কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ৮.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

৮.
গায়ের উড়নাটা ঠিক করতে করতে ডাইনিং এর একটা চেয়ার টেনে বসলো ঐচ্ছি। তাহেরা বেগমকে তাড়া দিয়ে বললো,

‘মা, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও। এমনিতেই যা লেইট হয়েছে আজকে বোধ হয় আর প্রথম ক্লাসটা পাবো না।’

তাহেরা বেগমও মেয়ের কথা মতো একটা প্লেটে খাবার বেড়ে দেন। ঐচ্ছি এক টুকরো রুটি মুখে দিয়েই অগোছালো দৃষ্টিতে ডাইনিং এ বসা বাকি মানুষগুলোর দিকে তাকায়। ঐচ্ছি খেয়াল করে সকলের মুখ কেমন যেন থমথমে। ব্যাপার কি? ঐচ্ছি জোরালো দৃষ্টি এবার সাইভিদের উপর নিবদ্ধ হয়। ডানহাতে সাইভিদ খাচ্ছে, কিন্তু তার বাম হাত জুড়ে আছে সাদা ব্যান্ডেজ। ঐচ্ছি আতকে উঠে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিগ্যেস করে,

‘তোমার হাতে কি হয়েছে, সাইভিদ ভাইয়া’

ঐচ্ছি চিন্তিত মুখে চেয়ে রইল সাইভিদের দিকে। কিন্তু সাইভিদের সেদিকে খেয়াল নেই। যেন ঐচ্ছির কথা তার কর্ণগোচর হয়নি। সে তার মতো খেয়েই যাচ্ছে। সাইভিদের কোনো হেলদোল না দেখে ঐচ্ছি এবার তার খালা খালুর দিকে ইশারা দিয়ে তাদের জিগ্যেস করে তারা কিছু জানে কিনা। কিন্তু তারাও চোখ মুখ কালো করে ইশারা করে জানায় তারাও কিছু জানে না। ঐচ্ছি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পুরো ধরণীর মানুষগুলো যদি এক হয়েও সাইভিদকে তার হাতের কথা জিগ্যেস করে তাহলেও সে কিছু বলবে না। সাইভিদ যখন কিছু বলতে চাই না তখন দুনিয়া উল্টে গেলেও তাকে দিয়ে কিছু বলানো যায় না। ঐচ্ছি জানে এখন প্রশ্ন করতে করতে মরে গেলেও সাইভিদ তার কথার কোনো জবাব দিবে না। তবে কেন যেন তার মনে হচ্ছে সাইভিদের কালকে রাত থেকেই রেগে থাকার কারণ ঐ জ্বীন। ঐ জ্বীনই কিছু একটা করেছে। নাহলে হুট করেই সাইভিদ এতটা রেগে যেত না। ঐচ্ছি আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ নিজের খাবার শেষ করে ভার্সিটিতে চলে গেল।

.

দিবাকরের উষ্ণ ছোয়ায় যেন প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত গাছের ডাল পালাগুলোও যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। চারদিক রোদে ঝলমল করছে। ঐচ্ছি ছোট ছোট চোখ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশিক্ষণ তাকানো যায়না, চোখের দৃষ্টিপট যেন ঘোলা হয়ে আসে। বারকয়েক বার চোখ পিট পিট করে ঐচ্ছি আবারো তার চোখের দৃষ্টি বাইরের দিকেই অব্যাহত রাখে। সায়মা খেয়াল করে ব্যাপারটা, ঐচ্ছি তখন থেকেই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লাসে কি পড়াচ্ছে তাতে বিন্দু মাত্র মনোযোগ নেই তার। সায়মা ঐচ্ছির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ঐ ঐচ্ছি, বাইরে কি দেখছিস এত? ক্লাসে মনোযোগ দে নয়তো পরীক্ষায় ডাব্বা মারবি।’

ঐচ্ছি তার চোখ ঘুরিয়ে সায়মার দিকে তাকায়। মেয়েটা উৎসুক মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,

