কৃষ্ণাবতী
২৭তম_পর্ব
এবার লোকটা তার হেলমেট খুললো। মুখে সেই ভুবন ভুলানো হাসি, সে হাসি অন্নার বুকে তীরে মত লাগে। এই হাসিতে সে সব কিছু বাজি দিতে রাজি। লোকটি তখন বলে,
– এখন যে পথে আমার হেমনলিনী রয়েছে সেপথের পিছু না নিয়ে উপায় আছে!
– বৃষ্টির মাঝে ফ্লাট না করলেই নয় অর্জুনদা!
– এই “দা” শব্দটা না কইলে কি হয় না তোর! নিজের প্রেমিকার মুখে দা শুনতে যে আমার একেবারেই ভালো লাগে না। পরে বিয়ের পর দেখা যাবে বাচ্চারা আমাকে মামা বলে ডাকা শুরু করলো।
অর্জুনের আক্ষেপের সাথে বলা কথাটা শুনে অন্না খিলখিল করে হেসে দেয়। বৃষ্টির ঝাপটায় মেয়েটিকে যেনো আরো মনোমুগ্ধকর লাগছে অর্জুনের কাছে। বারংবার মনে হতে লাগে সেদিনের কথা যেদিন সে এই নারীতে মত্ত হয়েছিলো। তার মনের এক কোনে চুপিসারে মেয়েটি জায়গা করে নিয়েছে। এখনো সেই দিনটির কথা হুবহু মনে আছে অর্জুনের।
দিনটি ছিলো জুলাই মাসের বারো তারিখ। অর্জুনের মাস্টার্স প্রায় শেষের পথে। এর পর সে চলে যাবে তার গন্তব্যে। অন্না তখন অনার্সে ভর্তি হয়েছে মাস চারেক হবে। অর্জুনের উদাসীনতায় সে অভ্যস্ত। লোকটা যেনো আরো বেশি উদাসীন হয়ে উঠেছে। তবুও মনের মাঝে অন্য কাউকে যেনো জায়গা দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারছে না। বারংবার মন চাইছে তাকে মনের কথাটা বলে দিতে। অনুভূতিগুলো মনের মাঝে জটলা পেকে অস্বস্তি যেনো আরো বাড়িয়ে তুলেছে অন্নার। অর্জুনের পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে। সে একবার চলে গেলে হয়তো আর মনের কথাটা তাকে বলা হবে না। তাই সাহস সঞ্চয় করে আজ অর্জুনকে তার অনুভূতিগুলো ব্যাখ্যা করবে অন্না। যদিও উত্তরটি নেতিবাচক তবুও মনের বোঝা আর নিতে পারছে না সে। আর মনকে বুঝাতে পারবে,
” আমি চেষ্টা করেছিলাম, ভাগ্য আমার পক্ষে ছিলো না”
পার্কে বসে রয়েছে অন্না। অর্জুনের আসার কথা। ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অথচ সে এখনো আসে নি। আসবে কি না এইটা নিয়েও সন্দেহ হচ্ছে অন্নার। আজকাল সোজামুখে কথা বলতে চায় না লোকটি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে অন্না। এক এক মিনিট খুব বেশি লম্বা লাগছে।
– ডেকেছিলি?
কথাটা শুনতেই মাথা তুলে তাকায় অন্না। সামনে তার মনমন্দিরের দেবতা দাঁড়ানো। এই দেবতা অলংকার, ধুতি, মুকুট পরা নয় বরং একটি নীল শার্ট এবং কালো জিন্স পরা৷ হাতে কালো ঘড়ি, শার্টের হাতাটা কনুই অবধি গুটানো। চুলগুলো এলোমেলো, পানি পড়ছে চুল থেকে। হয়তো স্নান করে এসেছে। চশমাটা ঠিক করতে করতে পুনরায় একই প্রশ্ন করলো,
– ডেকেছিলি কেনো?
– ব….ব্যাস্ত?
আমতা আমতা করে অন্না প্রশ্নটি করলো। অর্জুন নির্বিকার ভাবে উত্তর দিলো,
– সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
– ওহ, কিছু কথা ছিলো৷ বেশি সময় নিবো না
– কি কথা? তাড়াতাড়ি বল
অন্নার সব কথা যেনো গলায় আটকে যাচ্ছে। অর্জুনের উপর বিরক্তও লাগছে ঘন্টাখানিক বসিয়ে রেখে এখন তাড়া দেখাচ্ছে। কেনো বাপু তোর কি ট্রেন ধরা লাগবে নাকি? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর কন্ঠে অন্না বললো,
– জানি অনেকটা বেহায়া দেখাবে, তাও কথাগুলো বলতে হবে৷ আজ যদি না বলি কখনো বলা হবে না।
– কি এমন কথা যে এতো ভনিতা লাগছে?
