কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৫.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৫.
ঐচ্ছি ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে। ঘাড় কাত করে পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই কিন্তু আবার আয়নার দিকে তাকাতেই আবার সেই প্রতিবিম্বটি কে দেখে। ঐচ্ছি এবার ভীষণ ঘাবড়ে যায়। চটজলদি উঠে গিয়ে রুমের লাইট জ্বালায়। পুরো রুমে সে ব্যতিত আর কাউকেই দেখতে পায় না সে। ঐচ্ছি আবারও গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তার খাটের উল্টো পাশে বিশাল চাদর জড়ানো কাউকে দেখতে পেয়ে ঐচ্ছি ভয়ে শিউরে উঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘ক-কে আ-আপনি?’

আয়নার মাঝে প্রতিবিম্বটি বলে,

‘ভাবিজান, আমি সাদমান। রাফসান ভাইজানের ছোট ভাই। চিনতে পারেননি আমাকে?’

ঐচ্ছি এবার তার ললাট কুঁচকে ফেললো। এক ভয়ংকর রাগে তার সারা শরীর রি রি করে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে এল। প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে ঐচ্ছি বললো,

‘আপনার সাহস তো কম না, এইভাবে এত রাতে আপনি কোন সাহসে আমার রুমে এলেন?’

সাদমান মাথানত করে বিনয়ের সুরে বললো,

‘ক্ষমা করবেন ভাবিজান, আপনার সাথে খুব জরুরি কথা ছিল তাই আমাকে এইভাবে আসতে হয়েছে।’

ঐচ্ছির রাগে যেন ঘি পড়ল। জ্বলে উঠল ঐচ্ছি। বক্র কন্ঠে বললো,

‘আমার সাথে আপনার আবার কিসের জরুরি কথা? এক্ষুণি এখান থেকে চলে যান বলছি, নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

রাফসান ফুঁস করে নিশ্বাস ফেললো। মিনতির সুরে বললো,

‘প্লিজ ভাবিজান আমার কথাটা একটু শুনুন। আমি আর কখনোই আপনার সামনে আসবো না। আপনার সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি ভাবিজান। আমি বেশি সময় নেবো না। একটু খানি সময় দিন আমায়,প্লিজ!’

ঐচ্ছি রাগে দাঁতে দাঁত পিষছে। রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ।

‘একদম ভাবি ডাকবেন না। আমি আপনার ভাবি না, বুঝতে পেরেছেন? আর এখন কি বলার বলে জলদি এখান থেকে বিদায় হোন।’

সাদমান দুঃখি দুঃখি মুখ নিয়ে ঐচ্ছির দিকে তাকালো। ঐচ্ছির চোখে মুখে স্পষ্ট রাগ। সাদমান ছোট্ট করে একটা ঢোক গিললো, নরম সুরে বললো,

‘ভাইজান আপনাকে খুব ভালোবাসেন, ভাবিজান। আর ভাইজা..’

চেচিয়ে উঠে ঐচ্ছি। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘বললাম না আমায় ভাবিজান ডাকবেন না। আর এখন কি আপনি আপনার ভাইয়ের হয়ে উকালতি করতে এসেছেন।(একটু থেমে)..এই এক মিনিট, এক মিনিট, আপনার ভাই তো আমাকে তিনমাস সময় দিয়েছে। বলেছে এই তিনমাস উনি আমাকে বিয়ে সম্পর্কে কোনোপ্রকার জোর জবরদস্তি করবেন না। ওওহহ আই সি, উনি তাই এখন আপনাকে পাঠিয়েছে। নিজে বিয়ের কথা বলতে পারবে না বলে এখন আপনাকে পাঠিয়েছে তাই তো? বাহ, আপনার ভাইতো দেখছি ভীষণ চালাক।’

সাদমান চোখ মুখ কুঁচকে এলো। কিছু বুঝতে না পারার ভঙ্গিমা করে বললো,

‘এসব কি বলছেন, ভা..(বলতে গিয়েও থেমে যায়, নিশ্বাস ছেড়ে বললো) তিন মাসের সময় মানে? কিসের সময়? আর ভাইজান তো আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি।’

ঐচ্ছি অধর বাঁকালো। বললো,

‘আমাকে আপনারা খুব বোকা ভাবেন তাই না? যাকগে, আমি আর আপনার সাথে কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি না। আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান।’

সাদমান অসহায় দৃষ্টিতে ঐচ্ছির মুখের দিকে চেয়ে রইল। বিষন্ন কন্ঠে বললো,

‘ভাইজান খুব কষ্ট পাচ্ছে। উনি খুব ভালোবাসে আপনাকে, ভাবিজান। দয়া করুন, আমার ভাইজানকে আর কষ্ট দিয়েন না। প্লিজ, ভাবিজান; প্লিজ।’

