কৃষ্ণাবতী ২৮তম_পর্ব

কৃষ্ণাবতী
২৮তম_পর্ব

চায়ের দাম দিতে দিতে খেয়াল করলো অর্জুন তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাত কাঁপছে অন্নার। খুব নার্ভাস লাগছে। কেনো এমনটা অনুভব হচ্ছে নিজেও জানে না। তখনই হাতের কয়েনটা টুপ করে মাটিতে পড়ে গেলো। কয়েনটা তুলতে যেয়ে নিচু হতেই অর্জুন কয়েনটা তুলে নিলো। কয়েনটা হাতে দিতেই অন্না দৌড়ে চলে যেতে নেয়। তখনই অর্জুন বলে,
– পালিয়ে যাচ্ছিস অন্না?

অর্জুনের কথাটা শোনা মাত্র পা থেমে যায় অন্নার। সত্যি ই তো পালিয়ে যাচ্ছিলো সে। অর্জুনের মুখোমুখি হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। অর্জুনের দিকে ফিরে আমতা আমতা করে বললো,
– পা…পালাচ্ছি না, ক্লাস আছে
– আমি যতদূর জানি আজ তোদের আর ক্লাস নেই। ল্যাব ছিলো, তাও শেষ হয়ে গেছে। কার ক্লাস করতে যাচ্ছিস এখন?

কথাটা বলতেই অন্না চুপবমেরে যায়। আসলে তার কোনো ক্লাস নেই এখন। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না বলে কলেজে বসে রয়েছিলো। অন্নার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অর্জুনের ঠোঁটের কোনায় বাকা হাসি ফুটে উঠে। এবার একটু ধীর কন্ঠে বললো,
– কাল চিটাগং যাচ্ছি, বেশ কিছু চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। সেগুলোর ডাক পরেছে৷ জানি না তোর সাথে আদৌ কবে দেখা হবে। তাই কিছু দিতে চেয়েছিলাম তোকে।

অন্নার চোখের কোনায় মনের আবেগগুলো বিদ্রোহ করে উঠে। অর্জুনের চোখের অগোচরেই জলটুকু মুছে নেয়। অর্জুন তার ব্যাগ থেকে একটা র‍্যাপিং প্যাপারে মোড়া জিনিস এগিয়ে দেয় অন্নার কাছে। জিনিসটা বই কিংবা ডাইরি হবে। অর্জুন হাসি মুখে বলে,
– এটা তোকে দেওয়ার ইচ্ছে অনেক দিন ধরে ছিলো। কিন্তু দেওয়া হয় নি। তোকে ধন্যবাদ জানাবার কোনো উপায় পাচ্ছিলাম না। অনেক সাহায্য করেছিস তুই আমাকে। তাই এই সামান্য উপহার। আসি ভালো থাকিস।

অন্না কিছু বলতে পারলো না। তার মনের মানুষটি এই প্রথম তাকে কিছু উপহার দিয়েছে। ভালো লাগছে কিন্তু সাথে একটা চাপা বেদনা ও অনুভূতি হচ্ছে। এটা তার বিদায় উপহার। অন্তিম বিদায়।

রাত ১০টা,
নিজ রুমে খাটের উপর গা এলিয়ে রেখেছে অন্না। ভালো লাগছে না তার। খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কোনোমতে খেয়ে এসেছে। পাশে অর্জুনের দেওয়া উপহারটি পড়ে রয়েছে। এখনো উপহারটি খোলা হয় নি। এবার উঠে বসলো অন্না। ধীরে ধীরে র‍্যাপিং প্যাপারটা খুললো। খুব যত্ন করে উপহারটি খুললো সে, যেনো এর যেয়ে দামী কিছুই হতে পারে না। মোড়ক টা খুলতেই চোখজোড়া অবাক হয়ে যায় অন্নার। উপহারটি একটি বই৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নৌকাডুবি”। এই বইটা তাকে উপহার দিবে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে অন্নার। বইটির পাতা উলটাতে, সেখানে একটি চিরকুট ভাজ করে রাখা। চিরকুটটি খুলতেই দেখে গোটা হাতে সুন্দর করে একটি চিঠি লেখা। অন্না চিঠিটি পড়তে লাগে,

