“লাল রঙে তোকে খুবই বাজে লাগে। তারপরেও কেন পড়িস? আরো যেই না চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা। কুঞ্জলতা নামটা তোর সাথে একদম বেমানান। আয়নায় দেখ একবার নিজেরে। আবার সাজ গোজ করছস কত্তটি! মাথা গেছে তোর?”
ঐশ্বর্যের কথা শুনে কুঞ্জলতা নীরবে অশ্রু বিষর্জন দেয়। এলাকায় সেরা সুন্দরীদের মধ্যে তাকেও একজন দাবি করা হয়। আর সেখানে নিজের পছন্দের মানুষটার কাছেই তার নেই কোনো দাম। ঐশ্বর্য তার ফুফির ভাসুরের ছেলে হয়। তাদের সাথে কুঞ্জদের অনেক ভালোই মিল আছে। তাইতো কুঞ্জের বোনের বিয়েতে তাদেরও একসপ্তাহ আগ থেকেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছে। সবাই আরো আগে এলেও ঐশ্বর্য এলো বিয়ের দিন। কুঞ্জ মাত্রই সেজেগুজে নিজ কক্ষ থেকে প্রস্থান করছিল। ওমনি কোথা থেকে ঐশ্বর্য এসে হাজির। কুঞ্জ ঐশ্বর্যকে পছন্দ করে তা ঐশ্বর্য জানে কিন্তু কুঞ্জকে সে ব্যাপারে বুঝতে দেয়নি। সে কুঞ্জকে কেন যেন সহ্য করতে পারেনা। কুঞ্জর প্রতি তার বিতৃষ্ণায় ভরা। কুঞ্জ যখন তার সামনে নতুন জামা আর বেশি করে সাজ দিয়ে হাঁটে তখন তার ইচ্ছে করে কুঞ্জকে নদীতে চুবিয়ে দিতে আচ্ছামতো। তবে সে অপারগ! এমন তো আর সম্ভব নয়। এই যে এখন কুঞ্জ কাঁদছে তার ইচ্ছে করছে ঠাঁটিয়ে একটা চড় দিতে। এই কুঞ্জর এক দোষ! ঐশ্বর্য একটু কটু কথা বলতেই কেঁদে গা ভাঁসিয়ে দেবে। বাইশ বছর বয়সী তরূণী যদি এখন এমন উদ্ভট আচরণ করে তাহলে আরো বেশি বিরক্ত লাগে। ঐশ্বর্য গটগট শব্দ তুলে পায়ে হেঁটে চলে যায়। কুঞ্জর কান্না থেমে যায়। নিজেকেই বকতে থাকে সে। যেই লোক তার কদর করেনা তার জন্য কেন কাঁদবে সে? পরমুহূর্তেই আবার কেঁদে দেয় কারণ একটাই! লোকটা কেন তার কদর করেনা? এই পাইলটটাকে যে সে পছন্দ করে তা কী সে বোঝেনা? বোঝে, বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। কুঞ্জ নিচে নেমে আসে। বড় গেটের কাছে ভাইয়েরা নতুন বর আটকেছে আর ছোট গেটে তারা মেয়েরা আটকাবে সেই প্রস্ততিই চলছে।
মেয়েরা সব দলবেধে দাঁড়িয়ে আছে। বরের বাড়ির ছেলেগুলো খুবই বাঁচাল। ঐ গেটে নাকি মাত্র দশহাজার দিয়েছে তারা। কুঞ্জ তো তা শুনে অবাক হয়। এতো বড়লোক বাড়ির ছেলের এইখানে দুইলাখ দিলেও কম পড়বে সেখানে দশহাজার দিয়েছে! পরেই আসল কাহিনী জানতে পারে সে। তার দুলাভাই পঞ্চাশ হাজার দিতে নিলে নাকি তার একটি বন্ধু খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে তা দশ হাজার করে দেয়। কিন্তু কীভাবে করেছে তা সে জানেনা! তবে ভাইয়েরা এখন বিরাট দায়িত্ব সপেছে বোন গুলোর উপরে। যে করেই হোক পঞ্চাশ উদ্ধার করতেই হবে। এই যে গেটটা দিয়েছে এটাতেই তো ষাট হাজার গিয়েছে। কুঞ্জর বাপ চাচা কৃপণতা না করে শুধু টাকাগুলো ঢেলেছে। উল্টা পাল্টা কাজেও কতগুলো টাকা নষ্ট করেছে তারা। আর সেই বিয়ের বরযাত্রী হয়ে পঞ্চাশ দিবেনা তা হয়?
