কৃষ্ণাবতী ১৭ম_পর্ব

#কৃষ্ণাবতী
১৭ম_পর্ব

কৃষ্ণার মুখের সবথেকে আকর্ষণীয় তার গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোঁড়া। দেবব্রত কি করছে নিজের ও জানা নেই। কৃষ্ণার বুক রীতিমতো ঢোল বাজাচ্ছে। কি করবে বুঝছে না। সে বুঝতে পারছে দেবব্রত তার মাঝে নেই। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের অধরে দেবব্রতের উষ্ণ ঠোঁটজোড়ার পরশ পেলো কৃষ্ণা। তৃষ্ণার্ত দেবব্রত তখন তার তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত। কৃষ্ণার হৃৎপিণ্ড যেনো বুক চিরে বেরিয়ে যাবে। এই অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। এ যেনো অন্য জগতের অনুভুতি, ভয় হচ্ছে, রাগ হচ্ছে আবার কোথাও না কোথাও একটা ভালোলাগাও কাজ করছে। উপন্যাসে লেখকেরা এই অনুভূতিকে সুখময় অনুভূতির কাতারে ফেলতেন। দেবব্রতের আচারণকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলে তারা দাবি করতেন। তবে কি কৃষ্ণার মাষ্টারমশাই তাকে ভালোবেসে ফেললো! দেবব্রতের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া থেকে তার যেনো নিস্তার নেই। কৃষ্ণার চোখ আবেশে বন্ধ হয়ে আসে। চোখজোড়া থেকে মুক্তাদানার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণার অশ্রু দেবব্রতের গালে স্পর্শ হতেই দেবব্রত তাকে ছেড়ে দেয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে,
– তুই কাঁদছিস কেনো? আমি তো তোকে ব্যাথা দেই নি।
– আপনার কি খুব খারাপ লাগছে মাষ্টারমশাই?

জড়ানো কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে কথাটা বলে কৃষ্ণা। দেবব্রত তখন ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কৃষ্ণার কানে মুখ লাগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
– উহু, এখন শান্তি লাগছে।

কৃষ্ণাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে সে। তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পারছে কৃষ্ণা। হাত পা ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। দেবব্রতের উষ্ণ শরীর তাকে জড়িয়ে রয়েছে। এই উষ্ণতার মাঝেও একরকম মাদকতা আছে। কৃষ্ণা তার মাষ্টারমশাই এর গায়ের সেই মাতাল করা গন্ধ পাচ্ছে। অজানা আবেশে তার হাত দেবব্রতের পিঠে চলে যায়। চোখ বুঝে চুপ করে শুয়ে তাকে কৃষ্ণা। দেবব্রত তখন শান্তির নিদ্রাতে। আর কৃষ্ণার চোখের ঘুম যেন হাওয়া হয়ে গেছে। এই অনুভুতি যেনো অজানা সুখের অনুভূতি, যা থেকে কৃষ্ণা অবগত নয়______

সকাল ৮টা,
সূর্যের তীর্যক রশ্নি চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙ্গে যায় দেবব্রতের। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। এখনো জ্বরটা পুরোপুরি নামে নি। শরীরটা ঘেমে আছে। বুঝা যাচ্ছে কাল রাতে খুব ধকল গেছে শরীরের উপর। সূর্যের আলো রুমটাকে পুরো আলোকিত করে রয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো তার গায়ের সাথে কেউ মিশে আছে৷ চোখে খুলতেই দেখলো তার বুকের সাথে বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে কৃষ্ণা। শাড়ির আঁচল এলোমেলো। সিঁদুরখানা লেপ্টে আছে। টিপটি প্রায় মুছেই গেছে। মেয়েটি জড়ো হয়ে তার বুকে ঘুমিয়ে আছে। দেবব্রত খানিকটা চমকে গেলো। চোখটা বুঝতেই কাল রাতের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। কতোবড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলো সে৷ তখন যদি নিজেকে না আটকাতো তাহলে খুব বড় অহিত হয়ে যেতো। এই ভুলটা চাইলেও শুধরাতে পারতো না। খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে, যাকে ভালোইবাসে না তার সাথে এভাবে আচারণ করাটা অনৈতিক। কৃষ্ণা যদি এখন কাল রাতকে কোনো ভুল ইঙ্গিত হিসেবে ন্যায় তাহলে তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবে দেবব্রতের। কি বলবে সে কৃষ্ণাকে! জ্বরের ঘোরে তার দ্বারা ভুল হয়ে গেছে। এটা তো বাচ্চা মেয়েটার হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে! মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে। শোয়া থেকে উঠে বসলো দেবব্রত। মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো সে। কি করবে সে! কিভাবে বুঝাবে কৃষ্ণাকে তাদের মধ্যে যা ঘটেছে তা কেবলই ঘোর, ভুল
– মাথাটা কি খুব ব্যাথা করছে মাষ্টারমশাই?

