বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-২৪ শেষ পর্ব

0
1175

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-২৪

ধারাকে ছাড়তে আরও মাসখানেক সময় নিল শাহেদ, যার বেশিরভাগ সময়টাই ধারা কাটিয়ে দিল কাঠের দোতলা বাড়িটাতে। বাড়ির পাশে ছোটো একটা বন আছে। অজস্র পাখি আর বানরে ভরপুর। ভোরে সে বের হয় বন ভ্রমণে। কিছুদূর গিয়ে আগাছায় ভরা একটা প্রাকৃতির লেক আছে, সেই লেকের পাড়ে বসে থাকে। ফিরে এসে খেয়েদেয়ে আকলিমা আপার সাথে গল্প করে। শাহেদ এলে তার সাথে কথাবার্তা বলে। বিকেলে ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। প্রায় প্রতিদিন শখ করে শাড়ি পরে, চুল বাঁধে, কাজল আর টিপ পরে সাজগোজ করে।

শাহেদ একদিন বলল, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব কনফিডেন্স বেড়েছে তাই না?”

ধারা প্রথমে জোর গলায় বলল, “হ্যাঁ।”

তারপর কী মনে করে কিছুক্ষণ গুম হয়ে গিয়ে শেষে ধীরে বলল, “আপনি তো জানেন আমার অবস্থা। এখনো মনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি আত্মনির্ভরশীল হতে। হয়ে যাব শিগগির ইনশাআল্লাহ।”

শাহেদ হাসল। বলল, “এরপর কী করবে?”

“ইউনিভার্সিটিতে যাব। গ্রাজুয়েশন শেষ করিনি এখনো। আরও দুটো সেমিস্টার বাকি। ওখানকার কী অবস্থা কে জানে!”

“সমস্যা হবে না। তোমার বাবা তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন শুনলাম।”

“হ্যাঁ।”

“তারপর ক্যারিয়ার গোছাবে?”

“হুম। আরও অনেক প্ল্যান আছে।”

শাহেদ হেসে বলল, “অনেক প্ল্যান?”

“অ-নে-ক!”

“দেখা যাবে।”

“আপনি দেখার সময় পাবেন কোথায়? রোগী নিয়েই তো কেটে যায় সারাদিন।”

“তা অবশ্য ঠিক।”

দু’জন হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন ধারার রুটিন চেকআপ করে শাহেদ চলে গেল।

এর তিনদিন পরেই বাবা মায়ের সাথে বাড়ির পথ ধরল ধারা।

“ওরা কোথায় গেছে বাবা?”

“জানি না।”

“বাড়ি করে আবার চলে গেল কেন?”

ধারা বাড়িতে পৌঁছে দেখেছে বর্ষণরা চলে গেছে একেবারে। ওদের বাড়িটা এই ক’দিনেই জঙ্গলমতো হয়ে গেছে।

প্রথমে কেউ কিছু না বললেও পরে মায়ের কাছে সে জানতে পারল সবটা। ধারা-বর্ষণের ডিভোর্সের পর টুম্পা বর্ষণদের বাড়িতে উঠে এসেছিল। প্রথমদিকে বর্ষণ বেশ ভালোমানুষ হওয়ার অভিনয় করলেও পরে একসময় দেখা গেল স্বভাব যায়নি৷ আগের মতোই বহু নারীতে আসক্তি আর মিথ্যে বলার স্বভাব তার রয়েই গেছে। টুম্পা অনেক চেষ্টা করেছিল বর্ষণকে ফিরিয়ে রাখতে, কিন্তু পারেনি।

শেষে একদিন সত্যি আত্মহত্যা করতে যায় মেয়েটা। প্রচুর পরিমাণে ইঁদুর মরার বিষ খেয়ে ফেলে। মরেনি ঠিকই, কিন্তু প্রচন্ড অসুস্ত হয়ে অনেকদিন হাসপাতালে থেকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়েছে। তখন টুম্পার বাবা মা কেস বর্ষণের পুরো পরিবারের নামে। পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে ওরা।

এলাকায় তখন সবকিছু জানাজানি হয়ে যায়। লোকজন ধারার সাথে বর্ষণের ডিভোর্সের কথা জানত, কিন্তু ওর আগের বিয়ের কথা জানত না৷ তাই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে টুম্পার ঘটনা।