বরযাত্রী ভাবতেই পারেনি দ্বিতীয় গেট নামক কিছুর সম্মুখীন হবে। এই বুদ্ধিটা অবশ্য কুঞ্জর ছিল। তারা মেয়েরা এই প্ল্যান করেছিল একটা কারণে যে ভাইয়েরা তাদের টাকার ভাগ দিবেনা। তাই নিজেরাও আলাদা করে বেশি না মাত্র বিশ হাজার নিবে। কিন্তু! এখন উল্টোই হয়েছে। যাক তাও ভালো আগেই সব কিছু ঠিক করা ছিল। এখানে না পেলে তৃতীয় গেইট মানে স্টেজ আছে। কোনো ব্যাপার না!
দুলাভাই এবারও পঞ্চাশ দিতে নিলে আবারও তার একটি বন্ধু তাকে আটকায়। কুঞ্জ যেহেতু সবার সামনে দাঁড়িয়েছে তাই সে ব্যাপারটা স্পষ্ট দেখছে ও বুঝছে। অতি সুদর্শন যুবক সে। কুঞ্জর নতুন দুলাভাই ইমরান সেই যুবককে বলছে,
“দেখ সৌহার্দ্য এমনটা করিস না। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে পরে আফসানা জানলে আমাকে বিয়েই করবেনা। আমার শালারা নরম হলেও শালীরা বারুদ! প্লিজ!”
কুঞ্জ সন্তুষ্ট হয় তবে ইমরানের কথায় নয় সৌহার্দ্যের নাম জেনে। মানুষটার সাথে নামটার দুর্দান্ত মিল পেয়েছে তাই। কুঞ্জ আরো বেশি পুলকিত হয় সৌহার্দ্যের গলার আওয়াজ শুনে। গম্ভীর কন্ঠে সে বলছে,
“উহু! তারা যেমন জিততে চায় আমরাও তেমন জিততে চাই। তারা যত বেশি টাকা পাবে তত তাদের জিতের পার্সেন্টেজ বাড়বে। আমরা যত কম দিতে পারব তত আমাদের বাড়বে। তাই এক চুলও ছাঁড় নয়।”
কুঞ্জর এবার কেন যেন সৌহার্দ্যের উপর রাগ চড়াও হয়। মানে কী? লোকটা হার জিত নিয়ে পড়ে আছে কেন? হারবিরোধী লোক নাকি সে? এখানে হারের কি আছে! জিতের কি আছে! আচ্ছা যদি কিছু থেকেই থাকে তবে হয়ে যাক লড়াই। আজ কিছু একটা করে হলেও জিততে হবে। সৌহার্দ্যের অহমিকা ভেঙে চুড়মার করতে হবে। কুঞ্জ হুট করেই হাতের মালাটির দিকে তাঁকায়। ভেবেছে টাকা দেওয়ার পর নতুন দুলাভাইকে মালা পড়াবে কিন্তু এবার তো এই মালা সে অন্যকাজে লাগাবে।
কুঞ্জ হুট করেই মালাটা সৌহার্দ্যের গলায় চেপে ধরে। আকস্মিক কাজটায় উপস্থিত সব মানুষ তব্দা খেয়ে যায়। কুঞ্জ তার পাশে থাকা চাচাতো বোন নিশাকে তাড়া দিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি পঞ্চাশ নে দুলাভাইয়ের হাত থেকে। নাহলে আজ এই লোকটাকেই এইভাবেই জব্দ করে রাখব।”
সাধাসিধে ইমরান চট করেই টাকা নিশার হাতে দিয়ে দেয়। তাতেই কনে পক্ষের সবার মধ্যে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। কুঞ্জও সৌহার্দ্যকে ছেড়ে দেয়। তবে গলায় মালাটা ঠিকই ঝুলে থাকে। যেন তারা মাত্র মালাবদল সেড়েছে! সৌহার্দ্যের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ হামলাতে সে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়েছিল সেই সাথে গলায় টান পড়াতে কথাও বলতে পারছিল না। কাজটা যেন খুব দ্রুতই হয়ে যায়। রাগে তার চোখ লাল হয়ে গেছে ও চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। মেয়েটিকে তুলে আছাড় মারতে চাইছে সে। সাহস তো কম নয় তার? ইব্রাহীম সৌহার্দ্যকে সে এভাবে হেনস্তা করেছে? ইমরান সৌহার্দ্যের দিকে ভীত চাহনিতে তাঁকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য একবার তাকে পরখ করে নেয়। চোখ দিয়েই যেন বলছে,
“বিয়েটা ভালোই ভালোই মিটতে দে। তারপর দেখবি তোর একদিন কী আমার একদিন!”