প্রিয় অন্না,
তুই আমার অনেক প্রিয় একটি মানুষ তাই প্রিয় সম্মোধন করাটা বেমানান লাগছে না। তোর সাথে আমার পরিচয় আজকের নয়। বহুদিনের। বহু বছরের। প্রথম যেদিন তোকে দেখেছিলাম তুই গোলগোল চোখে দু ঝুটি মাথায় একটা লাল রঙ্গের স্কার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলি। তাই আমার কাছে তুই সর্বদাই একজন পিচ্ছি মেয়ে ছিলি। তোর প্রতি কখনো ভিন্ন অনুভূতি আমার জন্মায় নি৷ মিতালিকে ঠিক যেভাবে আমি আদর করতাম তোকে ঠিক সেভাবেই আমি দেখেছি৷ কিন্তু কখন যে তুই বড় হয়ে গেলি বুঝতেই পারি নি। আমার মনের কোনে যখন শূন্যতা বিরাজ করছিলো তখন তুই আমার মনের আঙ্গিনাতে ধীর পায়ে প্রবেশ করলি। অথচ আমি সেটা বুঝতেও পারি নি। যখন জয়ন্তের কাছে অংক বুঝতে যেতি আমার খুব বিরক্ত লাগতো৷ তাই বারেবারে তোকে বকাঝকা করতাম। অহেতুক তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করতাম। নিজের অনুভুতি গুলোর ব্যাপারে আমি নিজেই অজ্ঞ ছিলাম। একবার প্রেমে ব্যাহত হবার জন্য পুনরায় প্রেম করার ইচ্ছে আর হলো না। ভালোবাসার বিষ পুনরায় খাবার ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু সেদিন যখন তুই তোর অনুভুতি গুলো আমাকে ব্যাখ্যা করলি, আমি তোকে ফিরিয়ে দিয়েছি। ভেবেছি হয়তো এগুলো বাচ্চা মেয়ের আবেগ। কিন্তু আমি যেনো পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। ভালোবাসা না পাবার যে কষ্ট আমি তা জানি। কিন্তু তোকে গ্রহণ করে যদি ভালো না বাসতে পারি তবে তোকে দ্বিগুণ কষ্ট দেওয়া হবে। তাই আমি তোকে মিথ্যে আশায় রাখতে চাই নি৷ তোকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও যেনো মনে হাহাকার শুরু হয়। মন বারবার তোর সাথে বিদ্রোহ করতে চায়। অনুভব করতে পারলাম মনমন্দিরে তোকে ঠায় দিয়ে ফেলেছি। তাই আজ আমি তোকে প্রশ্ন করছি,
” তুই কি আমার জীবনের হেমনলিনী হবি?”

ইতি
তোর অর্জুনদা

চিঠিটি পড়ে অন্না অনুভব করলো তার গাল ভেজা। তার অপেক্ষা আজ ফল দেখিয়েছে। তার রমেশ তার কাছে ফিরে এসেছে।

বর্তমান,
বৃষ্টির ঝাপটা হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করছে অন্না। তার পেছনে অর্জুন দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে তাকে অবলোকন করে যাচ্ছে। তাদের প্রেমের আজ তিন বছরের অধিক হয়েছে। তবুও তার অন্নাকে ঠিক আগের মতোই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অন্নার মনের পুরোনো অর্জুনের ক্ষত গুলো ভরিয়ে দিয়েছে নতুন অর্জুন। অন্নার আক্ষেপের অবসান করেছে সে, তার অপেক্ষার অবসান করিয়েছে সে। শহর থেকে দূরে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে তারা। বৃষ্টি থামলে শহরে রওনা দিবে। অন্না বৃষ্টির সাথে খেলতে ব্যস্ত। তখন কানে এলো,
“তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি,
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥
সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো,
রেখো না আর, বেঁধো না আর কুলের কাছাকাছি॥
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি॥”

অর্জুন গলা ছেড়ে গানটি গাইছে। অন্না মন্ত্রমুগ্ধ চোখে অর্জুনের গান শুনছে। এই মূহুর্ত টা থেমে গেলে মন্দ হতো না________