তখন আরেক সত্য বের হয়। জানা যায় এলাকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন হাওলাদারের মেয়ের সাথে বর্ষণের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটাকে অজস্র মিথ্যে বলে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিল। বুঝিয়েছিল ওর জন্যই ধারাকে ডিভোর্স দিচ্ছে বর্ষণ। পরে মেয়েটার চোখ খোলে টুম্পার কথা বের হওয়ার পর।

সব জেনে মহিউদ্দিন হাওলাদারের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। এলাকায় বৈঠক বসে। বর্ষণদের প্রায় একঘরে করে দেয়া হয়।

এই এলাকায় এরপর যতদিন তারা ছিল একেবারে অসহনীয় অবস্থায় জীবনযাপন করেছে৷ একসময় বুঝতে পেরেছে এভাবে থাকা যাবে না। তাই একদিন রাতের অন্ধকারে চোরের মতো পালিয়ে গিয়েছিল তারা৷ কোথায় গেছে কাউকে বলে যায়নি।

সব শুনে ধারা চুপচাপ বসে রইল সারাদিন। একটা যন্ত্রণা তাকে বারবার আঘাত করতে লাগল পুরো মনজুড়ে।

এখন গ্রীষ্মকাল। কৃষ্ণচূড়া গাছ আলো করে ফুটেছে লাল টকটকে ফুলের দল। বাতাসের ঝাপটা লেগে সেসব দিনরাত মাথা দোলায়। নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো দেখে অস্থির লাগে ধারার। জানালা বন্ধ করে দেয় সে।

ধারা বাড়িতে এক সপ্তাহ থাকল। তারপর একদিন ভোরবেলা রওনা হয়ে গেল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

তার বাবা আগেই দরখাস্ত দিয়ে কথা বলে রেখেছিলেন ডিপার্টমেন্ট আর হলে। তাই নতুন করে ভর্তি হতে তেমন সমস্যা হলো না। ওর হলের সিটটা খালিই পড়ে ছিল। নিজের জায়গা আবার দখল করল সে। নীরা আপু চলে গেছে। এক জুনিয়র মেয়ে এসেছে ওর পাশের বেডে। মেয়েটা খুব প্রাণোচ্ছল, বকবকিয়ে। কথা বলে বলে মাতিয়ে রাখে একেবারে। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগলেও ধারার মনে হয় এটা তার জন্য আশীর্বাদ। মনমরা পরিবেশ অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয় যেগুলো সে মনে করতে চায় না।

অনেকদিন পড়াশুনা থেকে দূরে থাকায় বোধহয় মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এবার পড়ার সুযোগ পেয়ে সব মনোযোগ লাগিয়ে দিল। আগের সেমিস্টার পড়েও পরীক্ষা দেয়নি, পুরানো পড়া বলে সহজেই সব মাথায় জায়গা করে নিতে থাকল। অবসর সময়গুলো সে কাজে লাগাল ফ্রিল্যান্সিং এর কোর্স করে। দ্রুত শিখে যেতে থাকল সব। একটু একটু করে কাজও পেতে থাকল।

সেমিস্টার পরীক্ষা খুব ভালো দিল সে। পরীক্ষার শেষদিন নিজের ইনকামের টাকা দিয়ে ক্লাসের সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াল৷ প্রাণ খুলে হাসল আর ঘুরে বেড়াল পুরো ক্ল্যাম্পাস।

রুমমেট জুনিয়র মেয়েটার সাথে রাত জেগে গল্প করল সেদিন। মেয়েটার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো অন্যদের মতো প্রেম ভালোবাসা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। মেয়েটা ভালোবাসে প্রকৃতি, পশুপাখি আর সিনেমা। ধারা সিনেমা দেখে না বলে প্রায়ই তাকে সিনেমার গল্প বলে শোনায়। শোনায় নিজের স্বপ্নের কথা৷ ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হওয়ার শখ মেয়েটার। শখ বন্যপ্রাণী রেসকিউ করার। মেয়েদের জীবন কেন ছেলেদের মতো স্বাধীন নয় এই নিয়ে আক্ষেপ করে আর বক্তৃতা দিয়ে সে একটা পুরো দিনও পার করে দিতে পারে বিনা ক্লান্তিতে। ধারা তার কাছ থেকে জীবনীশক্তি ধার নেয় একটু একটু করে। মনোবল বাড়ায়, চোখ বুজে একটা নতুন পৃথিবী কল্পনা করার চেষ্টা করে।

