনসব কথা বলে বসেছে যা আসলে বলা ঠিক হয় নি। মোহনার বোনের অপারেশনের খবর সে যে কেবল জানে তা না বরং সেই টাকাটা যে তার বাবাই দিয়েছেন। সে ই তো ডাক্তার আঙ্কেলকে বলেছিল মোহনাকে তাদের এড্রেসটা দিতে। এমনিতেই তার বাবা প্রায়ই ডোনেট করেন তাই মোহনার ব্যাপারে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। এইসব গল্প হয়তো মোহনা কোনোদিন জানবেনা। অবশ্য জানবে কিভাবে তার ধ্যানজ্ঞান তো রাইয়্যানের দিকেই ছিল। যদি এর বাইরে কোনোদিন খেয়াল করতো দেখতে পেতো তার পেছনেও কেউ একজন ছায়ার মতো ছিল। যে তাকে সবসময় দূর থেকে আগলে রেখেছে। তার সকল খোঁজখবর রেখেছে। সেদিন যখন রাইয়্যানের ফ্যামিলি তাদের বাসায় গেল ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল এই বুঝি মোহনাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললো! কিন্তু বিধাতার পজিটিভ সিগন্যাল দেখে আজ খুশিতে দিশেহারা হয়ে মোহনার সামনে দাঁড়াতেই সব এলোমেলো হয়ে গেল।
মোহনা কি কখনো জানবে তার জন্যও কেউ একজন এমন অস্থির হয়ে থাকে?
চলবে,,,
(গল্পটা কি ভালো হচ্ছে না? কোনো রেসপন্স পাচ্ছি না যে? এভাবে রসকষহীন রেসপন্স নিয়ে কতদূর লিখবো বলুন তো?)