কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৬.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৬.
সাইভিদ তার বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ঐচ্ছির ওষ্ঠাধর ছুঁইয়ে দিল। খানিকটা কেঁপে উঠল ঐচ্ছি। হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে সাইভিদের দিকে। সাইভিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঐচ্ছির লালচে অধরে। ঐচ্ছির যেন নিশ্বাস আটকে আসছে। সাইভিদের এতটা কাছে কখনো আসা হয়নি। আজ তাই এমন একটা পরিস্থিতিতে তার বুকটা ধরফর করছে। ঘোর কাটে সাইভিদের, ঐচ্ছিকে ছেড়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়। লজ্জায় মিঁইয়ে যাচ্ছে ঐচ্ছি। সাইভিদও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ভয়ানক এক অস্বস্তিতে ভুগছে দুজন। দুজনেই দুদিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সাইভিদ নিজেকে কিছুটা শান্ত করলো, হুট করেই সে খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। ঐচ্ছিকে এইভাবে কাছে টেনে নেওয়াটা তার একদমই ঠিক হয়নি। আফটার অল, দুদিন পর সে অন্য কারোর বউ হতে চলছে। এই সময় এমন একটা পরিস্থিতি মোটেও দৃষ্টিনন্দন না। সাইভিদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পেছন ফেরে তাকায়। ঐচ্ছিকে ডেকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছাদে তার মা চলে আসে। আয়েশা বেগম ছাদে এসেই ঐচ্ছিকে তাড়া দিয়ে বললেন,

‘এই ঐচ্ছি, তাড়াতাড়ি নিচে চল। রাফসান এসেছে।’

রাফসানের নাম শুনতেই চমকে উঠে ঐচ্ছি। রাফসান এইসময় তার বাড়িতে কেন আসবে? ঐচ্ছি চোখ মুখ কুঁচকে অবিশ্বাস্য চোখে তার ছোট খালামনির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘মানে কি, খালামনি? রাফসান এই সময় আমাদের বাড়িতে কি করছে?’

‘আমরাও তো সেটাই ভাবছি। বললো তোর সাথে নাকি কি জরুরি কথা আছে তোকে ডাকছে। চল তাড়াতাড়ি।’

ঐচ্ছির এবার রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ। তিন মাসের কথা বলে এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বেটা জ্বীনের আনাগোনা আবারও শুরু হয়ে গিয়েছে। বেটা অসভ্য, খবিশ একটা। ইচ্ছে করে নর্দমায় নিয়ে ইচ্ছে মতো চুবিয়ে আনি। ঐচ্ছি রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, দাঁত দিয়ে দাঁত চাপতেই তার মাথার দূপাশের শিরা ফুলে উঠে। ঐচ্ছির চোখে মুখে এমন উপচে পড়া রাগ দেখে সাইভিদ ভীষণ অবাক হয়। হবু বরের কথা শুনলে যেখানে মেয়েরা লজ্জায় নুয়ে পড়ে সেখানে ঐচ্ছি এতটা রেগে যাচ্ছে কেন? তার কি কোনোভাবে এই বিয়ে মত নেই? আয়েশা বেগম চলে যেতেই সাইভিদ তখন রসিকতার সুরে বললো,

‘বাব্বাহ, কি প্রেম দেখেছিস ঐচ্ছি? তোকে বোধ হয় খুব মিস করছিলো তাই বেচারা আর রাত দিন তোয়াক্কা না করেই তোকে দেখতে চলে এসেছে। কিন্তু, তুই এখনো এখানে এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, তোর বর তো তোর জন্য অপেক্ষা করছে নাকি?’