নীনার সাথে দেখা হলো একদিন। নীনা বদলে গেছে পুরোপুরি। আবার আগের মতো হয়ে গেছে। থিসিস নিয়ে মহাব্যস্ত দিন কাটাচ্ছে। ধারাকে দেখে দুর্বলভাবে হাসল সে। দেখতে দেখতে চোখ ভর্তি হয়ে এলো দুজনারই। জড়িয়ে ধরল একে অপরকে। পুরানো বিষয় নিয়ে কোনো কথা হলো না। কথা হলো বর্তমান নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে আর একটা খোলা আকাশের স্বপ্ন নিয়ে।

সেমিস্টার শেষের ছুটিতে বাড়িতে গেল ধারা। এবার গিয়েই আকষ্মিক বর্ষণের সাথে দেখা হয়ে গেল। ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বর্ষণকে দেখল
তাদের বাড়ির গেট খুলে ঢুকছে। আচমকা সে তাকাল ধারাদের বাড়ির ছাদের দিকে। চোখাচোখি হতেই ধারা একেবারে জমে গেল। বর্ষণের চোখে ঠিকরে পড়ছে অনুতাপ। ধারার গলা শুকিয়ে এলো। সে ঠিক দেখছে না ভুল? নিজেকে আজকাল বিশ্বাস হয় না৷ এই ভুতুড়ে বাড়িতে বর্ষণ কেন আসবে? আবার রোগটা ফিরে এলো না তো?

শাহেদ শিখিয়ে দিয়েছিল আবার যদি এরকম হয়, চোখের সামনে ঘটা ঘটনা সত্য না মিথ্যা তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়, তাহলে চোখ বুজে একশ থেকে এক পর্যন্ত গুনতে। গোনা শেষেও মানুষটাকে দেখা গেলে বুঝবে সে সত্যি।

ধারা চোখ বুজে ঠোঁট কামড়ে সময় নিয়ে সংখ্যা গুনল। যখন চোখ খুলল তখন সব ঘোলা লাগল খানিক্ষন। তারপর দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই বর্ষণকে আবার দেখতে পেল সে। এখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।

ধারা ছুটে নিচে চলে গেল। মাকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকল। কেন বর্ষণকে দেখে এত ভয় লাগছে তার?

একটু পরেই কলিংবেল বাজল। ধারা কেঁপে উঠল আরেকবার৷ তার মনে হচ্ছে বর্ষণ এসেছে। মা দরজা খুললেন৷ আসলেই বর্ষণ৷ মাথা নিচু করে সে ঘরে ঢুকল। ধারার থেকে অনেকখানি দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। আমি যা করেছি সেজন্য পারলে মাফ করে দিও। কিন্তু আমার মায়ের জন্য কোনো খারাপ অনুভূতি রেখো না প্লিজ। একটু দোয়া করো তার জন্য।”

কথাগুলো বলে কোনোদিকে না তাকিয়ে বের হয়ে গেল সে।

ধারা আবারও জড়িয়ে ধরল মাকে। এই ছেলেটা কেন তার সামনে আসে? এলোমেলো করে দিয়ে যায় তাকে? মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটা শিরায়৷

মা ভয় পেয়ে গেলেন। বাবাকে ফোন করলেন, ফোন করলেন শাহেদকে। বাবা একটু পর ছুটতে ছুটতে চলে এলেও শাহেদকে পাওয়া গেল না ফোনে।

অবশ্য একটু পরেই কলব্যাক করল সে। রোগীর কাছে ছিল বলে কল দেখেনি। মা খুলে বললেন সব। শাহেদ বলল, “ধারাকে দিন ফোনটা।”

ধারা অনেক কষ্টে ফোনটা কানের কাছে ধরে বলল, “বলুন।”

“ধারা তুমি আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”

“হু।”

“হু না, বলো শুনব।”

“শুনব।”

“কেমন লাগছে এখন?”

“ভালো না।”

“কী করতে ইচ্ছে করছে?”