সৌহার্দ্যের চোখ মুখ লাল হয়ে যাওয়াতে বরের জন্য রাখা শরবত সৌহার্দ্যকেই খাইয়ে দেওয়া হয়। কুঞ্জর মায়া হয়! শুভ্র মুখটি লাল হয়েছে কেমন! নিশ্চয়ই কষ্টও খুব হয়েছে। কিন্তু তারও তো কিছু করার ছিল না। সৌহার্দ্যের দেখানো অহংকারটা সে যেন নিতে পারেনি। তবে প্রকৃত পক্ষে সৌহার্দ্য কি অহংকার করেছে নাকি তারই বুঝতে অসুবিধা হয়েছে?
২
বন্ধুদের সাথে গোল হয়ে বসে আড্ডায় ব্যস্ত ঐশ্বর্য। তার কোনো দিকেই খেয়াল নেই। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখে তার মেজাজটাই বিগড়ে যাচ্ছিল। কুঞ্জর বাড়াবাড়িটা সে একদমই পছন্দ করেনি। এইসব কারণেই কুঞ্জকে তার মহাবিরক্ত লাগে। মেয়েটির সবকিছুতেই অতিরিক্ত না করলে বোধ হয় চলেনা। ঐশ্বর্যের বন্ধু একজন হুট করেই বলল,
“কুঞ্জলতাকে আজ কিন্তু অসাধারণ লাগছে। যেমন সাজ তেমন তেজ! আহ্! কি এক কেলমা দেখিয়েছে না! আমি দুই হাজার নিয়ে নিয়েছি তার মধ্য থেকে। তোরা কিছু নেস নি?”
বাকি সবাই আফসোস করতে লাগলো ভাগাভাগির সময় কেন ছিলনা! একমাত্র ঐশ্বর্যের মধ্যে সেসবের রেশমাত্র নেই। ভাগ বাটলার সময় সেও সেখানে ছিল কিন্তু ইচ্ছে হয়নি নেওয়ার। এসব টাকার তার কী দরকার? কী যে মজা পায় মানুষ এভাবে অন্যের টাকা হাতিয়ে! ঐশ্বর্য তো সেখানেই বিড়বিড় করে কুঞ্জকে উদ্দেশ্য করে বলেছে,
“ছোটলোক!”
কুঞ্জর খোরগোশের মতো খাড়া কানে তা ঠিকই পৌঁছেছে। তবুও সে চুপ থাকে ঐশ্বর্য তো শুধু তাকে কোনো না কোনো কারণে এভাবে কষ্ট দিয়েই থাকে। তবে আজ কুঞ্জর মাথায় ঐশ্বর্য নামক যন্ত্রণাটা কাজ করছেনা। সৌহার্দ্য নামক ঔষুধ টা খুঁজছে সে। যেটা কিছুক্ষণ আগেই তাকে ঐশ্বর্য নামক যন্ত্রণা ক্ষণিকের জন্য হলেও ভোলাতে সক্ষম হয়েছে।
বড় হলরুমটায় গিয়ে কুঞ্জর অস্থির চোখ দুটো সৌহার্দ্যকেই খোঁজে। পেয়েও যায়! একটি টেবিলে সে একা বসে আছে। হাতে লেমনেড্ দেখা যাচ্ছে বোধ হয়। কুঞ্জ মৃদু পায়ে সেদিকেই গমন করে। শরীর কিছুটা হলেও কাঁপছে কারণ অজানা! সে কী ভয় পেয়েছে সৌহার্দ্যকে? না ভয় পায়নি তবে! — এসব ভেবেই সে এগিয়ে যায়।
নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লাল লেহেঙ্গা পরিহিত কন্যাকে একবার আড়চোখে দেখে নেয় সৌহার্দ্য। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। ইচ্ছে করছে কুঞ্জকে কষে থাপ্পড় মারতে। কিন্তু সে কিছুতেই এটা করবেনা। এসব কাপুরুষদের কাজ। সে অবশ্যই কাপুরুষদের দলের নয়। নিতান্তই সুপুরুষ সে। তাইতো তার ভয়ঙ্কর ক্রোধ থেকে এখনও বেঁচে আছে কুঞ্জ।
“একটু বসি আপনার পাশে?”