সাদমানের অনুরোধ, ঐচ্ছি ব্রু কুঁচকে কিছু বলবে তার আগেই সাদমান সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। ঐচ্ছি চুপচাপ বিছানায় বসে পড়ে। যতই সে এইসব ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে ততই সে আরো বেশি করে সেইসবে জড়িয়ে পড়ছে। বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। তার সাথেই কেন এমন হচ্ছে? সেও তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে করে চাই, ভালোবাসাময় একটা ছোট্ট সংসার গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু এইসব কিছু কোনো জ্বীনের সঙ্গে না। ঐচ্ছির কান্না পাচ্ছে, কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে তার কণ্ঠনালীতে আটকে আছে। গলা কাঁপছে তার। তার সাথেই কেন এমন হলো। ঐ বজ্জাত জ্বীনটার নজর কেন তার উপরই পড়ল, কেন?

________________________

সময় গড়ালো। আজ এক সপ্তাহ, ঐচ্ছি আর রাফসানের দেখা হয় না কথা হয় না। অবশ্য রাফসান মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে ঐচ্ছিকে দেখেছে কিন্তু ঐচ্ছি দেখেনি আর দেখতে চায়ওনি। ঐচ্ছি যেন এইভাবেই ভালো আছে। ঐ জ্বীনটা যেন আর কোনোদিন তার সামনে না আসে সেটাই সে মনে প্রাণে চায়।

ঝলঝলে এক সকাল। ঐচ্ছির মেজাজ আছ ফুরফুরে। ঢাকা থেকে আজ তার ছোট খালামনি আসছে। সকাল থেকে তাই তার ব্যস্ত সময় কাটছে। আজ সে ভীষণ খুশি।তবে তার এই খুশির আরো একটা বিশেষ কারণ আছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবারও দেখা হবে তার সাথে। ইশ, ভাবতেই শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে চলছে। ওয়াশরুম থেকে মাত্রই গোসল করে বের হলো ঐচ্ছি। হালকা নীল রঙের একটা থ্রী পিছ পরেছে সে। নীল রঙ টা সাইভিদের খুব প্রিয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত ঐচ্ছি। অধর কোণে মিশে আছে মিষ্টি হাসি। আজ অনেক দিন পর তার মনে আনন্দ লেগেছে। সেই আনন্দের মূল চাবিকাঠিই হলো সাইভিদ।

কলিংবেলটা বেজে উঠতেই ঐচ্ছি ছুট লাগালো। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে তার খালামনিকে দেখতে পেল। ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। তাহেরা বেগমও দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছোট বোনের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। একে একে বাসার ভেতরে ঢুকলো সবাই, ঐচ্ছির খালু হাতের ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে ঐচ্ছির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন,

‘কেমন আছো, মামুনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি খালু। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’

‘আচ্ছা খালু, আপনি ভেতরে যান। আর ট্রলিটা আমাকে দিন আমি রুমে রেখে আসছি।’

ট্রলিটা নিয়ে ঐচ্ছি গেস্ট রুমে চলে গেল। মনটা ভীষণ অস্থির অস্থির করছে সাইভিদকে দেখার জন্য। কিন্তু বেটা গেলো কই? খালা,খালু চলে এসেছে অথচ তার কোনো দেখা নেই। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমের কাছে যেতেই ঐচ্ছি কানে খুব চেনা কারোর কন্ঠস্বর ভেসে আসে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে মানুষটিকে দেখা মাত্রই খুশিতে তার মন নেচে উঠে। ঐ তো সাইভিদ। ইশ, আগের থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে। উফ সাইভিদের সেই টোল পড়া হাসি। ঐচ্ছি জোরে একটা নিশ্বাস নিল। তারপর ঠোঁট কামড়ে লজ্জাসুলভ একটা হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে বললো,

‘কেমন আছো, সাইভিদ ভাই?’

সাইভিদ কপাল কুঁচকে ঐচ্ছির দিকে তাকাল। মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে। পাঁচ বছর আগে সে লাস্ট ঐচ্ছিকে দেখেছিল, তখন ঐচ্ছিকে পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগতো। তবে এখন আর লাগছে না। যৌবনের পদার্পণ করা এক সদ্য যুবতী মেয়ে। হালকা নীলে মেয়েটাকে মিষ্টি লাগছে। সাইভিদ হাসলো, সেই হাসি ঐচ্ছির বুকে বিঁধল। সাইভিদ মুচকি হেসে বললো,

‘ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’

ঐচ্ছি লাজুক কন্ঠে বললো,

‘আমিও ভালো।’

‘ঐচ্ছি, মা যা তো রান্নাঘর থেকে একটু শরবতের স্ট্রেটা নিয়ে আয়।’