“পালিয়ে যেতে।”

“কোথা থেকে?”

“স্মৃতি থেকে।”

“তোমার মনে আছে, একদিন আমরা বনে গিয়েছিলাম পিকনিক করতে?”

“হ্যাঁ।”

“সেখানে একটা ছোট্ট শিয়াল দূর থেকে আমাদের দেখছিল?”

“হ্যাঁ।”

“সে ভেবেছিল আমরা হয়তো তার শাবকের ক্ষতি করব। কাছেই ওর আস্তানা ছিল।”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু আমরা তার ভুল ধারণা ভাঙিয়ে দিয়েছিলাম তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা তাকে কী খেতে দিয়েছিলাম?”

“মুরগি।”

“গুড! সব মনে আছে তোমার।”

“কিন্তু…”

“শিয়ালটার ভয় অমূলক ছিল কারন সে ভাবত আমাদের দ্বারা তার ক্ষতি হবে। কিন্তু আসলে হয়নি।”

“হুম।”

“তোমারও ভুল ভাঙতে হবে ধারা। তুমি ভাবো বর্ষণের দ্বারা তোমার আর কোনো ক্ষতি হওয়া সম্ভব নয়।”

“ভাবছি।”

“ভাবছ না মুখে বলছ। আমি জানি তার জন্য তীব্র ভালোবাসা থেকে পরিণত হওয়া দগদগে ক্ষতটা অনেক কষ্টে বয়ে বেড়াচ্ছ তুমি। কিন্তু সেটা সারাতে তো হবে। সারাতে পারো একমাত্র তুমি। মনকে জোর করে অন্যদিকে সরাও। সেদিন পিকনিকের কথা ভাবো। আমরা একসাথে সূর্যাস্ত দেখেছিলাম লেকের পাড়ে বসে। তুমি বলেছিলে আকাশে এত রঙের খেলা কখনো দেখোনি।”

“হ্যাঁ।”

“সেদিন সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। তুমি বলেছিলে বৃষ্টির পর ভেজা মাটির ঘ্রাণ তোমার অসম্ভব পছন্দ।”

“হ্যাঁ।”

“একদিনে একটা ডানা ভাঙা পাখি তোমার বারান্দায় এসে পড়েছিল। তুমি সেটার শুশ্রূষা করে বনে পাঠিয়ে দিয়েছিলে।”

“হ্যাঁ।”

“ভাবো সেই ডানা ভাঙা পাখিটা তুমি। নিজের যত্ন করতে পারবে না?”

“হ্যাঁ।”

“উহু, বলো পারব।”

“পারব।”

“শিওর?”

“শিওর।”

“আজকের প্ল্যান যা ছিল সেই অনুযায়ী বাকি দিনটা কাটাতে পারবে?”

“পারব।”

“কী কী করবে?”

“ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করব। একটা অর্ধসমাপ্ত বই শেষ করব তারপর রাতে একটু ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করব।”

“ভেরী গুড! রাত এগারোটায় আমি অপেক্ষা করব। আমাকে আপডেট জানাবে, কেমন?”

“ঠিক আছে।”

“মাথা ব্যথা কমেছে?”

“অনেকটা।”

“আচ্ছা রাখি।”

ফোন রেখে ধারার মনে হলো মাথাব্যথা প্রায় চলে গেছে। হালকা চিনচিন করছে কেবল। সেই কাঠের বাড়ি, বন, শিয়ালের বাচ্চাগুলো, অপূর্ব সূর্যাস্ত আর শাহেদের কথাগুলো! সব ভাবতে ভাবতে মিলিয়ে যেতে থাকল বর্ষণের কথাগুলো।

সেদিন ধারা নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখল,”মানুষ ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যখন সে কারো কাছ থেকে ভীষণ যত্ন, মনোযোগ আর সাপোর্ট পায়। আমি ভাগ্যাবতী, আমি ডক্টর শাহেদের কাছ থেকে সবগুলো পেয়েছি। এমন অকৃত্রিম বন্ধু কয়জনের হয় আমি জানি না। হ্যাঁ, আমি তাকে নিজের চিকিৎসকের চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু ভাবি।”