– আপনি কি সত্যি বুঝেন না অর্জুন দা কি এমন কথা?
– না বুঝতে পারছি না।
অন্না চোখ কুচকে তার দিকে তাকালো৷ লোকটা এমন কেনো! কেনো এই লোকটা এতো অবুঝ হয়ে থাকে! মাটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
– ভালোবাসি আপনাকে, কবে, কখন কিভাবে জানা নেই। তবে ভালোবাসি। আপনি একদিন বলেছিলেন, আপনার সাথে নৌকাডুবির একটাই অমিল, তা হল আপনার জন্য ভগবান কোনো হেমনলিনীকে অপেক্ষারত রাখেন নি। আমি জানি না আমি হেমনলিনী কি না, তবে আমি আপনার জন্য এখনো অপেক্ষারত রয়েছি৷
– কত বছর থাকতে পারবি?
– মানে?
– মানে খুব স্পষ্ট, কত বছর থাকবি, আমার অপেক্ষায়? আমি যদি বলি আমি তোকে ভালোবাসি না, তাহলে? আমি যদি বলি আমার সময় লাগবে তাহলে? কি করবি? এসব ফাও কথা। কেউ কারোর জন্য অপেক্ষায় থাকতে পারে না। তুই ও পারবি না। তোর বিয়ে হবে, বর হবে। এসব আবেগের কোনো স্থান হবে না তখন। বুঝা গেলো?
অন্নার চোখ ছল ছল করছে। অর্জুন তাকে ফিরিয়ে দিবে এই কথাটা জানা ছিলো। তবুও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাচ্ছে। সব মিলিয়ে গলাতে আবেগগুলো আটকে আছে অন্না। দৌড়ে পালাতে আরলে হয়তো ভালো হতো। অন্না এখনো মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। টুপ করে চোখের অশ্রুকণাগুলোকে মুক্তি দিলো সে। অর্জুন তখন বললো,
– তোর আর কোনো কথা আছে? না থাকলে আমি আসছি। এসব আবেগে নিজেকে ভাসাস না ভালো থাকবি।
বলেই গটগট করে হাটা দিলো সে। অন্না মাথা তুলে দেখলো লোকটি হেটে চলে যাচ্ছে। ফিরে তাকাবার প্রয়োজন অবধি বোধ করলো না। অন্না ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ সূর্য অস্ত যাচ্ছে, লাল কিরণ অন্নার মুখে পড়ছে। অর্জুনের অবয়ব মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশে।
দু সপ্তাহ পর,
বটতলার এক পাশে বসে রয়েছে অন্না। আজ অর্জুনের শেষ পরীক্ষা। লোকটাকে আর কাল থেকে কলেজের মোড়ে দেখা যাবে না। আর এই বটতলায় তার আড্ডা হবে না। আর চা খাওয়া হবে না এই চায়ের দোকানে। অন্নার কষ্টটা বুকে ধীরের মতো আঘাত দিচ্ছে। তবুও মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছে। ভাগ্যে যা নেই, তাতো জোর পূর্বক নেওয়া যায় না। হল থেকে অর্জুন বেরিয়েছে অর্জুনকে বের হতে দেখেই অন্না বটতলা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে জানে এখানে আর এখন বসাটা ঠিক হবে না। তাদের মুখোমুখি না হওয়াটা হয়তো সবথেকে ভালো। চায়ের দাম দিতে দিতে খেয়াল করলো অর্জুন তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাত কাঁপছে অন্নার। খুব নার্ভাস লাগছে। কেনো এমনটা অনুভব হচ্ছে নিজেও জানে না। তখনই হাতের কয়েনটা টুপ করে মাটিতে পড়ে গেলো। কয়েনটা তুলতে যেয়ে নিচু হতেই অর্জুন কয়েনটা তুলে নিলো। কয়েনটা হাতে দিতেই অন্না দৌড়ে চলে যেতে নেয়। তখনই অর্জুন বলে,
……….
চলবে
[ছোট করে দিয়েছি, সাথে দেরিও হয়ে গেছে। প্লিজ প্লিজ রাগ করবেন না। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল সকালে পোস্ট করবো। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ ত্রিপল পর্ব পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]
মুশফিকা রহমান মৈথি