মায়ের কথা মতো ঐচ্ছি মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। রান্নাঘরে এসেই সে বুকের উপর হাত রেখে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। উফফ, হৃৎপিণ্ডটা তার খুব জোরে জোরে বিট করছে। এই সাইভিদকে দেখলে সবসময়ই তার সাথে এমন হয়। কি আছে এই ছেলেটার মাঝে কে জানে?
শরবতের স্ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রেখে ঐচ্ছি তার মায়ের পাশে বসে। তাহেরা বেগম একে একে সবার হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দেয়। ঐচ্ছি আড়চোখে সাইভিদকে দেখতে ব্যস্ত। এতদিন বিদেশে থাকায় তার মধ্যেও একটা বিদেশী বিদেশী ভাব চলে এসেছে। গায়ের রংটা আগের থেকেও বেশি ফর্সা হয়ে গিয়েছে। আর তার চুলগুলো তো বরাবরের মতোই ঐচ্ছির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল তার। হালকা বাদামী রঙের। সাইভিদের চোখের রঙ আর চুলের রঙ এক। যেন এই কারণেই সাইভিদকে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। আর ও যখন হাসে। কি মারাত্মক টোল পড়ে গালে। ঐচ্ছি মেয়ে হয়েও তার হাসিতে টোল পড়ে না। কিন্তু সাইভিদ ছেলে হয়েও তার কত সুন্দর টোল পড়ে। এই নিয়ে আগে ঐচ্ছি প্রায়ই নাক ফুলাতো। সাইভিদ তখন তার গাল টেনে মিষ্টি হেসে বলতো,

‘টোল পড়া লাগবে না পুচকি, তোর এই মিষ্টি হাসি দেখলে এমনিতেই ছেলেরা নিহত হয়ে যাবে।’

ইশ, তখন যে ঐচ্ছি কি লজ্জাটাই না পেত। কথাগুলো ভাবতেই ঐচ্ছি মুচকি হাসলো। সেই হাসি সাইভিদেরও দৃষ্টিগোচর হলো। সেও মৃদু হাসলো, তবে সেই হাসি ছিল প্রাণহীন বিষন্ন হাসি।

ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ানোতে ব্যস্ত, সাইভিদ। বুকের ভেতরে কিঞ্চিত চাপা কষ্ট অনুভব করছে সে। সেই কষ্টটা কি কাউকে হারানোর? সাইভিদ বুঝে উঠতে পারেনা। তখনই হুট করে তার অধর জোড়ার মাঝখান থেকে কেউ সিগারেটটা টান দিয়ে বের করে ফেলে। সাইভিদ বিরক্ত চোখে সামনে তাকাতেই দেখে ঐচ্ছি। চোখে তার স্পষ্ট রাগ দেখতে পেয়ে বাঁকা হাসে সাইভিদ। সাইভিদের হাসিতে ঐচ্ছি আরো বেশি তেতিয়ে উঠে। রাগ দেখিয়ে বলে,

‘তোমার এই অভ্যাস এখনো যায়নি, তাই না ভাইয়া? ভেবেছিলাম তো বিদেশ যাওয়ার পর এসব ছেড়ে দিবে, কিন্তু না। আমারই বোঝা উচিত ছিল, তুমি তো হলে মি. সাইভিদ জুবায়ের, তুমি আর যাই করো না কেন এই সিগারেট খাওয়াটা জীবনেও ছাড়বে না।’

সাইভিদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বললো,

‘এই তো বুঝেছিস? তাহলে আর এত পকরপকর করছিস কেন? দে সিগারেট দে আমায়।’

ঐচ্ছি সিগারেটটা ছুরে ফেলে দেয়। তাতেই সাইভিদ ভয়ংকর রেগে যায়। সে সবকিছু পছন্দ করলেও তার এই সিগারেট নিয়ে টানাটানি তার মোটেও সহ্য হয়না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। কপালের শিরা ফুলে উঠে। এমনিতেই মনে শান্তি নেই, ভেবেছিল এই নিকোটিনের ধোঁয়ার মাঝে একটু শান্তি খুঁজবে কিন্তু ঐচ্ছির কারণে তাও আর পারলো না। কেন যেন হঠাৎ করেই তার ঐচ্ছির উপর ভীষণ রাগ হয়। তবে রাগটা শুধু এই সিগারেট ফেলার কারণে না অন্য কারণে, কিন্তু সেই অন্য কারণটা সাইভিদেরও জানা নেই। সে হুট করেই ঐচ্ছির কোমর চেপে তাকে তার খুব কাছে নিয়ে আসে। হুট করেই এমন কিছু হওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে ঐচ্ছি। কেন যেন চোখ খুলে সাইভিদের দিকে তাকানোর বিন্দু মাত্র সাহস হচ্ছে না তার। সাইভিদকে এখন তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। মনে মনে পণ করে নিয়েছে আর যায় হোক এখন আর চোখ খুলবে না সে। কিন্তু তার সেই পণ বেশিক্ষণ টিকল না। অধর জোড়ায় কিছু একটার ছোয়া পেতেই চমকে উঠে চোখ মেলে তাকায় ঐচ্ছি।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here