কৃষ্ণার কথায় ঘোর ভাঙ্গে দেবব্রতের। পাশে ফিরে দেখে কৃষ্ণা গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি মায়াবী মুখখানা! মেয়েটার সাথে কিভাবে এতোটা খারাপ কাজ করলো সে! নিজের উপর মারাত্নক রাগ হচ্ছে তার। নিজেকে কোনোমতে সামলে ধীর কন্ঠে বললো,
– কখন উঠলি? আমি কি তোকে জাগিয়ে দিয়েছি?
– নাহ, কেবল ই ঘুম ভাঙলো। এখন শরীরটা কেমন?
– হু ভালো৷
– দেখি জ্বর আছে কি না

বলেই কপালে হাত দিতে যাবে তখনই বাধা দেয় দেবব্রত। কৃষ্ণা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাল রাতে যে ব্যাক্তি ভালোবেসে তাকে আলিঙ্গন করেছে, আজ তার শরীর স্পর্শ করতে দিচ্ছে না। অবাক না হবার তো কোনো কারণ ই খুজে পাচ্ছে না কৃষ্ণা। দেবব্রত কৃষ্ণার চাহনী বুঝতে পেরে শান্ত কন্ঠে বলে,
– জ্বর নেই। তুই চিন্তা করিস না। আমরা আজ দুপুরে বের হবো কিন্তু।

বলেই বিছানা ছাড়ে দেবব্রত। একটু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। কৃষ্ণার চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু হচ্ছে না। কৃষ্ণা অবাক চোখে তার মাষ্টারমশাই এর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের মাঝে এক অজানা হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। এই হাহাকারের উত্তর তারও জানা নেই_____

বটতলায় বসে রয়েছে অর্জুন৷ চোখ কলেজ গেটের দিকে। হাতে চায়ের প্লাস্টিকের কাপ। কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শীতের সকালে এই এক কাপ চা যেনো সবচেয়ে উপাধেয় পানীয়। কিন্তু এখনো এক চুমুক ও দেয় নি সে কাপে। কারণ তার চোখ একজোড়া চোখকে অধীর হয়ে খুজছে। আজ চারদিন হলো এই চোখজোড়াকে দেখতে পায় নি সে৷ মনটা আনচান করছে। খুব বড় অসুখে পড়েছে সে এটা বুঝতে পারছে। এই কৃষ্ণাবতী সাহাকে একদিন না দেখলেই তার বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। আজ তো চারদিন। সেই জানে তার কি অবস্থা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে তার। এই চারটা দিন ছ ঘন্টাও ঘুম হয় নি তার। চোখ বুঝতেই কৃষ্ণার মুখখানা চোখের সামনে ভাসে। ঘুমানো যে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো কলেজ গেট দিয়ে অন্না ঢুকছে। অধীর হয়ে অর্জুনের চোখ জোড়া কৃষ্ণাকে খুজতে থাকে। আশেপশে কোথাও কৃষ্ণাকে না দেখতে পেয়ে মনটা আবার হু হু করে উঠে তার। এবার আর বসে থাকতে পারে না অর্জুন। ছুটে যায় অন্নার কাছে। হঠাৎ অর্জুনকে নিজের সামনে দেখে অবাক হয়ে যায় অন্না। কিছু বলার আগেই অর্জুন প্রশ্ন করে উঠে,
– কৃষ্ণা আসে নি অন্না?

অর্জুনের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অন্না। ছোট হলেও অর্জুনের চাহনী,ব্যকুলতা বুঝতে বেশি সময় লাগে না অন্নার। মুখে হাসি টেনে বলে,
– কৃষ্ণা আসে নি অর্জুন দা।
– ওর কি শরীর খারাপ? চারদিন হয়ে গেছে আসে নি।

অর্জুন বেশ আকুল হয়ে প্রশ্নটা করে অন্নাকে৷ অন্না নিজেকে শান্ত রেখে খুব ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়,
– ও সুস্থ আছে, মামা বাড়িতে ঘুরতে গেছে। আর ফিরবে। কাল থেকে আসবে কলেজে।
– অহহ

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্জুন। আরো একদিনের অপেক্ষা। গোবেচারা মুখখানা করে চলে যেতে নিলে অন্না গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– আগুন নিয়ে খেলছো অর্জুনদা। দেখো হাতের সাথে সাথে মনটা ও না জ্বলে যায়। তখন শুধু জ্বলতে হবে তোমাকে। সেই জ্বলন কাউকে বুঝাতেও পারবে নি। কিন্তু তুমি জ্বলবে। বিরহ জ্বালা খুব কষ্টের।

অন্নার কথাটা অর্জুনের পা জোড়া আটকে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলো সে অন্নাকে। অন্না আর কথা বাড়ালো না। গটগট করে ক্লাসের দিকে রওনা দিলো। অর্জুন এখনো অন্নার কথার জালের মর্মার্থ খুজছে। সত্যি কি আগুন নিয়ে খেলছে সে!!

১৪.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। দেবব্রতের অদ্ভুত আচার-আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে। লোকটা এখনো তার সাথে অস্বাভাবিক আচারণ করে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার সময় সারাটা রাস্তা কোনো কথা বলে নি সে। কেমন যেনো এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। কৃষ্ণা বুঝে উঠতে পারছে না তার দোষটা কি! ভেবেছিলো এবার হয়তো মাষ্টারমশাই এর ঘরে তার ঠায় মিলবে। কিন্তু হলো কই! মাষ্টারমশাই তার ট্রাংক অন্নার রুমেই দিয়ে গেলো। কৃষ্ণার মনে অন্ধকার ছেয়ে আছে। খুব কান্না পাচ্ছে। দেবব্রতের আচারণ তাকে ব্যাথিত করছে। কিন্তু দেবব্রত কি জানে সেটা! না সে জানে না। না আর চুপ থাকবে না কৃষ্ণা। প্রশ্ন করবে দেবব্রতকে। যদি এভাবে এড়িয়েই যায় তবে কেনো তাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছিলো সে। চোখের অশ্রু মুছে দেবব্রতের রুমের দিকে রওনা দেয় সে। রুমের কাছে যেতেই……

চলবে

[ পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here