‘ভালো লাগছে না ক্লাস করতে।’

সায়মা দাঁত কেলিয়ে হাসে। দুষ্টুমি করে বলে,

‘আহারে জিজুকে বুঝি খুব মিস করছিস? তাই তাকে ছাড়া আর কিছুই ভাল লাগছে না।’

ঐচ্ছি চোখ পাকিয়ে সায়মার দিকে তাকায়। সায়মা ঠোঁট টিপে হাসে। ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

‘থাপ্পড় খেতে মন না চাইলে চুপ থাক।’

‘আরে রাগ করছিস কেন? কয়দিন ধরেই তো দেখছি এমন মনমরা হয়ে থাকিস। কি হয়েছে জিগ্যেস করলে কিছু বলিসও না। তাই একটু মজা করে তোর মুডটা ভালো করার চেষ্টা করছিলাম আরকি। আচ্ছা দোস্ত বল না কি হয়েছে তোর? আচ্ছা, তুই কি বিয়েটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস? তোর যদি বিয়েতে মত না থাকে তবে তুই আন্টি আংকেলকে বারণ করে দে। তাহলেই তো হয়।’

ঐচ্ছি ভেজা গলায় বললো,

‘আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাতে কিছু যায় আসে না রে।’

চোখের পাল্লা প্রশ্বস্থ করে থমথমে গলায় সায়মা বললো,

‘মানে?’

ঐচ্ছি সোজা হয়ে বসে ক্লাসে থাকা ইকোনমিক্স স্যারের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ক্লাসের পর বলছি।’

সায়মা মুখ কালো করে গম্ভীর হয়ে বসে রইল বাকিটা ক্লাস।

সবুজ ঘাসের গালিচায় বসা ঐচ্ছি আর সায়মা। ঐচ্ছি উদাস মনে মাথা নিচু করে পায়ের কাছ থেকে ছোট ছোট ঘাস পাতাগুলো টেনে তুলছে। অনেকক্ষণ যাবৎ সে এই একই কাজ করে যাচ্ছে। সায়মা বিরক্ত থেকে এবার মহা বিরক্ত। এই মেয়েটা মুখে এমন কুলুপ এঁটে বসে আছে কেন কে জানে? সায়মার বিরক্তির বাঁধ ভাঙতেই সে খেঁখিকে উঠে। গলার স্বরে তেজ ঠেলে বলে,

‘কি সমস্যা তোর? তখন থেকে এইভাবে বোবার মতো বসে আছিস কেন? বল কি হয়েছে?’

ঐচ্ছির চোখের পাল্লা ভারি হয়। গলা ধরে আসে। অধর জোড়া কিঞ্চিত কেঁপে উঠে। নাক টেনে বলে,

‘আমি এই বিয়েটা করতে চাই না, সামু।’

সায়মা খেয়াল করে ঐচ্ছির স্বচ্ছ অক্ষি কোটের টলমল করছে। সায়মার বুকে ব্যাথা করে। মেয়েটার চোখের পানি সে সহ্য করতে পারে না। ঐচ্ছির গালে হাত রেখে কোমল গলায় বলে উঠে,

‘কি হয়েছে, দোস্ত? বল আমাক? কাঁদবি না প্লিজ।’

ঐচ্ছি ঠোঁট উল্টে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,

‘আমি রাফসানকে বিয়ে করবো না, সামু। কিন্তু মা বাবা তো আমার কোনো কথা শুনছেই না। আমাকে জোর করেই রাফসানের সাথে বিয়ে দিতে চায়।’

সায়মা চোখ মুখ কুঁচকে নিরুত্তাপ গলায় বললো,

‘কিন্তু কেন? রাফসান কি ছেলে হিসেবে ভালো না। ছবি দেখে তো তুই বলেছিলি, ছেলে তোর পছন্দ। তাহলে এখন আবার তোর কি হলো?’