সময়গুলো ব্যস্ততার চাপে একেবারে উড়ে চলে গেল। ধারা বুঝতে পারল না কোনদিক দিয়ে তার অনার্স, মাস্টার্স শেষ হয়ে গেল। যেদিন মাস্টার্সের ভাইভা দিয়ে বের হলো, নিজেকে কেমন মুক্ত পাখির মতো মনে হতে লাগল। সেই সাথে বুকে কিসের এক বেদনা যেন আটকে রইল! আহারে! আর ক্লাসে দৌড়াতে হবে না, পরীক্ষার চাপে পিষ্ট হতে হবে না, পরীক্ষা শেষের খুশিটা বোধহয় এই শেষ হয়ে গেল, বন্ধুরা সব হারিয়ে যাবে, এই ক্যাম্পাসটা পর হয়ে যাবে চিরতরে….

অনেক স্মৃতি পিছু ফেলে ফিরতে হলো ধারাকে। তার রুমমেট মেয়েটার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে এর মাঝে। ফেরার আগে খুব কাঁদল দু’জন। প্রিয় জায়গাটাকে বিদায় জানিয়ে চোখ মুছে বাসে উঠে বসল ধারা। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবে।

এবার শরীর মনে অন্যরকম শক্তি চলে এসেছে। নিজেকে স্বাধীন ডানামেলা পাখি মনে হচ্ছে। সে বহুদিন ধরে যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে চাচ্ছে সেটা কেমন করে যেন আজ বুকের ভেতরটা জুড়ে বসেছে। এখন চাকরির চেষ্টা করবে সে। মা বাবাকে নিয়েই তার সুখের সংসার হবে।

বাড়ি ফিরে কিছুদিন জিরিয়ে নিল সে। তারপর লেগে গেল চাকরির আশায়৷ বাবা অবশ্য অনেকবার বললেন ফ্রিল্যান্সিং করে যথেষ্ট আয় হয়, শুধু শুধু বাইরে গিয়ে চাকরি করা কেন? এটাতে সময় দিলে চাকরির চাইতে বেশি ইনকাম করা সম্ভব।

ধারারও ইচ্ছে করে না নয়টা-পাঁচটার রুটিনে আটকে পড়ার! কিন্তু সারাদিন বাড়িতে বসে থাকলে তার অর্জিত আত্মবিশ্বাসটুকু যদি নষ্ট হয়ে যায়? সে আসলে ব্যস্ত থাকতে চায়, ভীষণ ব্যস্ত। ব্যস্ততায় হারিয়ে গিয়ে ভুলে থাকতে চায় সবটুকু কষ্ট, না পাওয়ার যাতনা, আত্মীয়-পরিজনদের কটু কথা, মগজে আলোড়ন তুলে দেয়া অতীত…সব….

চাকরি একটা পেয়েও গেল সে। ছোটো পোস্ট, কিন্তু কাজ অজস্র। এটাই চেয়েছিল সে। কাজে ডুবে গেল পুরোপুরি। কলিগদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। বলা চলে নতুন একটা জগতে ঢুকে গেল সে।

“গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে কারে ভালোবাসে! —
পাখির মতন কেঁপে — ডানা মেলে — হিম চোখ বুজে
অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে
উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে —
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে, তবু — ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসেঁ —
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!”

জীবনানন্দ পড়তে গিয়ে থমকে যেতে হয় প্রায়ই। অবসর সময়টা বড্ড পোড়ায় ধারাকে। আচ্ছা, তার তো এমন ছন্নছাড়া পাখি হবার কথা ছিল না। কথা ছিল সুখী সংসার হবে। এমন হতচ্ছাড়া নির্জীব, নিষ্প্রাণ, ম্লান একটা জীবন সে কখনো চায়নি! তবে কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে এখন?