ঐচ্ছি অগ্নি দৃষ্টিতে সাইভিদের দিকে তাকায়। ঐচ্ছির এমন দৃষ্টি দেখে সাইভিদ কিছুটা ভড়কে যায়। তবে কিছু বলে না। তার মন বলছে ঐচ্ছির এই রাগের পেছনে কোনো গুরুতর কারণ আছে। ব্যাপারটাকে তাকে খুব ঠান্ডা মাথায় দেখতে হবে। ঐচ্ছিও সাইভিদকে কিছু বলে না। চুপচাপ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। তবে মনে মনে ঠিক করে নেয়, আগে ঐ জ্বীনটাকে দেখবে তারপর এই সাইভিদকে।

ফুঁস করে তপ্ত এক নিশ্বাস ফেললো ঐচ্ছি। চোখ মুখ স্বাভাবিক করে ড্রয়িং রুমে ঢুকলো। রাফসান তখন ঐচ্ছির বাবা আর খালুর সাথে কথা বলছে। ঐচ্ছিকে দেখা মাত্রই তার বাবা বলে উঠলেন,

‘মা, রাফসান এসেছে তোর সাথে নাকি কি জরুরি কথা বলবে। যা তো মা রাফসানকে তোর রুমে নিয়ে যা।’

ঐচ্ছি চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

‘আমার রুমে নেয়ার কি আছে? উনার যা বলার এখানেই বলুক।’

ঐচ্ছির বাবা মেয়ের কথায় ক্ষেপে গেলেন। কর্কশ কন্ঠে বললেন,

‘এটা কেমন ধরনের কথা, ঐচ্ছি? বললাম না রাফসানকে তোমার রুমে নিয়ে যাও। একদম আমার করার অবাধ্য হবে না।’

রাগে ঐচ্ছির মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে। রাফসানের দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন পারলে তাকে এক্ষুণি চিবিয়ে খাবে। দাঁতে দাঁত চেপে কোনোরকমে নিজেকে শান্ত করলো ঐচ্ছি। তারপর রাফসানের দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘চলুন।’

রাফসান সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে ঐচ্ছির পেছন পেছন তার রুমে এল। রুমের গিয়েই ঐচ্ছি তার রণচন্ডালী রূপ ধারণ করলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,

‘ঐ মি. জ্বীন, কি সমস্যা আপনার? এখানে কেন এসেছেন?’

রাফসান ঐচ্ছির বিছানার একপাশে আরাম করে বসে। ঐচ্ছির রুমের চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,

‘বাহ, রুমটা তো দেখছি খুব সুন্দর ভাবে গোছানো। আপনি তো বেশ গোছালো মেয়ে!’

ঐচ্ছি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

‘আপনি নিশ্চয়ই আমার রুম দেখতে এখানে আসেননি। এখানে কেন এসেছেন সেটা বলুন।’

রাফসান এবার পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঐচ্ছির উপর। মেয়েটা রেগে গেলে তার ফর্সা গাল দুটো রক্তিম হয়ে যায়। ওষ্ঠাধরে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুললো, রাফসান। নরম সুরে বললো,

‘আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ঐচ্ছি।’

খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে,ঐচ্ছি। রাফসান অমন নীল চোখের গাঢ় দৃষ্টিতে যেন তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। ঐচ্ছি ব্রু কুঁচাকালো। গলার স্বরের তেজ কিছুটা কমিয়ে বললো,

‘এখানে কেন এসেছেন, রাফসান? আপনি তো বলেছেন তিনমাস পর্যন্ত আমাকে বিয়ের ব্যাপারে কোনোপ্রকার জোর করবেন না। তাহলে?’

‘তিনমাস পর্যন্ত বিয়ে নিয়ে কোনো কথা হবে না সেটা ঠিকই বলেছি। তবে আপনার সাথে দেখা না করার কথা তো বলেনি। আমার ভাই সাদমান এই তিনমাসের সময়ের কথা জানতো না, আর না সেদিন রাতে আমি ওকে আপনার কাছে পাঠিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমি কিছু জানতামই না। আপনার কাছ থেকে যাওয়ার পর সাদমান আমাকে সব বলেছে। তখন আপনার মতো আমারও ওর উপর ভীষণ রাগ হয়, ছেলেটাকে সেদিন খুব বকি। অভিমান করে এতদিন আমার সাথে করা বলেনি। আসলে আমাকে বড্ড ভালোবাসে তো তাই এমন করে। আমার কষ্ট সেও সহ্য করতে পারেনা।(একটু থেমে) যাকগে সেসব, যেটা বলতে এসেছিলাম, আমি একটু আপনার খালাতো ভাই সাইভিদের সাথে দেখা করতে চাই। উনাকে কি একটু ডাকা যাবে?’