কুঞ্জর প্রশ্নে সৌহার্দ্য চোখ তুলে তাঁকায়। তখনকার মতো তেজ নিয়ে মেয়েটি কথা বলেনি। অতি সুমিষ্ট স্বরেই সে তাকে যেন অনুরোধ করে। সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়। কিছুটা ঝাঁঝ দেখিয়ে বলে,
“আশেপাশে আর কী জায়গা নেই?”
“আমি নিশ্চয়ই আপনার সাথে বসতে চাই তাই এতগুলো খালি টেবিল পাড় করে এসেছি।”
“কেন? পুনরায় আক্রমণ করবেন?”
“করলেও করতে পারি।”
“নিজেকেই বিশ্বাস করেননা দেখছি।”
“তা একটু করিনা। মন মস্তিষ্কের কথা তো আর আমি বলতে পারিনা। তারা কখন কি চায় তা নিজেরাও জানেনা। আমি তো সেখানে নিরীহ প্রাণী।”
“নিরীহ আর আপনি?”
“সন্দেহ আছে জনাব?”
“আলবাত আছে।”
“সৌহার্দ্য নামটা চমৎকার।”
সৌহার্দ্য প্রতিউত্তর করেনা। কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা তার। কুঞ্জ তার পাশে বসে বলে,
“আরো চমৎকার একটি নামও এই দুনিয়াতে আছেন। জানেন?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকায়। আরেকটি নাম কি তার যেন জানতে ইচ্ছা হয়। কুঞ্জ হেসে বলে,
“আরেকটি নাম হলো কুঞ্জ, কুঞ্জলতা সেরনিয়াবাত।”
সৌহার্দ্য থমকায়। কুঞ্জলতা তার প্রিয় ফুল। এই কুঞ্জলতা সেরনিয়াবাত কি এই মেয়েটা? কুঞ্জ মৃদু হেসে বলল,
“কী হলো? নাম শুনেই প্রেমে পড়লেন? আমার নামটাই এমন প্রেমে না পড়ে উপায় আছে!”
সৌহার্দ্যর হাসি পায় খুব। সে হো হো করে হেসে ওঠে আর সেই মনমুগ্ধকর হাসি কুঞ্জ নিজের চোখে বন্ধী করে নেয়। লোকটি আসলেই নামের মতো চমৎকার এবং অতি সুদর্শন। কুঞ্জ সেই দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেই দেখে ঐশ্বর্য তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। আশ্চর্য! এভাবে তাঁকানোর মানে কী? বিড়বিড় করে কথাটি বলল কুঞ্জলতা।
#চলবে।
#কুঞ্জলতা (পর্ব-১)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
(গল্পটি ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন। খুব বেশি হলে তিন বা চার পর্বের হবে। হুট করেই শুরু হচ্ছে পরীক্ষা। হ্যাঁ আমার সামনে পরীক্ষা তাই আমি বড় গল্প লিখতে পারবো না। সিন্ধুর নীল ডিসেম্বরে দিব কারণ সেটি উপন্যাস আমি চাইনা আমার ব্যস্ততার জন্য আপনারা অপেক্ষা করে বিরক্ত হোন। উপন্যাস টানতে পারব না এই মুহূর্তে তাই এমন ছোট গল্পই লিখব আপাতত। যাতে দ্রুত শেষ করতে পারি। দয়া করে আমাকে একটু বুঝুন। আমি ডিসেম্বরের আগে কোনো ভাবেই উপন্যাসটি শুরু করতে পারব না।)