২২.
দেবব্রতের নজর পেপারের দিকে। এক মতে খবরের কাগজ পরে যাচ্ছে সে। সামনের টেবিলে বইয়ের পাতা উলটাচ্ছে কৃষ্ণা। তার মনটা বইয়ের পাতায় আর টিকছে না। কিন্তু মাষ্টারমশাই সেটা শুনবেন না। তাই মনের ক্ষোভগুলো বইয়ের উপরেই বের করছে কৃষ্ণা। বাহিরে ঝরঝর বৃষ্টি হচ্ছে। কৃষ্ণার ইচ্ছে ছিলো বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে বিধায় দেবব্রত তাকে ভিজতে দেয় নি। বইয়ের পৃষ্ঠা জোরে জোরে উলটানোর শব্দে দেবব্রত চোখ কুচকে তার দিকে তাকায়।
– কি হয়েছে? এভাবে পাতা উলটাচ্ছিস কেনো? পাতা ছিড়ে যাবে তো
– আমার এখন পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।
– কেনো শুনি?
– সবসময় কার ভালো লাগছে মাষ্টারমশাই?
– কালকে তোর পরীক্ষা আছে, না পড়লে ভালো নাম্বার পাবি কি করে!
– আমার যে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে
– এ কেমন পাগলামী! ঠান্ডা লাগবে না?
– লাগবে না সত্যি, একটু ভিজবো। একটু

পেপারটা নামিয়ে চোখ থেকে চশমাটা নামালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে বললো,
– আর পড়াটার কি হবে?
– আমার পড়া শেষ। আর বাকিটুকু কাল সকালে করে ফেলবো। এখন যাই?

উচ্ছ্বাসিত মনে কৃষ্ণা বলে উঠলো৷ কৃষ্ণার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। এই দৃষ্টি এড়াবার সাধ্য দেবব্রতের নেই। তাই তাকে সম্মতি দিলো সে। কৃষ্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। এরপর ছুটলো সে ছাদে। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। আর তাতে উম্মাদের মতো ভিজছে কৃষ্ণা। ঠান্ডা বৃষ্টির স্নিগ্ধ আভায় কৃষ্ণার মন যেনো উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠেছে। ঘুরে ঘুরে ভিজছে সে। ছাদের দরজার বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। কি অপরুপ লাগছে কৃষ্ণাকে। গায়ের শাড়িটা কেপ্টে আছে। সাদা কোমড়ে বৃষ্টির পানিগুলো গড়িয়ে পড়ছে। কৃষ্ণার মুখে পানি গুলো লেপ্টে রয়েছে। ভেজা মুখখানা সবচেয়ে বেশি মায়াবী লাগছে দেবব্রতের কাছে। চোখে তার মোহ লেগেছে, কৃষ্ণার মোহ। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো কৃষ্ণার কাছে। কৃষ্ণা তখন হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। কোমড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভূত হতেই শরীরটা কেঁপে উঠে কৃষ্ণার। পেছনে ফিরতেই দেখে মোহ চোখে দেব তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ জড়ানো কন্ঠে কৃষ্ণা তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কি দেখছো?
– তোকে
– আমাকে দেখার কি আছে? আমি তো একই আছি।
– জানি, কিন্তু আজ তোকে আরোও অপরুপ লাগছে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।
– আমি তো বাধা দেই নি।

কৃষ্ণার কথাটা শুনে মুচকি হাসি হাসে দেবব্রত। কোমড়টা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। ভেজা ঠোঁট গুলো কাঁপছে কৃষ্ণার। দেবব্রতের নজর তার কাঁপা ঠোঁটজোড়ার দিকে। একটু ঝুকে ঠোঁটগুলোকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো দেবব্রত। কৃষ্ণা তখন…….

চলবে

[ পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ বিকেলের দিকে পোস্ট করবো। আজ ইনশাআল্লাহ ত্রিপল পর্ব পোস্ট করবো। কার্টেসী ব্যাতীত দয়া করে কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here