ঐচ্ছি বিস্মিত হয়। সেটাই স্বাভাবিক। রাফসান হঠাৎ সাইভিদের সাথে দেখা করতে চাইছে কেন? আর সাইভিদের নাম পরিচয়ই বা কি করে জানলো সে? ঐচ্ছির চোখে মুখে কৌতুহলের ছাপ দেখে বাঁকা হাসে রাফসান। তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘কি হলো, ঐচ্ছি? ডাকুন তাকে।’

ঐচ্ছি ঠোঁট কামড়ে মৌনতা নিয়ে সেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ডাইনিং রুমের কাছে যেতেই দেখে সাইভিদ ডাইনিং-এ বসে ফোট টিপছে আর আপেল খাচ্ছে। ঐচ্ছি সাইভিদের কাছে গিয়ে বললো,

‘ভাইয়া, একটু আমার রুমে চলো তো, রাফসান নাকি তোমার সাথে কথা বলবে।’

সাইভিদ আপেলে একটা বাইট দিয়ে ঐচ্ছির দিকে তাকায়। তারপর মুখের ভেতরে থাকা আপেলটা দাঁত দিয়ে চর্বণ করতে করতে বললো,

‘কেন রে আমার সাথে তোর বরের আবার কিসের কথা।’

ঐচ্ছি বিরক্তির সুরে বললো,

‘জানি না। চলো তুমি।’

এই বলে ঐচ্ছি বড় বড় পা ফেলে আবারও নিজের রুমে চলে গেল। সাইভিদ কিছুক্ষণ অবাক চোখে ঐচ্ছির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে সেদিকে হাঁটা দিল।

.

‘হ্যালো, মি. জেন্টাল ম্যান। আই এম সাইভিদ জুবায়ের। ঐচ্ছির কাজিন।’

কথাটা বলেই রাফসানের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় সাইভিদ। রাফসান স্মিত হেসে হাত মিলিয়ে বললো,

‘হ্যালো, সাইভিদ। আই এম রাফসান হোসাইন। ঐচ্ছির ফিয়ন্সি।’

ঐচ্ছি বাঁকা চোখে রাফসানের দিকে তাকায়। কিন্তু রাফসান আগের মতোই স্বাভাবিক। সে অধর কোণের হাসিটাকে আরো প্রগাঢ় করে বললো,

‘তা কেমন আছে আপনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা, তো চলুন বসে একটু কথা বলা যাক। আর ঐচ্ছি আপনি একটু আমাদের জন্য গরম গরম চা বানিয়ে আনুন। চায়ের সাথে আড্ডাটা জমে যাবে। কি বলেন, মি. সাইভিদ?’

সাইভিদ হেসে বললো,

‘একদম।’

ঐচ্ছি বড় বড় চোখ করে দুজনের দিকে তাকালো। মানে তারা এখন আড্ডা দিবে আর ঐচ্ছি তাদের জন্য চা বানাবে? আর এই বেটা খবিশ জ্বীন এমন ভাবে তাকে হুকুম দিচ্ছে যেন সে তার বিয়ে করা বউ। ঐচ্ছির দৃষ্টিকোণ আরো ধারাল হলো। কিন্তু তাতেও খুব বেশি একটা লাভ হলো না। রাফসান আবারও তাকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘কি হলো, ঐচ্ছি। এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, যান।’

ঐচ্ছি নাক মুখ ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ঐচ্ছি চলে যেতেই সাইভিদ রসিকতার সুরে বললো,

‘যা রাগি মেয়ে। একে সামলাতে কিন্তু আপনার বেশ বেগ পেতে হবে।’

সাইভিদের কথার প্রতি উত্তরে রাফসান কেবল হাসে। কিছু বলে না। রাফসানকে নিরব থাকতে দেখে সাইভিদ বললো,

‘কি ব্যাপার মি. রাফসান আমার সাথে কথা বলবেন বলে ডেকে এখন দেখি আপনি নিজেই একদম চুপ হয়ে আছেন?’

রাফসান মৃদু হাসে। ডানহাত দিয়ে চুল ঠিক করে সাইভিদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর কাট কাট গলায় বলে,

‘ঐচ্ছিকে আপনি পছন্দ করেন তাই না, মি. সাইভিদ জুবায়ের?’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here