ব্যস্ততা সব ভুলিয়ে দেয় তাকে, কিন্তু তার মা বাবাকে কী দিয়ে ভোলাবে? বাবা রিটায়ার করেছেন কিছুদিন আগে। আগের চেয়ে অনেক স্থবির হয়ে পড়েছেন এখন। মা গুম হয়ে থাকেন সবসময়। মা বাবার চিরাচরিত খুনসুটি হারিয়ে গেছে কোন অতলে! তাদের মুখে বয়সের ভাজ পড়ছে, পড়ছে চিন্তার ভাজ। শুধু তার শোকে মানুষ দুটো অকালবৃদ্ধ হয়ে পড়ছে। তাদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয় না ধারার।

চিৎকার করে তাদের বলতে ইচ্ছে হয়, আমি সুখী আছি! আমাকে নিয়ে ভেবো না! কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয় কথাটা। বলতে পারে না তাই বড় মুখ করে।

মা বাবা হয়তো ভরসা পেতেন তার বিয়ে দিতে পারলে। কিন্তু তারা বিয়ের কথা সাহস করে তোলেন না ধারার সামনে। আর ধারা বিয়ের কথা ভাবেও না৷ ভাবতে কখনো মন সায় দেয় না।

শুধু অধরা স্বপ্নের মতো কিছু তাকে ডেকে যায়। সেটা কী? বুঝে উঠতে পারে না ধারা৷ সুখ? শান্তির জীবন?

বর্ষাকাল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে আজ। অফিস থেকে বের হয়ে বিপদে পড়ে গেল ধারা। কী করে বাড়ি ফিরবে? আষাঢ়ী ঢল নেমেছে। কখন থামবে ঠিক নেই। বাসগুলো যাত্রী বোঝাই। রাস্তায় জমে যাচ্ছে পানি। সে শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি নিয়ে পানি ডিঙিয়ে বাড়ি যাওয়া কী করে সম্ভব কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না।

একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশেপাশে অনেক মানুষ৷ ঠিক পাশেই একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। না তাকিয়েও ধারা বুঝতে পারছে ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ধারা চেষ্টা করছে ছেলেটাকে এড়িয়ে যেতে, কিন্তু সে যত সরে দাঁড়ায়, ছেলেটাও সরে তার কাছাকাছি চলে আসে।

ধারা একটা কড়া কথা বলার জন্য ছেলেটার দিকে তাকাল। তারপর ভীষণ অবাক হয়ে বাচ্চাদের মতো চেঁচিয়ে বলল, “ডক্টর শাহেদ!”

শাহেদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “চিনতেই তো পারোনি।”

“আমি আপনাকে দেখিনি আসলে…” ধারার উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মুখটায় রক্ত উঠে আসছে।

“তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, পথে বৃষ্টিতে পড়ায় এখানে এসে তোমাকে পেয়ে গেলাম।”

“আমাদের বাড়িতে?”

“হ্যাঁ, যেতে পারি না?”

“অবশ্যই পারেন।”

“বৃষ্টি আরও অনেকক্ষণ হবে, চলো মলের ভেতর কফিশপে গিয়ে বসি।”

“আচ্ছা।”

কফিশপে বসে অনেক কথা হলো। ধারা বর্তমান মানসিক পরিস্থিতি, কর্মজীবন অনেক কিছু নিয়েই বলল। শাহেদও নিজের জীবনের কথা বলল৷ আগে কখনো সে নিজের সম্পর্কে বলেনি। আজ বলে গেল অনেক কথাই। কেউ নেই তার। ছোটোবেলায় মা বাবা মরে গেছে৷ এখন থাকার মধ্যে এই রোগীরাই আছে। জীবনটা খারাপ কাটে না রোগীদের সাথে।

শাহেদও কত একা! নিজের সাথে মিল খুঁজল ধারা। সে জানে একটা বয়সে একা থাকা খুব কষ্টের। “আমার মন ভালো নেই, একটু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?” বলার মতো মানুষটাও যার নেই সে কেমন করে ভালো থাকে?

তারা যখন কফিশপ থেকে বের হলো, তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। সন্ধ্যার আকাশ ভেসে যাচ্ছে অপার্থিব রক্তিম আলোয়। রাস্তায় থৈ থৈ করছে পানি৷

আচমকা কিছু না বলেই ধারাকে কোলে তুলে নিল শাহেদ। কৈফিয়তের সুরে বলল, “এভাবে না গেলে শাড়ি পরে কেমন করে যাবে তুমি?”

ধারা কিছু বলল না উত্তরে। সে তাকিয়ে আছে শাহেদের থুতনির নিচে কাটা দাগটার দিকে৷ ঠিক বহুদিন আগে দেখা স্বপ্নের মতো!

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

★ঈদ মোবারক সবাইকে★

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here