ঐচ্ছি নিশ্চুপ। ঠোঁট কামড়াচ্ছে। মনে মনে ভাবছে সায়মাকে সত্যিটা বলা ঠিক হবে কিনা? সায়মা ব্যগ্র গলায় বললো,

‘কিরে চুপ করে আছিস কেন? বল কিছু?’

ঐচ্ছি উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সায়মার দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো,

‘সায়মা, রাফসান আসলে কোনো মানুষ না। উনি একজন জ্বীন। এখন তুইই বল আমি একজন মানুষ হয়ে একটা জ্বীনকে কিভাবে বিয়ে করতে পারি।’

সায়মা চোখ মুখ খিঁচে অবিশ্বাস্য নয়নে ঐচ্ছির দিকে তাকিয়ে আছে। ঐচ্ছি ঠোঁট গুজ করে নিচের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই সায়মার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। ঐচ্ছির বাহুতে জোরে চাপড় মেরে বললো,

‘বদমাইশ মেয়ে, সব ব্যাপারে মজা না করলে তোর হয় না, না?’

ঐচ্ছি অসহায় মুখে সায়মার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আই এম সিরিয়াস, দোস্ত।’

সায়মা ব্রু কুঁচকালো, বিমূঢ় গলায় বললো,

‘মগের মূলক পেয়েছিস নাকি, রাফসান জ্বীন? সিরিয়াসলি? তোর মা বাবা একটা জ্বীনের সাথে তোর বিয়ে দিতে চাইছে? তুই বলবি আর আমি সেটা বিশ্বাস করবো? আমাকে কি তোর এতটাই বোকা মনে হয়?’

ঐচ্ছি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে জানে এই মাথামোটা মেয়েটাকে তার কথা বিশ্বাস করাতে গেলে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। এই জন্যই সে সায়মাকে কিছু বলতে চাইনি। ঐচ্ছি নিশ্চলভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকে। মাঠের এই দিকটাই বড় বড় কিছু নারকেল গাছ থাকায় বেশ সুবিধাই হয়েছে। নয়তো এতক্ষণে সূর্য মামা তার তেজ দিয়ে তাদেরকে ঝলসে দিত। ঐচ্ছি এবার একটু নড়ে চড়ে বসলো। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কাউকে একটা কল লাগালো। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই ঐচ্ছি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘আপনি যে একটা জ্বীন, আমি সেটা বিশ্বাস করিনা মি. রাফসান হোসাইন। আমাকে প্রমাণ দিতে হবে। নয়তো আমি কখনোই বিশ্বাস করবো না।’

রাফসান ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি ঐচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে কল দেই?’

ঐচ্ছি কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘না না আমাকে এক্ষুণি প্রমাণ দিতে হবে যে আপনি জ্বীন। নয়তো আমি কিন্তু..আমি কিন্তু কিছু একটা করে বসবো, হু। প্রমাণ দিন জলদি।’

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। পাশে থাকা সায়মা বোকার মতো হা করে ঐচ্ছির দিকে চেয়ে রইল। কি হচ্ছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ করেই কিছু একটা ঐচ্ছির কোলের উপর এসে বসে। আচমকা এমন কিছু হওয়াতে চমকে উঠে সে। বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখে একটা কবুতর। সাদা ঝকঝকে একটা কবুতর। যার বাদামী রঙের পা গুলোতে একটা সাদা চিরকুট বাধা। ঐচ্ছি খুব যত্ন সহকারে চিরকুটটা কবুতরের পায়ের থেকে খুলতেই সেটা আবার ফুড়ুৎ করে উড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। ঐচ্ছি চিরকুটটা ধীরে ধীরে খুলে, চোখের সামনে ভেসে উঠে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা দুটো লাইন,

‘আপনার বান্ধবীকে বিশ্বাস করানোর জন্যই তো আপনার প্রমাণ চাই তা না? এই যে প্রমাণ, আমি একজন জ্বীন ঐচ্ছি। আর এই জ্বীনের ভালোবাসা থেকে আপনি কখনোই মুক্তি পাবেন না।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here